আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিশুর বিকাশ ও শিশুর মনঃসামাজিক সমস্যা - ১



শিশুর বিকাশ ও শিশুর মনঃসামাজিক সমস্যা - ১ আহমেদ হেলাল ছোটন শিশুর বিকাশ, বিকাশজনিত সমস্যা ও তার মনঃসামাজিক গঠন ও অভিভাবকদের করণীয় নিয়ে সম্প্রতি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা থেকে একটি গাইডবই প্রকাশিত হয়েছে। বইটির মূল অংশটুকু লেখার দায়িত্ব ছিল আমার। আমরা চাই বিষয়টি বহুল প্রচারিত হোক। সচেতনতা বাড়ুক। অতিপ্রাকৃত ও অভিশপ্ত ভেবে যেন কোনো শিশু চিকিৎসা বঞ্চিত না হয়।

সামহোয়ার ইন ব্লগের পাঠকদেন জন্য গাইডবইটির নির্বাচিত কিছু অংশ ধারাবাহিকভাবে দেয়ার ইচ্ছা আছে। প্রথম কিস্তি আজ দিলাম। আপনাদের সহযোগিতা, পরামর্শ এবং আরো তথ্য বইটির পরবর্তী সংস্করণকে সমৃদ্ধ করবে বলে আশা করি। শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ /sb] আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যত। এই ভবিষ্যত গড়তে চাই সুস্থ সবল প্রাণবন্ত শিশু।

শারীরিক বৃদ্ধির পাশাপাশি শিশুর মনোসামাজিক বিকাশও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মায়ের গর্ভে থাকার সময় থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর যে বিকাশ ঘটে তা হচ্ছে প্রারম্ভিক বিকাশ। শৈশব থেকে কৈশোর, এরপর বয়োসন্ধিকাল পার করে সে হয়ে ওঠে পরিপূর্ণ মানুষ। প্রতিটি পর্যায়ে শরীরের পাশাপাশি তার মনেরও পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনের সাথে সাথে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যবহার এবং ভাষা, চিন্তা-চেতনা, অনুভূতি,জ্ঞান, বুদ্ধি,আবেগ ও ভাবের আদান প্রদানের ক্ষেত্রে ক্রমাণ্বয়ে দক্ষ হয়ে ওঠাটাই শিশুর মানসিক বিকাশ।

জন্মের পরপরই শিশু শুরু করে শিখতে। চোখ, কান, নাক, ত্বক ও জিহ্বা - এই পাঁচ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে শিশু তার চারদিকের জগতকে আবিষ্কার করে। শিশু নতুন নতুন জিনিস দেখতে চায়- ধরতে চায়, নতুন শব্দও শুনতে চায়। শিশুদের জন্য খেলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, খেলার মাধ্যমে শিশুরা কল্পনা করতে শেখে, সৃজনশীলতার চর্চা করে। শিশুর সার্বিক বিকাশের জন্য তাকে নানা রঙের জিনিস দেখানো, ধরতে দেয়া, এবং তার সাথে খেলা করা জরুরি।

শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য চাই নিরাপদ ও সহায়ক পরিবেশ। শিশুর চারপাশে যারা আছেন, যেমন বাবা-মা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, ভাই-বোন এমনকি তার যত্নের জন্য থাকা কাজের লোকটিকে নিয়ে তার সামাজিক পরিবেশ। আর শিশুর চারপাশের ঘরবাড়ি,স্কুল গাছপালা, মাঠ ইত্যাদি তার বস্তুগত পরিবেশ। পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য এ দু ধরণের পরিবেশই হতে হবে শিশুবান্ধব ও নিরাপদ। এছাড়া শিশুর বিবেক, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও গণতান্ত্রিক মানসিকতা বিকাশে পিতামাতা, পরিবার ও শিক্ষকদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

শিশুরা কিভাবে শেখে ? ছবির মাধ্যমে, নির্দেশনা থেকে, অন্যের সংগে মেশার মাধ্যমে, আনন্দের মাধ্যমে, বারবার চেষ্টা করে, সক্রিয় অংশগ্রহণ করে, দেখে ও প্রশ্ন করে, গল্পের সাথে বাস্তবতাকে মিলিয়ে, খেলার মাধ্যমে, শরীরের নাড়াচাড়ার মাধ্যমে, কল্পনা করে, অনুকরণ করে, তুলনা করে , স্বাদ নিয়ে, অনুসন্ধান করে , কাজ করে, পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশের জন্য করণীয় শিশুর চারপাশের মানুষজন ও পরিবেশ তার সাথে কি ধরণের আচরণ করে তার উপর অনেকটাই নির্ভর করে শিশুর মানসিক বিকাশ। শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন....... গর্ভকালে মায়ের যত্ন মাকে বাড়তি ও পুষ্টিকর খাবারসহ প্রয়োজনীয় টিকা (টিটি) দেয়া ভারী কাজ থেকে মাকে বিরত রাখা মাকে হাসিখুশি ও চিন্তামুক্ত পরিবেশে রাখা, মাঝে মাঝে বাড়ির বাইরে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হাসপাতালে নিরাপদ প্রসব অথবা জরুরি প্রসূতিসেবার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে রাখা ছেলে বা মেয়ে যে সন্তানই হোক না কেন- তাকে সাদরে গ্রহণ করা হবে বলে মাকে আশ্বস্ত করা জন্ম থেকে ৬ মাস...... বুকের দুধ খাওয়ানো বা শিশুর অন্য পরিচর্যার সময় তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা শিশুকে মৃদুস্বরে গুনগুন করে গান/ছড়া/কবিতা শোনানো, তার মতো করে বিভিন্ন শব্দ করা মায়ের চুড়ির শব্দ, মৃদু আওয়াজের ঝুনঝুনি বা আঙুলের তুড়ি দিয়ে দিনে কিছু সময় শিশুকে উদ্দীপ্ত করা শিশুকে বুকে জড়িয়ে আদর করা শিশুর শরীর প্রতিদিন মালিশ করা শিশুর সাথে মুখ ঢেকে ‘টুকি’ বা লুকোচুরি খেলা, ও আনন্দসূচক শব্দ করে কথা বলা শিশুর প্রতি মায়ের পাশাপাশি বাবার দায়িত্বও গুরুত্বপূর্ণ। তাই বাবাকেও শিশুর পরিচর্যা ও আদরে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে হবে ৭ মাস থেকে দেড় বছর শিশুকে পরিচিত জিনিসগুলোর নাম বলুন ও তা দেখাতে বলুন মুখে দেবেনা এ’ধরণের খেলনা শিশুকে বেশি বেশি দিন শিশুর শরীরের বিভিন্ন অংশের নাম বারবার বলুন ও শিশুকে তা বলতে ও দেখাতে উৎসাহিত করুন হাত পা ব্যবহার করে শিশুকে খেলতে দিন ও তার সাথে খেলা করুন শিশুকে ছোট ছোট প্রশ্ন করুন, তার প্রশ্নের জবাব দিন ও প্রয়োজনে তার কাছ থেকে জবাব শুনুন শিশু কোনো কিছু দেখে ভয় পেলে তার ভয় ভাঙিয়ে দিন । আস্তে আস্তে ‘ভয়ের’ বস্তুটির সাথে শিশুকে পরিচিত করিয়ে দিন। নয়/দশ মাস বয়স থেকে শিশুকে দাঁড়াতে ও হাটতে সাহায্য করুন দেড় বছর থেকে ৩ বছর শিশুকে অন্য শিশুর সাথে খেলার সুযোগ করে দিন ও নিরাপদ পরিবেশে ছোটাছুটি করতে উৎসাহিত করুন প্রতিদিন ব্যবহৃত হয়, এমন জিনিস যেমন- বল , হাতের চুড়ি, বই এসব দিয়ে বিভিন্ন রং ও আকৃতি সম্পর্কে শিশুকে ধারণা দিন শিশুকে ছবির বই নাড়াচাড়া করতে দিন ও কাগজ/স্লেট পেন্সিলে আঁকাআঁকি করতে উৎসাহিত করুন গল্প ও ছড়ার মাধ্যমে শিশুকে নতুন নতুন শব্দ শেখান ছোট ছোট কাজ করতে শিশুকে উৎসাহিত করুন ও সেগুলো করতে পারলে তাকে প্রশংসা করুন, আদর দিন দাঁত মাজা, হাত ধোয়া, নিজের পোশাক নিজে পড়া ইত্যাদি কাজ যাতে শিশু তার অভ্যাসে পরিণত করতে পারে সেজন্য সাহায্য করুন শিশুকে তার প্রস্রাব ও পায়খানার জন্য নির্দিষ্ট স্থান ব্যবহার করতে ও এগুলোর কথা বলতে শেখান ৩ বছর থেকে ৫ বছর কথা বলা, গান গাওয়া, বই পড়া ইত্যাদির মাধ্যমে শিশুর ভাষা শেখাকে উৎসাহিত করুন শিশু যাতে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে তার সুযোগ করে দিন- যেমন, ছবি আঁকা, কাগজ, মাটি, পুরাতন কাপড় দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করা শিশুরা বড়দের সাথে কি ধরণের আচরণ করবে ( সালাম দেয়া, মেহমান এলে বসতে বলা ইত্যাদি) তা শেখান ও পালন করতে উৎসাহিত করুন শিশুরা সমবয়সী শিশুদের সাথে কি ধরণের আচরণ করবে তা শেখান এবং ঘরের বাইরে অন্য শিশুর সাথে খেলার সুযোগ করে দিন শিশুকে নিজে থেকে কিছু পছন্দ করা ও দায়িত্ব নেবার সুযোগ করে দিন ভালো কাজের জন্য শিমুকে প্রশংসা, আদর ও পুরষ্কার দিন এবং মন্দ বা অনাকাংক্ষিত কাজের জন্য আদর প্রশংসা ও পুরষ্কার বন্ধ রাখুন।

শিশুকে বকা দেয়া, মারধোর করা ও তার সমালোচনা বন্ধ রাখুন। বিকাশের সমস্যা নানা কারণে শিশুর বিকাশের সমস্যা হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মায়ের যে কোনো ধরণের রোগ, অপুষ্টি, রক্তশূণ্যতার কারণে গর্ভস্থ শিশুর বিকাশ হতে পারে বাধাগ্রস্ত। প্রসবকালীণ যে কোনো ধরণের জটিলতা বিশেষ করে পরিণত সময়ের আগে জন্ম নেয়া শিশু অথবা প্রসবকালীণ সময় দীর্ঘ হলে শিশুর বিকাশজনিত সমস্যা দেখা যায়। রক্তের সম্পর্কের মধ্যে বাবা-মায়ের বিয়ে এবং বাবা বা মায়ের বেশি বয়সে জন্ম নেয়া সন্তানেরা বিকাশজনিত সমস্যার ঝুঁকির মধ্যে থাকে।

জন্মের পরপর শিশুর কান্না না হওয়া, শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যা হওয়া, কোনো কারণে খিঁচুনি হওয়া ইত্যাদিও তার স্বাভাবিক বিকাশের অন্তরায়। অনেক সময় নবজাতকের গুরুতর সংক্রমণ বিশেষত মস্তিষ্কের প্রদাহের (মেনিনজাইটিস, এনকেফালাইটিস, ব্রেন অ্যাবসেস) কারণেও বিকাশের সমস্যা হতে পারে। থায়রয়েড সহ অন্যান্য হরমোনের অভাব বা আধিক্য এবং জন্মগত কিছু ত্র“টি ও বিপাক ক্রিয়ার অসামঞ্জস্যতাও বাধাগ্রস্ত বিকাশের কারণ। এর বাইরে শিশুর চারপাশের জগতের সাথে তার পারস্পরিক ক্রিয়া যদি সমণ্বিত না হয়- আশেপাশের মানুষজনের আচরণ যদি বৈরি বা অস্বাভাবিক হয় এবং শিশুর পরিবেশ যদি নিরাপদ না হয় তবে তার মানসিক বিকাশ স্বাভাবিক হয় না। বাবা- মায়ের মধ্যে সবসময় কলহ, পারিবারিক নির্যাতন,পরিবারে মাদকাসক্তি, সমাজ বিরোধী পরিবেশ, শব্দদূষণ, ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ ও ঝুঁকিপূর্ণ পেশা ইত্যাদিও শিশুর বিকাশের স্বাভাবিক ধারাকে প্রতিহত করে।

বিকাশের সমস্যা হওয়ার লক্ষণসমূহ ঠিক বয়সে ঘাড় সোজা রাখতে না পারা, বসতে না পারা, হাটতে না পারা, কথা বলতে না পারা বা কথা অস্পষ্টভাবে বলা, অস্বাভাবিক ভংগিতে হাঁটা, বড় বয়সেও বিছানায় প্রস্রাব-পায়খানা করা, মুখ দিয়ে সবসময় লালা পড়া, বয়স অনুযায়ী নিজের যতœ নিজে নিতে না পারা, অস্বাভাবিক আচরণ করা, মনোযোগের অভাব, হঠকারী আচরণ করা, হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া, অতিরিক্ত চুপচাপ বা অতিরিক্ত চঞ্চল হওয়া, সমবয়সী কারো সাথে মেলামেশা না করা, আদর গ্রহণ না করা, চোখে চোখ না রাখা, খিঁচুনি হওয়া, বাবা মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার, ঘরের জিনিসপত্র চুরি করা, বাইরে থেকে অন্যের জিনিস চুরি করে নিয়ে আসা, টাকা পয়সার হিসাব রাখতে অপারগতা, নিজের শরিরে নিজে ক্ষতি করা (হাত কাটা, চুল ছেড়া, হাত কামড়ানো, মাথা পেটানো, আত্মহত্যার চেষ্টা), স্কুল পালানো, স্কুলে যেতে না চাওয়া, খুব বেশি মন খারাপ করে থাকা, কানে গায়েবী আওয়াজ শোনা, যে কোনো ধরণের অস্বাভাবিক আচরণ করা ইত্যাদি। তবে এই সমস্যার সবগুলিই একটি শিশুর মধ্যে যেমন থাকবে না তেমনি এধরণের দু একটি সমস্যা কোনো শিশুর মধ্যে সামান্য সময়ের জন্য থাকলেই তার মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত বলে ধরে নেয়া যাবে না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক উপযুক্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নির্ণয় করতে পারবেন শিশুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে কিনা। সাধারণ ধারণার বশবর্তী হয়ে কোনো শিশুকে রোগি বা অসুস্থ হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.