আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এ জার্নি বাই ব্রেইন



“দেখিতেছি আমি আজি - এই গিরিরাজি এই বন চলিয়াছে উন্মুক্ত ডানায় দ্বীপ হতে দ্বীপান্তরে, অজানা হইতে অজানায়। নক্ষত্রের পাখার স্পন্দনে চমকিছে অন্ধকার আলোর ক্রন্দনে। । ” কাশ্মীরের ঝিলম নদীতে আসন্ন সন্ধ্যায় এক ঝাঁক বুনোহাসের উড়ে যাওয়ার দৃশ্য রবী ঠাকুরকে কাব্য রচনার যে প্রেরণা যুগিয়েছিলো, সে ‘বলাকা’ কবিতায় যেমন চলমান নক্ষত্র তার পাখার স্পন্দনে আলোর কান্না সৃষ্টি করে চমকে দিচ্ছিল সেদিনের সে অন্ধকারকে। তেমনি চিত্তগুহা ছেড়ে আবিদের মনও চলন্ত ট্রেনটার সাথে স্রোতের মতো ভেসে চলেছে মহাকাল সমুদ্রে, কোথায় আবিদের গন্তব্য সেটা এ মূহুর্তে তার জানা নেই।

সৃষ্টিজগতের স্বরূপেই রয়েছে প্রসারণ-গতি-আলোর আকাংখায় এই চলা সর্বদাই স্থিতিশীল নীড় পরিত্যাগী। প্রকৃতির মতো মানুষের আশা-আকাংখা-স্বপ্ন যুগ থেকে যুগান্তরে ধাবিত হচ্ছে। অতীত থেকে উৎসারিত এই অপূর্ণ-অচরিতার্থ বাণী পূর্ণতা-সন্ধানী, তাই চলমান। ‘জীবনকে আমরা কোন চোখে দেখি ?’ এইসব অর্বাচীন, নিরঙ্কুষ জিজ্ঞাসা আবিদের মনে প্রচন্ড ঝড় তোলে। ভ্রমণে এমন গোমড়ামুখো সঙ্গীকে লাবিবের অসহ্য লাগে।

পাশে বসা লাবিব তাই কথার কাতুকুতু না দিয়ে পারলো না। - কিরে মনে পড়ে গেলো নাকি ? - হুম... না। এমনিতেই মনটা উদাস হয়ে গেলো রে। কিন্তু...... কাকে ‘মনে পড়া’র কথা বলছিস ? - ‘মনে করি’ টাইপের আর কি, বুঝিস না ! লাবিব হো হো করে হাসতে লাগলো। - হারামজাদা।

বাঁদরামি করার জায়গা পাস না। - তোর পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন ? - দি মোর ইউ রিড দি মোর ইউ ফরগেট। - ওই ফাজিল তুই কবে ভালো হোবি ? - বিয়ের পরে। - মানে ? - মানে, ছেলেরা কাঁদে বিয়ের পরে। কাঁদতে কাঁদতে ভালো হয়ে যাবো রে..... লাবিব নাটকীয় বিলাপ জুড়ে দিলো।

- যন্ত্রের শাসনে চলছি আমরা। ঢং করিসনা। আল্লা আল্লা কর। - মন্ত্রের মুগ্ধতায় হারিয়ে গেলেন নাকি জনাব ? সামনের সিটে বসা এক সুনয়নার দিকে চোখ ঘুরিয়ে লাবিব মুচকি হাসে। সামনের আসনেই বসা ছিলো মানুষটি।

নীপবনের বৃন্তচ্যুত ফুল যেন ! এতঘন্টা ভ্রমণ করার পরও আবিদের চোখ একটিবারের জন্যও সে চোখে ভ্রমণ করেনি। আশ্চর্য ! আবিদের আজ কি হয়েছে ? আমরা হারিয়ে যাই না, কেউই হারিয়ে যেতে চাই না। মাভৈঃ (ভয় নাই) মাভৈঃ রবে কোন মিছিল আমাদের মুখোমুখি হয়না। তথাপি নৈবচঃ (কিছু হবে না) জেনেও অনুসন্ধিৎসু মন খুঁজতে খুঁজতে হারিয়ে যায়। আমরা কি খাদ্যের সন্ধানে ছুটে বেড়াই ? ক্ষুধার রাজ্যে বিচরণ করতে করতে সত্যিই কি আমরা হারিয়ে যাই ? খুব কি ক্ষুধা আমাদের ? না, না।

তাহলে সৈয়দ মুজতবা আলী ওরকম বললেন কেন - “ পরান্নং প্রাপ্য দুর্বুদ্ধে, মা প্রাণেষু দয়াং কুরু। পরান্নং দুর্লভং লোকে প্রাণাঃ জন্মনি জন্মনি। ” যার সহজ বাংলা করলে দাঁড়ায় - “ওরে মূর্খ, নেমন্তন্ন পেয়েছিস, ভালো করে খেয়ে নে, প্রাণের মায়া করিসনে, নেমন্তন্ন কেউ বড় একটা করেনা। বেশী খেয়ে যদি মরে যাস তাতেই বা কি - প্রাণ তো ভগবান প্রতি জন্মে ফ্রি দেন, তার জন্য তো আর খর্চা হয় না। ” এইসব সাতপাঁচ ভাবনা আবিদকে যখন আচ্ছন্ন করে তুলছিলো তখনই দূরন্ত ট্রেনের ছাড়িয়ে যাওয়া শব্দের মাঝে হংসী কন্ঠের মতো একটি শব্দ কানে বাজলো।

‘কোথায় যাবেন ?’ প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। ট্রেনের মতো লম্বা একটি যান-এ বসে কেউ কাউকে এরকম প্রশ্ন করতেই পারে। কিন্তু কার উদ্দেশ্যে সেটিই বিবেচ্য। প্রাসঙ্গিক উত্তর প্রদান করা যুক্তিসংগত। উত্তর খোঁজার জন্য এ মূহুর্তে একটি লোক তো দরকার।

কে, কাকে উদ্দেশ্য করে এ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে সেটিও খুঁজে বের করতে হবে। নিশ্চয়ই লাবিবকে প্রশ্ন করা হয়েছে। - লাবিব। এই লাবিব তোকে বোধ হয় কিছু জিজ্ঞেস করছে। লাবিব একবার আবিদের দিকে আর একবার সুনয়নার দিকে তাকায়।

- আমি নিশ্চিত, ঐ বেডি তোরেই ডাকতাছে। - ক্যান। বেডি বুঝি তোরে ডাকতে পারে না ? - বলে দে, গয়া যাচ্ছিস। যথাসম্ভব ভদ্রতা প্রদর্শন পূর্বক আবিদ পাল্টা প্রশ্ন রাখলো - আমাদের বলছেন ? - হ্যাঁ। এখানে তো আপনারাই ভ্যাদর ভ্যাদর বেশী করছেন।

সুতরাং প্রশ্নটাও আপনাদের উদ্দেশ্যে নিশ্চয়। - না মানে। আবিদ লজ্জা পেয়ে বসলো। - এই পৃথিবীতে শুধুমাত্র এ প্রশ্নটির উত্তরই সবার অজানা। আমরা কি জানি, আমরা কোথায় যাই ? -নিজেকে সামলে নিয়ে আবিদ ভারি একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো।

- মানে ? - আমরা তো প্রতিনিয়তই চলছি। কখনও কি আমরা থামি ? আমরা কি বলতে পারি যে, ওমুক জায়গা আমাদের শেষ ঠিকানা। - ইন্টারেস্টিং। আপনি অন্য ভাষায় কথা বলছেন। - নিখুঁত বাংলায় বলছি।

একটুও ইংরেজি কিংবা ঊর্দু বলিনি। তবে হ্যাঁ, গতানুগতিক উত্তর হবে সিলেট যাচ্ছি। - মনে হয় আপনাদের সাথে জমবে। - আলবত। সম্পূর্ণ বরফ হয়ে যাবেন যে।

ঠাট্টা করলো লাবিব। হাঁসির রোল পড়ে গেলো। - হ্যাঁ কি যেন বলছিলেন ? ওই যে ঠিকানা। - জানেন। মানুষ এখন মঙ্গল গ্রহে তাদের ঠিকানা তৈরি করার চেষ্টা করছে।

- হ্যাঁ। কিন্তু সেটা কি সম্ভব ? - অনেকেরই ধারণা সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহের মধ্যে পৃথিবীর সাথে একমাত্র মঙ্গলেরই মিল বেশী। চারশত কোটি বছর আগে মঙ্গল আর পৃথিবীর অবস্থা ছিলো একই রকম। দু'টোই ছিলো জীবনধারণের অনুপযুক্ত। উভয় গ্রহেই অগণিত আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত হতো ফুটন্ত লাভা, ধোঁয়ায় আকাশ থাকতো অন্ধকার, উল্কাপতন হতো যখন তখন।

আর ক্রমাগত এক কোটি বছর ধরে বৃষ্টিপাত হয়েছিলো দু’টি গ্রহে। পৃথিবী আজ প্রাণে পরিপূর্ণ। কিন্তু মঙ্গল ! প্রাণহীন, পাথুরে এখনও। মঙ্গলের সময় পৃথিবীর মতোই। এখানে রাত-দিন হয় ২৪ ঘন্টা ৩৭ মিনিটে।

আর গ্রীষ্মকাল দু’টো। ৬৮৭ দিনে বছর হয়। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর রাতের বেলার তাপমাত্রা থাকে ৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উজ্জ্বল কমলা রঙের আকাশ। - এই রকম তাপমাত্রায় জীবন ধারণ কি সম্ভব ? - মঙ্গলে বসবাসের জন্য সবসময় স্পেসস্যুট পরিধান করে থাকতে হবে।

যেটা সূর্যের আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মি থেকে বাঁচাবে। পৃথিবীর একশ কেজি ওজনের মানুষের ওজন মঙ্গলে গিয়ে দাঁড়াবে মাত্র আটত্রিশ কেজি। - ওয়াও। - মঙ্গল গ্রহে থাকার জন্য তাপমাত্রাকে সহনীয় করা হবে। পৃথিবীর চেয়ে একশ গুণ পাতলা বায়ুমন্ডলকে মানুষের সহ্য মতার সাথে সামঞ্জস্যশীল করা হবে।

আর এজন্য গ্রীণ হাউজ ইফেক্ট পদ্ধতি সবচেয়ে বেশী ফলদায়ক হবে। মধ্যাকর্ষণ মঙ্গলের আর একটি সমস্যা। অবশ্য বিজ্ঞানীরা মনে করেন, কয়েক পুরুষ পরেই মানুষের শরীরের হাড় অভিযোজিত হয়ে পাতলা হয়ে যাবে। - আচ্ছা। খেয়ে পরে তো বাঁচতে হবে নাকি ? - সে ব্যবস্থাও হবে।

- কিভাবে ? - মঙ্গলে মাত্র ১৬০ একর জমিতে সবার সারা বছরের খাবার ফলানো সম্ভব হবে। মরু অঞ্চলের বরফগলা পানি হবে পানীয়। বৈজ্ঞানিকরা মনে করেন টমেটো আর গম মঙ্গলে ভালো জন্মাবে। শুধু কি তাই ! সয়াবিনের চাষও হবে। কৃষি বিজ্ঞানীরা মাছ-মুরগির খামার গড়ে তোলার ব্যাপারেও আশাবাদী।

- ভালো কথা। সেটা কবে নাগাদ সম্ভব হবে ? - চেষ্টা চলছে। মঙ্গলে বসতি গড়ে তোলার জন্য উন্নত দেশগুলো উঠে পড়ে লেগেছে এ কথা বলা বাহুল্য। জাপান সহ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া পদেেপর পর পদপে নিচ্ছে। ‘৯৬ ও ‘৯৮-এ রাশিয়া মঙ্গলে পরীক্ষামূলক অভিযান চালিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র সে বিচারে এক কাঠি সরেস। মনুষ্যবাহী রকেটযান পাঠানোর পরিকল্পনাও এখন তাদের হাতে। ৪০ হাজার কোটি ডলার ব্যয়ে মার্কিনীদের আপত্তি দেখে মার্কিন বিজ্ঞানী রবার্ট জুবেরিন একটা নতুন সমাধানে এলেন। মাত্র ৫ হাজার মার্কিন ডলারের পরিকল্পনা সবার হাতে ধরিয়ে দিলেন। - কি রকম সেটা ? - নাসার বিজ্ঞানীরা মঙ্গলে বসতি স্থাপনের জন্য একটি ক্যালেন্ডার তৈরি করেছেন।

- অ্যাঁ। ওই হালা কি কস। ক্যালেন্ডারও বানাই ফালাইসস। একপিস আমারেও দিস। মঙ্গলের ক্যালেন্ডার বইলা কথা।

ভালোমত ছাপাইয়া বাণিজ্য কইরা ফালামু। লাবিব তার স্বভাবসূলভ ভঙ্গিতে কথার মধ্যখানে ঢুকে পড়লো। - কি রকম ক্যালেন্ডার ? বিকেলের প্রকৃতির মতো লালচে সুনয়নার হাসি মাখা প্রশ্ন। - ২০১৫-২০৩০ ঃ এ সময়ের আগে মানুষ পা রাখবে মঙ্গলে। বসবাসের জন্য গড়ে তোলা হবে কলোনি, যাতে বাস করবেন বিজ্ঞানীরা।

আবহাওয়ামন্ডল, ধূলিঝড় আর রেডিয়েশন সম্পর্কে নিরীক্ষাসহ পুরো ৫০০ মাইল এলাকা জুড়ে অভিযান চালানো হবে। প্রাণের উপস্থিতি বা সৃষ্টির সম্ভাবনাও পরীক্ষা করা হবে। ২০৩০-২০৮০ ঃ এ সময়টা হবে সবচেয়ে কঠিন। কেননা এ সময়েই পৃথিবী থেকে মানুষ স্থানান্তর শুরু হবে। ছোট আকারের পারমানবিক চুল্লি দিয়ে পাম্প করে গ্রিন হাউজ গ্যাস ছড়িয়ে দেয়া হবে বায়ুমন্ডলে।

যার ফলে একটি ঘন পর্দা সৃষ্টি হয়ে মানুষকে প্রচন্ড উত্তাপ থেকে বাঁচাবে। প্রথমদিকে বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, কৃষিবিদ প্রমুখদের নিয়ে আসায় বাসিন্দা দাঁড়াবে ১০ হাজারে। স্পেসস্যুট পরেই সব কাজকর্ম করতে হবে। এ সময় প্রতি বছর খরচ পড়বে ১৫ বিলিয়ন ডলার। - এত্তো খরচ ! - শুধু কি তাই।

ক্যালেন্ডার তো আরও আছে। ২০৮০-২১১৫ ঃ পরিকল্পনা সফল হলে এ সময় জীবন অনেক সহজ হয়ে যাবে। তাপমাত্রা থাকবে ৪০০ ফারেনহাইট থেকে ৫০ ফারেনহাইট। ভূত্বক থেকে CO2 ও পানি চোয়ানো বৃদ্ধি পাবে। বায়ুচাপ বাড়বে।

তাপমাত্রা ১৫০ ফারেনহাইট হলে তুন্দ্রা অঞ্চলে সবজি চাষ সম্ভব হবে। ইতোমধ্যেই বাসিন্দাদের সংখ্যা দাঁড়াবে ৫০,০০০-এ। তৈরি হবে রাস্তা-ঘাট। CO2 থেকে অক্সিজেন O2 বের করে অক্সিজেন সমৃদ্ধ বায়ুমন্ডল তৈরির প্রচেষ্টা করা হবে। গড়ে তোলা হবে যোগাযোগ ব্যবস্থা।

এ পর্যায়ে বার্ষিক খরচ দাঁড়াবে ৪৫ বিলিয়ন ডলার। ২১১৫-২১৩০ ঃ এ সময় তাপমাত্রা ৫০ ফারেনহাইট থেকে ৩২০ ফারেনহাইটের মধ্যে চলে আসবে। CO2 হ্রাস ও O2 বেড়ে যাওয়ায় সৃষ্টি হবে জীবাণু। ৩২০ ফারেনহাইট তাপমাত্রায় চিরহরিৎ বৃক্ষ রোপণ সম্ভব হবে। এ সময় বাসিন্দাদের সংখ্যা দাঁড়াবে ২,৫০,০০০-এ।

বাড়ি নির্মাণ, এয়ারটাইট ট্রাক ও গাড়ির প্রচলন হবে। পৃথিবী থেকে উচ্চ প্রযুক্তির জিনিস আমদানি করা হবে। - তার মানে এতো সময় পরও আমরা সাধারণ মানুষগুলো মঙ্গলে মঙ্গল সাধন করতে পারবো না ? - সমস্যা নেই। চাষাবাদের জন্য মানুষ সেখানেও লাগবে। ২১৩০-২১৫০ ঃ এ সময় তাপমাত্রা দাঁড়াবে ৩২০ ফারেনহাইট থেকে ৪৫০ ফারেনহাইট।

নানা ফসলের চাষ সম্ভব হবে। সৃষ্টি হবে নদী, পুকুর, ঝরনাসহ ছোট ছোট জলাশয়। কোনো বন্যপ্রাণী থাকবে না। এ সময় ব্যয়ও কমে যাবে। ২১৫০-২১৭০ ঃ অভিবাসন পর্ব শেষ হবে এ পর্যায়ে।

সৃষ্ট O2 - এর হার বাড়ায় মানুষ স্পেসস্যুট ছাড়াই চলতে পারবে। কোন করে উৎপাদন করা হবে নানা বন্যপ্রাণী। পৃথিবীর অনুরূপ পরিবেশ সৃষ্টি হবে এখানে। মহাকাশে শহর গড়ে ওঠার পরপরই গড়ে ওঠবে শিল্প কারখানা। আর জ্বালানির উৎস হবে সূর্য।

যেহেতু সবসময় সূর্যালোক থাকবে তাই জ্বালানিও থাকবে নিরবিচ্ছিন্নভাবে। গ্রহগুলোতে সিলিকন, অ্যালুমিনিয়াম, টাইটেনিয়াম, কাঁচ তৈরির সিলিকা, লোহা গন্ধক, ক্যালসিয়াম পাওয়ার সম্ভাবনা বিপুল। ভারহীন পরিবেশে প্রথমেই ব্যাপক হারে গড়ে উঠবে ‘সেমিকন্ডাক্টর মনোক্রিস্টাল’ তৈরির কারখানা। ইতোমধ্যেই মানুষের চুলের চেয়েও পাতলা প্লাস্টিক বল তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। উঁচু মানের কাঁচ আর অপটিক্যাল ফাইবার তো বটেই, প্লাইউডের মতো হালকা ইস্পাতের জিনিস বা হালকা ধাতুর তৈরি শক্ত জিনিস তৈরির জন্য মহাকাশের পরিবেশ আদর্শ।

- ও আচ্ছা। এটাকে ক্যালেন্ডার না বলে ভবিষ্যৎ বাণী বললে সুন্দর হয় না ? লাবিব প্রশ্ন রাখলো। - কেনো ? - যেভাবে বলছিস যেনো সত্যিই সব সম্ভব হবে। - ওই ব্যাটা এগুলো কি আমার কথা ? - রাইট। আধুনিক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের গবেষণার কথা।

সুনয়নার সাবলীল সমর্থন। - তাছাড়া শিগগিরই চালু হতে যাচ্ছে মহাকাশ পর্যটন বা ‘স্পেস ট্যুরিজম’। ইতোমধ্যেই স্টোম অ্যাডভেঞ্চারস এবং জে গ্রাম স্পেস ভয়েজেস নামে আমেরিকার দু ট্রাভেল এজেন্ট অগ্রিম বুকিং দিতে শুরু করেছে। টিকেটের দাম ? খুব বেশি নয়, মাত্র ৫০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ ডলার। - ও আল্লা ব্যাটায় কয় কি ? মঙ্গলে হবে পর্যটন ! - তবে কথা উঠেছে মহাকাশ শহর না হওয়া পর্যন্ত এ ভ্রমণ খুব একটা মজাদার হবে না।

গিয়ে শুধু পাক খেয়েই চলে আসতে হবে। আর টাকা খরচ করে যদি মঙ্গলের মাটিতে নামা না যায় কিংবা ‘অলিম্বাস মসস’-কে কাছ থেকে যদি নাই দেখা গেল তাহলে মজাটা আর থাকলো কোথায় ? - দূর ব্যাটা। যত্ত সব আষাঢ়ে গল্প। - আমাদের মতো দেশের মানুষের কাছে আষাঢ়ে গল্প বইকি। মানুষের তীব্র আকাংখার কোন সীমা নেই।

তাই সে সীমাহীন আকাংখা এখন সৌরজগৎ ছাড়িয়ে যেতে চাইছে অসীমে। অথচ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের তারা ‘প্রক্সিমা সেন্টারাই’র কাছে পৌঁছাতেই লেগে যাবে ৭০ হাজার বছর বা ৪.২ আলোকবর্ষ। বর্তমান প্রযুক্তিতে সেখানে পৌঁছানো অসম্ভব। আবার মানুষের জীবদ্দশায় সেখানে পৌঁছাতে হলে বহনকারী মহাকাশযানের গতিবেগ হতে হবে আলোর বেগের দুই-তৃতীয়াংশ। তাতে ‘প্রক্সিমা সেন্টারাই'তে পৌঁছাতে লাগবে ৪০ হাজার বছর।

কিন্তু কথা হচ্ছে এ বেগ অর্জন করা কি সম্ভব ? আবিদ এবং লাবিবকে অবাক করে দিয়ে সুনয়না যোগ করলো। - দেখুন তো। আমরা কেউ কারো সাথে এখনো পরিচিত হইনি। আমি লাবিব। - আমি আবিদ।

- আমি নিশি। - খুব সুন্দর নাম। উচ্ছ্বসিত প্রশংসা আবিদের। - আপনার মতো। লাবিব আরও এক ধাপ এগুলো।

- ধন্যবাদ। বিনয়ের সুরে নিশির প্রতিউত্তর। - কোথায় যাওয়া হচ্ছে ? - নানুর বাড়ি সিলেট। সেখানেই যাচ্ছি। - একা যাচ্ছেন ? আবিদের আশ্চর্যবোধক প্রশ্ন।

- পেছনের সিটে আব্বু-আম্মু আছেন। - যাক। বাঁচালেন। - কেনো ? - আমাদের সমাজে সাধারণত একজন মেয়ে মানুষ লম্বা ভ্রমণে একা যায় না তো। তাছাড়া আমরাও এরকম শুনতে অভ্যস্থ্য না।

- কি যে বলছেন। একা ভ্রমণে সমস্যা কোথায় ? - পুরুষ শাসিত সমাজে মেয়েদেরই সমস্যা বেশি। সাহায্যের প্রয়োজন হয়। - পুরুষ হয়ে কি খুব গর্ববোধ করেন ? - কখনও কখনও মেয়ে না হওয়ার জন্য আফসোস হয়। লাবিব বললো।

- ঠাট্টা করছেন। - মোটেই না। ভুলে গেলে চলবে না। দেশের দু’প্রধান ব্যক্তিত্ব মহিলা। - ওগুলো ব্যতিক্রম।

- তারপরও। মেয়েরা এখন অনেক কিছু করছে। - এখনও মেয়েরা-ই সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। দেশে দেশে সেটার প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে। - কথা হচ্ছে সাবধানের মার নেই।

ওই অর্থেই আমরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে রাখতে চাই, এই আর কি। লাবিবের রসালো সংযোজন। - আমরা যখন বিছানায় শুয়ে থাকি তখন দূর্ঘটনার আশংকামুক্ত থাকি। আবার হাঁটতে শুরু করলে এই আশংকামুক্তির খানিকটা হ্রাস ঘটে। অপরদিকে হাঁটার পরিবর্তে দৌঁড়ানো শুরু করলে, আশংকামুক্তি আরও কমে যায়।

এরপর দ্রুতগামী বাসে চড়লে আমরা প্রবেশ করি অনিশ্চিত এক আশংকায়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে দূর্ঘটনা হবেনা এই মর্মে কোন নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। কারণ, পুরো ব্যাপারটাই অনিশ্চিত আশংকার অন্তর্ভূক্ত। মোদ্দা কথা বিকশিত হতে হলে মানুষকে ঝুঁকি নিতেই হবে। মেয়েরাতো মানুষের অংশ।

নাকি ? - তারপরও সান্ত্বনা হচ্ছে আপনি আপনার বাবা-মা’র সাথেই আছেন। আপনি এটাও স্বীকার করবেন যে, উনারাও আপনার সাথে থাকতে পেরে স্বস্তি বোধ করছেন। এটা আমার কথা নয়। আমাদের মধ্যবিত্ত রণশীল সমাজে এটাই বাস্তবতা। - আচ্ছা, আবিদ এবং লাবিব সাহেব একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন ? - কি ? দু’জনে সমস্বরে প্রশ্ন করলো।

- মানুষের জ্ঞান অর্জন করে কী লাভ ? টিকে থাকার জন্য জ্ঞানই সবচেয়ে জরুরী। নিজেদের ভেতর এমন কিছু বোধ বা নীতিমালার জন্ম হওয়া। যেমন - কাউকে অযথা আক্রমন করা ঠিক নয়, জোর করে কিছু ছিনিয়ে নেওয়া উচিৎ নয়, কাকে ভালোবাসবো অথবা কাকে ঘৃণা করবো - এসব তো জ্ঞান। স্বল্প আয়ুর মানুষের পে শুধু শুধু এতো জ্ঞান - বিজ্ঞানের চর্চা করে কী লাভ ? - কতটুকু জানলে আমাদের লাভ হবে আর কতটুকু না জানলে চলবে - এটাই আমাদের পড়ালেখার মূল শ্লোগান। এভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হতে পারে না।

ইউকিডের কাছে জনৈক ছাত্র জ্যামিতির প্রথম পাঠ নেওয়ার সময় জিজ্ঞেস করেছিলেন - “এইগুলো শিখে আমার কী লাভ হবে ?” একথা শোনামাত্র ইউকিড তাঁর দাসকে ডেকে বললেন - “একে একটি মুদ্রা দান কর, কারণ সে যা শেখে তার দ্বারা সব সময় লাভ করতে চায়। ” আমাদের সমাজব্যবস্থাও ঠিক একই রকমভাবে লাভের সাগরে ভাসার চেষ্টায় অবিরাম ঘর্মাক্ত হচ্ছে। ক্রমেই আমরা নাম্বারবাজ জাতিতে রূপান্তরিত হচ্ছি। নেপথ্যে ভূমিকা রাখছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। অবশ্য সবগুলো নয়।

আজ বেশির ভাগ যাঁরা ডাক্তার হয়েছেন কিংবা হচ্ছেন তাদের অনেকে শুধু এই ভাবনার বশবর্তী হচ্ছেন যে যে এতে প্রচুর অর্থ আসবে, সামাজিক সম্মান নিশ্চিত হবে। এমন ডাক্তারদের কাছে আন্তরিকতা আশা করা অর্থহীন। আমাদের দেশের যে কোন ধারার পড়াশোনার অবস্থাই এরকম। লাবিব বললো। - একজন মানুষের কতটুকু জানলে প্রয়োজন মিটে যাবে তা অনির্ণেয়।

মানুষ হিসেবে সে আসবে, তিন বেলা খাবে, ঘুমোবে আর সন্তান জন্ম দেবে, তারপর মারা যাবে। এটাই কি মানুষের কাজ ? আবিদের প্রশ্ন নিশির জন্য। - আগেতো আমাদের শিতি হতে হবে। তারপর জ্ঞানের অন্বেষণে বেরিয়ে পড়বো। তাই নয় কি ? ‘শিক্ষা’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃত ‘শাস্’ ধাতু থেকে।

‘শাস্’ ধাতুর অর্থ হলো ‘শাসন করা’, ‘নিয়ন্ত্রণ করা’, ‘নির্দেশ দেয়া’, ‘তিরস্কার করা’, ‘উপদেশ দেয়া’ ইত্যাদি। অন্যদিকে শিা শব্দের সমার্থক ‘বিদ্যা’ শব্দটির উদ্ভব হয়েছে সংস্কৃত ‘বিদ’ ধাতু থেকে। ‘বিদ’-এর অর্থ জানা বা জ্ঞান অর্জন করা। বুৎপত্তিগত অর্থে শিক্ষা হলো জ্ঞানার্জনের প্রয়াস। বাংলা ভাষার ‘শিক্ষা’ শব্দটি দ্বারা নানা অর্থ প্রকাশ পায়।

এ শব্দটির দ্বারা জ্ঞান চর্চা, অনুশীলন বা অভ্যাসের মাধ্যমে কোন বিশেষ কর্মে দতা অর্জন বা কোন কিছু আয়ত্ত করাকে বুঝায়। আবার এর দ্বারা জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা অর্জন বা কোন বিধি নিষেধ পালনের কথাও বুঝায়। এমনকি অন্যায় বা অবাঞ্চনীয় কাজের জন্যে শাস্তিদানের কথাও এ ‘শিক্ষা’ শব্দটি দ্বারা প্রকাশ পায়। যেমন কাউকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়া অর্থাৎ শাস্তিদান করা বুঝায়। আমার তো মনে হয় আমরা শিতি হচ্ছি কেবল ‘উচিৎ শিক্ষা’ দানের জন্য।

আমাদের সরকারি কিংবা বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানে ‘উচিৎ শিক্ষা’র প্রতিযোগিতায় কম বেশি সবাই মত্ত। সক্রেটিস বলেন - ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো সত্যের আবিষ্কার ও মিথ্যার অপনোদন। ’ অথচ আমরা আমাদের দেশে না হচ্ছি সুশিতি না হচ্ছি প্রকৃত জ্ঞানী। অবধারিতভাবে আমরা সুনাগরিকও নই। আমরা সবাই জানি যে, সাধারণভাবে গণতান্ত্রিক সমাজের বিকাশের জন্য আবশ্যকীয় গুণাবলী যেমন-বুদ্ধি, বিবেক, আত্বসংযম এসব যে নাগরিকদের মধ্যে বিদ্যমান থাকে তাকে সুনাগরিক বলা হয়।

একটি দেশ ও জাতির সুখ্যাতি ও অগ্রগতিতে সুনাগরিকের গুরুত্ব অপরিসীম। সুনাগরিক দেশ ও জাতির মূল্যবান সম্পদ। একটি রাষ্ট্রের মান-মর্যাদা ও শৌর্য-বীর্যের জ্বলন্ত প্রতীক হলো সুনাগরিক। কিন্তু মহামান্য সাংসদ কিংবা সরকার যন্ত্রের চালকেরা আমাদের উপর যে গজব চাপিয়ে দেন আমরা সবাই তা ধর্মের চেয়েও বড় বলে মেনে নিই। বিধাতাকেও গালাগাল করতে আমাদের বাধে না অথচ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম তোলা আশি টাকাকে ছাড়িয়ে গেলেও ‘ব্যাপার না’ টাইপের ভাব করে মেনে নিচ্ছি।

সত্যি সেলুকাস ! এধরণের বিরক্তিকর সহ্যশীলতা, প্রকারান্তরে গা বাঁচানো ভাবওয়ালা কোন জাতির উন্নতির পথ যথেষ্ট বন্ধুর হয়। গম্ভীর মুখে নিশি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। - সংস্কৃত ভাষায় ‘দর্শন’ মানে দেখা। ‘দৃশ’ ধাতু থেকেই দর্শন শব্দের উৎপত্তি। দর্শন বলতে সাধারণত চাুষ প্রত্যণকে বুঝায়, তবে এক্ষেত্রে ‘দর্শন’ মানে তা নয়।

‘দর্শন’ মানে তত্ত্ব-দর্শন - জগতের এবং জীবের স্বরূপ উপলদ্ধি। সত্যের প্রত্যক্ষ উপলদ্ধি বা তত্ত্বসাক্ষাৎকারই দর্শন। সে কারণে ভারতীয়দের দৃষ্টিতে তিনিই দার্শনিক যাঁর সত্যের প্রত্য উপলদ্ধি হয়েছে, যাঁর তত্ত্বসাক্ষাৎকার ঘটেছে, যিনি এই বিশ্বজগৎ ও জীবনের স্বরূপ জেনেছেন। আবিদ আমরা কি নিজের চোখ দিয়ে সে দেখা দেখি ? লাবিব প্রশ্ন করলো। - এই জগতের দিকে মানুষ যখন তাকিয়ে দেখে তখন বিস্ময়ে তার মন ভরে যায়।

জগতের অসীম ব্যাপকতা, অনন্ত বৈচিত্র্য তার মনে অদম্য কৌতুহল সৃষ্টি করে। এই বিস্ময় থেকেই আসে জিজ্ঞাসা, তাই তার মনে নানারকম প্রশ্ন জাগে - এ জগৎ কি ? কোথা থেকে এ জগতের উৎপত্তি হলো ? এ জগতের কি কোন সৃষ্টিকর্তা আছে ? জগতকে ঘিরে যে সূ কলা কৌশল, নিয়ম-শৃংখলা, কে এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে ? এইভাবে একের পর এক অসংখ্য প্রশ্ন মনের মাঝে ভিড় করে। বিস্ময় থেকে জেগে ওঠে মানুষের মনের আকাংখা। বিস্ময় নিয়ে আসে জিজ্ঞাসা। আর বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন জীব সেই জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে পেতে চায়।

এইভাবে দর্শনের উৎপত্তি। দার্শনিক প্লেটো বলেছেন - ‘বিস্ময়ই দর্শনের জনক’। আমরা আমাদের দেশে প্রতিদিনের ভাত-কাপড়ের সংগ্রামী জীবনে কোন কিছুতেই বিস্মিত হচ্ছিনা। পৃথিবীর মধ্যে যতগুলো জাতি আছে বোধ হয় সবচেয়ে অবাক করার মতো সহ্যশীল জাতি আমরা। যা কিছু ঘটে সেটা প্রাকৃতিক কিংবা মনুষ্য সৃষ্টি যা-ই হোক না কেন তার জন্য যেন আমরা প্রস্তুত ছিলাম।

‘সবই উনার (উপরওয়ালার) ইচ্ছা’-টাইপের দৃষ্টিভঙ্গিতে এড়িয়ে চলছি সবকিছু। এতে যতটা দোষ আমাদের, তার চেয়ে বেশি দোষ সরকার নামক গাড়িতে বসে যে বা যারা আমাদের চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে যুগের পর যুগ তাদের। - আবিদ সাহেব এক হিসেবে আমরা সবাই তো দার্শনিক। আমাদের প্রত্যেকেরই জগৎ ও জীবন সম্পর্কে কতগুলি ধারণা আছে। কিন্তু আমাদের এইসব ধারণা সব সময় যথার্থ বা সঙ্গতিপূর্ণ হয় না।

একটু বিচার করলেই দেখা যায় যে, আমাদের ঐ সকল অনেক ধারণাই উদ্ভট, ভ্রান্ত এবং অসংগত। বস্তুর স্বরূপ বা যথাযথ রূপ সম্পর্কে জ্ঞান দান করাও দর্শনের কাজ। দর্শনের অঙ্গীভূত অধিবিদ্যা বা তত্ত্ববিদ্যা ইংরেজি ভাষার গবঃধঢ়যুংরপং এই জ্ঞান দান করে। আমরা সাধারণতঃ বস্তুর দু’টি রূপ সম্পর্কে অবহিত হই। একটি তার বাহ্যরূপ এবং অপরটি তার স্বরূপ বা যথার্থ রূপ।

আকাশের যে নীল রং আমরা প্রত্য করি, সেটি তার বাহ্যরূপ, আমরা জানি স্বরূপতঃ আকাশ বর্ণহীন। জলপূর্ণ পাত্রের মধ্যে অর্ধনিমজ্জিত কাঠের টুকরেটিকে বাঁকা মনে হয়, অথচ আমরা জানি স্বরূপতঃ তা নয়। বস্তুর এই বাহ্য বা বাইরের রূপটিকে বলা হয় অবভাস বা প্রতিভাস, Phenomena বা Appearance এবং বস্তুর স্বরূপ বা যথার্থ রূপকে বলা হয় Noumena বা Reality। কিন্তু স্বাভাবিক দৃষ্টিকোন থেকে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো আমাদের দেশের প্রত্যেকটা সাধারণ মানুষ ঐ দু’টি রূপ সম্পর্কে সত্যিই ওয়াকিবহাল। কিন্তু কী এক অজ্ঞাত কারণে তাঁরা প্রত্যেকে অন্ধ।

রাত্রির নিস্তব্দতা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। নিশির কথায় যেন সে পূর্বাভাস নেমে এলো। কিছুণের জন্য সবাই কথা হারিয়ে ফেললো। - আসলে আমরা বাঙালী জাতি যুদ্ধের পর থেকে এ পর্যন্ত শুধুমাত্র অসৎ রাজনীতির কারণে এতটা পিছিয়ে পড়েছি। অন্যথায় আমাদের সবই ছিলো এবং আছে।

জাতি হিসেবে আমাদের একমাত্র রোগের নাম অসৎ রাজনীতি। লাবিব নিরবতা ভেঙ্গে বললো। - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সৈয়দ ইমতিয়াজ আহমদ এশিয়ান স্কলারশীপ এওয়ার্ডের ‘ Modernity, Identity & Recognition : Malaysia in the post 9/11 world ’ শিরোনামে International Policy বিষয়ক ৯ মাসের গবেষণা কাজের অংশ হিসেবে মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের ৮৬ তলায় যেটা ঐ টাওয়ারের সর্বোচ্চ তলা সেখানে আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার খ্যাত মাহাথির মোহাম্মদের সাথে একান্ত সাাৎকারে মিলিত হয়েছিলেন। আবিদ একটা ম্যাগাজিনের নাম উল্লেখপূর্বক প্রসঙ্গটা তুললো। - সাক্ষাৎকারটা কেমন ছিলো ? নিশি ও লাবিবের সমস্বর জিজ্ঞাসা।

- অধ্যাপক সৈয়দ ইমতিয়াজ আহমদের মতে ‘মাহাথির চূড়ান্তভাবে একজন আধুনিক মানুষ। তিনি তার সময়ের চেয়ে এগিয়ে থেকে চিন্তা করতে পারতেন। অনেক সময় অন্যরা তা বুঝতে পারতেন না। ’ ‘৯৭/৯৮ সালে এশিয়াজুড়ে অর্থনৈতিক সংকটের সময় মাহাথিরের দূরদর্শিতা প্রমাণিত হয়। জর্জ সরোস নামে এক হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন ধনকুবেরের ফটকাবাজির দরুন দণি-পূর্ব এশিয়ার নিজস্ব মুদ্রাগুলোর ব্যাপক দরপতন ঘটে।

অর্থনৈতিক সংকটের আগের দশকে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দণি কোরিয়ার মতো দণি-পূর্ব এশিয়ার বেশ কিছু দেশ অভাবনীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল। ‘এশিয়ার ব্যাঘ্র’ নামে সুপরিচিত এই দেশগুলোর চার দশকে প্রবৃদ্ধি অর্জনের হার ছিল ১৫০০%। সস্তা শিতি শ্রমিক, বেসরকারীকরণ, নিয়ন্ত্রণমুক্ত পুঁজিবাজার এবং মুক্তবাণিজ্যের কারণে এ দেশগুলো প্রত্য বৈদেশিক বিনিয়োগ লাভে সমর্থ হয়েছিল। ধস আসে হঠাৎ করেই। গুজব ছড়িয়ে পড়ে বিনিয়োগকৃত অনেক কোম্পানীই আসলে ‘হায় হায়’ কোম্পানী।

শুরু হয় শেয়ার বাজার থেকে পুঁজি প্রত্যাহারের হিড়িক। পুরো দণি-পূর্ব এশিয়ায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে এই প্রবণতা। ’৯৭ এর মে মাসে থাই বাথের পতনের মধ্য দিয়ে এর সূত্রপাত। ধাক্কা খায় মালয়েশিয়ান রিঙ্গিটও। ’৯৮ সালের জানুয়ারিতে ডলারের সঙ্গে রিঙ্গিটের বিনিময় হার ২.৪২ থেকে বেড়ে ৪.৮৮-তে ঠেকে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতির এমন বেহাল দশার জন্য দেশগুলোকেই দায়ী করে। আইএমএফ বলে ‘স্বচ্ছতার অভাবের’ কারণে বিদেশীরা এসব দেশের অর্থনীতির পুরো চালচিত্র জানতে পারেনি। কাজেই বিদেশী বিনিয়োগকারীরা না জেনে অনেক কম উৎপাদনশীল শিল্প কারখানার শেয়ারে বেশী টাকা ঢেলেছে। বিপর্যস্ত দেশগুলোকে ‘উদ্ধারের’ নামে আইএমএফ শর্তসাপেে সাহায্য প্যাকেজ নিয়ে আসে। এরকম একটি শর্ত ছিলো, বিনিয়োগকারীদের অবাধ বিনিয়োগ এবং ইচ্ছামাফিক পুঁজি তুলে নেবার সুযোগ দিতে হবে।

আইএমএফের ‘পরামর্শ’ না মেনে উপায় ছিলোনা মালয়েশিয়া, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া, থাইল্যান্ডের। অর্থনৈতিক সংকট এসব দেশকে একেবারে পঙ্গু করে দিয়েছিলো। - হ্যাঁ ঘটনাটা সারা এশিয়াকে টালমাটাল করে তুলেছিলো। লাবিব বললো। - মালয়েশিয়ার উদাহরণ দেয়া যায়।

অর্থনৈতিক ধসের আগে মালয়েশিয়ার বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিলো ৮.৭%, মুদ্রাস্ফীতি ৪%-এর কম, বেকারত্বের হার ২৫%। বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিলো কম। ঋণ সেবার অনুপাত ছিলো ৬:১। জাতীয় সঞ্চয় হার ৩৮.৫%। ধসের কারণে ১৯৯৮ সালে বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২৫.২% কমে যায় এক ধাক্কায়।

সঞ্চয় এবং বিনিয়োগ অর্ধেক হয়ে যায়। লাখ লাখ লোক হঠাৎ বেকার হয়ে যায়। কাজেই মালয়েশিয়াও অন্যান্য দেশের মতো প্রথম পর্যায়ে আইএমএফের ‘প্রেসক্রিপশন’ মানতে বাধ্য হয়। কিন্তু এক বছর পরেও দেখা গেলো, মুদ্রার দরপতন অব্যাহত রয়েছে। এক বছরে রিঙ্গিটের মূল্য কমেছে ৩৫%।

অন্যদিকে কুয়ালালামপুর শেয়ারবাজারে সার্বিক সূচকের পতন ঘটেছে ১২০০ পয়েন্ট বা ৫২ শতাংশ। মাহাথির বুঝতে পারলেন আইএমএফের পরামর্শ মেনে কাজ হবে না। - তারপর কি হলো ? নিশি প্রশ্ন রাখলো। - ‘৯৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর মাহাথির টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। বছরখানেক আগে এমনই এক টিভি ভাষণে অর্থনৈতিক ধসের জন্য তিনি জর্জ সরোসকে ‘বেজন্মা’ বলে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছিলেন।

এ দিনের ভাষণটি দ্ব্যার্থবোধক। মাহাথির ঘোষণা দেন, দেশের বাইরে মালয়েশিয়ান মুদ্রা রিঙ্গিটে কোন রকম ব্যবসা-বাণিজ্য চলবে না। বিদেশী ব্যাংকে গচ্ছিত রিঙ্গিট এক মাসের মধ্যে দেশে ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়ে বলেন, এরপর এই মুদ্রা অবৈধ হয়ে যাবে। এছাড়া ডলারের সঙ্গে রিঙ্গিটের বিনিময় হার ৩.৮-এ বেঁধে দেয়া হয়। শেয়ার বেচাকেনার মাধ্যমে বিদেশীর অর্জিত লাভ বাইরে নিয়ে যাওয়ার ওপরেও কড়াকড়ি আরোপ করেন।

এছাড়া যারা মালয়েশিয়ার অধিবাসী নন, তাদের জন্য রিঙ্গিট ব্যবহার অবৈধ ঘোষণা করেন। কার্যত মাহাথির আইএমএফের কোন পরামর্শ বা সাহায্য নিতে অস্বীকার করেন। মাহাথির মোহাম্মদের এমন ‘উদ্ভট’ সিদ্ধান্ত দেশের ভেতর-বাইরে সমালোচনার ঝড় তোলে। আইএমএফসহ পশ্চিমা দাতাগোষ্ঠী এই ভেবে শঙ্কিত হয় যে, মালয়েশিয়ার দেখাদেখি যদি অন্যান্য এশিয়ান, আফ্রিকান কিংবা ল্যাটিন আমেরিকান দেশ এমন কড়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আরোপ করে তাহলে পশ্চিমা বিনিয়োগকারীদের শেয়ারবাজারে ‘ফটকাবাজি’ বন্ধ হয়ে যাবে। যদিও মাহাথিরকে আরও বড় বিপদের ভয় দেখানো হয়।

- আমরা জানি মাহাথির সে ভয় ভীতি উপো করে নিজের পথেই অটল ছিলেন। কিন্তু সেটা কিভাবে ? লাবিব প্রশ্ন রাখলো। - আদতে দেখা যায়, মাহাথির সঠিক কাজটিই করেছিলেন। রিঙ্গিটের অফ-শোর লেনদেন বন্ধ করে এবং শেয়ারবাজারের লাভ তুলতে বাধা দিয়ে দেখা গেলো কয়েক মাসের মধ্যেই দরপতন ঠেকেছে। ২০০০-এর মাঝামাঝিতে বিদেশী লগ্নিকারকদের লাভ তুলে নেওয়ার উপর কড়াকড়ি শিথিল করা হয়।

যদিও সেই লাভ অন্তত ১ বছর মালয়েশিয়ায় মুদ্রা বাজারে থাকাটা বাধ্যতামূলক করা হয়। নয়তো সেই লাভের উপর রপ্তানি শুল্ক বসানোর হুমকি দেন মাহাথির। হুমকিতে কাজ হয়। এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে অর্থনৈতিক সংকট চলতে থাকলেও মালয়েশিয়ার অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে আসে। বিশ্বব্যাংকের দেয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ’৯৮ সালের মাইনাস ৭.৫% অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ’৯৯ সালে ত্বরিত বৃদ্ধি পেয়ে ৬%-এ ওঠে।

২০০৩ সালে অর্থাৎ মাহাথিরের অবসর গ্রহণের বছরে এ হার ৪%-এ স্থিতিশীল ছিলো। তিনি যখন মতায় আসেন (অর্থাৎ ১৯৮১ সালে) তখন ক্রয়মতা সাম্যের (পিপিপি) মালয়েশিয়ার মাথাপিছু জিএনপি ছিলো ২৩২০ ডলার। মাহাথির সেটিকে নিয়ে যান ৮৯২০ ডলারে (২০০২)। - আসলে মালয়েশিয়ার মাহাথির না বলে আমরা যদি মাহাথিরের মালয়েশিয়া বলি আমার মনে হয় ভুল হবে না। নিশি বললো।

- Obviously । ক্ষমতার শেষের দিকে এশিয়াউইক পত্রিকায় তার একটি সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। সর্বশেষ প্রশ্নটি ছিলো - মানুষ কেনো আপনাকে মনে রাখবে ? মাহাথির জবাব দেন, আমি এর তোয়াক্কা করি না। সৈয়দ ইমতিয়াজ আহমেদের সঙ্গে মাহাথিরের আলোচনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ইসলাম, আধুনিকতা ও মৌলবাদ বিষয়ক কথোপকথন। সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে মাহাথির বলেছেন, ‘আমরা মধ্যপন্থি মুসলমান নই, আমরা মৌলবাদী মুসলমান।

’ সারা বিশ্বেই ইসলাম এবং মৌলবাদ নিয়ে বিতর্ক চলছে। আমেরিকা বলছে, লাদেন মৌলবাদী। ইসলামের সত্যিকার শিক্ষা যিনি মেনে চলেন, মাহাথিরের দৃষ্টিতে তিনিই মৌলবাদী। ইসলাম শান্তির কথা বলে। কাজেই একজন ‘মৌলবাদী’ মুসলমানের কাজ হবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।

‘মাহাথির আসলে ইসলামকে মধ্যপন্থি, মৌলবাদী ইত্যাদি ভাগে ভাগ করতে চান না। তাঁর দৃষ্টিতে ইসলাম একটাই। আন্তর্জাতিক এক মিডিয়ার সাথে সাক্ষাৎকারে ‘মালয়েশিয়া ছিল রাবার রপ্তানির অন্যতম দেশ। সেখান থেকে বিশ্বের শীর্ষ ২০টি অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। উন্নতির রহস্যটা কী ছিল ?’ - এ প্রশ্নের জবাবে মাহাথির বলেন - ‘বহু আগে আমরা বুঝেছিলাম ঔপনিবেশিকতার মনোভাব বা রীতিনীতি ধরে রাখলে উন্নতি হবে না।

দেশের জনসংখ্যা বাড়ছিল। ১ একর জমিতে চাষাবাদ করেও কৃষক জীবন নির্বাহের জন্য অর্থ জোগাতে পারছিলো না। কিন্তু ঐ একই জমিতে যদি কারখানা বসানো হয় তাহলে অন্তত ৫০০ পরিবারের জীবিকা নির্বাহ সম্ভব। দ শ্রমশক্তিকে কাজে লাগাতে কারখানা তৈরি করা হয়েছিল। কর্মসংস্থান সৃষ্টিই ছিলো মূল ল্য।

ক্রমান্বয়ে এই কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আমরা এতোটাই সফল হয়েছি যে, এখন বিদেশ থেকে শ্রমিক আনতে হয়। কর্মসংস্থানের সংখ্যা প্রকৃত দক্ষ শ্রমজীবির চেয়ে বেড়ে গেছে। ’ - আচ্ছা আমাদের দেশে এমনটি হয় না কেন ? হতাশা মাখা প্রশ্ন নিশির। - আমাদের দেশের তথাকথিত রাজনীতিবিদদের Psychic Surgery করলে বিষয়টার ব্যাপারে পরিস্কার ধারণা পাওয়া যেতো। - এইডা আবার কি ? লাবিব জানতে চাইলো।

- যে ক্ষমতার বলে কোন যন্ত্রপাতি ছাড়াই মানুষের শরীরে অস্ত্রোপাচার সম্ভব এবং দূর থেকে ইচ্ছার জোরে চামচ বাঁকানো যায়। তাকে সাইকিক সার্জারি বলে। - ও আবিদ, ডিএনএ না কি যে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।