আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বৈশ্বিক মন্দার ঢেউ ও হিমায়িত খাদ্যশিল্প



বৈশ্বিক মন্দার ঢেউ ও হিমায়িত খাদ্যশিল্পঃ সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বৈশ্বিক মন্দার ঢেউ আস্তে আস্তে আছড়ে পড়তে শুরু করেছে আমাদের রফতানি খাতে। ২০০৭ সালে এই খাতে রফতানি লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬শ মিলিয়ন আমেরিকান ডলারের সমপরিমাণ। কিন্তু ওই বছরে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। ২০০৭ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই আমেরিকায় চিংড়ির দাম কমে যায়। যেখানে সাধারণ সাইজের (১৬-২০ সাইজ, ১৬ থেকে ২০টি মাথা ছাড়ানো চিংড়িতে এক পাউন্ড ওজন) চিংড়ির দাম ছিল সাড়ে পাঁচ পাউন্ডের মতো; সেই চিংড়ির দাম কমে আসে সাড়ে চার পাউন্ডের মতো।

অর্থাৎ অঙ্কের হিসাবে ২০% দাম কমে যায়। ফলে মোট রফতানি মূল্যের পরিমাণ কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৫শ' ৮ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ হিমায়িত মৎস্য রফতানিকারক সমিতির পরিচালক এস হুমায়ূন কবির বলেন, দাম কমে যাওয়ার এই প্রবণতাটি অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান বছরেও বিশ্ববাজারে চিংড়ির দাম বাড়বে এমনটি তো আশা করাই যায় না; বরং আশঙ্কার কারণ হচ্ছে, ক্রেতাদেশগুলোর আমজনতা চিংড়িকে একটি সাধারণ পণ্যের মতো করেই ব্যবহার করতে শুরু করেছিল; যা এখন সেই ক্রেতাদের কাছেই অভিজাতদের খাবার হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। তিনি এটিকে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সরাসরি প্রতিক্রিয়া হিসাবে উল্লেখ করে বলেন, ক্রেতাদেশগুলোর নাগরিকদের আয় কমে যাওয়ায় তাঁরা এখন তুলনামূলকভাবে কম দামে খাবার কিনতে শুরু করেছেন; এই প্রবণতা যত দীর্ঘায়িত হবে, আমাদের চিংড়ি খাতে প্রতিক্রিয়া তত বেশি পড়বে।

বর্তমানে বিদেশের বাজারে সাধারণ সাইজের চিংড়ির গড়মূল্য ৪ ডলারের সামান্য বেশি। এই দাম স্থিতি পর্যায়ে থাকলে এবারেও হয়তো পাঁচশ' মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ চিংড়ি রফতানি করা যাবে। তবে দাম কমে গেলে এই অর্জন সম্ভব হবে না বলে রফতানিকারকরা মনে করেন। আর পুঁজিবাদী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার এই ধাক্কায় প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পটি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি চিংড়ি চাষিরাও আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। শ্রমিকদের শ্রমের অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে যারা কাজ করেন, সেই সূত্রগুলো বলছে, মন্দার এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে রফতানিকারকরা সরকারের কাছ থেকে আরও বেশি সুবিধা নিতে চাইছে।

এমনিতেই এই শিল্পে শ্রমিকদের এখনও ন্যূনতম বেতন কাঠামো নির্ধারিত হয়নি; বেতন কাঠামো তৈরির একটি চেষ্টা প্রক্রিয়াধীন। শ্রমিকদের চাকরিরও কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারখানাগুলোয় অধিকাংশ নারী শ্রমিক। যারা বাজারমূল্যের চেয়ে বেশ কম মজুরি পেয়ে থাকেন। এই শ্রমিকদের কাজ ও মজুরির কোনো নিশ্চয়তা নেই।

খুলনাঞ্চলে ৫৬টি প্রক্রিয়াজাত কারখানার মধ্যে বর্তমানে ৩০টির মতো কারখানা কমবেশি চালু রয়েছে। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান বলেন, মন্দার একটি ধাক্কা আমাদের রফতানি খাতে পড়বে এটি স্বাভাবিক, তবে আমাদের রফতানি খাতের প্রধান আয় যেহেতু চিংড়ি নয়, সেহেতু চিংড়ি খাতের প্রতিক্রিয়া সামগ্রিকভাবে খুব বেশি নয়; তবে জনশক্তি রফতানি খাতে এই প্রতিক্রিয়াটি তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশি শ্রমিকদের দুর্গতি শুরু হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও। মিশিগান, ক্যালিফোর্নিয়া, সাউথ ক্যারোলাইনা ও রোডস আইল্যান্ড- এই চারটি রাজ্যে হাজার হাজার বাংলাদেশি বেকার হয়ে পড়েছে। তারা এখন দেশে ফেরার কথা ভাবছে।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিশ্বমন্দা বাংলাদেশকে আঘাত করার ফলে শ্রমঘন শিল্প হিসাবে পরিচিত গার্মেন্টস, নিটওয়্যার ও হিমায়িত মৎস্য খাতে নিয়োজিত বহু কর্মী চাকরি হারাবে। এই তিনটি খাতেই শ্রমিকদের একটি বড় অংশ নারী। এরা বেকার হলে নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির পথই শুধু বাধাগ্রসত্ম হবে না, তাদের পরিবারে আয়ের অঙ্কও কমে যাবে, বাড়বে দারিদ্র্য। বেকারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণও কমতে থাকবে। অর্থনীতির চাকা চলতে শুরু করবে উল্টোদিকে।

রফতানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পরিমাণও কমতে থাকবে। হ্রাস পাবে রিজার্ভের পরিমাণ। পণ্য আমদানির প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দেওয়ার জন্য সরকারকে তখন হাত পাততে হবে বিদেশি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে যা কোনও শুভ ফল বয়ে আনবে না। শুধু বাংলাদেশ নয়, মন্দার ধাক্কা অনেক আগেই লেগেছে পাশের দেশ ভারতেও। শিল্পখাতগুলো মন্দায় আক্রান্ত হওয়ার পরই শেয়ারবাজারেও ধস নামতে শুরু করেছে।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি আয়ের লোকজন শেয়ারবাজারে টাকা লগ্নি করার বদলে ঝুঁকে পড়েছে সোনা কেনার দিকে। তারা দেখেছে, স্টক মার্কেটের টাকা লগ্নি করলে এক বছরে আয়ের পরিমাণ ৫২ শতাংশ, ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট রাখলে তার পরিমাণ ৮ থেকে ১০ শতাংশ। অথচ সোনা কিনলে লাভ হয় বছরে ২৯ শতাংশ। এ কারণে ভারতে সোনার দাম চড়চড় করে বেড়ে যাচ্ছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০০৮ সালের অক্টোবরে ১০ গ্রাম সোনা ছিল ১১ হাজার ৮শ রুপি, ২০০৯ সালের ফের্রুয়ারিতে সেই সোনার দামই উঠেছে ১৫ হাজার ৩শ ২৪ রুপিতে।

শুধু ভারত কেন, আন্তর্জাতিক বাজারেও সোনার দাম বেড়ে গেছে। ২০০৮ সালের অক্টোবরে ১ আউন্স সোনার দাম যেখানে ছিল ৮শ ৬ ডলার, ২০০৯ সালের মার্চে এর দাম উঠে গেছে ৯শ' ১৯ ডলারে। অর্থাৎ সোনা হয়ে উঠেছে নিরাপদ লগ্নির এক মাধ্যম। যুক্তরাষ্ট্রও মন্দার ধকল কাটাতে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বেশ কিছু পরিমাণ সোনা বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মন্দার ধাক্কা কাটানোর জন্য বিক্রির মতো সোনা বাংলাদেশের হাতে নেই।

তো বাংলাদেশ কী করবে? এরই মধ্যে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা মন্দার ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকারের কাছে ৬ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ সুবিধা চেয়েছেন। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মন্দার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এখনই জরুরি কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। সেগুলো হচ্ছে- ১. জনশক্তি রফতানির জন্য নতুন নতুন ক্ষেত্র অনুসন্ধান। এ জন্য প্রয়োজন কূটনৈতিক উদ্যোগ ও দক্ষ ব্যক্তি নিয়োগ। দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনও জরুরি।

২. রফতানি খাত বিশেষত গার্মেন্টস, নিটঅয়্যার ও হিমায়িত খাদ্যশিল্পে বোনাস, ভর্তুকি দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ। ৩. শিল্প খাতে ব্যাংক ঋণের সুযোগ বৃদ্ধি ও খেলাপি ঋণ সম্পর্কে নমনীয় ভাব প্রদর্শন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.