আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিরব দর্শক

জীবন যেখানে থমকে দাঁড়ায় কবিতারা সেখানে উপছে পড়ে বাঁধ ভাঙা জোয়ারে....

বিকেলের আলো ছড়িয়ে পড়েছে । তখনো কেউ মাঠে এসে পৌছায়নি। পশ্চিমের নারিকেল গাছের ছায়া ঢলতে ঢলতে মাঝ মাঠে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। সমসত্ম মাঠ ছায়া হতে তখনো ঘন্টা খানেক বাকি। যদিও খেলোয়াররা এলেই সবাই মাঠে নেমে পড়বে।

এখন হাতে একটুও সময় নেই, দুদিন বাদে স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। প্রতিপক্ষকে হারিয়ে শিরোপা ঘরে তুলতে ব্যসত্ম হয়ে পড়েছেন- আমাদের কোচ, টিম ম্যানেজারসহ সকল খেলোয়াড়। গতকাল একটু দেরিতে আসায় আমার শাসিত্ম বিধান হিসাবে এক ঘন্টা মাঠের চারপাশ দিয়ে ষোলশ মিটার স্কেলে দৌড়াতে হয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে আগে আসা।

বিকেলের রোদের উত্তাপ তেমন ছিলনা। যদিও চৈত্রের রোদ একটু বেশিই অসহনীয়। বেশ কিছুক্ষণ বসে বসে কাটালাম। প্রায় আধা ঘন্টা সবুজ ঘাসের কার্পেটে শুয়ে বসে কাটানোর পর আমাদের কোচ এল। তিনি বেশ খুশিই হলেই।

একটু হেসে বললেন, শাসিত্ম দিলে কি সব পরিবর্তণ হয়ে যায়? আমি একটু ইতোসত্মতো করে বললাম, প্রতিদিন যদি দেরি করে আসি তাহলে নির্ঘাৎ ক্রিকেট ছেড়ে আমাকে এ্যাতলেটে যোগ দিতে হবে। আমাদের একজন নিরব দর্শক ছিল। মাঠের পাশের বিল্ডিংএর ছাদে তাকে প্রায়ই দেখতাম। অবস্য সেটা আমাদের খেলা দেখার জন্য না বিকেলটা উপভোগ করার জন্য তা আমাদের কাছে খুব একটা পরিষ্কার না। মাঝে মাঝে মনের অজানেত্ম চোখ চলে যেত ছাদের দিকে।

চোখা চোখি যে হয়নি তা কিন্তু নয়। টানা টানা চোখ নিয়ে যখন সে মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকতো তখন তার মুখে লেগে থাকতো এক ধরণের প্রশানিত্ম। মৃদু হাসিতে চপল তরুণীর মিষ্টি ঠোঁটে যেন দোল খেত হিম হিম মু্‌ক্ত বাতাস। তাকে ভাললাগার যতেষ্ঠ কারণ থাকলেও, ভালবাসার মত সাহস ছিলনা। কেননা আমাদের টিমের বেশ কয়েকজনের নজর ছিল তার দিকে।

মফস্বলের মানুষ শহরে এসে জুটেছি এই ঢের । তারপর যদি আবার ওদের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে যায় তাহলে মাঠ ছাড়তে হবে। তাই ভাললাগলেও ভালবাসার স্বপ্ন দেখা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। মাঝে মাঝে মনের সাথে পেরে উঠতে না পারলে হুট করে চোখ চলে যায় ছাদের দিকে। চোখ পড়লেই দেখি সে হাসছে।

তখন মনে মনে ভীষণ লজ্জা পেতে হয় এই ভেবে যে, আমার খেলা হয়তো তার হাসির খোরাক জোগাচ্ছে। ছাদে চোখ যাওয়া নিয়ে টিমের মধ্যে মাঝে মাঝে কথা কাটাকাটিও হয়। কেউ যদি কোনদিন বিশেষ করে ব্যাটিংএ খারাপ পারফর্মেন্স করে তখন ধরে নেওয়া হয় ও বেটার চোখ ছিল ছাদের দিকে। আমি অবশ্য সব দিকেই প্রায় পেছনে, বোলার এমনকি ব্যাটসম্যান হিসাবেও। অলরাউন্ডার।

তাই বোলারদের ব্যাটিং যা হয়, কোনদিন অপরাজিত, কোনদিন ধুমধাম করে ৪-৬ মেরে মাঠ কাপানো। মাঝে মাঝে দর্শক বা সতীর্থদের কাছ থেকে ব্যাপক হাত তালিও জুটতো। অনুশীলন মাঠে নিজের অবস্থান মোটামুটি নিশ্চিত করলাম। ব্যাটিংএ নামলেই ছাদে চোখ যাবে, স্টাইকিং পিচ থেকে কোন ভণিতা ছাড়াই সহজে ছাদ দেখা যায় । ইদানিং ব্যাটিংএ নামলেই কেন যেন চার ছয় না হয় জোড় রান ছাড়া দৌড়াতে মন চায় না।

সেদিন তো দুই রান নিতে গিয়ে রীতিমত হোঁচট খেলাম। কোচ বকা দিয়ে বসিয়ে দিলেন। মনে হলো তাদের মহামূল্যবান সম্পদ আমি ক্ষতি সাধন করতে যাচ্ছিলাম। যেমনটা হয় হাটি হাটি পা পা করে এগিয়ে যাওয়া শিশুর হাতে হালকা কাচের কোন পাত্র থাকলে। মাঝে মাঝে ভীষণ একরোখা হয়ে যেতাম।

রান তোলার চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে যেত বলটাকে ছাদের দিকে পাঠাতে। যদিও বাহুতে জোর হয়নি, তবুও বেশ কাছাকাছি যেত। ছাদের দর্শকের নিঃশব্দ হাততালি পেলে মনে হতো যেন সদ্য কোন রাজকুমারকে পরাজিত করে প্রথম রাউন্ড টপকে এলাম। আমার সতীর্থরা ভীষণ হিংসুটে দৃষ্টিতে তাকাতো, তখন নিজেকে খুব অহংকারী মনে হতো। স্বাধীনতা কাপ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট’র সকল আয়োজন সমাপ্ত হলো।

প্রতিদিনের চেয়ে একটু আগে খেলা শুরু হলো। যদিও চৈত্রের রোদ অনেকটা উপহাস করছিল আমাদের। টসে জিতে প্রতিপক্ষকে ব্যাটিংএ আমন্ত্রণ জানানো হলো। একটু বিপাকেই পড়লো তারা। আমাদের বিনা টিকিটের দর্শক তার আসন গ্রহণ করেনি।

ফাঁকা ছাদটা তাই আমার কাছে মরুভূমির মত খাঁ খাঁ করছিল। ২০ ওভারে ১১৫ রানের টার্গেট পেলাম। খেলার শুরুতেই কোন রান না করে ফিরে গেল টিমের নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান, দ্বিতীয় অভার যেতে না যেতেই আরেক সর্তীথ ভুল পথে পা বাড়িয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে গেলেন। তখন দলের সংগ্রহ ৭। টিম ম্যানজারসহ দলের সকলে ভীষণ উদ্বিগ্নতার মধ্যে সময় কাটাতে লাগলেন।

পরবর্তী জুটি রানের চাকা ঘুরিয়ে নিজেদের অবস্থান দৃড় করে দলকে অধশত রানের লক্ষ্য পৌছ দিলেন। দশ ওভার শেষ। দলের সংগ্রহ ৫৫। আর একবার বিপর্যয়ের সম্মুখিন হতে হলো আমাদের। পরবর্তী ৩ অভারে ৩ জনকে প্যাভিলিয়নে ফিরতে হলো।

দলের খাতায় জমা হলো ১০ রান। আমি পিচে দাঁড়িয়ে একবার মঞ্চের দিকে তাকালাম। স্বাধীনতা কাপ ক্রিকেট টুর্নামেন্টের গোল্ডকাপ জ্বল জ্বল করে উঠলো। আমি যেন সব হারানোর বেদনায় একবার কেঁপে উঠলাম। পরাজয় মেনে নিয়ে ব্যাটিংএ নামলাম।

কয়েকটা বল খেলার কোন কৌশল পেলাম না। চৌদ্দ ওভার খেলার পর পানি পানের বিরতি পেলাম। ৫ উইকেট হারিয়ে ৬ ওভারে ৫০ রানের লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামলাম। এবার শূন্য গ্যালারীর পূর্ণতা পেলাম। আমি তাকাতেই যেন বিজয় সূচক ভি চিহ্ন তুলে ধরলো।

অন্য কারো চোখে পড়লো কিনা বলতে পারবো না, তবে দর্শক সারিতে যে কেউই তার দলকে উৎসাহিত করতে পারে তাতে কোন ভাবাভাবির সুযোগ নেই। আমি যেন হারতে রাজি আছি। আমার কোন দুঃখ নেই। মনে হলো হারের মধ্যেও হয়তো আনন্দ আছে। কেউ একজন যে আমার খেলা দেখছে সেটাই আমার কাছে বড়।

তাকে খেলা দেখাতে আমিও মারিয়া হয়ে উঠলাম। তখনই আবার বিপর্যয়, দুই রান নিতে গিয়ে রান আউট হয়ে আরেক সতীর্থ ফিরে গেলেন। ১৮ বলে রান যোগ হলো ২২। ৬ উইকেট হারিয়ে শেষ ৩ ওভারে ২৮ রানের লক্ষ্য নিয়ে মাঠে চললো ভাগ্য নির্ধারণের খেলা। চরম বিপর্যয় নেমে এল।

পর পর দু বলে দুটি উইকেট হারিয়ে আরেকবার হতাশায় ডুব দিলাম। তবুও চোরা চোখ দেখে নিতে চাইলো আমাদের নিরব দর্শক কিভাবে দেখছে আমাদের পরাজয়কে। না, একটু হতাশ বটে তবুও জয়ের আশা ছাড়েননি। মাঠের অন্যান্য সমর্থকদের প্রত্যাশা কি ছিল জানিনা। তবে তার প্রত্যাশা আমার কাছে উপহাসের মত মনে হতে লাগলো।

১ ওভারে রান প্রয়োজন ১২ হাতে আছে ২ উইকেট। সুন্দর করে বল তুলে দিলাম, আমি জানি নিশ্চিত আউট। ভাগ্যদেবী প্রসন্ন হলেন। বল তালুবন্দী করতে ব্যর্থ হলো মিড অনের খেলোয়াড়, বল হাত থেকে পড়তে দেখেই দ্রুতার সাথে মাঠ ছাড়তে গিয়েও রান নিলাম। পরের বলে ঘটলো বিপত্তি, বোল্ড হয়ে ফিরে গেল স্টাইকিং এর খেলোয়াড়।

শেষ ভরসা, বুক কাঁপছে। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে রীতিমত হিমশিম খাওয়ার পালা। ১টা বল খেয়ে বসলো, নো বলের খাতিরে অবস্য সেটা পুরণ করা সম্ভব হলো। টান টান উত্তেজনা, মাঠে দাঁড়িয়ে গা ঘেমে যাচ্ছে। দুই বলে ৫ রান নিতে হবে।

এক রানের বিনিময়ে স্ট্রাইকিং পেলাম। নিশ্চিত পরাজয় মেনে নিয়ে শেষ বলটি খেলতে চেষ্টা করলাম। বাউন্ডারী করতে না পারলে পরাজয়ের গ্লানী নিয়ে মাঠ ছাড়তে হবে। আমার কাঙ্খিত দর্শকও উত্তেজনায় দাড়িয়ে পড়েছে। হয়তো পরাজয় মেনে নিতে পারবে না বলে চলে যাওয়ার পাঁয়তারা করছে।

শেষ বলে প্রাণপণ চেষ্টায় যা ঘটলো তা আমি কখনোই প্রত্যাশা করিনি। এতদিন হাজার চেষ্টা করে যে কাজটা করতে পারিনি, বলটা হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে সেদিকেই এগিয়ে গেল। সমর্থকদের উল্লাসে ঢাকা পড়ে গেল আমার কাঙ্খিত দর্শক। যখন ভীড় কমতে শুরু করলো তখন ৭-৮ বছরের একটা ছেলে এসে আমার হাতে একটা প্যাকেট তুলে দিতে দিতে ছাদের দিকে দেখালো। আমি ছাদের দিকে তাকাতেই সে একটু মিষ্টি করে হাসলো।

সে যেন ঝড়ের গতিতে অনেক কিছু বলে গেল। আমি তার কোন কিছুই ঠিকমত বুঝে উঠতে পারলাম না। বাড়ি ফিরে প্যাকেটা খুলে ভীষণ অবাক হলাম। মেডেল পাঠিয়েছে। সাথে একটা চিরকুট- ‘তোমার খেলা আমার ভীষণ ভাললাগে, তুমি মাঠে এলে তোমার খেলা দেখতে আমার ছাদে আসা চাই।

আজ ফাইনালে হেরে গেলে তোমার জন্য এটা সান্তনা জয়ী হলে এটা আমার পক্ষ থেকে পুরস্কার। সত্যিই বলছি তোমার খেলা আমার ভীষণ ভাললাগতো। ইতি, তোমাদের অনুশীলনের নিরব দর্শক- নন্দিনী। ’ একবার শুধু মনে হলো- আমার খেলা ভাললাগতো, কিন্তু আমাকে? না সে প্রশ্নের আর জবাব নেওয়া হয়নি। নির্মলেন্দু পোদ্দার ইমেইলঃ


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।