আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সংখ্যামিত্র ‘পাই’, অর্পিত ‘পাইদিবস’, অত:পর আমার ‘পাই মানব’ হয়ে উঠা-২

আত্মবিশ্বাসহীনতায় প্রকট হচ্ছে আত্মার দেউলিয়াত্ব, তবুও বিশ্বাস আগের মতই নিশ্চল..

আগের পর্ব এই পর্বে শুধু 'পাই মানব' এর কাহিনী লেখা হবে। । পরিচিত মহলে কেউ কেউ আমাকে ‘পাই মানব’ সম্বোধন করে, কারণ আমি পাইয়ের মান দশমিকের পর ২৩৩৮ ডিজিট পর্যন্ত লিখতে পারি। সম্ভবত এটা বাংলাদেশী রেকর্ড হবে , তবে এই ধরনের রেকর্ড আমার ঠিক ভাল লাগেনা, বরং পাইয়ের সিরিজ সংক্রান্ত আলোচনাতেই আার ঝোঁক বেশি। যাইহোক, আমার ব্লগজীবনের শুরুর দিকে পাইকাব্য নামে বেশ দীর্ঘ একটি সিরিজ লিখেছিলাম; তখন ব্লগার পারভেজ ভাই আমার এই ‘পাই মানব’ হয়ে উঠার কাহিনী জানতে চান, এমনকি বইমেলার বসন্ত আড্ডাতেও তিনি এই সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন।

সেদিন তাকে বলেছিলাম এটা নিয়ে একটা আলাদা পোস্ট দেব। তাই পোস্টের বাকি অংশটুকু ‘পারভেজ ভাইকে’ উৎসর্গ করছি। এবার কাহিনী শুরু করা যেতে পারে। ‘হেরমান হেস’ এর ‘সিদ্ধার্থ’ বইয়ের দৃষ্টান্ত দিয়েই শুরু করি। বইয়ের একটি অংশ আছে এমন : সণ্ন্যাসী সিদ্ধার্থ সণ্ন্যাস ত্যাগ করে সংসারের বাধনের মধ্যে থেকেই চিরমুক্তির স্বাদ গ্রণ করতে নগরের সেরা সুন্দরীর কাছে প্রেমের দীক্ষা নিতে আসে, কিন্তু সুন্দরী তার জন্য পূর্বশর্ত দেয় অর্থোপার্জনের।

কিন্তু সে তো এমন কিছু পারে না যা দিয়ে অর্থ সমাগম ঘটতে পারে। সে বলল “ আমি ধ্যান করতে পারি, উপবাস করতে পারি, আর পারি অপেক্ষা করতে’”। ---- আমি এই তিনটির কোনটিই পারিনা, শুধু একটি জিনিস পারি – ‘visualize’ করতে, অর্থাৎ একটি ঘটনার সমান্তরাল অন্য একটি ঘটনাকে দেখতে পারি, বা না ঘটা ঘটনাকেও এমনভাবে অনুভব করতে পারি আশেপাশে যেন সত্যিই এটা ঘটেছে। সেইসঙ্গে আলবেয়ার ক্যামুর ‘আউটসাইডার’ পড়ার পর নিজের ‘পযর্বেক্ষক সত্তা’ সম্পর্কে কিছুটা আত্মবিশ্বাস জন্মেছে। ‘পাইমানব’ হয়ে উঠার নেপথ্যেও এই দুটি বিষয়ই ভূমিকা রেখেছে।

আমার সংখ্যাপ্রীতিটা আশৈশবের, আমার নিকের সঙ্গেও ৭৭৭ সংখ্যাটির সংযুক্তি সেই প্রীতিকে আরোও ভালভাবে ফুটিয়ে তুলে। তো, যে কোন কারণেই হোক, সংখ্যা সংক্রান্ত কিছু ন্যাচারাল দক্ষতা আমার ছোটবেলা থেকেই গড়ে উঠেছে। যেমন খুব ছোটবেলা থেকেই আমি ২ ডিজিটের যে কোন সংখ্যার সঙ্গে ৭-৮ ডিজিট পর্যন্ত যে কোন সংখ্যাকে গুণ করতে পারতাম নিমিষের মধ্যে, কখনো কখনো সেই রেঞ্জটা বেড়েও যায়, যে জন্য দীর্ঘদিন আমি ক্যালকুলেটর ব্যবহার করিনি। এরপর হাইস্কুলে পড়ার সময় খেয়াল করলাম একটি নির্দিষ্ট রেঞ্জর মধ্যে যে কোন সংখ্যা দেখেই আমি তার ‘বিজোড় রুট’ বলে দিতে পারি যদি রুটটি পূর্ণসংখ্যা হয়। সেটা কিউব রুট, ফিফথ রুট, সেভেনথ রুট যা-ই হোক না কেন, শুধু রুটটি পূর্ণসংখ্যা হলেই হয়।

যেমন ৪০৬৫৩ এই সংখ্যাটি দেখেই বলা সম্ভব এর কিউব রুট ৩৭, যদিও ৪০৫৫৩ বা অন্যকিছু দেখে বললে সেটা ভুল হবে। সংখ্যার আরোও কিছু ব্যাপার কাজ করে আমার মধ্যে। যেমন, একদিন ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ একটা সিরিজ লিখে ফেললাম যাতে xএর মান বসালেই ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত মৌলিক সংখ্যাগুলোকে একত্রে পাওয়া যায়। এজন্য যে, আমি কোন ম্যাথমেটিকাল লজিক ব্যবহার করি এমন নয়, বা আমার গণিতের ভিত্তিও খুব আহামরি রকম কিছু নয়। পুরোটাই ভিজুলাইজেশন।

আমাকে গুণ করতে বলা হলে, আমি সংখ্যাগুলো ভিজুয়ালাইজ করার চেষ্টা করি, তার উত্তরের সংখ্যাটা বিচ্ছিন্নভাবে দেখতে পাই.....যেমন ৭৯ * ৪২৭=৩৩৭৩৩ এটা মুখে বলার সময় আমি বলি ৩,৩,৭,৩,৩ এরকম একটা একটা করে। রুটের প্যাটার্ন অবশ্য ভিন্নরকম। প্রতিটি মানুষকেই আমার চরিত্রের বদলে একেকটি ‘ইমেজ’ মনে হয়, তাই কাউকে স্মরণ করতে গেলে নামের আগে তার বৈশিষ্ট্য মনে পড়ে যায়। আমার মোবাইলে সবার নাম্বরাগুলোও সেই অনুসারে সেভ করা। যেমন আমার বড়বোনকে আমি অসম্ভব শ্রদ্ধা করি,তাই মোবাইলে তার নাম ’99 tan89’ কোড দিয়ে সেভ করা, বন্ধুদের ক্ষেত্রেও সবার আলাদা কোড, কারণ আমি নাম ভুলে যাই....একইভাবে ওদের ফোন নাম্বারগুলোকেও কোন না কোন ছন্দে ফেলে দেই।

ভিজুয়ালাইজেশন আর অবজারভেশনের প্রয়োগ ঘটেছে বুয়েটের প্রোগ্রামগুলোর সময়েও, এখনো ফার্স্ট ইয়ারে লেখা স্ক্রিপ্টগুলো হুবুহু মনে আছে, কারণ নিজে কিছু লিখলে সেটা আর কখনই ভুলিনি, কিন্তু কোন পড়া বই থেকে উদ্ধৃতি দিতে গেলে তখন আর মনে রাখতে পারিনা...এই স্ক্রিপ্টটির ক্ষেত্রে যে বিষয়টি কাজ করে সেটি হচ্ছে, আমার স্মৃতিতে সময়টি স্থির হয়ে থাকে, তাই কখনই স্ক্রিপ্টটি লেখার সময়টা বদল হয়না, তাই ২বছর পরেও সেই স্ক্রিপ্টের কথা বলামাত্র মনে হবে এখনো লিখছি----এমন একটা ব্যাপার। । আমার এই ভিজুয়ালাইজেশনের ব্যাপারটা কাজ করে পড়ার ক্ষেত্রেও, তাই একটি লেখা পড়ার সময় সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন কোন ঘটনাকে মিলিয়ে ফেলি লেখার সঙ্গে, এই ব্যাপারটি সবচেয়ে বেশি ঘটে ব্লগে “ছন্নছাড়ার পেন্সিল’ ভাইয়ের লেখা পড়ার সময়। প্রশ্ন হচ্ছে হঠাৎ পাইয়ে আগ্রহী হলাম কেন?আর এত ডিজিট শেখার কারণ কি?আর পাই প্রসঙ্গে এত কথা বলা কেন? পইয়ের মান শেখাটা ছিল আসলে একটা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার ফল। সঙ্গে সংখ্যার প্রতি ভাল লাগাটা তো ছিলই, যদিও এত ডিজিট পর্যন্ত শেখাটাকে আমার সময়ের অপচয় বলেই মনে হয়।

কিন্তু কিভাবে শিখলাম? প্রথম আলোতে পাই দিবসের সংখ্যায় কয়েকটা পাই কাব্য দেখেছিলাম ইংরেজিতে। সেটা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে আমি নিজেই একটা লিখে ফেলি প্রথম ২০০ ডিজিটের জন্য। পাই কাব্য-১ কিন্তু হঠাৎ মনে হল বাংলায় কাব্য লিখিনা কেন? তাতে বাংলায়ও কয়েকটা কাব্য লেখা হয়ে গেল! এভাবেই ১৩৪৭ পর্যন্ত শিখে ফেলাম। পাইকাব্য-২ পাইকাব্য-৩ পাইকাব্য-৪ পাইকাব্য-৫ পাইকাব্য-৬ এরপর অনেকদিন বিরতি। মাঝে বেশ কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটল, একসময় মনে হল পরিচিত মানুষগুলো সব অচেনা লাগছে, হারিয়ে যাচ্ছে আমার থেকে, তাদেরকে ধরে রাখা দরকার।

এই ভাবনা থেকেই ক্লাসের সবাইকে নিয়ে পাইকাব্য লিখলাম তাদের চরিত্র বিশ্লেষণ করে। ইংরেজি পাইকাব্য-৭ এরপর আবার বিরতি। আমি জীবনে একজন মানুষের কাছে ভয়ানক ভাবে ঋণী- সে হচ্ছে আমার বড় বোন, এমনকি আমার এই হিমালয় নামটিও তার দেয়া। যখনই বয়সে বড় কেউ আমাকে ‘হিমালয়’ বা ‘হিমু’ নামে ডাকে, কিভাবে যেন তার মাঝে বড় আপাকে দেখত পাই। আমার পুরো কলেজ জীবন কেটেছে তার বাসায়, এখন হলে তাকে খুব মিস করি।

এরকম কোন এক মন খারাপ করা সমযে ইচ্ছা হল বড় আপাকে নিয়ে এমন কিছ একটা করি যাতে কখনো তাকে মিস না করি, সেই ভাবনা থেকেই সর্বশেষ পাই কাব্যটি লেখা.ইংরেজি পাইকাব্য-৮ .আপাতত এভাবেই ২৩৩৮ ডিজিট পর্যন্ত শেখা হল। যদিও এই শেখাটা আমার অপছন্দের ভীষণরকম, তবুও অনেক সময় অনেক অপছন্দের কাজই আমরা করি নিজেদের অজান্তেই। এটাও তেমনি। এভাবেই আমার সংখ্যা মানব থেকে পাই মানবে রূপান্তর ঘটে। আপাতত আর কিছু বলার নেই।

সবাইকে পাই শুভেচ্ছা। [এই পোস্টটি দেয়ার পরিকল্পনা ছিল ১৪ই মার্চ, কিন্তু কাল বাসায় যাচ্ছি ২দিনের জন্য। ফিরতে ফিরতে ১৪ তারিখ চলে যাবে। তাই আগেই দিলাম। সবাইকে পাইদিবসের অগ্রিম শুভেচ্ছা জানাই]


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।