আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একুশের গল্প

তাহমিদুর রহমান

১. ইথার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। প্রতিদিনের মত আজকেও স্কুলে এসেছে সে। আজ বৃহস্পতিবার হওয়ায় সে খুব খুশি। কালকে শুক্রবার। ছুটির দিন।

বাবা বলেছে, তাকে কালকে বই মেলায় নিয়ে যাবে। সে অনেকগুলো বইয়ের লিস্ট করেছে। জাফর ইকবালের গল্পের বই তার লিস্টের সর্বপ্রথমে আছে। সেই বইটায় আগে কিনবে বলে মনস্থির করেছে। যখন ইথার ক্লাসে ম্যাডামের কথা না শুনে এইসব কথা ভাবছে তখন নোটিশটা এল।

একুশে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষে শনিবার স্কুল ছুটি থাকবে মানে শুক্রবার এবং শনিবার দুইদিন স্কুল বন্ধ। ম্যাডাম ক্লাসে না থাকলে নিশ্চিতভাবে ইথার চিৎকার করে উঠত। অনেক কষ্টে নিজেকে দমিয়ে রাখে। বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে দেখে তাদেরও একই অবস্থা। ইথারের পাশে বসেছে কনা।

কনা ইথারকে জিজ্ঞেস করে, -একুশে ফেব্রুয়ারী কি জানিস? -হুম। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। -ধুর। ওইটা তো আমিও জানি। কিন্তু সেদিন কি হয়েছিল জানিস? -নাতো।

-ধুর। তুইও জানিস না! ইথার জানে না বলে আফসোস লাগে তার। একবার ভাবে ম্যাডামকে জিজ্ঞেস করবে। তারপর ভাবে, না থাক। ম্যাডাম যা রাগি।

যদি বকাঝকা করেন তার চেয়ে না জিজ্ঞেস করায় ভাল। বারটার দিকে ইথারের স্কুল ছুটি হয়। প্রতিদিন ইথারের মা জাহানারা রহমান গাড়িতে করে ওকে নিতে আসেন। আজকেও এসেছেন। ইথার গাড়িতে উঠেই বায়না ধরে, -আম্মু আইসক্রিম খাব।

-না। -তাহলে চকলেট। -না। -ধুর। তুমি কিছুই কিনে দাওনা।

বাবা প্রতিদিন কতকিছু কিনে দেয়। -হুম। ওই খেয়েই তো দাঁতে পোকা লাগিয়েছিস। প্রত্যেকটা দাঁত ডাক্তারের কাছে তুলে আনতে হয়। খবরদার চকলেটের নাম করবি না আমার সামনে।

-আচ্ছা চকলেট খাব না। আইসক্রিম দাও। -ওটাও হবে না। ডাক্তার আইসক্রিম খেতে বারন করেছে। তোর বাপ যেমন পচা।

একটু ঠান্ডাতেই সর্দি লাগে। তোরও একই অবস্থা। যেমন বাপ তেমন তার বেটা। -আমি আব্বুকে বলে দিব। -দিস।

তোর বাপকে আমি ভয় পাই নাকি? -পাওনা আবার। ইথার ফোকলা দাঁতে হাসতে থাকে। ইথারের আম্মু চোখ পাকিয়ে ইথারের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলেন। কিছুক্ষন পর ইথারের কনার কথা মনে পড়ে। আম্মুকে জিজ্ঞেস করবে ভাবে।

-আচ্ছা আম্মু একুশে ফেব্রুয়ারীতে কি হয়েছিল? -কেন রে? -এমনি। বলই না... জাহানারা রহমান ছেলের মাথায় হাত রাখেন। বলেন, -আমাদের ভাষা বাংলা। কিন্তু ১৯৫২ সালে পাকিস্তানিরা জোর করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষনা করে। আমাদের দেশের মানুষ তা মেনে নেইনি।

একুশে ফেব্রুয়ারিতে এর প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে সালাম, রফিক, জব্বার সহ আরো অনেকে শহীদ হোন। তারপর থেকে এইদিনটি আমরা ভাষা দিবস হিসেবে পালন করে আসছি। ইথার চুপ থাকে কিছুক্ষন। তারপরে বলে, -পাকিস্তানিরা খুব পচা ছিল। তাইনা আম্মু? -হুম।

-আচ্ছা আম্মু, আব্বু কি ওখানে গিয়েছিল? জাহানারা রহমানের কিছুক্ষন লাগে ব্যাপারটি বুঝতে। বুঝার পর হাসতে থাকেন। বলেন, -ধুর বোকা ছেলে। তখন কি আর আমাদের জন্ম হয়েছে নাকি? আমি আর তোর আব্বু মুক্তিযুদ্ধই তো দেখিনি। আর ১৯৫২ সাল তো দূরের কথা।

ইথার অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে, -তাহলে কিভাবে জান তুমি? -তুই যেভাবে জানলি। -তারমানে নানাভাই বলেছে তোমাকে? -হুম। তবে বই পড়েও জেনেছি। -আমিও পড়ব।

-হ্যাঁ পড়িস। -কিন্তু ওগুলো তো বাংলায় লেখা। আমি তো বাংলা ঠিকমত পড়তে পারি না। এ কথায় জাহানারা রহমান একটু অবাক হোন। ভাবেন, ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানো কি ঠিক হচ্ছে? নিজের ভাষাতেই পড়তে পারে না।

জোর করে চিন্তাটা মাথা থেকে বের করে দেন। ২. ইথারদের বাসার কাছেই চারকোনা ছোট্ট একটা ফাঁকা জায়গা আছে। সেখানেই ওরা খেলাধুলা করে। বিকেলের শেষে ইথার এবং ওর বন্ধুরা বাসায় ফিরছিল। ওরা সবাই আশেপাশের ফ্ল্যাটেই থাকে।

ইথার বলল কনাকে, -একুশে ফেব্রুয়ারী কি জেনেছিস? সবাই ইথারের কথায় আগ্রহ প্রকাশ করে। সবাই কনার দিকে তাকায়। কনা বলে, -নাহ। ইথার বলে, -আমি জেনেছি। আম্মু বলেছে।

-কি বলেছে? -বলেছে ওইদিনে আমাদের দেশের মানুষ ভাষার জন্যে শহীদ হয়েছেন। নিপু যে কিনা ওদের মধ্যে বয়সে একটু বড় সে বলল, -কিরে তোরা এটা আজকে জানলি? হাহ্। এটাতো আমরা অনেকদিন আগেই জেনেছি। তাইনারে রিহাত? রিহাত মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। বলে, -আমি তো প্রতিবারই নিজেই শহীদ মিনার বানায়।

ফুল দেই। বাবা ফুল দিতে নিয়ে যায় না ছোট বলে। রিহাত মুখটাকে একটু সংকুচিত করে। ইথার আর কনা প্রথমে অবাক হলেও সামলে নেয় ব্যাপারটা। ইথার বলে, -আব্বুকে বললেই নিয়ে যাবে।

তাইনারে কনা? -হুম। আমরা আসল শহীদ মিনারেই ফুল দিব। নিপু বলে, যা দেখবনি। সবই জানা আছে। কাদের দৌড় কতদূর পর্যন্ত।

ইথার এবং কনা কিছু বলে না। তাদেরও একটু সন্দেহ আছে যে তাদের আব্বুরা তাদেরকে শহীদ মিনারে ফুল দিতে সংগে না নিতেও পারেন। এগুলো ভাবতে ভাবতে ইথার আর কনা নিজেদের ফ্ল্যাটের দিকে এগুতে থাকে। রাতের খাবার খেতে বসে ইথার তার আব্বুর কাছে শহীদ মিনারে যাওয়ার কথা বলে। -আব্বু আমি শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাব।

-না বাবা। -কেন? -ওখানে অনেক ভীড় হবে। তোর না যাওয়ায় ভাল। -না আমি যাব। -না বাবা।

জেদ করিস না। তোকে বলেছি না বই মেলায় নিয়ে যাব। ইথার বইমেলার নাম শুনে চুপ করে থাকে কিছুক্ষন। তারপর বলে, -তাহলে আমিও রিহাতদের মত নিজেই শহীদ মিনার বানাব। বাবা হাসেন।

বলেন, -আচ্ছা বানাস। ইথার চলে যেতেই জাহানারা রহমান বলেন, -ছেলেটা দেখতে দেখতেই বড় হয়ে যাচ্ছে। তাইনা? -হুম। -আমি ভাবছিলাম ওকে ইংলিশ মিডিয়ামে দেওয়া ঠিক হল কিনা? -কেন? -ওতো বাংলা ঠিকমত পড়তেই পারে না। বইমেলা থেকে বই কিনে এনে আমাকেই জ্বালাবে।

তারপর বসে বসে ওকে বই পড়ে শুনাতে হবে। তাই বলছিলাম, ওকে কি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানো ঠিক হল? -ভাল কথা বলেছ তো। আমি এভাবে তো ভেবে দেখি নাই। -ভেবে দেখ একবার। আমি যাই থালা বাসন ধুয়ে তবেই ঘুমাতে যাব।

-তাড়াতাড়ি এস কিন্তু। জাহানারা মুচকি হেসে রান্নাঘরের দিকে রওনা দেন। ৩. সকাল বেলা থেকেই মহাউৎসাহে ইথার আর কনা শহীদ মিনার বানাতে বসে। ইথারদের একটা বড় লাইব্রেরী আছে। ওখানে হরেক রকমের বই আছে।

খুঁজে খুঁজে সে শহীদ মিনারের ছবি আঁকা আছে এরকম একটা বই বের করেছে। সেটাই দেখে দেখে তৈরি করার চেষ্টা করছে। রঙ্গিন কাগজ কেটে বানানো হচ্ছে ওদের শহীদ মিনার। কনা বলে, -দেখবি নিপু আর রিহাত আমাদের শহীদ মিনার দেখে জ্বলে পুড়ে মরবে। ওদের একটা উচিত শিক্ষা হবে।

আমি যখন ওদের বললাম যে আমরাও শহীদ মিনার বানাচ্ছি তখন এমনভাবে তাকালো মনে হল শহীদ মিনার খালি ওরাই বানাতে পারে। ইথার এক হাতে আরেক হাত দিয়ে কিল মেরে বলে, -হুম। উচিত শিক্ষা দিতেই হবে। তারপর দুজনে শহীদ মিনার বানাতে বসে। ওরা দুজনেই কাগজ দিয়ে অনেক কিছু বানাতে পারে।

নৌকা, হাতী, প্লেন, আরো কত কি! ওদের শহীদ মিনার বানানো যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে তখন ওদেরকে দেখতে নিপু আর রিহাত এল। রিহাত বলল, -কিরে তোদের শহীদ মিনার বানানো এখনো বানানো শেষ হল না! আমরা সেই কবে শেষ করে ফেলেছি। ইথার উত্তর দেয়, -আমরা তো আর যেই সেই শহীদ মিনার বানাচ্ছি না। একেবারে রিয়েল। নিপু বলল, -তোদেরটা ভালই হয়েছে তবে আমাদেরটার মত হয়নি।

আমাদেরটা আরো সুন্দর। কনা বলে, -হুম। দেখা যাবেনি কাদেরটা ভাল। বানানো শেষ করে নেই তারপর তোদেরটা দেখতে যাব। -আচ্ছা।

৪. আজ একুশে ফেব্রুয়ারী। ইথারের বাবা রফিকুল রহমান সেই সকালে গিয়েছিলেন শহীদ মিনারে ফুল দিতে। সারিবদ্ধভাবে হাজারো মানুষ শহীদ মিনারে গিয়েছে ভাষা শহীদদের আরো একবার শ্রদ্ধা জানাতে। ওদের জন্যেই তো আমরা আজও নিজেদের ভাষাতেই কথা বলি। বাসায় ফিরে রফিকুল রহমান দেখলেন, ইথার কান্না-কাটি করছে।

তিনি জাহানারাকে জিজ্ঞেস করলেন, -কি হয়েছে বলতো? আমার সোনামুনি কাদে কেন? -তোমার ছেলে শহীদ মিনারে ফুল দিতে পারেনি তাই কাদছে। -এই ব্যাপার। রফিকুল রহমান ইথারকে কাছে টেনে নেন। বলেন, -আমাদের বাসার নিচে কিছু ফুল গাছ আছে ওখান থেকে কিছু ফুল আনতে পারিসনি। ইথার কাদতে কাদতে বলে, -আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি কে যেন সব ফুল ছিড়ে নিয়ে গেছে।

-ও। আচ্ছা আমি ফুল কিনে নিয়ে আসি। তারপর তুই শহীদ মিনারে ফুল দিস। ঠিক আছে? -আচ্ছা। কিন্তু এখনি নিয়ে আস।

-হ্যাঁ। এখনি নিয়ে আসব। তার আগে কান্না থামা। ছেলে মানুষ কাদে নাকি? ইথার চোখ মুছতে মুছতে বলে, -আব্বু আমি আর স্কুলে যাব না। রফিকুল রহমান বেশ অবাক হোন।

কারন ইথার পড়াশোনায় খুব ভাল। জিজ্ঞেস করলেন, -কেন বাবা? -ওই স্কুলে বাংলা পড়ায় নাতো। আমি বাংলায় পড়তে পারি না। যে ভাষার জন্যে এদিনটি সেই ভাষায় তো আমি পড়তে পারি না। আম্মু বলেছে, আমাকে আর বই পড়িয়ে শোনাবে না।

রফিকুল রহমান বুঝতে পারলেন ছেলের দুঃখ। তারও যেন একটু খারাপই লাগল। জাহানারার দিকে তাকিয়ে বললেন, -হ্যাঁ। তোর স্কুল এবার পাল্টিয়ে দিব। যেখানে নিজের ভাষা শিখতে পারা যায় না সেখানে তোকে আর পড়তে হবে না।

ইথার খুশি হয়। বাবাকে তাড়া দেয় ফুল কিনে আনার জন্যে। জাহানারা বললেন, -বাইরে যাওয়ার আগে তোমার ছেলেকে বলে যাও নাস্তা করতে। বলতে বলতে পাগল হয়ে গেলাম আমি। ইথার জলদি উত্তর দেয়, -তুমি যাও বাবা।

আমি এখনি নাস্তা করছি। রফিকুল রহমান জাহানারা দিকে তাকিয়ে হাসেন। জাহানারাও ছেলের কথায় হাসেন। ইথারকে বলেন, ডাইনিং-এ চল। ইথার বাধ্য ছেলের মত ডাইনিং এর দিকে যেতে থাকে আর রফিকুল রহমান ফুল কেনার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েন।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।