আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্যাকটাস তুমি কেঁদো না... যীশুর মুকুটে কাঁটা

বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে বলি এই তো জীবন

মাঝে মাঝে পুরো আকাশটাই অভিমানে কেমন যেন নীল হয়ে যায়। গাঢ় নীল? ফ্যাকাশে নীল? লালচে নীল? কালচে নীল? জানি না। যারা এতক্ষণে এটুকু পড়ে নীলের ব্যাপারে বিড়ম্বনায় পড়ে গেছেন সেই সব রং-বাদী লোকদের আমার কিচ্ছু বলার নেই; কিন্তু ‘নীল’ শব্দটা যাদের মনের অজান্তে একটু করে হলেও দুঃখ, বেদনা কিংবা মন খারাপের খোঁচা দিয়ে গেছে তাদের বলছি... সেই সব নীল পিপাসুদের বলছি... আজ আমি আবার ক্যাকটাস হয়ে গেছি! এমনও কিছু দুঃখ আছে যাকে ভোলার মত দুঃখ আর নেই। তেমন কিছু দুঃখ কাঁটা হয়ে বিধে আছে আমার সর্বাঙ্গে। আজ আরও একটা কাঁটা বাড়লো আমার ক্যাকটাস দেহে।

আর তাতে... আমার পুরো আকাশটা আজ নীল হয়ে গেছে। ক্লাস শেষে বাড়ি ফেরার জন্য নীলক্ষেতের মোড়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। হতভাগা বাসটা যাও আসলো তাও লোকে লোকারণ্য। বাসটা চলে যেতেই আবারও পরের বাসের জন্য অপেক্ষা। মধ্য-দুপুরের চিড়বিড়ে রোদ গায়ের সোয়েটারটাকে অসহনীয় করে তুলছিল।

হাসফাস করতে করতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল তখনই চোখে পড়লো বাচ্চাদুটো। ফ্রকপরা। একজনের লাল ফ্রক, অন্য জনের সাদা। আলথালু চেহারা। লাল ফ্রক পরা বাচ্চাটা বয়সে বড় হতে পারে।

ওর ডান হাতেটা কব্জি থেকে উড়ে গেছে। বা হাতের কনুই থেকেই নেই! অন্য বাচ্চাটা সভয়ে লাল ফ্রক পরা বাচ্চাটার আধেক কাটা কুনুই জড়িয়ে রেখেছে। ভীতু ভীতু চোখে এর কাছে ওর কাছে ভিক্ষে চাইতে চাইতে ওরা এগিয়ে আসছিল। মায়াভরা দুটো বাচ্চা। না না।

ভুল বলেছি। ধনীদের বাচ্চারাই বাচ্চা হয়। তাদের তফাৎ থাকে না। কিন্তু গরীবদের থাকে। গরীবের বাচ্চা মানেই মেয়ে বাচ্চা আর ছেলে বাচ্চা।

ছেলে বাচ্চা ঝোলা টাকা বয়। মেয়ে বাচ্চা বোঝা অসহায়তা বয়। জন্মের পর মুহূর্ত থেকেই বিভেদ, অবহেলা, নিরাপত্তাহীনতা, লজ্জা আর একটা ভাঁজভরা দেহ মিলে সমাজে নিরেট মেয়ে মানুষ হিসেবেই এরা পরিচিত হয়। সে হিসেবে বাচ্চাদুটো মেয়ে বাচ্চা। আমার সামান্য দূরেই ভার্সিটির কয়েকটা ছেলে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল।

বাচ্চা দুটো লোকজনের কাছে হাত পাততে পাততে ছেলেগুলোর কাছে এসে দাঁড়ালো। ভিক্ষে চাইলো। কে জানে? একঘেয়ে পড়াশুনা আড্ডা মুভি রিংটোন ক্রমশ নিরস হয়ে যাওয়া ছেলেগুলো নতুন মজায় মেতে উঠলো বোধহয়। একটা ছেলে মেয়ে একটার মাথা চাটি দিয়ে বলল, এই নাম কী রে তোর? রহিমা। আর তোর নাম? রহিমা নামের আগের মেয়ে পিচ্চিটাই উত্তর দেয় হের নাম সালমা।

দাবড়ানি দেয় আরেকটা ছেলে ওই? তুই বলিস ক্যান? হে চোহে দ্যাহে না। আরে দেখছস কাণ্ড! ওর চোখ দেখলে তো বোঝাই যায় না! ভিক্ষের নতুন ফন্দি বোধহয় হলুদ টি-শার্ট পরা ছেলেটা বলল। এই বলতো আমার হাতে কয়টা আঙুল। পারলে টাকা দিব। হে চোহে দ্যাহে না।

আগের পিচ্চিটার আবারও উত্তর। বলার পর এবার আর দাঁড়ায় না। ওদের কাছ থেকে ভিক্ষের আশা ছেড়ে দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসে। আফাগো দুইটা টাকা দেন। কী মনে করে আরেকটা বাক্যও যুক্ত করলো হে চোহে দ্যাহে না কেন করলো কে জানে? হতে পারে অন্ধত্বের ব্যাপারটা বলে ওর কাটা হাতটার মতই করুণা পেতে চায়।

কাটা হাত দেখা যায়। অন্ধত্ব দেখা যায় না। জিজ্ঞেস করলাম ও কী জন্ম থেকেই অন্ধ? জ্বে না। হাত কাটা মেয়েটা বলল। বুমা ফাটছিল।

হের চুখের পুতলা নষ্ট হয়া গ্যাচে। আর আমার হাত গ্যাছে। কী! বোমা পড়েছিল তোমাদের গায়ে!! না, বুমা পড়ে নাই। আমার ভইন আর আমি পথের পাশে একটা বল পাইছিলাম। বলটা কালা আর ময়লা ছেল।

আমি পরিষ্কার করতে গেছি আর বল গ্যাছে ফাইট্টা। তহন বুঝলাম বুমা। বলতে বলতে মেয়েটা হেসে ফেলে। যেন হাত উড়ে যাওয়াটা কোন আসল ব্যাপার না, বলটা বোমা হয়ে ফেটে যাওয়াটাই বড় আশ্চর্যের। মেয়েটা খিল খিল করে হাসছে।

কাটা কনুই আকড়ে ধরা অন্ধ মেয়েটা হাসছে না। কোন ধরণের বিকার নেই ওর মুখে। কে জানে? অন্ধকার জগতে হাসি কান্নার মত ব্যাপারগুলো থাকে না। সেখানে শুধুই অন্ধকার। অন্ধরা নিজেরাও একটা জীবন্ত অন্ধকার।

অনেক দিন পর আমার ভেতরের ক্যাকটাসটা নড়ে উঠলো। খচ করে আমার দেহে বিঁধে গেল একটা কাঁটা। এই মেয়ে দুটো রাজনৈতিক রেষারেষির শিকার। এই একটা বোমাফাটায় কোন দলের কিছু যায় আসে নি। শুধু নষ্ট হয়েছে দুটো জীবন।

অন্ধত্ব আর পঙ্গুতার অভিশাপ নিয়ে এরা কিছুদিন মা বাবার বোঝা হয়ে কাটাবে। কিন্তু তারপর? এদের বিয়ে হবে? এরা খেয়ে পরে বাঁচতে পারবে? কিভাবে? আফা হে চোহে দ্যাহে না। আমাগো খিদা লাগছে। আমি তাড়াতাড়ি ব্যাগের ভেতর থেকে ফটোকপির গাদা সরিয়ে একটা পাঁচ টাকার নোট তুলে আনলাম। টাকাটা পেয়েই কী খুশি মেয়ে! অন্ধটাকে ঠেলা দেয় সামনে এগোনোর জন্য।

একটা হাসিহীন আর একটা হাসি মাখা মুখ ধীরে ধীরে পথের আড়ালে মিলিয়ে যায়। আর আমার জন্য রেখে যায় একটা কাঁটা। আমার কষ্ট কষ্ট লাগে। বোমাটা ফাটার কারণে মেয়ে দুটোর যে ক্ষতি হয়েছে না ফাটলেও তেমন কিছু অ-ক্ষতি হতো না। হয়ত আর দশটা মেয়ের মতই হাত-পা-চোখ ওয়ালা মেয়ে হয়ে ওরা গার্মেন্টস বা যে কোন কারখানায় কাজ খুঁজে নিত।

এক টুকরো আশ্রয়হীনতা আর জ্বলন্ত পাকস্থলীটা তাদের থেমে থাকতে দিত না। আর দশটা অসহায়ের মতই হয়ত দিনমজুর হত, ভিক্ষুক হত, ভিক্ষুকের বউ হত, মজুর হত। কামলা হত। দেহপসারীণি হত। এই সব ছিন্নমূল শিশুদের কোন জীবন থাকে না।

মেয়ে শিশুদের তো নয়ই। ওদের প্রাপ্তি কেবল করুণা ভরা একটা দীর্ঘশ্বাস। কিংবা একটা টাকা। আমার কান্না কান্না লাগে। ওদের দিকে হাত বাড়ানোর মত হাত আমার নেই।

আমি কেবলই কাঁদতে পারি। ওদের দেখে আমি কেবলই দুঃখ পাই। দুঃখ জমাই। বিদ্ধ হই দুঃখ কাঁটায়। কিন্তু আমার কিচ্ছু করার থাকে না।

আমি বোবা ক্যাকটাস। চিৎকার করে ওদের কথা কাউকে বলতে পারি না। গতকাল ব্লগে মাদকবিরোধী একটা লিখা লিখেছিলাম ‘পাগল সাপ-লুডু খেলছে বিধাতার সঙ্গে’ শিরোনামে। আমার এক ব্লগার বন্ধু মাদকের পক্ষ নিয়ে আমাকে মাইনাস রেটিং করেছে। তার এই মাদক সমর্থন কেন আমার জানা নেই।

আমার এ লেখাও আজ অনেক ব্লগার বন্ধুরা পড়বে। আমাকে নানা মন্তব্য করবে। প্লাস মাইনাসের রেটিং-এ চাপা পড়ে যাবে ক্যাকটাসের বোবা কান্না। মেয়ে দুটো হয়তো কয়েকজনকে ভাবাবে। তারপর সেই ভাবনগুলোও হারিয়ে যাবে বিস্মৃতির অতলে।

লাল ফ্রক পরা মেয়েটার হাত গজাবে না। অন্ধ মেয়েটাও চোখে দেখবে না। বোমায় আরও দুটো চোখ রং হারাবে। আমিও হয়তো কাঁটার যন্ত্রণা এক সময় সয়ে নেব। ক্যাকটাস তাই নিজেকে নিজে স্বান্তনা দিচ্ছে ক্যাকটাস তুমি কেঁদ না... যীশুর মুকুটে কাঁটা।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।