আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কি দাঁড়ালো: প্রণব ও বাউচারের সফরের পর - ২



টাক্সফোর্স "সন্ত্রাস দমনে" বাংলাদেশকে জড়ানোর ক্ষেত্রে আমেরিকা ও ভারতের মতদ্বৈধতার কারণে মাঝখান থেকে প্রস্তাব দিয়ে, ইলেকশন মেনিফেষ্টো বানিয়ে শেখ হাসিনা বিপদে পড়েছেন। আর বিপদে সবচেয়ে পাবলিক বেইজ্জতি হয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি। অবস্হা হয়েছে এমন যাদের জন্য চুরি করলাম তাদের নিজেদের ক্যাচালে বমালের ভাগ না নেওয়াতে বমালসহ ধরা পরলাম আমি। শেখ হাসিনার দক্ষিণ এশীয় টাক্সফোর্স বা সংক্ষেপে টাস্কফোর্স নিয়ে আমেরিকা ও ভারত একমত না হওয়াতে এতবড় বেইজ্জতিতে পড়বেন - এটা সম্ভবত শেখ হাসিনাও ভাবেন নি। চলতি সফরে প্রণব ও বাউচারের হাসিনার দক্ষিণ এশীয় টাক্সফোর্স নিয়ে মন্তব্য থেকে একটা জিনিষ পরিস্কার যে, হাসিনার প্রস্তাব যথেষ্ট শলাপরামর্শ শেষ করার আগেই উপস্হাপিত হয়েছে।

অথবা বলা যায়, আগাম শলাপরামর্শে আমেরিকান ও ভারতীয়দের মধ্যেকার অবস্হান ভিন্নতা বা স্বার্থ-বিরোধ নিরসিত করা যায় নাই। অথচ ইতোমধ্যে সময় শেষ, প্রণব ও বাউচারের সফরের সময় এসে গেছে। ফলে আমাদের সকলের সামনেই আমেরিকান ও ভারতীয় মধ্যেকার অবস্হান ভিন্নতার প্রকাশ দেখতে পেলাম। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার দায়ে ব্যক্তিগতভাবে এর সমস্ত পাবলিক হাসানোর দায় বেচারা দিপু মনিকে নিতে হলো। কথা ছোট্ট করার জন্য, কেবল প্রণব ও বাউচারের বাংলাদেশ সফরে সাংবাদিকদের কাছে বাংলাদেশের দক্ষিণ এশীয় টাক্সফোর্স প্রস্তাব নিয়ে বক্তব্য প্রসঙ্গে বিচার করব।

প্রণবের বক্তব্য ছিল, "there are already certain regional and international mechanisms in place". বাংলা ভাব অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, "ইতিমধ্যেই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ও কিছু আঞ্চলিক পদক্ষেপ নেবার ব্যবস্হা জারি আছে তো"। কিন্তু এই কথার ভিতর দিয়ে প্রণব সব কথা, মন যাতনা, মত ভিন্নতা সব বলে ফেলেছেন। এমনকি হাসিনার নিজ দেশে মুখরক্ষার কথা ভেবেও নিজের স্বার্থ, কী চান তা প্রকাশেও দ্বিধা করেন নি, লুকান নি। মেকানিজম বলতে প্রণব কী বুঝিয়েছেন: গোড়া থেকেই অর্থাৎ ২০০১ সাল থেকেই আমেরিকানদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্তযুদ্ধের করণীয় বা দাওয়াই কী - এপ্রসঙ্গে অবস্হান হলো, ১. দুনিয়ার সবদেশকেই তার যুদ্ধের পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে সামিল করা। ২. কোন দেশের ভিতরের রাজনীতি কেমন থাকবে, কেমন সরকার হবে সেদিক থেকে এর ফর্মুলা হলো, ইসলামের নামগন্ধ নাই এমন সব রাজনৈতিক দল আর স্হানীয় সেনাবাহিনীর সমর্থন সহ একটা রক্ষাবুহ্য বানানো।

এর আমেরিকার পছন্দের অবয়ব ধারণা হলো, একটা জাতীয় সরকার ধরনের কিছু। তবে বাস্তবে এটা শেষ পর্যন্ত জারদারি বা হাসিনার ধরণের সরকার হিসাবে যা পাওয়া গেছে তা নিয়েও সে সন্তুষ্ট। ৩. ওদিকে আমাদের আঞ্চলিক দক্ষিণ এশীয় ভুগোলে, দেশ হিসাবে সবাইকে বিশেষত ভারত, পাকিস্তান বাংলাদেশকে এক সন্ত্রাসবিরোধী জোটে বা প্লাটফর্মে দেখতে চাওয়া। এই হলো মোটা দাগে "সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমেরিকান দাওয়াই"। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমেরিকান দাওয়াইকেই "প্রণব আন্তর্জাতিক মেকানিজম বলে বুঝিয়েছেন।

তাহলে সমস্যা হলো কো্থায় হলো? জেল থেকে ছাড়া পেয়ে হাসিনা ওয়াশিংটনে গিয়ে বাউচারের সাথে দেখা করেছিলেন। সাক্ষ্যাতের পর বাইরে বের হয়ে সাংবাদিকদের সামনে হাসিনাকে কবুল করে বলতে হয়েছিলো, "তিনি আমেরিকার সাথে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে একসাথে কাজ করতে চান"। আমেরিকান রাষ্ট্রদূত মরিয়র্টিও ঐ আলোচনায় উপস্হিত ছিলেন। বাউচারের পর আলাদা আরও দেড় ঘন্টা ধরে মরিয়র্টির সাথে খুটিনাটি বিযয় নিয়ে আলোচনা হয়। তখনও হাসিনা সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে কীভাবে একসাথে কাজ করবেন এর মোডালিটি বা ধরণ নিয়ে কিছু বলেন নি।

পরে ইলেকশনের আগে আমরা দেখলাম, দক্ষিণ এশীয় টাক্সফোর্স নামে নিজেই পরের যুদ্ধ ও শত্রু নিজের কান্ধে নিয়ে প্রস্তাব করবেন বলে জানালেন। আরও আগিয়ে একে ইলেকশন মেনিফেষ্টো বানিয়ে খোলাখুলি প্রচারে চলে গেলেন। সমস্যা বেধেছে ভারতকে নিয়ে। "সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে" আমাদের দক্ষিণ এশীয় ভুগোলে আমেরিকানদের শুরু থেকেই চাওয়া হলো - ভারত, পাকিস্তানের পারস্পরিক বিরোধ সত্ত্বেও তারা একসাথে "সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে" আমেরিকার সাথে কাজ করুক। এটা তার স্বার্থ অনুযায়ী স্বাভাবিকও বটে।

কারণ, ভারত, পাকিস্তানের পারস্পরিক বিরোধের চেয়ে এরা জোটবদ্ধ হয়ে আমেরিকার পক্ষে দাঁড়াক। এদিকে ভারত রাষ্ট্রের স্বার্থের দিক থেকে কাশ্মীর ও পাকিস্তানই তার সমস্যা। ফলে "সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে" সে আছে ঠিকই কিন্তু তার কাছে সন্ত্রাসবাদ মানে আলাদা - তার পুরানো কাশ্মীর ও পাকিস্তান - "সীমা পারকে আতঙ্কবাদ" এগুলো। ইদানিং বাংলাদেশকেও তার দেখা "সন্ত্রাসবাদ" এর কারণ মনে করাতে বাংলাদেশও ঐ তালিকায় ঢুকিয়েছে। ভারতের এই নতুন ভয় ও আবিস্কারের কথা আমেরিকাকে জানিয়ে বাংলাদেশকে দিয়ে দক্ষিণ এশীয় টাক্সফোর্স প্রস্তাব করিয়েছে।

এতে সফল কূটনীতিতে Click This Link)আমেরিকাকে রাজী করাতে সক্ষম হয়েছে। এর সাদা মানে হলো, আমেরিকান যাতা (leverage) ব্যবহার করে হাসিনাকে দিয়ে টাক্সফোর্স প্রস্তাব উপস্হাপন করানো। কিন্তু "সন্ত্রাসবাদ" এর মানে আমেরিকা ও ভারতের কাছে দুইরকম থেকে যাওয়া ঘটিত সঙ্কট না কাটিয়েই এতদূর এগিয়ে যাওয়া হয়েছে, হাসিনার প্রস্তাব রওয়ানা হয়ে গেছে। ভারতের আশা ছিল, হাসিনার টাক্সফোর্স প্রস্তাব উপস্হাপনের ভিতরেও আবার শব্দের দুই-অর্থ রেখে এটাকে ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সন্ত্রাসবাদ বিরোধী টাক্সফোর্স বলে কার্যত মানে দিতে পারবে। যদি আমারিকাকে মানাতে পারে যে আসলে পাকিস্তান জোটে আসবে না বা আসার যোগ্য নয় তাহলেই দক্ষিণ এশীয় টাক্সফোর্সে কার্যত দ্বিপাক্ষিকই হয়ে দাঁড়াবে।

কিন্তু ভারতের সমস্ত পরিকল্পনা ফ্লপ বা ভেস্তে গেছে। প্রণবের বাংলাদেশ সফর যতই ঘনিয়ে এসেছে আমেরিকা ততই পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে কোন কিছুর ব্যাপারে শক্ত অবস্হান নিয়েছে। প্রণবের সফরের আগে বাউচারের সফরের কারণ সম্ভবত বাংলাদেশকে আমেরিকান সর্বশেষ অবস্হান মনোভাব জানিয়ে দেওয়া। হাসিনার সাথে আগের আলোচনার কারণে কোন ভুল বোঝাবুঝি বা মানে যেন বাংলাদেশ না করে, তাই সরাসরি এসে জানানো। এটা বুঝার জন্য পাঠক আসুন, বাউচারের সফরে টাক্সফোর্স প্রসঙ্গে মন্তব্য পড়ে দেখি।

বলছেন, the countries in the region need to cooperate to combat terrorism. "We will extend supports in this regard if the countries want some kind of support from us." এখানে cooperate শব্দটাকে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে - কাদের cooperate করা বা না করার কথা বলছেন তিনি? এটাই পাকিস্তান ও ভারতের cooperate। এটা হচ্ছে না দেখে তিনি বলেছেন আমার "সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দাওয়াই" মতে এদের পরস্পর সহযোগিতা করা উচিত। যেহেতু এটা হচ্ছে না বুঝে গেছেন তাই if লাগিয়ে বলছেন, if the countries want some kind of support from us - অর্থাৎ, হলে ও যদি চায় তবে আমেরিকা সমর্থন করবে। পাঠক লক্ষ্য করবেন, বাউচারের এই গা-ছাড়া বক্তব্য আর হাসিনার ওয়াশিংটন সফরের সময়ের "আমেরিকার সাথে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে একসাথে কাজ করতে চাই" - এর আকাশ পাতাল পার্থক্য হয়ে গেছে। বাউচারের এখনকার বক্তব্যের খাঁড়া মানে হলো - ওরা কী করে দেখি ( if the countries want) তারপর আমরা আছি।

অথচ আগে একসাথে কাজ করবে এটাই হাসিনা দিয়ে কবুল করানো হয়েছিল। এবার প্রণবের কথা দেখব। ঢাকায় সাংবাদিকদের তিনি টাক্সফোর্সে প্রশ্নে বলছেন, "there are already certain regional and international mechanisms in place" - মানে হলো, আছেই তো আর কী দরকার। বেচারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। এরপরে তিনি মনের রাগ প্রকাশ করছেন এভাবে, "What is more important is the sincerity to fight against terrorism. It can be achieved if we have bilateral, regional and global mechanisms." এখানে sincerity কথাটা কার জন্য? কার sincerity নিয়ে কথা বলছেন প্রশ্ন তুলছেন তিনি? আমেরিকার নিশ্চয় নয়, প্রশ্নই আসে না।

তাহলে বাংলাদেশের? তাও মিলে না। কারণ বাংলাদেশ প্রস্তাবক। তাহলে কার? তিনি পাকিস্তানকে নির্দেশ করে বলছেন -আমেরিকা তোমারে নিয়ে সন্ত্রাস বিরোধী টাক্সফোর্স করতে বলে। কিন্তু তোমার তো sincerity নাই। মুম্বাই হামলা ইত্যাদি.....।

পাঠক, তাহলে দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানকে নেয়া না নেয়া নিয়ে বাউচার ও প্রণবের মনোমালিন্যের কারণে প্রস্তাব দিয়ে ফাঁন্দে পরে গেছেন হাসিনা। আর এসব সামলাতে গিয়ে নাকানি চুবানি দীপু মনির। কিন্তু পাঠক খুশি হবেন না। ভাববেন না যে এযাত্রায় আমরা বেঁচে গেছি আর হাসিনারও নাক কাটা গিয়েছে। কারণটা হলো, প্রণব এবার সরাসরি আবদার করে গেছেন, বাংলাদেশকে দ্বিপাক্ষিক টাক্সফোর্স করতে হবে।

পরের লাইনটা দেখুন, It can be achieved if we have bilateral, regional and global mechanisms। এবার, bilateral এর চাপ কী হাসিনা সামলাতে পারবে? না রাজি হয়ে যাবেন? আমরা এখনও ঠিক জানি না। তবে পরের দিন, এবার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে নিয়ে গিয়ে ব্রিফ করেছেন, "ভারত দ্বিপাক্ষিক টাক্সফোর্স চাচ্ছে"। ভারতের "সন্ত্রাসবাদ" মানে বাদে কাশ্মীর ও পাকিস্তান - "সীমা পারকে আতঙ্কবাদ", মুম্বাই হামলা, আলকয়েদা - এইসবকিছুতে ভারতের যুদ্ধ ও শত্রুকে নিজের বলে কান্ধে নিয়ে হাটা, বরণ করে নেয়া। ফলে দ্বিপাক্ষিক টাক্সফোর্সের মানে হবে এরকম।

এবার কী হবে?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।