আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দিনাজপুরের কাশিপুরে শিশু হত্যা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা-

২২ আগষ্ট রোজার ইফতারেরপর দিনাজপুর শহরের উপকন্ঠে দিনাজপুর-ফুলবাড়ী মহাসড়কের ধারে কাশিপুরে এক নিমর্মম হত্যাকান্ডে এক শিশুর লাশ উদ্ধার তারই আপন মহোদয় মাত্র দুই বছরে বড় মারাত্মক জখম অবস্থায় উদ্ধার এবং দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। পরিনামে সেখানে তুলকালাম কান্ড মহাসড়কটি প্রায় ২০ ঘন্টা একটানা অবরম্নদ্ধ। শত শত উত্তেজিত জনতার রাসত্মায় অবস্থান। ডা: আজাদের কথিত বাড়ী ভাংচুর, লুটপাট। অভিযোগডা: আজাদের এই বাসায় শিশুদের হত্যা করে কিডনি এবং কঙ্কাল সংগ্রহ করে পাচার বা বিক্রি করা হয়।

ডা: আজাদ কিডনি ও কঙ্কালের ব্যবসার জন্যই এমন রহস্য জনক বাসাটি নির্মান করেছেন। কেন রহস্যয়ক? অন্ধকুপ এবং সেখানে সর্বভূখ বিদেশী মাগুর মাছের চাষ। কাশিপুর থেকে এই সব লোমহর্ষক গুজব দ্রম্নত ডালপালা বিসত্মার করে ছড়িয়ে পড়ে শহরময়, গোটা দিনাজপুর পত্রপত্রিকা এবং ইন্টারনেটে দেশ বিদেশ সর্বত্র। যারা ডা:আজাদকে জানেন, চিনেন তারা হতবাক, এমন এক হাসিমাখা মুখের সজ্জন ব্যক্তির একি কান্ড! আসুন সর্বপ্রথম কিডনি এবং কঙ্কালের ব্যবসার দিকে নজর দেয়া যাক। প্রথমত কিডনির কথাই ধরাযাক শিশু হোক কিংবা যেকোন বয়সের মানুষই হোকবনে জঙ্গলে কিংবা কারো জোর পূর্বক ধরে বেঁধে পেট কেটে কিডনি নিলে সেই কিডনি কোন কাজে লাগবে না।

অন্যকারো শরীরে প্রতিস্থাপন কিংবা সহজ ভাষায় বললে লাগানো যায় কি? একটু স্থীর মাথায় ভেবে দেখলেই বিষয়টি সম্পর্কে ভ্রানত্ম ধারণা কেটে যাবে। কিডনিজোরপূর্বক কেটে নিয়ে যেকোন পাত্রে বহন করে অন্যত্র নেয়া যায় না। কিডনি মানিব্যাগ, মোবাইল, অলঙ্কার বা টাকা পয়সা নয় যে যখন তখনকেড়ে নেয়া যায়। মাছ মাংসের মত ব্যাগে ভরে নেয়া কিডনি কারো শরীরে সংযোজন করা যায় না। একথা সত্য যে, একজনের কিডনি কিংবা চোখ বিশেষ ব্যবস্থায় অন্যকোন ব্যক্তির শরীরে সংযোজন করা যায়।

সেই জন্য বিষেশায়িত হাসপাতালে এই কাজের জন্য অপারেশন থিয়েটার প্রয়োজন। কিডনির বেলায় উভয় ব্যক্তির রক্তের গ্রম্নপ ছাড়াও আরো কিছুম্যাচিং পরীড়্গা নিরীড়্গা করে তবেই কিডনি নেয়া এবং দেয়ার সিদ্ধানত্মটি গ্রহণ করা হয়। তারপর কিডনি দাঁতা এবং গ্রহিতাকে একই অপারেশন থিয়েটারে রেখে দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা জরম্নরী। ভুলিয়ে ভালিয়ে বা অর্থের লোভ দেখিয়ে কিডনির যে অবৈধ ব্যবসা চলছে সেড়্গেত্রেও হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে সুক্ষ্ম অপারেশনের মধ্য দিয়ে কিডনি বা চোখ দেয়া নেয়ার কাজটি সম্পন্ন হয়। তাই কারো কিডনি কেটে নিয়ে অন্য কোথাও যেকোন ব্যক্তির শরীরের সংযোজন বা প্রতিস্থাপন করার যে গল্প বা গুজব এতবিসত্মর ডালপালা বিসত্মার করল তার প্রকৃত কোন ভিত্তিই নেই।

কেউ প্রশ্ন করতে পারেন তাহলে কিডনি ছাড়াদেহের অন্যকোন প্রতঙ্গ নেয়া হতো এখানে। এমন সন্দেহ কারো থাকতে পারে। আসুন সেদিকে নজর দেয়া যাক। কিডনি ব্যতিরেকে মানুষের রক্ত দেওয়া নেওয়া করা যায় এবং হৃদযন্ত্র (হার্ট) সংযোজন বা প্রতিস্থাপন করা যায় তবে এমন জটিল প্রতিস্থাপন গোটা বিশ্বে খুবই বিরল যদিও চিকিৎসা বিজ্ঞান হৃদযন্ত্র মানব দেহে প্রতিস্থাপনে সফল হয়েছে। আর একটি অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা সম্ভব তা চোখ।

তবে এই সব অঙ্গ প্রতঙ্গ এক মানব দেহে থেকে নিয়ে এবং অন্য দেহে প্রতিস্থাপনের ব্যাপারটি সহজ সরল নয় বাজার থেকে ক্রয় করে আর একজনের দেহে লাগিয়ে দেয়ার মতো। একজনের সব অঙ্গ প্রতঙ্গই অন্যের দেহে প্রতিস্থাপন করা যায় না। আমাদের মত দেশে এখনো হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন সম্ভব হয় নাই। তবে চোখ এবং কিডনির বেলা বাংলাদেশে এইটি সম্ভব। চোখ এবং কিডনি রাসত্মাঘাটে কেড়ে নিয়ে কোন কাজে লাগে না সে কথা আগেই উলেস্নখ্য করেছি।

আর এইটুকু বুঝবার জন্য সাধারণ জ্ঞানই যথেষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজন হয় না। কিডনি’র ব্যবসা বা পাচার এই অভিযোগ মিথ্যা এবং বানায়ট। অভিযোগটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং অসৎ উদ্দেশ্যে আরোপিত। বাকী থাকে কঙ্কাল। শিশু দেহের কঙ্কাল হয় না।

কঙ্কালেরজন্য পূর্ন বয়স্ক দেহেরপ্রয়োজন। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের দেহের কঙ্কাল সংরড়্গণ করা যায়না। কারণ সেই হাড় হাড় হিসাবে পরিপক্ক নয় তাই তা কঙ্কাল হিসাবে কোন কাজে লাগেনা। পুরাতন কবর থেকে কঙ্কাল সংগ্রহকরে অনেক ভন্ড জীনের বাদশা, ভন্ড তান্ত্রিকের নানা রকম ভন্ডামীর গল্প শোনা যায়এবং কবর থেকে কঙ্কাল তুলে বিক্রয় কাহিনী ও শোনা গেছে। কবর থেকেই যখন কঙ্কাল তুলে বিক্রিকরা এবং ক্রয় করার মত বিকৃত মানসিকতার লোক যখন রয়েছে তখন কঙ্কালেরজন্য কেন মানুষ খুন করার মতো মারাত্মক ঝুঁকি নিতে যাবে! ডা: আজাদের ঐ বাসাতে কিডনি এবং কঙ্কালের কারবার হয়বলে যা ঘটানো হয়েতে তা শ্রেফ্‌ গুজব বাসত্মবতার সাথে যার কোন সম্পর্কই নেই।

তাহলে ঐ বাড়ীতে কেন জানালা নেই, আন্ডার গ্রাউন্ড রম্নম এবং বিদেশী মাগুর মাছের চাষনিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। আমি নিজে ২৩ আগষ্ট সকাল ১০ টায় রাসত্মা যখন অবরম্নদ্ধ,শতশত বিুদ্ধ মানুষ রাসত্মার উপর তখন মানুষের সাথে যেখানে কথা বলছি এবং সমসত্ম এলাকাটি এক নজর দেখে নিয়েছি। ডা: আজাদের বাড়ীবলে প্রচারিত প্রাচীরের ইট চুরি ঠেকানোর জন্য প্রাচীরের উপর টিন ঢেকেটিনের একচালা ঘর করা হয়েছিল। প্রাচীরের জানালা কেউ করে না, তাই সেখানে জানালা ছিল না। যেহেতু ডা: আজাদ নিজে ওখানে বসবাস করেন না বা অদূর অভিষ্যতে বসবাস করবেন না, তাই নতুন করে জানালা রাখার ব্যবস্থা করা হয়নি।

২৩ আগষ্ট ১০ টা পর্যনত্ম তিন/চার রম্নমের বাড়ীটি অর্দ্ধেক অংশে তখন ও কিছু টিন ছাদে ছিল এবং দুদিকের দেয়াল আংশিক অড়্গত ছিল। ঐ অবস্থায় ঘরগুলি আমি পরিদর্শন করেছি। সেখানে কোন আন্ডারগ্রাউন্ড রম্নম, বেজম্যন্ট বা মাটি নিচেরম্নমের অসিত্মত্ব ছিল না। ঐ বাসার দড়্গিণ প্রানেত্ম সম্ভবত ২০০ গজ দূরে একটি চৌবাচ্চা আছে সেখানে জমানো পানি রয়েছে। এখানেই শিশুটির লাশ পাওয়া গিয়েছিল।

চৌবাচ্চার আরো দড়্গিণে এক কোনে ইট এবং ঘাসের উপর রক্তের দাগ তখন স্পষ্ট দেখা গেছে। হত্যা এবং জখমের ঘটনা যে তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। ইটের বাড়ী নির্মান কালে ইট ভিজানোর যেমন ‘হাউস’ করা হয় এই চৌবাচ্চাটি তেমনইএকটি হাউস। হাউসে পানিওরয়েছে তবে ময়লা আবর্জনাও যথেষ্ট। মাগুর মাছের কোন অস্থিতসেখানে পাওয়া যায় নি।

ডা: আজাদের বাড়ী বলে প্রচারিত বাড়ীটিতে আজাদ বসবাস করেন প্রথমতআমার এই ধারনা হয়েছিল। কিন্তু জায়গাটি পরিদর্শনে বুঝলাম এইটি একজন ডাক্তারের বসবাসের মত উপযুক্ত নয়। ডা: আজাদ এখানে বসবাসও করেন না। শুনেছি ঐটুকু জায়গা এবং ধ্বংস প্রাপ্ত বাড়ীটির মালিক তিনি। রাসত্মা সংলগ্ন এই বাসার সঙ্গেই একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় তারপাশে যুব প্রশিড়্গন কেন্দ্র, খুববেশী বাড়ীঘর এখানে নেই।

শিশুদের জন্য কোচিং সেন্টার হিসাবে বাসাটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ডা: আজাদ গ্রেফতারকৃত সন্দহভাজন শাহিনুরকে কোচিং সেন্টার হিসাবে ব্যবহারের জন্য মাসিক চুক্তিতে ভাড়া দিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য সম্পত্তি রড়্গা এবং পাহারা। মানুষ হত্যা করে মানবদেহের অঙ্গ প্রতঙ্গের ব্যবসা এখানে হতো এইটি একেবারেই মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা, কেউ কোন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যই এই গল্প এঁটেছেন। কিন্তু তারপরও সত্য হলোএখানেই শিশুটিকে হত্যা করা হয়েছে এবং চিকিৎসাধীন শিশুকে এখানেই আহত করা হয়েছে এইটুকু গল্প নয়, সত্য।

সকলেই জানি মানুষ হত্যাকোন হালকা বিষয় নয় এবং বিনা কারণে কেউ কাউকে হত্যা করে না। প্রতিটি হত্যার পিছনে এক বা একাধিক গুরম্নতর কারণ থাকে। কাশিপুরে শিশু হত্যার পিছনের তেমনই কোন কারণ অবশ্যই রয়েছে। লোক মুখেপ্রচারিত ‘কিডনি এবং কঙ্কালের জন্য হত্যা’ এইটি হত্যার কারণ হতে পারে না। কঙ্কাল যখন কবরেই পাওয়া যেতে পারে তখন হত্যার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজের দায়িত্ব কেন নেবে।

তাহলে ‘হত্যার উদ্দেশ্য’কি? আমার ধারণা হত্যাকারী ‘উদ্দ্যেশ’ এবং নিজকে আড়াল করার জন্যই ‘কিডনি এবং কঙ্কালের’ ব্যবসার আজগুবি গল্প সাজিয়েছে। তদনেত্ম নিশ্চয় হত্যার উদ্দেশ্যে উদঘাটিত হবে। অপরাধ বিজ্ঞান মনেকরে হত্যাকারীর যতই চতুর হোক কিছু চিহ্ন অজানেত্মই রেখে যায়। তাই হত্যার উদ্দেশ্য জানা গেলে হত্যাকারী পাওয়া সহজ। আমাদের দেশে কত সহজে একটি সম্পূর্ণ অবাসত্মব, ভিত্তিহীন কল্প কাহিনীকে বিদ্যুৎ গতিতে সত্য বলে ছড়িয়ে দেয়া যায় এবং শিড়্গিত ও অশিড়্গিত সব ধরনের মানুষ কিছুমাত্র যাচাই না করেই তা মেনে নেয়।

কাশিপুরে শিশু হত্যার ঘটনা তার জলনত্ম প্রমান। এই হত্যার পিছনে কিডনি এবং কঙ্কালের ব্যবসা এবং এর সাথে একজন চিকিৎসককে জড়িত করে নেপথ্যে থাকা হত্যাকারি তাৎড়্গনিক প্রচার সাফল্য পেলেও মানুষ ক্রমশ সত্য উপলব্ধি করছেন। গুজব যেমন দ্রম্নত শাখা প্রশাখা বিসত্মার করে তেমনি সত্য উদ্‌ঘাটনে তা নেতিয়ে যায়। কাশিপুরে শিশু হত্যার প্রকৃত সত্য উদঘাটন হোকহত্যকারির বিচার হোক সকলের সাথে আমিও এই কামনা করি। আমিন বাজারের বালুর মাঠে ছয় নিরীহ ছাত্রের মত আর কাউকে যেন গনপিটিনিতে জীবন দিতে না হয়।

আর কাউকে ডা: আজাদের মত বিনা কারণে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে না হয়। সাধারণ জ্ঞান সম্পন্য বিবেকবান মানুষের কাছে এইটুকু প্রত্যাশা। আসুন গুজবে কান না দিয়ে প্রকৃত হত্যকারীর শাসিত্ম দাবী করি কিন্তু নিরপরাধ কেউ যেনসামান্যতম সাজা না পায় এই বিষয়ে আমাদের সকলকে সতর্ক থাকা অতি প্রয়োজন। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.