আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কোমা



বেশ কয়েকদিন কিছুই লিখিনি। আপনাদের লেখা পড়েছি। বেশ কিছু লেখা মনে রাখার মতো। কয়েকদিন বিরতি দেওয়ার পর আজ আবার একটা গল্প নিয়ে হাজির হচ্ছি পাঠকদের দরবারে। গল্পের নাম 'কোমা'-- জয়া'র কথা : আমি এখন এমন একটা অবস্থার মধ্যে রয়েছি যা সত্যি ভারি অদ্ভুত এবং বেশ মজারও বটে।

আমি সকলের কথা শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু কিছুই বলতে পারছি না। আমার চোখের পাতা পর্যন্ত কাঁপছে না। ভ্রূ কুঁচকে যাচ্ছে না। আমি সব দেখছি, সবাইকে দেখছি, কিন্তু কেউ তা টেরই পাচ্ছে না। সিনেমায় দেখেছি আমার মতো এইভাবে নি:স্পন্দ ভাবলেশহীন চোখ-মুখ নিয়ে চিত্ হয়ে শুয়ে থাকা অবস্থাকে বলে কোমায় থাকা।

সিনেমায় দেখা এইরকম একটা ব্যাপার যে আমার জীবনেই ঘটবে তা কে জানতো! কোমায় থাকলে যে বিছানা ছেড়ে যেখানে খুশি যাওয়া যায়, যার পাশে খুশি গিয়ে দাঁড়ানো যায় অথচ আমার শরীরটা বিছানাতেই পড়ে থাকে--সবাই যখন আমার বিছানা ঘিরে আমার দিকে ভারি দু:খু দু:খু মুখ করে তাকিয়ে থাকে তখন আমি ঠিক তাদেরই পাশে দাঁড়িয়ে থেকে আমি আমার বিছানায় পড়ে থাকা শরীরটা দেখি। আমারও মুখ দিয়ে আহা-উহু শব্দ বেরিয়ে আসে অথচ কেউ শুনতে পায় না। ব্যাপারটা বেশ মজার নয়? সেদিন বাথরুম থেকে তড়িঘড়ি বেরুতে গিয়েই তো যত বিপত্তি। মার্বেলের মেঝেতে তেল আর সাবানের জলের মতো কিছু ছিল বোধহয়, দড়াম করে পড়ে গেলাম মার্বেলের মেঝেতে। দু'এক মুহূর্তের জন্যে শ্বাস-প্রশ্বাস আটকে গেল।

চোখে ঘন অন্ধকার। ভারি শরীর পতনের একটা নিজস্ব শব্দ থাকে, তার কান টানার ক্ষমতাও থাকে বেশ--প্রথমে শুনতে পেল কাজল, আমার ছায়ায় লতার মতো বেড়ে ওঠা দূর সম্পর্কের দিদির মেয়ে। ভীষণই দূরবস্থা। পড়াশোনায় ভালো। স্কুলে ভর্ত্তি করে দিয়েছিলাম।

এবারই কলেজে ঢুকেছে। আমি যদি কোমা থেকে না ফিরি তাহলে বড়বউ তপতী সবার আগে কাজলকে বাড়ি থেকে তাড়াবে। ---কাজল ছাদে জামাকাপড় মেলতে গিয়েছিল। পড়িমরি করে যেভাবে ছুটে আসছিল তাতে আমার নিজেরই হাত-পা কাঁপছিল। পড়ে না মরে মেয়েট।

আমার বড়সড় ভারি শরীরের ওপর হুমড়ি খেয়ে মরণ আর্তনাদে গোটা বাড়ি কাঁপিয়ে দিল ছুঁড়ি। যে যেখানে ছিল দৌড়ে এলো। তিনি এলেন বেশ কিছুটা পরে। তাঁর হাই সুগার, হাই ব্লাডপ্রেশার, হাই মেজাজ। তাঁর অবস্থা দেখে আমার মনে হচ্ছিল তিনি না আবার আমার পাশে শুয়ে পড়ে জগঝম্প বাধিয়ে তোলেন।

স্নান সেরে তাঁকে ওষুধ দেওয়ার কথা ছিল আমার। দিতে পারিনি। খুবই প্রয়োজনীয় ওষুধ। বাদ পড়লে বিপদ হতে পারে। কাজলকে বারবার বলছিলাম ওষুধটা তাঁকে দিতে--কিন্তু কে কার কথা শোনে! তিনি আমার মুখের দিকে তাকালেন।

এমন দৃষ্টি কখনো দেখিনি। কোনো ভাষা নেই। তাঁকে বললাম, ভয় নেই, আমি ঠিক আছি। তুমি ওষুধটা খেয়ে নাও। --কথাটা মনে হলো গ্রাহ্যই করলেন না।

এমনটা তো উনি করেন না কখনো। ওঁর চোখে জল দেখলাম। গালের ওপর দিয়ে গড়াচ্ছে অথচ তিনি মুছছেন না। আমার বুকের মধ্যে একটা চিনচিনে ব্যথা টের পাচ্ছিলাম। পাড়ার ডাক্তার সুদর্শন বোস (নামের এমন সাংঘাতিক অপচয় এই ডাক্তারকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না) আমার নাড়ি টিপে-টুপে বললেন, মনে হচ্ছে হার্ট অ্যাটাক--ফেলিওরও হতে পারে! কে ওকে ডাক্তারি ডিগ্রি দিয়েছে তা ভগবানই জানেন! হার্টফেল হলে এতসব দেখছি শুনছি কি করে? ডাক্তারের কথা শোনামাত্র সবাই ডুকরে উঠলো হাউ-মাউ করে।

এমন কী বড়বউ তপতী পর্যন্ত। না, কিছুই ভুল দেখছি না। আমি মরে গেছি এটা শুনে সকলকে যেভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখলাম তাতে নিজের হাতে গড়ে তোলা এই সংসারের কর্ত্রী হিসেবে সানন্দে নাচতে নাচতে স্বর্গে যাওয়াই উচিত। কিন্তু আমি জানি আমি এখনো মরিনি। সবাইকে দিব্যি দেখতে পাচ্ছি।

সকলের কথা-কান্না শুনতে পাচ্ছি। ওই তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তিনি দেওয়ালে হেলান দিয়ে কাঁপছেন থরথর করে। পড়ে না যায় লোকটা! কেউ কেন ওঁর দিকে তাকাচ্ছে না-- --আর এক মিনিটও দেরি না করে নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া দরকার। সুদর্শন ডাক্তারের কথা শুনে সকলেই চমকে তাকালো তার দিকে। তার মানে তারও মনে হচ্ছে আমি মরিনি।

বড় ছেলে তাপস তাড়াতাড়ি মোবাইল অন করে শহরের এক নামী নার্সিংহোমে ফোন করে আ্যম্বুলেন্স পাঠাতে বললো। তপতীর চোখের জল মুহূর্তে উধাও। প্রথম থেকেই ওকে আমার পছন্দ হয়নি। স্রেফ ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মেনে নিতে হয়েছে। তাপসের কপালে অনেক দু:খ আছে।

তিনি এতক্ষণে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। জামার হাতায় চোখ মুছে আবার তাকালেন আমার মুখের দিকে। আমি আবার বললাম, শোবার ঘরের টেবিলের ওপর ট্যাবলেট রাখা আছে, খেয়ে নাও। --তিনি গ্রাহ্যই করলেন না! নার্সিংহোমে দ্রুত গতিতে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলো। ডাক্তার রায় দিল, মিসেস মিত্র কোমায় চলে গেছেন।

কথাটা শোনামাত্র সবাই কেমন শান্ত হয়ে গেল। তাপস ওর দুই দিদিকে ফোন করেছিল। তারা কয়েকঘন্টা পরে যখন একজন টালা আর একজন বালীগঞ্জ থেকে সোজা উদভ্রান্তের মতো ছুটে এলো আমার বিছানার পাশে তখন তাদের দিকে তাকিয়ে আমার বেশ লজ্জাই করছিল। এত সেজেগুজে কেউ নার্সিংহোমে রুগী দেখতে আসে--বিশেষ করে যে সে রুগী নয়, নিজেরই মা! সকলের চোখেই আবাক দৃষ্টি। আমার দুটি মেয়েই বেশ সুন্দরী।

তাই সম্ভবত ওদের ধারণা--সব সময়ে সেজেগুজে থাকাটা ওদের হকের বিষয়। বোকা মেয়েদুটোকে বোঝাতে পারিনি--সৌন্দর্য্যকে কোথায় কখন তুলে ধরতে হয়। তিনি আমার মাথার কাছে একটা প্লাস্টিকের টুলের ওপর বসেছিলেন। মেয়েদের নাটকীয় প্রবেশ ও তাদের সাজসজ্জা যে তাঁর মোটেও ভালো লাগেনি তা তাঁর চোখের ভাষাতেই স্পষ্ট। কিন্তু আশ্চর্য, আজ তিনি হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন না! এই আচরণ তাঁকে মানায় না।

বড় মেয়ে আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে তার বাবাকে বলল, মায়ের গলা থেকে এত ভারি হারটা খুলে রাখোনি কেন বাবা? হাতে অতগুলো চুড়ি, মায়ের কষ্ট হচ্ছে না? --এসব নিয়ে ভাববার সময় পাইনি। তোর মায়ের কষ্ট হচ্ছে কি না তা-ই বা বুঝবো কি করে? ছোটমেয়ে আমার পায়ে হাত বোলাচ্ছিল। দ্রুত উঠে এলো দিদির পাশে। একবার হাত বুলিয়ে আমার গলার চারপাশের অবস্থাটা অনুভব করে হয়তো বুঝতে চাইছে কতটা কষ্ট হচ্ছে আমার। আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছিলাম এই হার-চুড়ি-আংটি-দুল নিয়ে দুই মেয়ের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেবে।

আমি তাঁকে বললাম, এগুলো তুমি খুলে নিয়ে নিজের কাছে রেখে দাও। --তিনি আমার দিকে তাকালেন না পর্যন্ত! দুই মেয়ের মধ্যে না চুলো-চুলি বেধে যায়। কাজলটাও যে কোথায় গেল কে জানে। হয়তো কোথাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। আমার ছোট ছেলে দীপু ব্যাঙ্গালোরে পড়তে গেছে।

খুব নাকি শক্ত পড়া। এখানে ওসব পড়ার ভালো ব্যবস্থা নেই। ওকেও ফোন করেছে তাপস। শুনলাম কাল সকালেই নাকি সে আসছে। দীপু আর তাপস দুটোই মা-পাগলা ছেলে।

তপতী তাই উঠতে বসতে তাপসকে হেনস্থা করে। ধিক্কার জানায় এখনও কথায় কথায় 'মা' 'মা' করার জন্যে। কিন্তু এখনো তাপস টলেনি। এই নিয়ে বড়বউয়ের অশান্তির শেষ নেই। সংসারের কর্তৃত্ব নিজের হাতে নেওয়ার প্রহর গুণছে।

এমন সময়ে আমার কোমায় চলে যাওয়াটা ওকে কি ভেতরে ভেতরে কিছুটা আশান্বিত করছে? না হলে ও ডাক্তারের কাছে কেন জানতে চাইবে--কোমা থেকে ফিরে আসার চান্স কতটা, বিশেষ করে আমার ক্ষেত্রে। ডাক্তার বেশ গম্ভীর হয়েই উত্তর দিয়েছিলেন--সাতদিনের মধ্যেও হতে পারে আবার সাত বছরও হতে পারে। ফিরে আসার চান্স যে নেই তা তো বলতে পারি না। বড়বউ ডাক্তারের এই কথা শুনে গুম হয়ে গিয়েছিল। আমি কাজলের সঙ্গে দীপুর বিয়ে দেবার কথা ভেবে রেখেছি।

ওঁকেও কথাটা বলেছি। উনি বলেছেন--আশা কোরো না কিছু। আজকালকার ছেলেদের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত তাদের অগোচরে না নেওয়াই উচিত। দীপুর সঙ্গে কথা না বলে আগ বাড়িয়ে কিছু ভেবো না। আমি অবশ্য ভাবনাটা ছাড়িনি।

দেখা যাক্ কি হয়! কাজলের কথাই ভাবছিলাম। কাজল ঘরে ঢুকে ওঁর পাশে গিয়ে বললো, মেসমশাই, ডাক্তারবাবু মাসিমার গয়নাগাটি খুলে নিতে বলেছেন। আমি কি খুলে দেবো? সঙ্গে সঙ্গে দুই মেয়ে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার বুকের ওপর। প্রায় ছিনতাইয়ের স্টাইলে হারটা দুই মেয়ের হাতের মুঠোয় চলে যাচ্ছিল আর একটু হলেই! ডাক্তার প্রায় শিউড়ে ছুটে এলেন আমার পাশে। আমার বোকা মেয়েদুটিকে ধমক দিলেন।

ওরা থতমত খেয়ে একটু সরে দাঁড়ালো। উনি কাজলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন-- --খুব সাবধানে ওগুলো খুলে নে তো মা--দেখিস যেন না লাগে। আমার আছাড় খেয়ে মাটিতে পড়া এবং তারপর কোমায় চলে যাওয়ার ঘন্টা দশেক পর এই প্রথম ওঁর গলার আওয়াজ শুনলাম। একেবারে অপরিচিত শোনালো। তবু এতক্ষণে যেন প্রাণ ফিরে পেলাম।

গলা শুনে এটুকু অন্তত: বুঝলাম শরীরটা খুব খারাপ হয়নি। এখন আমার গোটা শরীর এবং চেতনায় বড় ক্লান্তি টের পাচ্ছি। আমি কাজলের দিকে তাকিয়ে বললাম--যদি ঘুমিয়ে পড়ি তুই তোর মেসমশাইকে মনে করে রাতের খাবার খাইয়ে ওষুধটাও দিয়ে দিস মা। (শেষাংশ আগামীকাল)

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।