আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কোমা (শেষাংশ)



কাজলের কথা : জয়ামাসিকে আমি মায়ের মতোই ভালোবাসি। শুধু এই সংসারের সর্বময়ী কর্ত্রী বলেই নয়--জয়ামাসিকে মা ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যায় না বলেই জয়ামাসির মুখে আমার মায়ের মুখটাই অবিকল সেঁটে থাকে সব সময়। এই বাড়িতে আশ্রিত হয়ে আসা এবং তারপর অবধারিতভাবে ক্রমশ: এই বাড়ির বিনা মাইনের ঝি হয়ে ওঠার ব্যাপারটা জয়ামাসির জন্যেই সম্ভব হয়নি। আমি নিজের মনের তাগিদে কর্তব্য বলে যা মনে করি যতটুকু করি তা মাসির জন্যেই করি। করতে আমার ভালো লাগে খুব।

জয়ামাসি বাথরুম থেকে বেরুতে গিয়েই যে ওভাবে মৃত্যুমুখে চলে যাবেন আমি তা ভাবতেই পারিনি। আমি ভেবেছিলাম মাসি বোধহয় সত্যি সত্যি মরে গেল। বুকটা আমার ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছিল। নিরাশ্রয় হবার ভয়ে নয়--একটা দাপুটে প্রাণবন্ত জননী-মানবী এভাবে মারা যাবেন কেন? ইতিমধ্যে ঘন্টাদশেক কেটে গেলেও মাসির জ্ঞান ফেরেনি এখনো। ডাক্তারের মতে তিনি কোমায় চলে গেছেন।

এই অবস্থা থেকে তিনি ঠিক কবে সুস্থ হবেন কিংবা আদৌ হবেন কিনা সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে ডাক্তারের পক্ষে কিছু বলা সম্ভব হয়নি। ডাক্তারের এই কথা শুনে তপতীবৌদি তাপসদাকে নার্সিংহোমের সিঁড়ির নীচে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে রাগে ফেটে পড়েছিল-- --সাত বছর ধরে যদি তোমার মা এইভাবে শুয়ে থাকেন পারবে নার্সিংহোমের হাতির খরচ জোটাতে? দুম্ করে এত বড় নার্সিংহোমে না তুলে এসএসকেএম হাসপাতালে কি তোলা যেত না? ওখানেও তো শুনেছি বড় বড় ডাক্তার আছে-- --তোমাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। তোমার বাবার কাছে টাকা চাইতে যাব না আমার মায়ের জন্যে। মায়ের ট্রিটমেন্ট করাবার মতো সামর্থ্য আমাদের আছে-- তাপসদার কথা শুনে বোবা হয়ে গিয়েছিল বৌদি। মিনিট দশেক উদাসভাবে এদিক ওদিক ঘুরে বাড়ি চলে গিয়েছিল।

সময় যত পার হচ্ছে ততই কেমন যেন মানুষগুলোও বদলে যাচ্ছে। জয়ামাসির খারাপ কিছু ঘটে গেলে কিংবা সত্যি সত্যি সাতবছর কোমায় থাকলে আমাকে ফিরে যেতে হবে এখান থেকে। যাবার আগে অবশ্য গোছাবার কিছুই নেই তেমন--দু'একটা শাড়ি চুড়িদার ছাড়া। তবু মনে মনে প্রস্তুত হবার চেষ্টা করছিলাম আমি। মেসমশাই হয়তো প্রথম ধাক্কাটা সামলে উঠতে পেরেছেন।

সকালে দুর্ঘটনার সময়ে আমার মনে হচ্ছিল উনিও হয়তো হার্টফেল করে মারা যাবেন। জয়ামাসির নির্বাক মুখের দিকে যেভাবে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিলেন তাতে আমি বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মাসির দুই খোলা চোখে কোনো ভাষা ছিল না। তবু কেন জানি না ঐ চোখ দুটো আমাকে তীব্রভাবে কিছু বলতে চাইছিল। আমিও মাসিকে বলতে চাইছিলাম, তুমি চিন্তা কোরো না--আমি মেসমশাইকে ওষুধ খাইয়েছি।

যতদিন না আমি বিতাড়িত হই এ বাড়ি থেকে ততদিন আমি ওঁকে দেখাশোনা করবো। শুধু তুমি কোমা থেকে তাড়াতাড়ি এসো জয়ামাসি! না হলে এতবড় সংসারটা যে তছনছ হয়ে যাবে-- তিনদিন ধরে আত্মীয়-স্বজনের মেলা লেগে গেল নার্সিংহোমে। দীপুদা পরদিনই ব্যাঙ্গালোর থেকে সোজা নার্সিংহোমে এসে জয়ামাসির দিকে তাকিয়ে বাচ্চা ছেলের মতো কেঁদে ফেললো। ওর কান্না দেখে সকলেরই চোখে জল এলো আবার। আমার চোখের জল তো কিছুতেই থামে না।

ছোট ছোট এই দুটো চোখের ভেতরে জলের এত সঞ্চয় থাকে কি করে? তারপর যত দিন যায় ভিড় কমতে কমতে প্রায় শূন্যে এসে দাঁড়ালো। বাড়িতে তপতীবৌদির দাপটে সকলের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। যেকোনো ব্যাপারেই অশান্তি। বিশেষ করে আমাকে এখন হাতের মুঠোয় পেয়ে যা খুশি তাই করিয়ে নেওয়ার জেদ ক্রমশ:ই বেড়ে যাচ্ছে। রান্না থেকে বাসনমাজা পর্যন্ত যতটা আমাকে দিয়ে করানো যায় তার চেষ্টা করতে গিয়ে নিজেরই সুখের বারোটা বাজাচ্ছে বৌদি।

কিন্তু কে তাকে বোঝাবে। মেসমশাই আমাকে রক্ষা করে চলেছেন। তবু বুঝে পারছি জয়ামাসি যদি না ফেরে তাহলে আমার পড়াশোনা শেষ। এ বাড়ির আনাচে-কানাচে বেড়ে ওঠা আমার স্বপ্নগুলো মাটিতে মিশে যাবে নিশ্চিত। এখন তাই অপেক্ষা।

ইতিমধ্যে দেখতে দেখতে দু'মাস কেটে গেল। জয়ামাসির মেয়েরাও ফোনে জিজ্ঞেস করে--ডাক্তার কি বলছে? আর কতদিন? এভাবে কষ্ট পাওয়ার কোনো মানে হয়? এখন আর আমার চোখে জল আসে না। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে হাউ-হাউ করে কাঁদি। জয়ামাসির মাথায় কপালে পায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলি--জয়ামাসি তুমি তাড়াতাড়ি উঠে বসো, না হলে মেসমশাই বাঁচবেন না। বড্ড চুপচাপ হয়ে গেছেন।

মাঝে মাঝে অন্ধকার ঘরে নি:শব্দে কাঁদেনও। তোমার গয়না তোমার দামি দামি শাড়ি তোমার নামে কেনা জমি-বাড়ির দলিল নিয়ে আজকাল সবসময়ে কথা হয়। ছেলেমেয়েরা কে কতটা পাবে, কার কতটা পাওয়া উচিত এসব নিয়ে একএকদিন তপতীবৌদি দুই মেয়ে আর জামাইদের মধ্যে ফাটাফাটি লেগে যায়। তাপসদা আর দীপুদাকে এসব আলোচনায় ডাকার সাহস এদের হয় না। মেসমশাই অন্ধকার ঘরে বসে বসে মাঝে মাঝে সবই শোনেন--কিন্তু গর্জে ওঠেন না! তুমি কি এসব টের পাচ্ছো না জয়ামাসি? জয়ার কথা : দু'মাস কোমায় থাকার সময়ে আমি যা দেখলাম যা শুনলাম তাতে বাঁচার ইচ্ছে মানুষের থাকার কথা নয়।

হয়তো এই অনিচ্ছাই মানুষকে আর কোমা থেকে জাগতে দেয় না। যাদের বাঁচার ইচ্ছে প্রবল থাকে তারাই হয়তো কোমা থেকে ফিরে আসে। গত দু'মাসে আমি যা দেখলাম, শুনলাম তাতে কি সত্যি সত্যি আমার বাঁচার আর ইচ্ছে হয় না? বিষয়টা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। আমার বড় ছেলে তাপস আর তার বউ আমারই পাশে দাঁড়িয়ে যখন কথা বলছেআমি সাগ্রহে কান পেতে অপেক্ষা করছিলাম এই আশা নিয়ে যে ওরা আমার জন্যে কতটা উদ্বিগ্ন সে কথাই বলাবলি করবে। আমার অভাবে সংসারে যে কতবড় শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে ওরা তাই নিয়ে কথা বলবে।

ওরা সে-সব কিছুই বলেনি। তপতী আমার ঘরের নির্জনতার সুযোগে তাপসকে পরামর্শ দিচ্ছিল-- --কতদিন এভাবে উনি পড়ে থাকবেন তার তো কোনো ঠিক নেই। ওঁকে বাড়িতে নিয়ে গেলেই তো হয়-- --এই অবস্থায় বাড়িতে নেওয়া যায়? কে দেখাশোনা করবে? তারচেয়েও বড় কথা বাড়িতে এরকম রোগের ট্রিটমেন্ট হয় না। চব্বিশঘন্টা ডাক্তারের নজরে থাকা দরকার। --তুমি কি বিশ্বাস করো উনি আবার সুস্থ হয়ে উঠবেন? --কি বলতে চাও তুমি--আমার মা লস্ট কেস? বলতে বলতে দৃশ্যত:ই ভেঙ্গে পড়লো তাপস।

আমি পাশ থেকে বলে উঠলাম-- --বোকার মতো কাঁদিস না যেন বাবা--আর দু'চারদিন অপেক্ষা কর। যদি আমার বেঁচে ওঠার ইচ্ছেটা আর একটু বেড়ে যায় তাহলে কোমা থেকে উঠে বসতে পারি। তাপস আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল চুপচাপ। বুঝলাম আমার কথা ও শুনতেই পায়নি। ওর বুকের ভেতর ঝড় বইছে।

মা-পাগলা ছেলেদুটো আমার বেঁচে ওঠার অপেক্ষায় মুহূর্ত গুণছে। মেয়ে দুটো ধরেই নিয়েছে আমার আর কোনো আশাই নেই। তাই এখন আর ঘন ঘন আসে না। মাঝে মধ্যে বরের সঙ্গে মার্কেটিংয়ে বেরুলে ফেরার পথে ঘুরে যায়। ওদিকে কাজলের ওপর দিয়ে রোলার চালাচ্ছে তপতী।

আজ আমার মৃত্যু ঘোষণা হলেই তপতী কাজলকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে। কিন্তু তাপস আর দীপু কি তা হতে দেবে? জোর দিয়ে বলা কঠিন। আমি না থাকলে তপতীর ওপরেই সকলকে নির্ভর করতে হবে। আমার সমস্যা তো শুধু আমার ছেলেমেয়েদের সুখ-শান্তি নিয়েই নয়। শুধু কাজলকে নেয়েও নয়।

ওঁকে কে দেখবে। এই তো গত বছরেই একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে। মানসিকভাবে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছেন সে তো আমি জানি। সবাই কপালে সিঁদুর নিয়ে মরতে চায়--কিন্তু আমি ওঁকে বলেছিলাম উনি বেঁচে থাকতে আমি মরবো না। ওঁকে অসহায় রেখে যাবো না।

আমার সে অঙ্গীকার কি ব্যর্থ হবে? সময়ে ওষুধ খাওয়ানো, মেজাজ বুঝে খেতে দেওয়া, হাতের কাছে প্রয়োজনীয় সবকিছু গুছিয়ে রাখা--এসব আমি না থাকলে কাজল নিশ্চয়ই করতো। কিন্তু কাজলকে তাড়িয়ে দিলে কি হবে? মানুষটা একেবারে অসহায় হয়ে পড়বে না? শেষের কটা দিন বড় কষ্টের মধ্যে দিয়ে কাটবে। ভাবতেই আমার বুকের ভেতরের হাওয়া নি:শেষ হওয়ার উপক্রম! প্রবলভাবে আমি হাত নেড়ে নেড়ে মৃত্যুকে ঠেকাবার চেষ্টা করছি। প্রবলভাবে আমার মধ্যে বাঁচার ইচ্ছে তৈরি হচ্ছে! আমার বিছানার পাশে ঠিক এই মুহূর্তে তিনি প্লাস্টিকের টুলের ওপর চুপচাপ বসে আছেন। আমার পায়ের কাছে বসে আছে কাজল।

আমার ডান দিকে তাপসও একটা টুলের ওপর বসে আছে। গতরাতে নাকি আমার অবস্থার অবনতি হয়েছিল। আসলে গত রাতে আমি আমার মৃত্যুকে ঠেকাবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলাম। তীব্র উত্তেজনায় আমি বিছানা ছেড়ে নেমে ছুটে নার্সিংহোম থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছিলাম। কিন্তু কয়েকজন ডাক্তার আমার মুখের ওপর হুমড়ি খেয়ে থাকায় তা সম্ভব হয়নি।

এই মুহূর্তে আমি একদৃষ্টে ওঁকে লক্ষ্য করছিলাম। এতদিন একবারের জন্যেও বুঝতে দেননি আমার থাকা না থাকাটা কতটা গুরুত্বপর্ণ ব্যাপার তাঁর কাছে। আমার অবস্থার অবনতির কথা শুনে সকাল হতে না হতেই ছুটে এসেছেন আমার পাশে। আমি সকলের মুখের দিকে একবার করে তাকালাম। তাপসের চোখে জল।

কাজলের উদভ্রান্ত দৃষ্টি--আহা বেচারি! ওঁরও চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছে। আমি তাপসের নাম ধরে প্রাণপণে ডাকলাম--তাপস তোর বাবার আবার স্ট্রোক হতে যাচ্ছে--ডাক্তারকে এক্ষুণি একবার ডাক বাবা! কেউ কিচ্ছু শুনছে না। আমি প্রবলভাবে হাত নাড়ছি পা ছুঁড়ছি--প্রবল শব্দে ডাক্তারকে ডাকছি! উনি চমকে উঠে আমার হাত চেপে ধরলেন। সবাই হৈ-হৈ করে উঠলো। আমার বাঁচার উচ্ছের কাছে মৃত্যু কি শেষপর্যন্ত হার মানছে? (শেষ) এই গল্পের প্রথমাংশ কেন জানিনা প্রথম পাতায় আসেনি।

অতএব সম্পূর্ণ গল্প পড়তে হলে আমার ব্লগে যেতে হবে গল্পরসিকদের।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।