কুরআন, হাদীস ও বিবেক-বুদ্ধি অনুযায়ী
শাফায়াত দ্বারা কবীরা গুনাহ বা দোযখ থেকে
মুক্তি পাওয়া যাবে কি?
-প্রফেসর ডাঃ মোঃ মতিয়ার রহমান
মূল বিষয়
শাফায়াত ইসলামের একটি মূল বিষয়। কেউ, শাফায়াতে বিশ্বাস না করলে তার ঈমান থাকবে না। বর্তমান মুসলিম সমাজে শাফায়াত সম্বন্ধে ব্যাপকভাবে চালু থাকা তথ্যগুলো হল-
১. নবী-রাসূলগণসহ বিভিন্ন ধরনের মানুষেরা পরকালে শাফায়াত করবেন।
২. শাফায়াতের মাধ্যমে মু’মিনের কবীরা গুনাহও মাফ হয়ে যাবে।
৩. দোযখের শাস্তি ভোগ করছে এমন মুমিন ব্যক্তিদেরও শাফায়াতের মাধ্যমে দোযখ থেকে বের করে এনে বেহেশতে পাঠিয়ে দেয়া হবে।
৪. কাফির ব্যক্তিরা শাফায়াতের মাধ্যমে দোযখ হতে মুক্তি পাবেন এমন ধারণা কেউ পোষণ করেন না।
শাফায়াত সম্বন্ধে ঐ সকল ধারণার বাস্তব যে কুফল মুসলিম সমাজে বর্তমানে দেখা যায় তা হল-
১. শাফায়াতের মাধ্যমে মাফ পেয়ে যাবে মনে করে মুসলিমরা এমন কাজ করছে বা এমন কাজ ছেড়ে দিচ্ছে যা না করলে বা করলে কবীরা গুনাহ হবে বা দোযখে যেতে হবে বলে কুরআন বা সূন্নাহ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে।
২. শাফায়াত করতে পারবে ধারণা করে লোকেরা জীবিত অনেক মানুষকে, ইসলাম নিষেধ করেছে এমন উপায়ে খুশী করার চেষ্টা করছে।
৩. কবরে শুয়ে থাকা ব্যক্তির শাফায়াত পাওয়ার আশায় কবর পূজা করছে।
৪. কিছুলোক শাফায়াতের লোভ দেখিয়ে নানাভাবে মানুষকে প্রতারিত করছে।
ঈমান ও আমলের উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর সকল মানুষ জীবিত অবস্থায় এবং মৃত্যুর সময় যে সকল বিভাগে বিভক্ত থাকবে
মু’মিন হল সেই ব্যক্তি যে কালেমা তৈয়্যেবার ব্যাখ্যাসহ অর্থটি অন্তরে বিশ্বাস করে এবং মুখে তার ঘোষণা দেয়। অন্তরের বিশ্বাসটাই আল্লাহ দেখেন। মুখের ঘোষণাটি অন্য মানুষের বোঝার জন্যে যে, ব্যক্তিটি ঈমান এনেছে।
কাফির বলে সেই ব্যক্তিকে যে কালেম তৈয়্যেবার ব্যাখ্যাসহ অর্থটি অন্তরে বিশ্বাস করে না।
নেক্কার মু’মিন হল সেই ব্যক্তি যে গুনাহ করেনি বা তাওবার মাধ্যমে মাফ করিয়ে নেয়ার কারণে যার আমলনামায় গুনাহ উপস্থিত নাই।
মুসলিম হল সর্বনিম্ন স্তরের নেক্কার মু’মিন।
মুত্তাকী হল মধ্যম স্তরের নেক্কার মু’মিন।
মুহসিন হল সর্বউচ্চ স্তরের নেক্কার মু’মিন
ছগীরা গুনাহগার মু’মিন হল সেই মু’মিন যে প্রায় সমান গুরুত্ব বা পরিমাণের ওজর, অনুশোচনা ও উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টাসহ এক বা একাধিক করণীয় কাজ ছেড়ে দেয় বা নিষিদ্ধ কাজ করে।
মধ্যম (না ছগীরা না কবীরা) গুনাহগার মু’মিন হল সেই মু’মিন যে মধ্যম (৫০%) গুরুত্ব বা পরিমাণের ওজর, অনুশোচনা ও উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টাসহ এক বা একাধিক করণীয় কাজ ছেড়ে দেয় বা নিষিদ্ধ কাজ করে।
সাধারণ কবীরা গুনাহগার মু’মিন বলে সেই মু’মিনকে যে প্রায় না থাকার মত গুরুত্ব বা পরিমাণের ওজর, অনুশোচনা ও উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টাসহ এক বা একাধিক বড় করণীয় আমল ছেড়ে দেয় বা নিষিদ্ধ কাজ করে।
কুফরীর কবীরা গুনাহগার মু’মিন হল সেই মু’মিন যে ইচ্ছা করে, খুশী মনে, ঘৃণাসহকারে বা কোন ধরনের ওজর, অনুশোচনা ও উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা ব্যতীত এক বা একাধিক বড় বা ছোট করণীয় কাজ ছেড়ে দেয় বা নিষিদ্ধ কাজ করে।
প্রকাশ্য কাফির হল সেই কাফির যে কালেমা তাইয়্যেবার ব্যাখ্যাসহ অর্থটি মনে বিশ্বাস করে না এবং প্রকাশ্যে তার ঘোষণাও দেয়।
গোপন কাফির বলে সেই কাফিরকে যে প্রকাশ্যে ঈমান আনার ঘোষণা দেয় কিন্তু অন্তরে ঈমান আনে না। এরাই হল সবচেয়ে খারাপ ধরনের কাফির।
সাধারণ কাফির হল সেই প্রকাশ্য কাফিররা যারা অন্যরা ইসলাম পালন করল কি করল না সে বিষয়ে কোন মাথা ঘামায় না।
তাগুত কাফির বলে সেই প্রকাশ্য কাফিরদের যারা অন্যদের ইসলাম পালনে নানাভাবে বাধা দেয়।
(বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি ‘পবিত্র কুরআন হাদীস ও বিবেক-বুদ্ধি অনুযায়ী গুনাহের সংজ্ঞা ও শ্রেণীবিভাগ’ নামক বইটিতে)
ইসলামে দুনিয়ায় গুনাহ মাফ হওয়ার উপায়সমূহ
ইসলামে দুনিয়ায় গুনাহ মাফ হওয়ার উপায় দুটি
১. তাওবা
২. নেক আমল
তাওবার মাধ্যমে মানুষের হক ফাঁকি দেয়ার গুনাহ বাদে সকল ধরণের গুনাহ মাফ হয়ে যায়। কিন্তু সে তাওবা হতে হবে মৃত্যু আসার মুক্তিসংগত সময় পূর্বে। অর্থ্যৎ মৃত্যু ঘটার এমন সময় পূর্বে যখন ব্যক্তির একটি গুনাহ করার সুযোগ আসলে স্বজ্ঞানে ও সমতায় তা হতে দূরে থাকার মত অবস্থা থাকে।
আর মানুষের হক ফাঁকি দেয়ার গুনাহ সে হক ফেরত দেয়ার আগ পর্যন্ত মাফ হয় না।
তবে যার হক ফাঁকি দেয়া হয়েছে তাকে কোনভাবে খুঁজে পাওয়া সম্ভব না হলে সে হক গুনাহ মাফের আশায় কোন জনকল্যাণমূলক কাজে দান করে দিয়ে আল্লাহর নিকট মা চাইতে হবে।
নেক আমলের মাধ্যমে শুধুমাত্র ছগীরা গুনাহ মাফ হয়।
(বিষয়টি নিয়ে আলোচনা আছে ‘কুরআন হাদীস ও বিবেক-বুদ্ধি অনুযায়ী কবীরা গুনাহ সহ মৃত্যুবরণকারী মু’মিন দোযখ থেকে মুক্তি পাবে কি?’ নামক বইটিতে)
শাফায়াত শব্দের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ
শাফায়াত শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে সুপারিশ, মাধ্যম বা দোয়া। আর পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে পরকালে অপরের গুনাহ বা শাস্তি মুক্তির জন্যে আল্লাহর নিকট করা সুপারিশ।
মৃত্যুর পর তাওবার মাধ্যমে গুনাহ মাফ পাওয়ার আর কোন সুযোগ থাকবে না।
কিন্তু দয়াময় আল্লাহ মৃত্যুর পরও মানুষের গুনাহ মাফ হওয়ার ব্যবস্থা রেখেছেন। সে ব্যবস্থা হচ্ছে শাফায়াত।
যে সকল সত্তা শাফায়াত করবেন বা করতে পারবেন
ক. মহান আল্লাহ শাফায়াতকারী
মহান আল্লাহ যে শাফায়াতকারী হবেন এবং তাঁর শাফায়াতের কয়েকটি দিক কুরআন হাদীসে এভাবে এসেছে-
আল-কুরআন
তথ্য-১
অর্থ: (হে নবী,) বলে দিন সকল শাফায়াত সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর ইখতিয়ারে। (শাফায়াতসহ) আকাশ ও পৃথিবীর সকল বিষয়ের সার্বভৌম কর্তৃত্ব শুধু তাঁরই। (যুমার : ৪৪)
তথ্য-২
অর্থ: তিনি ব্যতীত তোমাদের জন্যে না আছে কোন (স্বাধীন) সাহায্যকারী এবং না আছে কোন (স্বাধীন) শাফায়াতকারী (সাজদাহ : ৪)
তথ্য-৩.
অর্থ: তিনি (আল্লাহ) ছাড়া তাদের জন্যে কোন (স্বাধীন) অভিভাবক ও সুপারিশকারী নেই।
(আনআম : ৫১)
তথ্য-৪
অর্থ: তবে কি তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে শাফায়াতকারী হিসেবে গ্রহণ করেছে? (যুমার : ৪৩)
আল-হাদীস
অর্থ: হে মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমা, আমার সম্পদ থেকে যা খুশি চাও (পরকালে) আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করার ব্যাপারে তোমার কোন উপকার করার মতা আমার নেই। (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যা: হাদীসখানি থেকে সহজে বুঝা যায় পরকালে অন্য কারো তো দূরের কথা, রাসূল (সা.) এরও শাফায়াতের মাধ্যমে স্বাধীনভাবে কারো গুনাহ মাফ করে নেয়ার মতা থাকবে না।
কুরআন ও হাদীসের উল্লিখিত তথ্যসমূহের আলোকে পরিষ্কারভাবে জানা ও বুঝা যায় পরকালে মূল শাফায়াতকারী অর্থাৎ-
কাউকে শাফায়াতের অনুমতি দেয়া না দেয়ার স্বাধীন মতার
অধিকারী,
কারো শাফায়াত কবুল করা না করার স্বাধীন মতার অধিকারী এবং
নিজ ইচ্ছায় গুনাহ মাফ করার অধিকারী সত্তা হবেন মহান আল্লাহ।
তাই দুনিয়ার কোন ব্যক্তিকে নজর-নিয়াজ দিয়ে খুশি করতে পারলে তিনি জোর করে আল্লাহর নিকট থেকে শাফায়াত আদায় করে দিতে পারবেন, এ ধারণা পোষণ করা এবং সে অনুযায়ী কাজ করার অর্থ যে কুরআন ও হাদীসের উল্লিখিত স্পষ্ট বক্তব্যগুলোকে অস্বীকার করার গুনাহ, তা বুঝা মোটেই কঠিন নয়, যদি বুঝতে চাওয়া হয়।
খ. কুরআন শাফায়াতকারী
তথ্য-১
অর্থ: আবু উমামা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, তোমরা পবিত্র কুরআন পাঠ কর (জ্ঞান অর্জন কর) নিশ্চয়ই তা কিয়ামতের ময়দানে তার সাথীদের জন্যে সুপারিশ করতে উপস্থিত হবে।
(মুসলিম)
তথ্য-২
অর্থ: সাঈদ ইবনে সুলাইম (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট নবী, ফেরেশতা বা অন্য কেউ কুরআন হতে শ্রেষ্ঠ শাফায়াতকারী হতে পারবে না।
তথ্য-৩ .
অর্থ: জাবের (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন : কুরআন পাক এত বড় সুপারিশকারী যে, তার আবেদন রা করা হবে। এত বড় একরোখা জেদী যে, তার অভিযোগ মেনে নেয়া হবে। যে একে সম্মুখে রাখবে তাকে সে বেহেশতের দিকে টেনে নিয়ে যাবে। আর যে একে পিছনে ফেলে রাখবে, তাকে সে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে।
এ তথ্যগুলো থেকে জানা ও বুঝা যায়, পরকালে আল-কুরআন শাফায়াত করবে। আর আল-কুরআনের শাফায়াতের দু’টি বিশেষ দিক হবে-
আল্লাহর অনুমতিসাপেে কুরআন শাফায়াত করবে।
কুরআনের পরে বা বিরোধী শাফায়াতকে নবী-রাসূল (সা.) সহ কোন মানুষ বা ফেরেশতা খণ্ডাতে পারবে না। আর ইচ্ছাকৃতভাবে কুরআনের জ্ঞান অর্জন এবং সে জ্ঞান অনুযায়ী আমল না করলে, পরকালে কুরআন বিপে সাী দিবে তথা বিপে সুপারিশ করবে একথা কুরআন ও রাসূল (সা.) স্পষ্টকরে জানিয়ে দিয়েছেন।
গ. রাসূল মুহাম্মাদ (সা.) শাফায়াতকারী
আল-কুরআন
অর্থ: হে নবী, সে ব্যক্তিকে (শাফায়াতের মাধ্যমে) কে বাঁচাতে পারে, যার উপর আযাবের ফয়সালা হয়ে গেছে।
তুমি কি তাকে (শাফায়াতের মাধ্যমে) বাঁচাতে পারবে যাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে? (যুমার : ১৯)
ব্যাখ্যা: এখানে প্রথমে আল্লাহ বলেছেন যার উপর শাস্তির সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে তাকে কেউই শাফায়াতের মাধ্যমে বাঁচাতে পারবে না। তারপর রাসূল (সা.) কে নির্দিষ্ট করে বলেছেন যাকে আল্লাহ দোযখে পাঠিয়ে দিয়েছেন তাকে শাফায়াতের মাধ্যমে তিনিও বাঁচাতে পারবেন না। এখান থেকে বোঝা যায় নবী-রাসূলগণ শাফায়াত করার অধিকারী হবেন।
আল-হাদীস
তথ্য-১
অর্থ: আমিই (রাসূল সা.) প্রথম শাফায়াতকারী ও আমার শাফায়াতই প্রথমে গ্রহণ করা হবে। (বুখারী, মুসলিম)
তথ্য-২
পূর্বে উল্লিখিত (পৃষ্ঠা নং ২১) হাদীসখানি যেখানে রাসূল (সা.) তাঁর কন্যা ফাতেমা (রা.) কে বলেছেন, কিয়ামতের দিন (স্বাধীনভাবে) তিনি শাফায়াত বা অন্য কোনভাবে তাঁর কোন উপকারে আসতে পারবেন না।
কুরআন ও হাদীসের উল্লিখিত তথ্যগুলো থেকে বুঝা যায়, রাসূল মুহাম্মাদ (সা.) শাফায়াত করবেন এবং তিনিই প্রথম শাফায়াতকারী হবেন।
ঘ. অন্য নবী-রাসূলগণ ও সাধারণ মানুষ শাফায়াতকারী
আল-কুরআন
পূর্বে উল্লিখিত সূরা যুমায়ের ১৯ নং আয়াতের আলোকে বোঝা যায় অন্য নবী-রাসূলগণ ও অন্য কিছু মানুষ পরকালে শাফায়াত করতে পারবেন।
আল-হাদীস
অর্থ: তিন ধরনের লোক কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবেন (করার অনুমতি পাবেন) নবীগণ, আলেমগণ ও শহীদগণ। (ইবনে মাজাহ, বায়হাকী)
ব্যাখ্যা: নবী-রাসূলগণ বাদে অন্য যে সকল মানুষ শাফায়াত করার অনুমতি পাবেন, তাদের নিশ্চয়ই সকল গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে অর্থাৎ নিষ্পাপ (নেককার মু’মিন) হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হবে। কারণ, তা না হলে তাদের নজেদেরই অন্য কারো শাফায়াতের মাধ্যমে শাস্তি থেকে রেহাই পেতে হবে।
সহজেই বুঝা যায় এ ধরনের মানুষের সংখ্যা খুবই নগণ্য হবে।
ঙ. ফেরেশতাগণ শাফায়াতকারী
ফেরেশতাগণ শাফায়াত করবেন তা জানা ও বুঝা যায় সূরা আম্বিয়ার ২৮ নং, নজমের ২৬ নং আয়াত এবং কিছু হাদীসের (পরে আসছে) মাধ্যমে।
শাফায়াত শেষ বিচারের দিন আল্লাহর রায় ঘোষণার আগে না পরে অনুষ্ঠিত হবে?
প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এর সঠিক উত্তরের সঙ্গে পুস্তিকার আলোচ্য বিষয়টি সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। তাই চলুন, বিবেক-বুদ্ধি, কুরআন ও হাদীসের মাধ্যমে উত্তরটি ভালভাবে জেনে ও বুঝে নেয়া যাক-
বিবেক-বুদ্ধি
বিবেক-বুদ্ধি বলে পরকালে শাফায়াত তথা সুপারিশের মাধ্যমে গুনাহ মাফ পেতে হলে, তা হতে হবে আল্লাহ বিচার-ফয়সালা করে শাস্তি ঘোষণা করা তথা দোযখে পাঠিয়ে দেয়ার আগে। কারণ-
ক. আল্লাহর শাস্তি ঘোষণা করা বা দোযখে পাঠিয়ে দেয়ার পর শাফায়াতের মাধ্যমে তা পরিবর্তন করার অর্থ হচ্ছে-
১. আল্লাহর বিচারে ভুল থাকা,
২. অন্য কারো দ্বারা আল্লাহর সিদ্ধান্তকে পাল্টাতে বাধ্য করা।
এরকম অবস্থার কথা চিন্তা করাও কুফরীর গুনাহ।
খ. একজন বিচারক বিচার করে ফায়সালা দিয়ে দিলে উচ্চতর আদালতে আবেদন ও পুনর্বিবেচনার মাধ্যমেই শুধু সে রায় পরিবর্তন হতে পারে। একই আদালতে একই বিচারকের মাধ্যমে তা আর হয় না। পরকালের আদালতে সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী একজনমাত্র বিচারক থাকবেন। তিনি হবেন মহান আল্লাহ।
তাই শাফায়াত হতে হবে আল্লাহর বিচার-ফয়সালা করে রায় ঘোষণার আগে।
আল-কুরআন
তথ্য-১
অর্থ: (হে নবী,) সে ব্যক্তিকে কে বাঁচাতে পারবে, যার উপর শাস্তির ফয়সালা হয়ে গিয়েছে? তুমি কি তাকে বাঁচাতে পারবে যাকে আগুনে (দোযখে) পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে? অবশ্য যারা তাদের রবকে ভয় করে চলে তাদের জন্যে তৈরি রয়েছে প্রাসাদের উপর প্রাসাদ, যার তলদেশ দিয়ে ঝর্নাধারা প্রবাহিত। এটা আল্লাহর ওয়াদা। আর আল্লাহ কখনও নিজের কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। (যুমার : ১৯, ২০)
ব্যাখ্যা: মহান আল্লাহ এখানে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন শেষবিচার দিনে বিচারের রায় ঘোষণার পর নবী-রাসূল (সা.) গণ সহ কেউই শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে তার শাস্তি ভোগ করা থেকে বাঁচাতে পারবে না।
শাফায়াতের অনুষ্ঠান পরকালে হবে এটি কুরআন ও হাদীসের আলোকে নিশ্চিত। তাই এ আয়াতের আলোকে সহজেই বলা যায় শাফায়াত হবে শেষবিচারের দিন আল্লাহর রায় ঘোষণার আগে।
তথ্য-২
পূর্বাল্লিখিত আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের আলোকে আমরা নিশ্চিতভাবে জেনেছি যে, আল্লাহ্ বিচার করে যাদের দোযখে পাঠিয়ে দিবেন তাদের চিরকাল সেখানে থাকতে হবে। তাই শাফায়াতের মাধ্যমে গুনাহ মাফ করাতে হলে সে শাফায়াত অবশ্যই আল্লাহর বিচারের রায় ঘোষণার আগে হতে হবে।
আল-হাদীস
পূর্বে উল্লিখিত (পৃষ্ঠা নং ২১) হাদীসখানিতে রাসূল (সা.) জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর কন্যা ফাতেমাসহ কোন মানুষকেই পরকালের বিচারের সময় আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করার ব্যাপারে তিনি স্বাধীনভাবে কোন উপকার করতে পারবেন না।
বিচার অনুষ্ঠানের সময় রাসূল (সা.) যদি কাউকে কোন উপকার করতে না পারেন তবে বিচারের মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে দোযখে পাঠিয়ে দেয়ার পর আল্লাহর সিদ্ধান্তকে শাফায়াতের মাধ্যমে আবার পরিবর্তন করাতে পারার প্রশ্নই আসে না।
কুরআন, হাদীস ও বিবেক-বুদ্ধির এ সকল তথ্যের আলোকে নিশ্চয়তাসহকারে বলা যায় শাফায়াত হবে শেষবিচারের দিন মহান আল্লাহর বিচারের রায় ঘোষণার আগে।
শাফায়াত করার অনুমতি পাওয়ার যোগ্যতা
বিবেক-বুদ্ধি
যে ব্যক্তি অন্যের গুনাহ মাফের জন্যে আল্লাহর নিকট শাফায়াত করবেন তাকে অবশ্যই যোগ্য হতে হবে। সাধারণ বুদ্ধিতে সহজেই বোঝা যায় যার নিজের জন্যে শাফায়াত লাগবে সে অন্যের জন্যে শাফায়াত করার যোগ্য হতে পারে না। তাই শাফায়াত করার যিনি যোগ্য হবেন তার আমলনামায় কোন গুনাহ থাকা চলবে না।
অর্থাৎ তাদের নেক্কার মু’মিন হিসেবে মৃত্যুবরণ করতে হবে। আবার এটিও সহজে বোঝা যায় নিম্নস্তরের নেক্কার মু’মিনগণের (মুসলিম) চেয়ে সর্বোচ্চ স্তরের নেক্কার মু’মিনগণের (মুহসিন) শাফায়াতের অনুমতি পাওয়া বেশি মুক্তিসংগত
আল-কুরআন
তথ্য-১.১.
অর্থ: কে আছে এমন যে (আল্লাহর) অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট শাফায়াত করতে পারবে? (বাকারা : ২৫৫)
তথ্য-১.২
অর্থ: তাঁর (আল্লাহর) অনুমতি ছাড়া শাফায়াত করার কেউ নেই।
(ইউনুস : ৩)
তথ্য-১.৩
অর্থ: এমন একদিন আসবে যে দিন আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ কথা বলতে পারবে না। (হুদ : ১০৫)
সম্মিলিত ব্যাখ্যা
আল-কুরআনের এই তথ্যগুলো থেকে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, পরকালে শাফায়াতকারীকে শাফায়াত করার জন্যে আল্লাহর নিকট থেকে অনুমতি নিতে হবে। আর অনুমতি নেয়ার শর্ত রাখা থেকেই বুঝা যায়, আল্লাহ সকলকে শাফায়াতের অনুমতি দিবেন না।
ঈমান ও আমলের ভিত্তিতে যাকে তিনি যোগ্য মনে করবেন, তাকেই শুধু তিনি শাফায়াত করার অনুমতি দিবেন। কিন্তু কী হবে সেই যোগ্যতা তা এ আয়াতখানি হতে বোঝা যায় না।
তথ্য-২
অর্থ: তাঁকে (আল্লাহকে) বাদ দিয়ে এই লোকেরা যাদের ডাকে তাদের শাফায়াত করার কোন মতাই নেই। ঐ লোকেরা ব্যতীত যারা জ্ঞানের ভিত্তিতে সত্যের স্যা দেয়। (যুখরুফ : ৮৬)
ব্যাখ্যা: আয়াতে কারীমায় আল্লাহ প্রথমে বলেছেন, পরকালে তিনি ব্যতীত অন্য কারো শাফায়াত করার স্বাধীন মতা নেই।
সবাইকে তাঁর অনুমতি নিয়ে শাফায়াত করতে হবে। এরপর আল্লাহ্ পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি শাফায়াতের অনুমতি দিবেন তাদের যারা দুনিয়ায় জ্ঞানের ভিত্তিতে সত্যের স্যা দিয়েছে। চিরসত্য জ্ঞান হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহের জ্ঞান। তাই জ্ঞানের ভিত্তিতে সত্যের স্যা দেয়ার অর্থ হচ্ছে, ঐ সত্যকে জেনে ও বুঝে নিয়ে (না জেনে না বুঝে নয়), বাস্তব কাজের মাধ্যমে তার সত্যতার স্যা দেয়া।
তাহলে মহান আল্লাহ এ আয়াতের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন, পরকালে শাফায়াতের অনুমতি পাবে বা অনুমতি পাওয়ার যোগ্য হবে শুধু সেই ব্যক্তিরা, যারা কুরআন ও সুন্নাহের বক্তব্যকে সকল দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিকভাবে জেনে ও বুঝে নিয়ে সে অনুযায়ী আমল করেছে।
কারণ জানা ও বুঝা না থাকলে অবশ্যই আমলে ভুল হবে বা আমল বাদ যাবে। এটা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কঠিন শর্ত। এখান থেকে বুঝা যায়, শাফায়াতের অনুমতি খুব কম ব্যক্তি বা সত্তারাই পাবেন। আর সাধারণ জ্ঞানে বোঝা যায় নবী-রাসূলগণ বাদে সেই ব্যক্তিরা হবে তারা যারা, ঈমান ও আমলের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ স্তরের নেককার মু’মিন হিসেবে ইন্তেকাল করবেন।
আল-হাদীস
. অর্থ: উম্মুল আ’লা (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, আল্লাহর কসম, আল্লাহর কসম, (আখিরাতে) আমার সাথে কী আচরণ করা হবে, তা আমি জানি না।
আর এটাও আমি জানি না (সে দিন) তোমাদের সাথে কী ব্যবহার করা হবে। অথচ আমি আল্লাহর রাসূল। (বুখারী)
ব্যাখ্যা: রাসূল (সা.) দু’বার আল্লাহর কসম খেয়ে অর্থাৎ অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, পরকালে তাঁর সঙ্গে এবং সাহাবায়ে কিরামদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করা হবে তা রাসূল হওয়া সত্ত্বেও তিনি জানেন না।
পরকালে আচরণ করার স্বাধীন মতা থাকবে শুধু মহান আল্লাহর। সে দিন তিনি প্রধানত দু’ধরনের আচরণ বা কাজ করবেন।
যথা-
ক. বিচার করে চূড়ান্ত পুরস্কার বা শাস্তি দেয়া এবং
খ. যোগ্য ব্যক্তিকে শাফায়াত করার অনুমতি দেয়া।
রাসূল (সা.) কে বিচার করে শাস্তি দেয়ার প্রশ্ন আসে না। তাই রাসূল (সা.) যে বলেছেন, তাঁর সঙ্গে কী আচরণ করা হবে তা তিনি জানেন না এ কথাটির একটিমাত্র অর্থ হবে। আর সে অর্থ হচ্ছে পরকালে শাফায়াতের অনুমতি দেয়া না দেয়ার ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে কী আচরণ করা হবে, তা তিনি জানেন না।
রাসূল (সা.) এর ন্যায় ব্যক্তি বলছেন, তিনি জানেন না তাঁকে শাফায়াতের অনুমতি দেয়া হবে কিনা।
এখান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় নবী-রাসূল বাদে অন্য যারা শাফায়াতের অনুমতি পাবেন তাদের মুহসিন মানের নেক্কার মু’মিন হতে হবে।
কুরআন, হাদীস ও বিবেক-বুদ্ধির এ সকল তথ্যের আলোকে স্পষ্টভাবে জানা যায় শাফায়াত করার জন্যে আল্লাহর নিকট থেকে অনুমতি নিতে হবে। আর নবী-রাসূল বাদে শুধুমাত্র মুহসিন স্তরের নেক্কার মু’মিনগণ শাফায়াত করার যোগ্য বলে বিবেচ্য হতে পারেন।
শাফায়াতের মাধ্যমে যে ধরনের গুনাহ মাফ হবে না
বিবেক-বুদ্ধি
তথ্য-১
দয়াময় আল্লাহ কুরআন সুন্নাহের মাধ্যমে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন মৃত্যুর যুক্তিসঙ্গত সময় পূর্বে খালিস নিয়াতে তওবা করে পরিপূর্ণ ইসলামে ফিরে আসলে তিনি মু’মিন ব্যক্তিদের (মানুষের হক ফাঁকি দেয়ার গুনাহ ব্যতীত) সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন। যে দুষ্ট মু’মিন আল্লাহর দেয়া এই অপূর্ব সুযোগ গ্রহণ না করে কবীরা গুনাহসহ তথা সমাজে বড় অশান্তি সৃষ্টিকারী অন্যায় কাজসহ মৃত্যুবরণ করল তার ঐ কবীরা গুনাহ পরকালে শাফায়াতের মাধ্যমে মাফ হওয়ার মুক্তিসংগত (বিবেক-সম্মত) নয়।
তথ্য-২
ইসলাম কবর পূজা, পীর পূজা ইত্যাদি বন্ধ করতে চায়। শাফায়াতের মাধ্যমে পরকালে কবীরা গুনাহ মাফ হয়ে যাবে তথ্যটি ঐ ধরনের কাজ করার জন্যে মানুষকে দারুণভাবে উৎসাহিত করে। তাই শাফায়াতের মাধ্যমে কবীরা গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। এ ধরনের কথা ইসলামের তথ্য হওয়ার কথা নয়।
আল-কুরআন
তথ্য-১
অর্থ: অবশ্যই আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করবেন, যারা অজ্ঞতা বা ভুলের কারণে গুনাহের কাজ করে বসে।
অতঃপর অনতিবিলম্বে তওবা করে নেয়। এরাই হল সে সব লোক, যাদের আল্লাহ মা করে দেন। আল্লাহ সর্ববিষয় অভিজ্ঞ ও অতীব বুদ্ধিমান। আর এমন লোকদের জন্যে কোন মা নেই, যারা অন্যায় কাজ করে যেতেই থাকে যতণ না তাদের মৃত্যু উপস্থিত হয়। তখন তারা বলে, আমি এখন তওবা করছি।
অনুরূপভাবে তাদের জন্যেও কোন মা নেই যারা মৃত্যু পর্যন্ত কাফির থেকে যায়। এদের জন্যে আমি কঠিন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি।
(নিসা : ১৭, ১৮)
ব্যাখ্যা: মহান আল্লাহ এ আয়াত দু’খানির মাধ্যমে প্রথমে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি অবশ্যই সে ঈমানদারদের মা করে দিবেন যারা অজ্ঞতা, ভুল বা ধোঁকায় পড়ে পাপ কাজ করে ফেলার সাথে সাথে তওবা করবে অর্থাৎ খালিস নিয়াতে তাঁর নিকট মা চাইবে এবং পরবর্তীতে সেই গুনাহের কাজ করা থেকে বিরত থাকবে।
এরপর আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন, যে সকল মু’মিন ব্যক্তি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অব্যাহতভাবে গুনাহের কাজ করে যাবে এবং মৃত্যু উপস্থিত হলে তওবা করবে, তাদের তিনি মা করবেন না।
আল্লাহ এখানে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন মু’মিন ব্যক্তি মৃত্যুর যুক্তিসংগত পূর্বে তাওবা করে মাফ করিয়ে না নিয়ে গেলে তিনি আর তাদের গুনাহ মাফ করবেন না।
তাই এ দু’খানি আয়াতের আলোকে এতটুকু নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, পরকালে শাফায়াতের মাধ্যমে গুনাহ মাফ হলেও তাতে কবীরা গুনাহ মাফ হবে না।
তথ্য-২.
অর্থ: যে সকল গুনাহ হতে তোমাদের (মু’মিনদের) বিরত থাকতে বলা হয়েছে তার মধ্যকার বড় (কবীরা) গুলো হতে যদি বিরত থাকতে পার তবে তোমাদের অন্য গুনাহসমূহ আমি নিজ থেকে রহিত (মাফ) করে দিব এবং তোমাদের সম্মানের স্থানে (বেহেশতে) প্রবেশ করাব। (নিসা : ৩১)
ব্যাখ্যা: আল্লাহ এখানে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন ঈমানদার ব্যক্তিরা কবীরা গুনাহ থেকে মুক্ত থাকতে বা মুক্ত হতে পারলে তাদের অন্য সকল গুনাহ তিনি নিজ থেকে কোন না কোনভাবে মাফ করে দিয়ে বেহেশত দিয়ে দিবেন।
কবীরা গুনাহ থেকে মুক্ত থাকা বা মুক্ত হওয়ার উপায় হচ্ছে কবীরা গুনাহ না করা বা কবীরা গুনাহ হয়ে গেলে মৃত্যুর যুক্তিসঙ্গত সময় পূর্বে খালিস নিয়তে তওবা করে মাফ করিয়ে নেয়া। আর মৃত্যুর পর গুনাহ মাফের উপায় হচ্ছে শাফায়াত বা আল্লাহর নিজ ইচ্ছা।
তাহলে এ আয়াতে কারীমার মাধ্যমে মহান আল্লাহ পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন তওবার মাধ্যমে কবীরা গুনাহ মাফ করিয়ে নিয়ে যে মু’মিন মৃত্যুবরণ করবে তার অন্য ধরনের গুনাহ থাকলে তা শাফায়াত বা নিজ ইচ্ছায় মাফ করে দিয়ে তিনি তাদের চিরকালের জন্যে বেহেশত দিয়ে দিবেন। তাই এ আয়াত থেকে জানা যায় শাফায়াতের মাধ্যমে কবীরা গুনাহ মাফ হবে না।
তথ্য-৩
অর্থ: আর পৃথিবী ও মহাকাশের সকল কিছুর উপর মতাবান মহান আল্লাহ। যেন তিনি গুনাহকারীদের তাদের আমলের প্রতিফল দেন এবং নেক আমলকারীদের দেন ভাল ফল। যারা বড় গুনাহ ও অশ্লীল কাজ থেকে বেঁচে থাকে তারা (কোন কারণে) ছোট-খাট গুনাহ করে থাকলে নিশ্চয়ই তোমার রবের মা সুদূর বিস্তৃত।
(নাজম : ৩১, ৩২)
ব্যাখ্যা: এ আয়াত দু’খানির মাধ্যমে আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন যে সকল মু’মিন কবীরা গুনাহ থেকে মুক্ত হতে বা মুক্ত থাকতে পারবে তাদের অন্য গুনাহ তিনি মাফ করে দিবেন। অর্থাৎ এ আয়াতের মাধ্যমেও আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন শাফায়াতের মাধ্যমে কবীরা গুনাহ তিনি মাফ করবেন না।
তথ্য-৪.
অর্থ: তোমাদের যা কিছু দেয়া হয়েছে তা শুধু দুনিয়ার কয়েক দিনের জন্যে। আর আল্লাহর নিকট যা রয়েছে (বেহেশতের সামগ্রী) তা অতীব উত্তম ও চিরস্থায়ী। সেগুলো হচ্ছে ঐ লোকদের জন্যে যারা ঈমান এনেছে এবং নিজেদের রবের উপর ভরসা রাখে।
আর যারা কবীরা (বড়) গুনাহসমূহ ও নির্লজ্জ কাজ থেকে বিরত থাকে এবং রাগ হলে মা করে দেয়। (শুরা : ৩৬, ৩৭)
ব্যাখ্যা: মহান আল্লাহ এখানে এবং পরের আয়াতে (৩৮ নং) কিছু বড় সওয়াব ও কিছু বড় (কবীরা) গুনাহ নাম ধরে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন বেহেশতের অধিকারী হবে শুধু সে মু’মিনরা যারা নাম উল্লেখ করাগুলোসহ অন্য সকল কবীরা গুনাহ হতে মুক্ত থাকবে। অর্থাৎ কবীরা গুনাহসহ মৃত্যুবরণকারী মু’মিন বেহেশত পাবে না। তাই এখান থেকেও স্পষ্টভাবে বোঝা যায় পরকালে শাফায়াত বা অন্যকোনভাবে কবীরা গুনাহ মাফ হবে না।
তথ্য-৫
অর্থ: এবং যে (মু’মিন বা কাফির) কোন মু’মিনকে অন্যায়ভাবে হত্যা করবে তার শাস্তি দোযখ।
সেখানে সে চিরকাল থাকবে। তার উপর আল্লাহর গযব ও অভিশাপ এবং তার জন্যে কঠিন শাস্তি নির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছে। (নিসা : ৯৩)
ব্যাখ্যা: কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা কবীরা গুনাহ। তাই আল্লাহ এ আয়াতের মাধ্যমে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, যে সকল মু’মিন একটি মাত্র কবীরা গুনাহসহ মৃত্যুবরণ করবে তাদের চিরকাল দোযখে থাকতে হবে। অর্থাৎ শাফায়াত বা অন্যকোনভাবে পরকালে কবীরা গুনাহ মাফ হবে না।
আল-হাদীস
তথ্য-১
অর্থ: হে মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমা, আমার সম্পদ থেকে যা কিছু খুশী চাও। (পরকালে) আল্লাহ নিকট জবাবদিহি করার ব্যাপারে তোমার কোনই উপকার করার মতা আমার নেই। (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যা: রাসূল (সা.) এখানে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন অন্যকারো ব্যাপারে তো দূরের কথা তার প্রাণপ্রিয় কন্যার গুনাহও পরকালে শাফায়াতের মাধ্যমে মাফ করিয়ে নেয়ার ব্যাপারে তিনি কিছুই করতে পারবেন না। তাই এ হাদীসের আলোকে সহজে বলা যায়, সকল ধরনের গুনাহ না হলেও কারো কবীরা গুনাহ যে রাসূল (সা.) শাফায়াতের মাধ্যমে মাফ করতে পারবেন না তা নিশ্চিত। আর রাসূল মুহাম্মাদ (সা.) শাফায়াতের মাধ্যমে যে ধরনের গুনাহ মাফ করতে পারবেন না, অন্য কোন ব্যক্তিও যে তা পারবেন না সেটিও নিশ্চিত করেই বলা যায়।
তথ্য-২
অর্থ: আমল কর এবং নিজের সাধ্য মত সর্বাধিক সংখ্যক সঠিক কাজ করার চেষ্টা কর এবং সত্যের কাছাকাছি থেক। জেনে রেখ, কোন ব্যক্তিকে শুধু তার আমল জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারবে না।
সাহাবায়ে কিরামগণ রাসূল (সা.) এর বক্তব্য শুনে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.), আপনার আমলও কি পারবে না? তিনি উত্তর দিলেন-
অর্থ: না, আমিও না, যদি না আমার রব তাঁর রহমত দ্বারা আমাকে আচ্ছাদিত করেন। (বুখারী, মুসলিম, আহমদ)
ব্যাখ্যা: আমলের ব্যাপারে অত্যন্ত বাস্তব যে কথাটি রাসূল (সা.) হাদীসখানির শেষে উল্লেখ করেছেন, সে কথাটি দিয়ে ব্যাখ্যা শুরু করলে পুরো হাদীসখানি বুঝতে সহজ হবে।
হাদীসখানির শেষে রাসূল (সা.) বলেছেন, নিখুঁতভাবে সকল আমলে সালেহ পালন করে পৃথিবীর কেউই এমনকি তিনিও জান্নাতে যেতে পারবেন না।
কারণ, সকলের জীবনেই কোন না কোন আমল করার ব্যাপারে কিছু না কিছু খুঁৎ থাকবেই। আর ঐ খুঁৎ দুনিয়া ও আখিরাতে কোন না কোনভাবে আল্লাহ মাফ করে দিলেই শুধু জান্নাত পাওয়া সম্ভব হবে।
তাই হাদীসটির প্রথমে রাসূল (সা.) বলেছেন, যত বেশি সংখ্যক আমল ঈমানের দাবি অনুযায়ী যথাযথভাবে পালন করা সম্ভব তা করার চেষ্টা অবশ্যই করতে হবে। আর কোন আমল বাধ্য হয়ে ছাড়তে হলে সত্যের কাছাকাছি থাকতে হবে। অর্থাৎ গুনাহ না হওয়ার স্তরের কাছাকাছি থাকতে হবে।
আমল ছাড়ার পর গুনাহ না হওয়ার স্তরের কাছাকাছি স্তর হিসেবে ছগীরা গুনাহগারের স্তরকে অবশ্যই ধরা যাবে। মধ্যম গুনাহগারের স্তরকে ধরা যেতেও পারে। কিন্তু কবীরা গুনাহগারের স্তরকে অবশ্যই ধরা যাবে না।
তাই এ হাদীসখানির আলোকে বলা যায় পরকালে শাফায়াতের মাধ্যমে ছগীরা গুনাহ অবশ্যই মাফ হবে, মধ্যম গুনাহ মাফ হতেও পারে কিন্তু কবীরা গুনাহ অবশ্যই মাফ হবে না।
কুরআন, হাদীস ও বিবেক-বুদ্ধির এ সকল তথ্যের আলোকে সহজেই বলা যায় পরকালে শাফায়াতের মাধ্যমে কবীরা গুনাহ মাফ হবে না।
শাফায়াতের মাধ্যমে দোযখ থেকে মুক্তি পেয়ে বেহেশত পাওয়া যাবে কিনা?
বিবেক-বুদ্ধি
তথ্য-১
ঈমান আনা আমলটির একটি সরল অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর ইলাহিত্বকে তথা আল্লাহর সরকারকে স্বীকার করা। আর কিছুদিন বা কিছুকাল, অনন্তকালের তুলনায় অতি নগণ্য পরিমাণ সময়, চাই সে কিছুকাল যত বড়ই হোক না কেন। তাই মানুষের দুনিয়ার জীবনে কিছুকাল ও অনন্তকালের কাছাকাছি বর্ণনা হবে-এক সেকেন্ড বা তারও কম সময় এবং সারা জীবন। সুতরাং বড় গুনাহ করলেও ঈমান থাকলে কিছুকাল দোযখের শাস্তি ভোগ করে অনন্তকালের জন্যে বেহেশত পাওয়া বিষয়টিকে দুনিয়ার যে কোন দেশের অপরাধের জন্যে জেল খাটা এবং সেখান থেকে মুক্তি পাওয়া বিষয়টির সঙ্গে মেলালে যে তথ্যটি দাঁড়ায় তা হচ্ছে- উপস্থিত সরকারকে স্বীকার করলে বড় অপরাধ করলেও এক সেকেন্ড বা তার চেয়ে কম সময় জেল খাটার পর মুক্তি পেয়ে বাকি জীবন মহা শান্তিতে মুক্তভাবে কাটানোর ব্যবস্থা থাকা।
পৃথিবীর কোন দেশের আইন-কানুনে যদি ঐ ধরনের একটি কথা বা তথ্য সত্যিই উপস্থিত থাকে আর তা সকলের জানা থাকে, তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, ঐ দেশে বড় বড় অপরাধীর সংখ্যা অগণিত হবে এবং সেখানকার সমাজ জীবনে শান্তির লেশমাত্রও থাকবে না।
তথা সেখানকার সমাজ জীবন ব্যর্থ হবে।
‘একজন ঈমানদার ব্যক্তি বড় গুনাহগার অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলেও পরকালে কিছু দিন দোযখে থেকে শাফায়াতের মাধ্যমে চিরকালের জন্যে বেহেশতে যেতে পারবে’ এমন একটি কথা ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় উপস্থিত থাকলে বিবেক-বুদ্ধি অনুযায়ী তার অবশ্যম্ভাবী ফল যা হবে তা হচ্ছে অসংখ্য ঈমানের দাবিদার ব্যক্তি ছোট-খাট বা না থাকার ন্যায় ওজর, অনুশোচনা ও উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টাসহকারে ইসলামের বড় বড় আমল ছেড়ে দিবে-বিশেষ করে যে আমলগুলো পালন করতে ব্যক্তিগত ত্যাগ স্বীকার বা য়-তির সম্মুখীন হতে হয়। আর এর চূড়ান্ত ফল দাঁড়াবে
১. মহান আল্লাহর মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য (আল্লাহর সন্তুষ্টিকে সামনে রেখে কুরআনে বর্ণিত সকল ন্যায় কাজের বাস্তবায়ন ও অন্যায় কাজের প্রতিরোধের মাধ্যমে মানুষের কল্যাণ করা) বাস্তবায়ন করা কল্পনার বিষয় হিসেবে থেকে যাবে। কারণ, তা করতে হলে অসংখ্য মু’মিনকে বিপদসংকুল, কষ্টসাধ্য ও কঠিন ত্যাগ স্বীকার লাগে, এমন অনেক কাজ করতে হবে।
২. মুসলিম সমাজ বা দেশ অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, অশান্তি ইত্যাদিতে ভরে যাবে।
তাই বিবেক-বুদ্ধি অনুযায়ী সহজে বলা যায় শাফায়াতের মাধ্যমে দোযখ থেকে বের হয়ে চিরকালের জন্যে বেহেশত পাওয়া যাবে এ ধরনের কথা ইসলামের কথা হতে পারে না।
তথ্য-২
কবীরা গুনাহ হচ্ছে বড় অপরাধ। ইসলামী জীবন বিধানে দুনিয়াতে বড় অপরাধ করা মু’মিনদের স্থায়ী শাস্তি তথা মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা আছে। যেমন অন্যায়ভাবে হত্যার শাস্তিস্বরূপ মু’মিনকে হত্যা করা, জেনার জন্যে মু’মিনকে সংগেসার করা। তাই কবীরা গুনাহসহ মৃত্যুবরণকারী মু’মিনের পরকালে স্থায়ী শাস্তি তথা স্থায়ী দোযখের শাস্তির ব্যবস্থা, ইসলাম সম্মত হওয়ার কথা।
অর্থাৎ শাফায়াতের মাধ্যমে দোযখ থেকে মুক্তি পাওয়ার কথা নয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।