আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পকারের গল্পকথা......



ইয়েস্তেন গার্ডার এর ‘সোফি’স ভারডেন’ পরেছেন নিশ্চয়ই। যেখানে সোফি একসময় আবিষ্কার করে সে নিজেই একজনের গল্পের চরিত্র। কেউ একজন তার মেয়ের জন্য একটি গল্প লিখছেন। আর সেই গল্পটিরই চরিত্র সোফি। বইটা পড়ে বেশ আলোড়িত হয়েছিলাম।

কে জানে! আমরাও হয়তো কারও গল্পের চরিত্র। জীবন ভাবছি যেটাকে, সেটা কারো আরোপ করা, কারো পরিকল্পনা মাফিক সাজানো। এই যে আমি প্রজ্ঞা তাসনুভা রূবাইয়াৎ, আমিও একটা ‘ক্যারেক্টার’, হয়তো আমাকে নিয়েই কেউ গল্প লিখছে, কিংবা অন্য কাঊকে নিয়ে লেখা গল্পের প্রয়োজনীয় চরিত্র আমি। ... আমাদের ভাবনা, চিন্তা, স্বপ্ন, আনন্দ-বেদনা-দুঃখ-সুখ-হাসি-কান্না সব কিছুই গল্পকার এর চিন্তা। সে ই ইচ্ছেমতো ঘটনার জাল বুনছে, আবার সেই একেক্টা ঘটনায় একেকটা চরিত্রকে যুক্ত করছে।

হতেই পারে... আমি অন্তত এভাবে ভাবতে ভালোবাসি। জীবনটাকে অনেক বড় মনে হয়। অনেক রহস্যের মনে হয়। কী হবে সামনে ভাবতে থাকি!...অপেক্ষা করি পরের দৃশ্যের...। গল্পকারের সাথে একটা অদৃশ্য ভিন্ন মাত্রিক যোগাযোগ এর চেষ্টা করি।

... তাকে অনুভব করার চেষ্টা করি। ...আর মনে মনে ভাবতে থাকি, এবার এই দৃশ্যটা হোক, আমাকে নিয়ে এভাবে সে গল্পটা সাজাক, ওভাবে ঘটনাগুলোর সংযোগ ঘটাক। গল্পকারই হয়তো আমাকে এভাবে ভাবায়! গল্পকার আমার চরিত্রটাকে অনেক ঘটনাবহুলতায় সাজিয়েছেন। অনেক অনেক চরিত্রের সাথে আমার সংযোগ ঘটিয়েছেন। নিজেকে ‘ডিফারেন্ট’ ভেবে নিতে লিখেছেন।

মিল্টন ভাই যেমনটা বলে, ‘তুই অনেক কিছুই করবি, কিন্তু কোনোদিন ‘সাধারণ’ হতে পারবিনা, আর জীবনে না পারার তালিকায় এইটাই তোর সবচেয়ে বড় ‘না পারা’ হবে’। কথাটা হয়তো সত্যি। ...... নিজেকে গল্পকারের একজন ‘এক্সপেরিমেন্টাল’ চরিত্র ভাবতে থাকি!... আমাকে নিয়ে সে প্রতিটা দৃশ্যে, প্রতিটা পর্বে দারুণভাবে এক্সপেরিমেন্ট করছে। চারিদিকে খুঁজে বেড়াতে থাকি আরো সব ‘এক্সপেরিমেন্টাল’ চরিত্রদের। গল্পকারই একটা সময় কারো কারো কাছে নিয়ে যায়।

তার সাথে সখ্য গড়ে তুলি। ভাবতে থাকি আমাদের মত এই পরীক্ষনমূলক চরিত্রগুলোর পরিণতি কি??......গল্পের শেষে কোনো ক্লাইম্যাক্স এ কি আমাদের কেউ প্রধানতম চরিত্র হয়ে যাবো?? যে কথাটা একজনকে বলছি তাকে কেন বলছি?...যেই আচরণটা করছি তা কেন করছি?...যে মানুষটার সাথে মিশছি তাও বা কেন??...যাকে ভালোবাসছি তাকে কেন ভালোবাসছি??...কেন আমি এই বাংলাদেশে, এই ঢাকায় একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় সন্তান হয়ে জন্মেছি?...এই আমারই আবার কেন বাবা’র সাথে দিনের পর দিন কথা হয় না নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া?...কেন আমি আমার মা’র যথেষ্ট প্রগতিশীল চিন্তা সত্ত্বেও তার ‘গোড়াপন্থী’ দিকটাকে বেসিক বলে না মেনে পারিনা?...কেন আমার ভাইয়ের সাথে আমার যোগাযোগটা নিরব দুরত্বের দিকে যেতে থাকে আর আমি সিপিইউ এর গায়ে দু’জনের নাম পাশাপাশি লিখে ভাবতে ভালোবাসি আমরা ভাই-বোন এখানে তো একসাথে!...... কিংবা আশেপাশের সব মানুষগুলো...যাদের বন্ধু বলি তারা......অনিক...সবাই...ওদের সাথে সম্পর্কগুলো, কিংবা নিতান্তই যারা পথ চলতে গিয়ে পরিচিত, কাজের সূত্রে ঘনিষ্ঠ, তাদের সাথে সম্পর্ক কোন উপসংহারের অপেক্ষায়?.....কিংবা এই আমিই কেন জীবনটাকে দেখছি একটা ‘এক্সপেরিয়েন্স’ হিসেবে যেখানে আমি ছুঁয়ে যেতে চাই জীবনের সব ক্ষেত্র!...ছবি আঁকছি, লেখালেখি করছি, ফটোগ্রাফি করছি, এটা-সেটা কাজ করছি...অনেক কিছুই করছি...গল্পকার আমাকে তিন বছর কোচিং এ কাজ করিয়েছে, দুই মাস অনিমেষ আইচ এর অ্যাসিস্ট্যান্ট কামলা হিসেবে কাজ করিয়েছে, এখন ক্যানভাস পত্রিকায় ‘কন্ট্রিবিউটর রিপোর্টার’ হিসেবে কাজ করাচ্ছে। সামনে প্রাচ্যনাটে গ্রুপ এ কাজ করাবে নাকি জানিনা। গল্পকার আমাকে তিন/চারটা টিউশনি করিয়েছেন। একটা চলছে।

আগের চারটার তিনটাই শেষ হয়েছে খুব বাজে ভাবে!...একপ্রকার হঠাত করে ছেড়ে দেয়ার ঘটনা বলা যেতে পারে!...এবারেরটা কি করবে সে জানিনা!... গল্পকারের কি খেয়ালে জানিনা, আমি সায়েন্স পেয়েও কমার্স এ পড়েছি, কমার্স থেকে ইণ্টারে আবার আর্টস এ এসেছি। ক্লাস সিক্স-সেভেন এ পড়ার সময় থেকে বাবা’র মত ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়বো, ‘বাপকা বেটি’ হবো চিন্তা করতে করতে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষার তিন দিন আগে সিদ্ধান্ত নিলাম ইংরেজি সাহিত্য না, আমি মনোবিজ্ঞান এ পড়বো! সবাইকে শকড্‌ করে আমি মনোবিজ্ঞানেই ভর্তি হলাম। এখন আবার সেই মনোবিজ্ঞান নিয়েই পড়াশোনায় গল্পকার আমাকে নিরুৎসাহিত করছেন। প্রথম বর্ষের ফার্স্ট গার্ল আমি সেকন্ড ইয়ারে হয়ে গেছি ‘গোনার বাইরে’। গল্পকারের কি উদ্দেশ্য, কে জানে! যেই আমাকে সে একসময় ভাবিয়েছে ভালোবাসা-প্রেম এগুলো’র জাগতিক রূপ এর কোনো মূল্য নেই।

প্রেম বলতেই সেটা কমিটমেন্ট হবে, ডেটিং হবে, এটা-সেটা খুন-সুটি হবে, জৈবিক চাহিদা থাকবে তা নয়। প্রেম অনেক বড় জিনিস। প্রেম একটা মহান ধর্মের মত পবিত্র। ভালোবাসা মানেই একজন আরেকজনকে চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কষা নয়। ভালোবাসা একটা তপস্যা।

ভালোবাসায় পাওয়ার কোনো চাহিদা থকবেনা। যাকে ভালোবাসি তার জন্য সব করবো, জীবন দিয়ে দিতে পারবো এরকম যদি মনের ভাব হয়, তবেই সেটা ভালোবাসা। প্রেম বলতেই আমি কারো সাথে ঘর বাধার স্বপ্ন দেখবোনা। প্রেম হবে দুইটা আত্মার সমক্রিয়ায়। আমি কাউকে ভালোবাসবো, সেও আমায় ভালোবাসবে।

এই ভালোবাসায় কোনো নিয়ম বাধা থাকবেনা। ...... বৈষয়িকতার উর্ধ্বে থাকবে সেই সম্পর্ক। সেই আমাকেই গল্পকার একটা সময় টিপিকাল ভালোবাসার চাহিদায় বন্দী করেছেন। কোনো একজনের দলীয় নাট্যচর্চার প্রধান নায়িকা হয়েছি আমি। আমার মুখ থেকে সে কৌশলে বের করে নিয়েছে ‘ I LOVE YOU’… তারপর বন্ধুমহলে খুব গর্ব করে বলেছে, ‘মেয়েটারে তো পটায় ফেললাম।

‘... আমি পরে জেনেছি এসবের পেছনে যাদের অনেক ভালো বন্ধু ভাবতাম তারাও ছিলো! ... প্রায় দেড় বছর নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে এক্সময় ওই নাটক থেকে নিজেকে বের করে আনতে পেরেছি, কিন্তু যুদ্ধে বিধস্ত হয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। গল্পকার আমার জীবনের আবহকে ওখান থেকে পাল্টাতে শুরু করেছেন। নিজেকে খুঁজে পাওয়ার জন্য দিক-বিদিক-জ্ঞানশূন্য হয়ে এদিক ওদিক ঘুরেছি। যখন হতাশ হয়ে গেছি, তখন গল্পকার আমাকে পরিচয় করিয়েছেন অনিক এর সাথে। ওর মত বন্ধু পেয়ে একটু একটু করে পথ চলতে চলতে নিজেকে আবার পেয়ে গেছি।

গল্পকার আবার আমাকে ভালোবাসিয়েছেন। তবে এবার সেই নিয়মহীন ভালোবাসা। গল্পকার আমাকে আগে কল্পনা করাতেন আমার একটা বন্ধু হবে সে এমন হবে, ওমন হবে...এই...সেই...অনিকের মাঝে তিনি সেই বিষয়গুলোর উপস্থিতি দেখিয়েছেন। আর আমি ভেবেছি গল্পকার তবে আমায় নিয়ে কেবল না’বোধক এক্সপেরিমেন্ট করেন না ! গল্প চলছে এভাবে। প্রতিদিন এটা সেটা করছি।

গল্পকার আমায় দিয়ে অনেক কিছু করাচ্ছেন, অনেক কিছুর এক্সপেরিয়েন্স দিচ্ছেন। ... আমাকে তিনি গল্প শেষে কোথায় দাঁড় করাবেন জানিনা। ...গল্প চলতে থাকবে। নতুন নতুন ঘটনা ঘটবে। একটার জন্য আরেকটা প্রভাবিত হবে, আর আমি ভাবতে বসি বাটারফ্লাই ইফেক্ট এর কথা, এমন যদি হতো তবে কেমন হতো!...গল্পকারকে বলি ঘটনাটা নতুন করে লিখতে...গল্পকার উত্তর দেয়না।

অমোচনীয় কালিতে সে গল্প লেখে ভেবে নিয়ে তার জন্য দুঃখিত হই...। আর ভাবি, পরেরবার হয়তো গল্পকার অনেক ভেবে চিন্তে কোনো একটা ঘটনা লিখবে যাতে পরে আমাকে আর ভাবতে না হয় দৃশ্যটা অন্যরকম হতেই পারতো!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।