আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কারাসুন পাহাড়ের শেয়াল ছেলে

শ্রদ্ধা আর মমতাই তোমাকে জয়ী করতে পারে; তুমি তোমার জ্ঞান প্রয়োগ কর।

[নানকিসি নিমি'র "শেয়াল ছেলে" নামের এই গল্পটি পড়েছিলাম ছোটবেলায়। গেঁথে ছিল হৃদয়ে, মাঝে মাঝে তন্ত্রীতে নাড়া দিত। ব্লগ সেই স্পন্দন এতই বাড়িয়ে দিল, ঈষৎ পরিমার্জিত ও সংক্ষেপিত অনুবাদ করে দিলাম। এ কাহিনী জাপানের।

বানরুকু নামের একটি বাচ্চা ছেলে প্রতিবেশী কিছু ছেলের সাথে চন্দ্রালোকিত এক রাতে দূরের গাঁয়ে মেলা দেখতে যায়। ছোট-খাট দুর্বল চেহারা বানরুকুর, কিন্তু বড় বড় মায়াকাড়া চোখ। মা অন্য ছেলেদের অনুরোধ করেন তারা যেন বানরুকুকে দেখে রাখে। এজন্য মা প্রায়ই তাদেরকে বাগানের ফলমূল উপহার দেন। মা বলে দিয়েছেন বানরুকু যেন লক্ষ্মী হয়ে চলে, আর নিজের জন্য একজোড়া নতুন খড়ম কিনে।

খড়ম কিনতে তাই সবাই যায় বুড়ি দাদিমার দোকানে। তাক থেকে খড়ম নামাতে নামাতে বুড়ি বলে, কেউ যদি প্রথমবারের মতো রাতের বেলা নতুন খড়ম পরে, তার উপর শেয়ালের আছর হয়, এবং এর ফলে সে শেয়ালও হয়ে যেতে পারে। ছেলেরা সব ভয়ে চমকে যায়, কিন্তু বুড়ি তাদেরকে আশ্বস্ত করে যে শেয়ালের আছর দূর করার নিয়ম তার জানা আছে। বানরুকুর খড়ম পছন্দ হওয়ার পর বুড়ি একটি ম্যাচ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে খড়মের তলা হালকা পুড়িয়ে দাগ করে দেয়; তারপর হেসে বলে, আর কোন ভয় নাই। মেলায় নানা মজা করার পর ছেলের দল গভীর রাতে বাড়ি ফিরে।

চন্দ্রালোকিত শুনশান নীরব মাঠের উপর দিয়ে ফেরার সময় তাদের মনে পড়ে যায় বানরুকুর খড়মের কথা। অস্বস্তি বোধ করতে থাকে তারা। একজন ফিসফিস করে পাশের জনের কানে বলে, "বুড়ি আসলে আছর দূর করতে পারেনি, সে ভান করেছে মাত্র। " ফিসফিস করে সেই কথা চলে যায় সবার কানে, বানরুকু ছাড়া। খানিক পর খুক খুক কাশে বানরুকু; চমকে উঠে তারা, ভাবে এ তো মানষের শব্দ না, শেয়ালের শব্দ।

দ্রুত পা চালাতে থাকে ছেলেরা। বানরুকুকে বাড়ির একটু দূরে রাস্তায় রেখেই চলে যায়। অন্য সময় হলে অবশ্য তারা তাকে একেবারে বাড়ি পৌঁছে দিত। ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে ভয়ে ভয়ে বাড়ি ফিরে বানরুকু। আজ তারা বাড়িতে আসলো না কেন? এরকম তো কখনো হয় না? খড়ম জোড়া কেনার পরই তা ঘটল! আমি কী আসলেই শেয়াল হয়ে যাচ্ছি! শেয়াল হয়ে গেলে কী হবে আমার? বানরুকুর বাবা কাজে বাড়ির বাইরে, ফিরতে ফিরতে রাত শেষ হয়ে যাবে।

মা তাকে শুইয়ে দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেকক্ষণ ধরে জানতে চান বানরুকু কী কী দেখল, কী কী করল। বানরুকু কথা ভালো বলতে পারে না, আধো আধো ভাঙা ভাঙা গলায় সে বর্ণনা করে সব কিছু। কিন্তু মা গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনেন বানরুকুর কথা, অনেক বার প্রশ্ন করেন, এবং খুশি হন। ] হঠাৎ বানরুকু মাকে প্রশ্ন করে, "মা, এটা কি সত্যি যে কেউ যদি প্রথম বার রাতে নতুন খড়ম পড়ে, সে শেয়াল হয়ে যায়?" মা এক মুহূর্তের জন্য চমকে যান। প্রথম তিনি বুঝতে পারেন না বানরুকু কিসের কথা বলছে।

একটু পর বুঝতে পারেন তার সোনামনির কী হয়েছে। "কে বলেছে এই কথা, বাবা?" মা জিজ্ঞেস করেন। বানরুকু শুধু তীব্র উদ্বিগ্নতায় আবারো প্রশ্নটি করে। "এটা সত্যি কিনা বলো। " "না, মোটেই না।

শুধু অনেক অনেক দিন আগে মানুষ এইসব কথা বিশ্বাস করত। " "তার মানে এ মিথ্যা কথা?" "হ্যাঁ বাবা, এটি মিথ্যা। " "তুমি কি সত্যি সত্যি জানো?" "অবশ্যই। " বানরুকু কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকে। তারপর তার বড় বড় চোখ ডানে বামে দুই একবার নাড়িয়ে বলে, "কিন্তু এরকম হলে তুমি কী করতে?" "এরকম কী হলে?" মা জানতে চান।

"মানে আমার উপর যদি শেয়াল ভর করে, আর আমি যদি শেয়াল হয়ে যাই, তুমি কী করতে?" হাসিতে ভেঙে পড়েন মা। "বলনা! বলনা মা!" কিছুটা বিব্রত হয়ে মায়ের কাছে গিয়ে মায়ের বাহু নাড়তে থাকে সে। "আচ্ছা, আচ্ছা," মা কিছুটা চিন্তার সুরে বলেন, "তুমি শিয়াল হয়ে গেলে তোমাকে তো বাড়িতে রাখতে পারতাম না আমরা। " মায়ের কথায় মনমড়া হয়ে উঠে বানরুকু। "তাহলে আমি তখন কোথায় যেতাম?" সে প্রশ্ন করে।

"হয়তো কারাসুন পাহাড়ে," মা উত্তর দেন। "তারা বলে সেখানে নাকি এখনও শেয়ালরা বাস করে। " "কিন্তু তুমি আর আব্বু তখন কী করতে?" মা চেহারায় একটা গম্ভীর ভাব আনেন, বয়স্করা বাচ্চাদের নিয়ে মজা করার সময় যেরকম করে থাকেন। "আমরা বিষয়টা নিয়ে খুব চিন্তা করতাম, এবং হয়তো বলতাম: যেহেতু আমাদের আদরের বানরুকু এখন শেয়াল হয়ে গেছে, পৃথিবীতে আমাদের আর আনন্দ রইল না। তাহলে মানুষ থেকে আর কী লাভ, চলো আমরাও শেয়াল হয়ে যাই।

" "তুমি আর আব্বুও শেয়াল হয়ে যেতে?" "তোমার আব্বু আর আমি আগামীকাল নতুন খড়ম কিনে পড়ব, তারপর আমরা সবাই শেয়াল হয়ে যাব। তাহলে আমরা তিনজন একসাথে কারাসুন পাহাড়ে চলে যেতে পারব। " বানরুকুর চোখ বড় হতে থাকে। "এটা কি সেই পশ্চিমে, যেখানে বড় বড় পাহাড় আছে?" "হ্যাঁ, এটা শিমান প্রদেশে, নারাওয়ার দক্ষিণ পশ্চিমে। " "গভীর পাহাড়ের ভেতরে?" "হ্যাঁ, আর পাইন গাছে ঢাকা।

" "সেখানে কি শিকারিরা থাকবে না?" "তুমি বলতে চাচ্ছ বন্দুকওয়ালা শিকারি? তারা তো থাকবেই, কারণ সেখানে তো কোনো মানুষ বাস করে না, শুধু অনেক পশুপাখি ঘুরে বেড়ায়। " "যদি শিকারিরা আমাদের গুলি করে, আমরা কী করব?" "আমরা গুহায় ঢুকে এক কোণে লুকিয়ে থাকব। তাহলে তারা আর খুঁজে পাবে না। " "কিন্তু শীত এলে তো বরফ পড়বে, আমাদের খাবার শেষ হয়ে যাবে। খাবারের জন্য আমাদের বাইরে যেতে হবে।

তখন তো শিকারিদের কুকুরগুলো আমাদের দেখে ফেলবে। " "তাহলে বাঁচার জন্য আমরা এক সাথে ছুটতে শুরু করব। " "তোমার আর আব্বুর তো কোনো সমস্যা হবে না, তোমরা তো বড়। কিন্তু আমি তো বাচ্চা শেয়াল, পেছনে পড়ে থাকব। " "আমরা তোমাকে আমাদের থাবায় বয়ে টেনে নিয়ে ছুটব।

" "আর পেছনে তো কুকুরেরা আসতেই থাকবে, তাই না?" মা চুপ হয়ে গেলেন, এবং একটু পর যখন কথা বললেন মজা করার ভাবটা আর নেই। "তখন আমি তোমাদের পেছনে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আসতে থাকব। " "কেন?" শিশুটি প্রশ্ন করে। "কারণ তাহলে কুকুরটা আমাকে তার দাঁতে কামড়ে ধরতে পারবে। সে কামড়ে ধরে রাখবে যতক্ষণ না শিকারিরা এসে আমাকে বেঁধে ফেলে।

এই সময়ে তুমি আর তোমার বাবা পালিয়ে যেতে পারবে। " বানরুকু স্তম্ভিত হয়ে গেল। মায়ের দিকে গোল গোল চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। "না, না মা," সে চিৎকার দিল, "তাহলে তোমাকে ছাড়া থাকব আমরা!" "লক্ষ্মীসোনা, এছাড়া কোনো উপায় নেই যে আর," মা দ্রুত বলে উঠলেন, "মা তোমাদের পেছনে খোঁড়াতে থাকবে, আস্তে, আস্তে। " "তুমি তা করতে পার না, পার না," বানরুকু চিৎকার করতে করতে লাফাতে থাকে, তার বিছানা এলোমেলো করে ফেলে, বালিশ ছুঁড়ে ফেলে।

তারপর মাকে জড়িয়ে ধরে থাকে, তার বড় বড় চোখ দিয়ে নামে জলের ধারা। মায়ের চোখেও পানি আসে, কিন্তু সে পানি মা গোপনে আঁচলে মুছে ফেলেন। তারপর মেঝে থেকে ছোট্ট বালিশটা তুলে বানরুকুর মাথার নীচে বসিয়ে দেন।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.