আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জয়নাল পলয়ান ০৩

অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা

মোবাইল নেওয়া হয় নি জয়নালের। অনেক কিছুই তেমন প্রয়োজন না হলেও মানুষ সাথে রাখে, যদি কোনোদিন প্রয়োজন হয়। জয়নাল নিজের কাছেই এই প্রযুক্তি তেমন প্রয়োজনীয় মনে হয় নি কখনও। সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখবে কার সাথে ও? বাসায় যায় না তাও তিন বছর হয়ে গেলো। কুষ্টিয়ার কদমখালী গ্রামের করম মিয়ার ছেলে পরিচয়টাই মুছে গেছে।

সম্পূর্ণ মুছে যায় নি এই পরিচয় আসলে। এখনও রাষ্ট্রের তালিকায় তার এই নামটা রয়ে গেছে। রাষ্ট্র নাগরিকের তালিকা তৈরি করে, রাষ্ট্র নাগরিকের পরিচয় তৈরি করে, প্রয়োজনীয়তা -অপ্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে। প্রতিষ্ঠান যেভাবে নিজের ক্ষমতা যাচাই করে দেখতে চায়। রাষ্ট্রের তালিকায় মোঃ জয়নাল, পিতা করম মিয়া, পোঃ+গ্রাম কদমখালী, জেলা কুষ্ঠিয়া , বাংলাদেশ, পিতা, স্থায়ী ঠিকানা আর জন্ম তারিখ দিয়ে রাষ্ট্র নাগরিক নির্ধারণ করে।

তাই এসএসসির সার্টিফিকেট দাখিল করেই নিজের জন্মের বৈধতা আর দিন তারিখের সত্যতা প্রমাণ করতে হয় নাগরিককে নিজ দায়িত্বে। রাষ্ট্রকে নাগরিক নিজ উদ্যোগে তথ্য দেয়। রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই মানুষ বাধ্য হয় নিজের অস্তিত্বের সত্যতা প্রমাণে। রাষ্ট্র যেকোনো সময়েই যেকোনো কাউকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করতে পারে, রাষ্ট্র কিংবা যেকোনো প্রতিষ্ঠানই কিছু পরিমাণে স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তিপ্রতিহিংসা ধারণ করে। পারসোনা নন গ্রাটা অভিধা দিয়ে কাউকে অচ্ছুত করে রাখা যেকোনো রাষ্ট্রেই সম্ভব।

রাষ্ট্র যখন কোন ব্যক্তিকে নিশ্চিহ্ন করতে চায় নিজস্ব নির্ধারিত বিধিমোতাবেক রাষ্ট্র এই ব্যক্তিপ্রতিহিংসা চরিতার্থ করে। তাই মানবিক হয়েও রাষ্ট্রের মানবিকতা অনেক সময়ই অমানবিক হয়ে উঠে। রাষ্ট্র এমন উন্মত্ত প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে উঠলেও রাষ্ট্র বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করে নেয়। সেখানে ক্ষমতাসীনদের অনুগত বাহিনী থাকে। যারা রাষ্ট্রের অবাঞ্ছিত মানুষদের নিশ্চিহ্ন করতে থাকে।

এইসব সময়ের জন্য হলেও রাষ্ট্র নিজ উদ্যোগে কিছু সন্ত্রাসীকে লালন-পালন করে। তবে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে সংশ্লিষ্টরা। তারা এইসব জানলেও সচেতনভাবেই উপেক্ষা করে যায়। তবে এইসব সংবাদ চাপা থাকে না। ভেতরে ভেতরে ঘোঁট পাকাতে থাকে ঘটনাগুলো এবং তার ছোয়া লাগে তথাকথিত আন্ডারওয়ার্ল্ডে।

তাই শামীমের খবরটাও চাপা থাকে না। ভাই একটা ফোন করা যাবে? ল্যান্ড লাইন না মোবাইল? মোবাইল। ১০ টাকা মিনিট। মানিব্যাগ খুলে কাগজ ঘেঁটে আন্দালিফের নম্বর খুঁজে বের করলো জয়নাল। ভাই এই নাম্বারটা লাগান- ০১৭ ১১৫৮৪২।

রিং হচ্ছে, ফোন ধরছে না কেউ। অস্থির লাগে জয়নালের। শরীরের ভার এক পা থেকে অন্য পায়ে নিয়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়। রিং বাজছে তো বাজছেই। মনে হয় অনন্তকাল এইভাবেই মোবাইলে রিং বাজছে।

তৃতীয় বার আন্দালিফের গলা পাওয়া গেলো। হ্যালো কে? আন্দালিফ ভাই আমি জয়নাল। ও জয়নাল। এইটা কার নাম্বার? আন্দালিফের কাছে মোমিনের দোকানের নাম্বারটা দেওয়া আছে। ওই দোকানের সাথেই সারা দিন কাটে ওর।

কেউ কোনো দরকার থাকলে ওই দোকানের নাম্বারেই যোগাযোগ করে। পুরান ঢাকার এক দোকানের। ভাই আপনি কি কালকে সকালে স্টেশনে আসতে পারবেন? খুব দরকার ছিলো। একটা কাজ করে দিতে হবে যে। কালকে? অনেকক্ষণ থেমে আন্দালিফ বললো কালকে তো শুক্রবার।

আপনাকে আসতেই হবে, জীবন মরন সমস্যা । বাসায় একটা কাজ ছিলো, দুপুরের দিকে। আচ্ছা আমি আসবো। ঠিক আছে ভাই, কালকে কথা হবে, কমলাপুর স্টেশনে। বইয়ের দোকানের সামনে ঠিক ১০টায়।

কত হইছে ভাই। ফোন নামিয়ে দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করলো জয়নাল। ৩০ টাকা দেন। ৩ মিনিট হইছে। জয়নালের সামনে মোবাইল নিয়ে দেখালো দোকানী ২ মিনিট ০১ সেকেন্ড।

জয়নাল টাকা দিয়ে হোন্ডার কাছে আসলো। এখন আর কোনো কাজ নেই এইখানে। হয়তো দেরি হয়ে যাবে, কিন্তু এটা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই ওর এখন। ও কোনোভাবেই মধুবাগে ঢুকতে পারবে না পরিস্থিতি যেমন বুঝলো বল্টুর কাছে শুনে, আপাতত বসে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া ওর অন্য কিছুই করবার নেই। ওর ঘটনার কেন্দ্রে নেই, ঘটনার সাথে ওর সংশ্লিষ্ঠতা তেমন নেই।

তবে কোথাও কোনো একটা প্যাঁচ লেগেছে, সেই ঘোঁট থেকে নিজেকে উদ্ধার করবার জন্য হলেও ওকে আগামী কয়েকদিন বেঁচে থাকতে হবে। আর বেঁচে থাকবার সবচেয়ে ভালো উপায় এই শহর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়া। এই শহরে কোথাও তেমন নিরাপত্তা নেই। জজকোর্টের সামনের জ্যাম পার হয়ে ইংলিশ রোড হয়ে গুলিস্তানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর হয়ে গেলো প্রায়। জয়নাল ছুটছে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে, মগবাজারের ধলা শামীম, ছেলেটা ভালোই।

পাঁকেচক্রে জড়িয়ে যাওয়া ছেলে। হয়তো অন্য কোনো স্বাভাবিক সময়ে ওর এমন বড় অসুবিধা হতো না, কিন্তু দেশের পরিস্থিতি বদলাচ্ছে, নির্বাচন ঘনিয়ে আসবার সাথে সাথে দেশের পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। আপাতত ঘাপটি মারা ছাড়া অন্য কিছু করবার নেই ওর, ও জানে এই বিষয়টা, তবে শামীমকে ওর খারাপ লাগে নি কোনোদিনও। গিট্টুর সাথে মানে জাহিদের সাথে শামীমের পরিচয় স্কুলে থাকতেই, একই সাথে কলোনীর মাঠে গিয়ে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট খেলেছে, এমন কি কলেজে জাহিদের সাথে মাঝে মাঝে কমলাপুর কিংবা বাসাবো গিয়ে ফেন্সিডিল নিয়ে আসা, বয়েসের স্বভাবে যতটুকু মানুষ করে ঠিক ততটুকুই করেছে বন্ধুর সাথে। জাহিদ হঠাৎ করেই ওয়ার্ড কমিশনারের নেক নজরে পড়ে যাওয়ার পরে সন্ত্রাসী হিসেবে ওর উত্থানের পরও শামীমের সাথে জাহিদের সম্পর্ক নষ্ট হয় নি।

একই এলাকায় থেকে বড় হওয়া আর একই সাথে অনেক স্মৃতি জমে যাওয়ায় সব সম্পর্ক ভুলে দুরে সরিয়ে দেওয়া যায় না। জাহিদদের দলের সাথে শামীমের তেমন সম্পর্ক নেই। জাহিদ পড়াশোনা করে নি আর, এইচএসসি পাশ করে কোনো মতে সিদ্ধেশ্বরী ডিগ্রী কলেজে ঢুকেছিলো, তবে সেটাই শেষ, অবশ্য ওর জীবনে এখন কলেজের ডিগ্রীর তেমন প্রয়োজন নেই। কমিশনার আতা ভাই ছাতা ধরে আছেন মাথার উপরে। মগবাজারের পরিস্থিতি বদলাচ্ছে।

আগে তেমন বাসা তৈরি হতো না, ঢাকা শহর হঠাৎ করেই উপরের দিকে বাড়তে শুরু করবার পরে এখানেও বহুতল বাসা উঠা শুরু করেছে, ডেভলপাররা নিয়মিত জায়গা কিনে বাসা তৈরি করছে, এইসব বাসা তৈরির বখরা থেকে কমিশনার যা পায় তার একটা অংশ আসে জাহিদদের কাছে। সেটা মোটেও সামান্য না। বরং বেশ ভালোমতোই চলে যায় ওর। শামীম নিজের কাজের পাশে জাহিদের কন্সট্রাকশন ফার্মের দেখাশোনা করে। মানে সন্ত্রাসী না হলেও ও এই সন্ত্রাসী দলের ক্যাশিয়ার।

সেই টাকায় রক্ত লেগে আছে কি নেই এটাও শামীম জানে না। এইসব কোন কাজের সাথেই ওর সংশ্লিষ্ঠতা নেই, কিন্তু স্কুলের বন্ধুর টানে এখনও জাহিদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করে চলে যেতে পারে নি। জাহিদ যখন ওকে বললো ও একটা কন্সট্রাকশন ফার্ম শুরু করবে, সেটার দায়িত্ব নিতে কিংবা পার্টনার হতেও শামীমের আপত্তি ছিলো না। সেই থেকে জড়িয়ে আছে ওদের সাথেই। জাহিদ এখন মগবাজারে নেই।

ওকে পাওয়া যাচ্ছে না। বল্টুর কাছে যা শুনলো তাতে নেক্সট টার্গেট শামীম। মহাখালীর তপুরা শামীমের দায়িত্ব নিয়েছে। যেকোনো দিনই ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নেওয়াই আছে, শুধু পুলিশ টহল কমলেই একদিন এই ঘটনা ঘটে যাবে।

শামীমের সাথে জয়নালের সম্পর্ক তেমন নেই। মানে মগবাজারে গেলে মাঝেমাঝে জাহিদের অফিসে বসেছে, সেখানে জাহিদ বসে খুব কম সময়ই, বেশীর ভাগ সময়ই শামীমের সাথেই কথা হয়েছে। সেই মুখচেনা সম্পর্কের দায় থেকেই শামীমকে সতর্ক করে দেওয়ার তাগিদ বোধ করছে জয়নাল। এই কাজটা গুছিয়ে আনলেই ও নিশ্চিত মনে ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে পারবে। অনেক অনেক দিন পরে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ঢুকলো।

অনেক দিন ঢুকা হয় না এখানে। এখানে কোনো হলে থাকতে পারলেও নিরাপত্তার অভাব হতো না। তবে যা শুনেছে, আজ কিংবা কাল রাতেই এখানে রেইড দিবে, এক রাতের জন্য এখানে থাকবার কোনো মানে হয় না। হাকিমের চায়ের দোকানের সামনে বসে থাকলো সন্ধ্যা পর্যন্ত। তারপর রাতের নিরাপদ আশ্রয় খুজবার জন্যই চলে গেলো রায়েরবাজার।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।