আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

থ্যাঙ্কস গিভিং ডিনার, ব্ল্যাক ফ্রাইডে

If you donot see bangla, download: http://www.omicronlab.com/avro-keyboard-download.html

ব্লু-রিজ মাউন্টেইনের গা বেয়ে প্রায় ২৫ মাইল ড্রাইভের পর ক্রিসের গাড়ি যেখানে থামল, সেটা শারলোটসভিল শহরের উপকন্ঠে, ভূমি থেকে প্রায় ১৮০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত, ছায়াঘেরা সুন্দর বাংলো টাইপ একটি বাড়ি। পাহাড়ের কোন এক চূড়ায় এই একটি মাত্র বাড়ি। আশেপাশে মাইল খানেকের মাঝে কোন জনমানব আছে কিনা সন্দেহ হতে লাগলো। আমাদেরকে দেখামাত্র গৃহকর্ত্রী মার্থা লেডফোর্ড এবং গৃহকর্তা হুইট লেডফোর্ড বাংলোর সামনের বারান্দার মত অংশে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাতে লাগলো। বাড়ির সামনের বিশাল গ্লাস ইউন্ডোর ভেতরে তাদের চারকন্যাকে দেখা যাচ্ছিল।

আসার পথে ক্রিস কেন বারবার ওদেরকে 'ক্রেইজি' বলছিল সেটা জানালার ওপাশ থেকে আমাদেরকে দেখে ওদের দু'হাত তুলে লাফালাফি করে অভ্যর্থনা জানানোর স্টাইলের বদৌলতে কিছুটা বুঝতে পারলাম। বাংলোটা ঠিক কয়তলা বেশ কিছুক্ষণ বোঝার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলাম- মনে হলো, আমরা সিড়ি বেয়ে ওঠার পর দোতলায় প্রবেশ পথের সামনের বারান্দার মত একটি অংশে আছি। বিকেল প্রায় পাঁচটার মত বাজে, অথচ সূর্য ডুবি ডুবি করছে। সন্ধ্যার আলো-আঁধারীতে সেখান থেকে শারলোটসভিল শহরকে দেখা যাচ্ছে। নভেম্বরের 'মিষ্টি' ঠাণ্ডা বাতাসে সূর্যের বিদেয় নেয়ার দৃশ্য, বহুদূরে সিএইচও এয়ারপোর্টের সিগন্যাল বাতির লুকোচুরি, জনমানবহীন পাহাড়ের ওপর থেকে আমাদের শারলোটসভিলের মোহনীয় আরেকটি রূপ-বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব দেখতেই বেশ ভালো লাগছিল।

আরও বেশি ভালো লাগলো এটা ভেবে যে, ইউভিএ'র পড়াশোনা আমাদের অবাক হবার ক্ষমতাকে এখনও পুরোপুরি কেড়ে নিতে পারেনি! বিস্ময় কাটতে সময় লাগবে বুঝতে পেরে, মার্থা ও হুইট আমাদেরকে তাদের গৃহে প্রবেশের অনুরোধ করলো। আমরা সানন্দে ঢুকে পড়লাম। আজ আমরা লেডফোর্ড পরিবারের অতিথি। আমেরিকায় এটা আমাদের প্রথম থ্যাঙ্কসগিভিং। 'থ্যাঙ্কসগিভিং কী, এটা কি কেউ জানো?- বহু বছর আগে প্রথম যখন ইউরোপীয়ানরা এদেশে 'বেড়াতে' আসে, তখন তারা এখানকার চাষ-বাস, শস্য উৎপাদন এসব কি করে করতে হয় তার কিছুই জানতো না।

একবার এই 'ভিজিটররা' খাদ্যের অভাবে পড়ে মারা যেতে শুরু করল। তখন নেটিভ রেড ইন্ডিয়ানরা তাদেরকে শেখায় কি করে জমিতে শস্য আবাদ করতে হয়, ফসল ফলাতে হয়। নেটিভদের সহায়তায় ভিজিটররা সেবার প্রচুর শস্য উৎপাদন করে এবং সে যাত্রায় বেঁচে যায়। নেটিভদের সেই অবদানকে স্বীকার করে ভিজিটররা এক বিশাল 'থ্যাঙ্কসগিভিং' এর আয়োজন করে। থ্যাঙ্কসগিভিংয়ের সেই প্রথা আজও আমেরিকা এবং কানাডায় প্রচলিত রয়েছে।

' খুব উৎসাহ নিয়ে হুইট আমাদেরকে এই পর্যন্ত বলে থামল। মনে হল, সারাদিন বেশ কয়েকবার প্রাকটিস করে শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে কথাগুলো বলতে পেরে একটা দায়িত্ব শেষের আনন্দ এখন তার চোখে-মুখে। থ্যাঙ্কসগিভিংকে নিয়ে গত কয়েক দিনে আমরা বোধহয় ডজন খানেকের মত ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাস শুনেছি, তাই এবার আর খুব বেশি মনযোগ দিতে ইচ্ছে করছিলনা। আরেকটা কারণে বরং একটু বেশি চিন্তিত ছিলাম। ঢোকার সময় মার্থা খুব আদিখ্যেতা করে আমাদের ওভারকোট খুলে নিয়ে কই যে গেল, আর আসছেনা।

এটাই বঙ্গবাজার থেকে ৮০০ টাকায় কেনা একমাত্র ওভারকোট, এটা হারালে এই হাড়কাপানো শীতে আমার আর রক্ষা নেই। মার্থা ফিরে এলে, স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে একে একে পরিবারের সবার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল। আগেই বলেছি, ওদের চার মেয়ে- লিলিয়ান, মীয়া, গ্রেচেন এবং ম্যাডেলিন। বড়মেয়ে লিলিয়ান একজন আর্কিওলজিস্ট, ওর সাথে ওর বয়ফ্রেণ্ডকেও দেখা গেল। বয়ফ্রেণ্ডটাও আর্কিওলজিস্ট এবং ভাবসাব দেখে মনে হলো ছেলেটা এই বাসাতেই থাকে।

বিয়ে-শাদী না করেও একত্রে আছে, এমন দম্পতি প্রথমবারের মত লাইভ দেখলাম। দ্বিতীয় মেয়ের নাম মীয়া। মীয়া একজন ফাইনআর্টস গ্রাজুয়েট। সে এখন অটিস্টিক শিশুদের একটা স্কুলে চাকরী করছে। তৃতীয়জনের নাম গ্রেচেন।

গ্রেচেন একজন এ্যাসপাইরিং জার্নালিস্ট আর সর্বকনিষ্ঠ ম্যাডেলিন এখন কলেজ পাস করে ইউনিভার্সিটিতে ঢোকার চেষ্টা করছে। ওর পছন্দ ইউভিএ। খেয়াল করে দেখেছি, এখানে ইউভিএ'র বেশ কদর। আমাদের দেশে যেমন বুয়েটে পড়ার জন্য সবাই একরকম পাগল থাকে, এখানে অনেকটা সেরকম। আমেরিকার 'পাবলিক' ইউনিভার্সিটি গুলোর মাঝে ইউভিএ'র র‌্যাংকিং বর্তমানে দ্বিতীয় স্থানে (ক্যালিফোর্নিয়া বার্কেলি এক নম্বর হলেও প্রায়শই আমাদের হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট নিজেদেরকে যৌথভাবে একনম্বর দাবী করেন)।

পড়াশোনার দিক থেকে পাবলিক-প্রাইভেট কোন ভেদাভেদ এখানে না থাকলেও, আমার ধারনা নেটিভ সিটিজেনরা এসব পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে পড়তে চাইলে বিশেষ কিছু সুবিধা পায়। সেজন্য তাদের পছন্দের তালিকায় ইউভিএ থাকেই। এছাড়াও যারা কাছে থেকে একবার এর ক্যাম্পাস দেখেছে, খুব বেশী খুঁতখুঁতে না হলে তারা আর অন্য কোথাও পড়ার কথা চিন্তা করবেনা। পরিবারের মানুষদের সাথে পরিচয় পর্ব শেষ হলে জন্তু জানোয়ারের সাথে পরিচয় শুরু হলো। (এদের কাছে মানুষের মত জীব-জন্তুও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

যেমন, সুপারমার্কেট স্টোরগুলোতে কুকুর-বেড়ালের খাবার-দাবার সহ নিত্য প্রয়োজনীয় সকল জিনিসের আলাদা সেকশন থাকবেই। পাখিদের ঘুমের অসুবিধা যেন না হয় সেজন্য অনেক রাস্তাতেই রাতে কোন স্ট্রিটলাইট দেয়া হয়না ইত্যাদি। ) ওদের দুটো কুকুর, বেশ কিছু খরগোশ, আস্তাবলে কিছু ঘোড়া, গরু এবং কিছু হাঁসও আছে। কুকুর গুলো ওদের সাথেই গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। একটার নাম 'অস্কার' আর আরেকটার নাম 'আভি'।

ওদেরকে জানালাম এই নামে আমাদের ইউনিভার্সিটিতে থিওরীর একজন প্রফেসর আছে। মনে হলো এটা শোনার পর নিজেদের কুকুরকে নিয়ে তারা বেশ গর্বিত। হুইট দূর থেকে আস্তাবলের ঘোড়াগুলোকে দেখালো। শিসের মত বিশেষ একটা আওয়াজ করতেই একটা ঘোড়া আস্তাবল থেকে একটু বেরিয়ে এল। বিশেষ আহামরি কোন ঘোড়া মনে হলনা।

পুরানো ঢাকার রাস্তায় যে ঘোড়াগুলো দেখা যায়, ওগুলোকে একটু সাবান ডলে পরিষ্কার করলেই এরকম মনে হবে। তারপরও আমরা বিস্ময় প্রকাশ করলাম যেন এই জীবনে এই টাইপ ঘোড়া কখনও দেখিনি। আমেরিকায় আসার পর এই একটা জিনিস শিখে ফেলেছি- কেউ আগ্রহ নিয়ে কিছু দেখালে প্রচণ্ড অবাক হবার ভান করা কিংবা কেউ মজার কিছু বলার বা করার চেষ্টা করলে খুব মজা পেলাম এমন একটা ভান করা। এদের হিউমার কালচার আমাদের তুলনায় অনেক বেশি নিম্নমানের। এদের সাথে তাল মেলাতে নিজের লেভেলটাকে যথেষ্ট নিচে নামিয়ে আনতে হয়।

আমাদের সাধারণ মানের রসিকতা সচরাচর এরা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা, তারপরও বুঝতে পারলে বেশ অবাক টাইপ মুগ্ধ হয়। মানুষ এবং পশুপাখির পর গাছপালা পর্ব শুরু হলো। বাড়ির চারপাশে বিভিন্ন জায়গায় গ্রীনহাউজ বসানো। সেখানে রাজ্যের সব গাছগাছালির চাষ হচ্ছে। বাড়িটার অবস্থান মূল শহর থেকে এত বেশি দূরে যে, চাষ-বাস ছাড়া এমার্জেন্সিতে এদের আসলে কোন উপায় নেই।

দুই একবার নাকি এমন হয়েছে যে, বরফ পড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে তারা বেশ কয়েকদিনের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে মূল শহর থেকে। এধরনের ক্ষেত্রে সিটি গভর্ণমেন্টও নাকি দু-তিন দিনের আগে বরফ সরানোর কাজ করেনা। মনে মনে চিন্তা করলাম, বুদ্ধি তাহলে ভালোই। এধরনের কেইসে একটা ঘোড়া জবাই করে গ্রীনহাউজের শাক-সব্জি দিয়ে দিব্যি সপ্তাহ খানেক চালানো সম্ভব। মার্থা যখন গ্রীনহাউজ দেখাচ্ছিল, তাকে বললাম, ঢাকায় আমাদের নিজেদের বাড়ির ছাদে আমার বাবার করা বাগানে এধরনের শাক-সবজি চাষ হয়।

পেয়ারা-আংগুর থেকে শুরু করে লাল-শাক, পালংশাক সবই সেখানে হয়। আমার কথা সে ঠিক বুঝে উঠতে পারলনা। গ্রীন হাউজ ছাড়া শাক-সবজি হচ্ছে এটা সে চিন্তা করতে পারছিলনা। আরেকটা কারণ হতে পারে, ছাদে চাষবাস বিষয়টা বোধহয় এদের কাছে অজানা। চিন্তা করে দেখলাম, এদেশের সব বাড়ির ছাদই ঢালু চালা দেয়া টাইপ।

শীতের দিনে বরফ পড়লে যেন জমে না থাকে, তার জন্যেই এই ব্যবস্থা। বাড়ির ছাদে ওঠার কোন অপশন এখানে নেই। কেউ একজন ছাদে উঠে শাক-সবজি লাগাচ্ছে এটা কল্পনা করতে পারাটা তাই এদের কাছে অসম্ভব। পরিবেশ পরিচিতি শেষ হতে আরও একধাপ বাকি। লিলিয়ান এবং মীয়া আমাদেরকে তাদের বাড়ির প্রতিটি ঘর ঘুরে ঘুরে দেখাল।

বাসাটা তিনতলা (ট্রিপ্লেক্স)। নিচের তলায় বাবা-মা থাকে, মাঝের তলার একপাশে বড় মেয়ে লিলিয়ানের 'সংসার' আর একপাশে ড্রয়িং-ডাইনিং-কিচেন। সবার ওপরের তলায় বাকি তিনমেয়ের রুম। এদের দাদা এই বাড়িটা অনেক বুদ্ধি করে বানিয়েছিলেন নিজের থাকার জন্য। ফায়ারপ্লেস, এয়ারপাথ, ওয়াটারফ্লো, সোলারপ্যানেল- সবকিছু এমন ভাবে ডিজাইন করা যে, বর্ণনা শুনে মনে হলো শীত-গ্রীষ্ম কোন ঋতুতেই এদের ইলেকট্রিসিটি তেমন ব্যবহার করতে হয়না।

পুরো বাড়িটা সত্যিই দেখার মত একটা জিনিস। প্রকৃতি থেকে যতভাবে সম্ভব সুবিধা নিয়ে পাওয়ার কনসাম্পশন একেবারে মিনিমাম বানিয়ে ফেলেছে। বাসাটা সাজিয়েছেও একদম ছবির মত সুন্দর করে। এ পর্যায়ে, নিজেদের বাসার অবস্থা চিন্তা করে মনে মনে একটু দুঃখই পেলাম। নিজেকে সান্ত্বনা দেবার জন্য ভাবলাম, আমাদের অ্যাপার্টমেন্টটাও 'ছবির' মতই বলা চলে- কত ধরনের আর্টিস্টই তো থাকতে পারে, তাই নয় কি? মূল খাওয়া-দাওয়ার আগে এপিটাইজার পর্ব।

কিচেনের সামনে টেবিলের মত অংশে সারি সারি থালায় থরে থরে অনেক ধরনের খাবার সাজানো। আমাদের যার যেটা পছন্দ, তাকে সেটা নিয়ে খেতে অনুরোধ করল। আমেরিকায় কেউ কাউকে প্লেটে তুলে খাওয়ায় না। যার যা পছন্দ নিয়ে খাবে। আমি বাছাই করা শুরু করলাম কি খাওয়া যায়।

এখানে গ্রিডি মেথডে এগোলে চলবে না, ডাইনামিক এ্যালগোরিদম লাগবে। কারণ, অন্য আরেক টেবিলে মূল খাবারের আয়োজনের আভাস দেখা যাচ্ছে। অবশ্য এপিটাইজার যা দেখলাম, তাতে আর কোন এ্যালগোরিদমের দরকার নেই। একটা প্লেটে দিয়েছে ছয়-সাত রকমের কপি- সাদা ফুলকপি, হলুদ ফুলকপি, সবুজ ব্রকলি, কমলা গাজর, পেয়াজের ডাটা, বীচিহীন শিম ইত্যাদি। মুখে নিয়ে মনে হলো ঠিকমত সেদ্ধ হয়নি।

জিজ্ঞাসা করাতে বলল, এগুলো সরাসরি বাগান থেকে আনা ফ্রেস সালাদ- তার অর্থ এগুলো কাঁচা। শোনার পর আর দেরি নয়, চাবানো বন্ধ করে কোৎ করে গিলে ফেললাম। এরপর থেকে সাবধান হয়ে গেলাম। আরেকটা প্লেটে নিমকি টাইপ কি যেন দেখলাম, সেটা খেতে ভালো, সেটাই একটু খেলাম। পাশেই তিন চার রকমের স্যুপ- লাউ/পাম্পকিন আর কি কি যেন দিয়ে তৈরি।

আমি পেট ভরে গেছে এমন একটা ভাব করে সরে আসলাম। বোঝাগেল, এনামুলের কথায় রাজি হয়ে দুপুরে না খেয়ে আসলে কপালে দুঃখই ছিল। ততক্ষণে ডিনার রেডি। হুইট আমাদের সবাইকে ডিনার টেবিলে আমন্ত্রণ জানালো। সুন্দর করে সাজানো টেবিলটায় দশটা চেয়ারে দশজনের বসার জায়গা।

ক্রিস সহ বাড়িতে মোট আটজন বাসিন্দা, এরসাথে অতিথি দুজন -এনামুল এবং আমি। যে যার মত বসে পড়লাম। শুরুতে গৃহকর্তার দায়িত্বের অংশ হিসেবে হুইট ছোট একটা বক্তব্য রাখল। এরপর আমাদেরকে অনুরোধ করল প্রত্যেকের দুপাশের দুজনের হাতে হাত রাখতে এবং চোখ বন্ধ করে রাখতে। সে এখন কোন এক বিশেষ প্রার্থনা করবে এবং সেটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সবাইকে এই পজিশনে থাকতে হবে।

প্রার্থনা শেষ হলে সে তার ডানপাশের জনের হাত একটু চাপ দেবে এবং সেই সিগন্যাল পাওয়া মাত্র ডানপাশের জন একই কাজের পুনরাবৃত্তি করবে তার ডানপাশের ব্যক্তির সাথে। এভাবে পুরো একটা সাইকেল শেষ হলে প্রার্থনা শেষ। নিঁখুত প্রটোকল। বিষয়টা নতুন হলেও আমার কেন যেন পরিচিত পরিচিত লাগছিল। চিন্তা করে বের করলাম, আমাদের দেশের মানববন্ধন কর্মসূচির সাথে এটার মিল পাওয়া যাচ্ছে।

সরকার কিংবা অন্য কোন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে খুব বেশি ঝামেলা না করে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে এটার ব্যবহার আমাদের দেশে বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়। খাবার টেবিলে কার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা হলো সেটা অবশ্য বোঝা গেলনা। তবে মাথায় আইডিয়া আসল, এটা আমরা বাংলাদেশেও চালু করতে পারি। যেমন, খেতে বসে দেখা গেল তরকারিতে লবন মাত্রাতিরিক্ত বেশি, ব্যস, সাথে সাথে সবাই একটা মানব বন্ধন তৈরি করে বাড়ির গৃহিনীর বিরুদ্ধে ছোট খাট মোক্ষম একটা প্রতিবাদ করে ফেলা যেতে পারে এই পদ্ধতিতে। খাবারের আইটেমগুলো বরাবরের মতই খুব বেশি আমেরিকান।

যেমন, শুধু পানিতে সেদ্ধ করে লবন মেশানো বরবটির মত একটা সবজি। মীয়া জিজ্ঞাসা করল, কেমন হয়েছে খেতে? বোধহয় সে নিজে রেঁধেছে তাই নিজের প্রশংসা শোনার জন্যে জিজ্ঞাসা করল। আমি জিনিসটা মুখে নিতে চাচ্ছিলাম না, কিন্তু মেয়েটা চরম আগ্রহ নিয়ে আমার অভিব্যক্তির জন্য অপেক্ষা করছে বিধায় একটু মুখে দিতে হল। সে আবারও প্রম্পট করল, 'কেমন?', আমি বললাম, 'স্পাইসলেস, তুমি কি মসলা দিতে ভুলে গেছ?' সে সাথে সাথে রেগে গিয়ে কিচেন থেকে তিন বৈয়াম শুকনা মরিচের গুড়া নিয়ে এসে বলল- 'খাও'। আমি সত্যি সত্যি এবার সামনের ডিশ থেকে এক চামচ 'পটেটো ম্যাশ' নিয়ে শুকনা মরিচ দিয়ে মেখে খেতে লাগলাম।

পটেটো ম্যাশ এদেশে আরেকটি জনপ্রিয় খাবার। সেদ্ধ আলুর সাথে মাখন/চিজ মিশিয়ে এটাকে বানানো হয়। এটাকে আমাদের দেশের আলুভর্তার আমেরিকান ভার্সন বলা চলে। পার্থক্য হলো এটাতে কোন ঝাল কিছু দেয়া হয়না। আমার কাণ্ড দেখে মনে হলো লিলিয়ান বেশ খুশি হয়েছে।

আমার দেখাদেখি সে এবং তার দেখাদেখি ক্রিসও শুকনো মরিচ মেখে পটেটো ম্যাশ খেতে শুরু করল। মীয়া একবার খালি আস্তে করে বলল, 'আই লাইক কম্পিউটার সায়েন্স গাইস'। খাবার টেবিলে বসে অনেক আলাপ হলো। আমরা যে বাংলাদেশ থেকে এসেছি সেটা তারা আগে থেকেই জানত। ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন আগেই আমাদের পরিচিতি তাদেরকে দিয়ে রেখেছিল।

বাংলাদেশ কোথায়, কেমন,এত দূর থেকে অন্য কালচারে এসে কেমন 'শক' খাচ্ছি এসব জিজ্ঞাসা করল। এখানে আসার আগে আমরা কে কি করতাম জিজ্ঞাসা করল। আমরা দুজনেই শিক্ষক ছিলাম জানতে পেরে তারা বেশ খুশি হলো। বিশেষত মীয়া ও মার্থা, কারণ তারা নিজেরাও শিক্ষকতা করছে। বিপাকে পড়লাম যখন আমাদেরকে বেতন কত পেতাম জিজ্ঞাসা করল।

বুয়েটের ১৩,৬৭৮ টাকাকে এখন ৭০ দিয়ে ভাগ করে ডলার বানিয়ে বলতে হবে। হিসেবের সুবিধার্থে ১৪০০০ ধরে দেখি মাত্র ২০০ ডলার হয়। উত্তর দিতে গিয়ে আমি নিজেই চিন্তায় পড়ে গেলাম। ২০০ ডলারের চাকরি করলাম এতদিন, নাকি ভাগ অঙ্কে ভুল হচ্ছে? ২০০০ ডলার নাকি? নাহ, তাহলে তো একটু বেশিই হয়ে যায়। এনামুল ততক্ষণে উত্তর দিয়ে দিয়েছে।

ওরা জিজ্ঞাসা করল, এই টাকায় একজনের ফ্যামিলি চলে? আমরা বললাম, 'আমাদের তো টাকা খরচ করতে হয়না, বাবা-মা আছে বিধায়, অন্যদের হয়ত 'সামান্য' একটু কষ্ট হয়। ' লুকোনোর চেষ্টা করে কোন লাভ হলনা, আমাদের দৈন্যতা যে বুঝে ফেলেছে, সেটা আস্তে আস্তে সান্ত্বনাসূচক মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল। এরপর আমাদের বাবা-মা ভাই-বোন কি করে সেটা জানতে চাইল। এনামুলকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার বোন আছে কিনা? এনামুল হ্যাঁ সূচক জবাব দিলে জানতে চাইল, সে কি কখনো স্কুলে গিয়েছে কিনা? এই প্রশ্ন শুনে আমি বুঝতে পারলাম ঘটনা কোথায়। এরা ধরে রেখেছে বাংলাদেশ মানেই বোধহয় দূর্যোগ, দুর্ভিক্ষ, অশিক্ষা আর কুসংষ্কার।

তাদের ধারণা আমাদের দেশের সামান্য কিছু মানুষ শিক্ষিত, আর মেয়েদের তো শিক্ষার কোন সুযোগই নেই। এনামুল যখন উত্তর দিল যে তার বোন ব্যাচেলরস কমপ্লিট করে এখন মাস্টার্স করার চেষ্টা করছে, মার্থার চেহারা দেখে তখন মনে হলো, কোন একটা হিসেব সে মেলাতে পারছে না। আমাকে একই প্রশ্ন করাতে জানিয়ে দিলাম- বাবা ইঞ্জিনিয়ার প্লাস যুগ্ম সচিব, মা বিএ, ভাই ফ্লোরিডায় পিএইচডি করছে, বোন নাই। এবার প্রশ্নকারিনী পুরোপুরি চুপ। আমি মোটামুটি নিশ্চিত, এখন থেকে বাংলাদেশি কোন মানুষ দেখলে কথা বলার আগে এরা একটু চিন্তা করবে।

১৯০৮ সালের বাংলাদেশ আর ২০০৮ সালের বাংলাদেশ যে এক নয় এটা বোধহয় তারা জানেনা। অবশ্য ওদের দোষই বা দিই কি করে। আমাদের মধ্যেই এক শ্রেণীর মানুষ দেশটার এধরনের একটি রূপ ওদের সামনে তুলে ধরে কোটি কোটি ডলার হাতিয়ে নেয়। ইউটিউবে মান্না দে'র 'কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই' গানের ভিডিও যারা দেখেছেন তারা জানেন, ভিডিও'র শুরুতেই এ্যাড দেখানো হয়, 'সেভ বাংলাদেশ', 'ডোনেট ওনলি ২৫ সেন্ট' ইত্যাদি। এই টাকা কই যায়, কে খোঁজ নিয়ে দেখেছে।

এবার টার্কির পালা। থ্যাঙ্কসগিভিং ডিনারের প্রধান আকর্ষণ হলো টার্কি। আলাদা একটা টেবিলে আস্ত এক টার্কি রোস্ট করে রাখা হয়েছে। চার বোন মিলে চিৎকার চেচামেচি করে বলা শুরু করল সেটাকে কিভাবে তারা কিনেছে, কিভাবে স্লটার হাউসে গিয়ে সেটাকে প্রসেস করেছে এবং এসব করতে গিয়ে তারা কে কি বোকামি করেছে তার পুক্ষানুপুংখ বর্ণনা দিতে লাগল। তারা নিজেরাই এটাকে জবাই করেছে বলে খুব বড়াই করছিল।

আমাদের জিজ্ঞাসা করল তোমরা কখনও কোন পশু জবাই করেছ? এনামুল বলল- 'চিকেন'। আমি বললাম, 'গরু'। প্রতি কুরবানীর ঈদেই ইমামের সাথে আমিও একটু ছুরিটা ধরি। সে ঘটনাই বললাম, শুধু ইমাম সাহেবের অংশটুকু বাদ দিয়ে। তারা সবাই একথা শুনে চোখ বড় বড় করে এমনভাবে তাকালো, যেটাকে ভাষায় প্রকাশ করে বাংলায় ট্রান্সলেট করলে শোনাবে- 'খাইসে'।

সবকিছুর মত টার্কিটাতেও কোন টেস্ট নেই। শুধু পানিতে সেদ্ধ করা জিনিস খাওয়ার মত আমেরিকান এখনও হতে পারিনি। এক সেন্টিমিটার সাইজের সামান্য একটা পিস গলা দিয়ে নামাতে আমার যথেষ্ট বেগ পেতে হলো। শেষ পর্যন্ত ব্রেড আর অ্যাপেল জুস দিয়েই ডিনার শেষ করলাম। খাওয়ার পর এবার বিনোদন পর্ব।

এ পর্বের শুরু থেকেই লিলিয়ানের বয়ফ্রেণ্ড হাওয়ার্ডকে বেশ সপ্রতিভ মনে হলো। সে তার সদ্য কেনা গীটার নিয়ে আসর বসিয়ে বিভিন্ন গানের সুর তোলা শুরু করল। গানগুলো বেশ পরিচিত হবার কথা, কেননা সবাই বেশ উপভোগ করছে, কিন্তু আমার স্বল্প জ্ঞানের দরূন একটা গানও চিনতে পারলাম না। গ্রেচেন কোত্থেকে একটা বাঁশ নিয়ে এসে সেটাকে ফুঁ দিয়ে দিয়ে বীকট আওয়াজ করা শুরু করলো। সেটি স্পষ্টতঃই আনুমানিক চার-পাঁচ ফিট সাইজের একটি বাঁশ।

এটাকে কোন একটা মিউজিক ইন্সট্রুমেন্ট হিসেবে মেনে নিতে আপত্তি জানালে, সে আমাকে তাৎক্ষণিক ইউটিউবের এক ভিডিও বের করে দেখিয়ে দিল এধরনের যন্ত্রে ফুঁ দিয়ে একজন বিখ্যাত কোন মিউজিশিয়ান বাদ্য বাজাচ্ছে। আমি নিশ্চিত, এটা আমেরিকায় বিরল কোন বাদ্যযন্ত্র হিসেবে পরিচিত এবং এর দাম এখানে হাজার ডলারের কম হবার কথা নয়। চিন্তা করে দেখলাম, আমাদের গ্রামের বাড়ির ঝাড়-জঙ্গল কেটে এই সাইজের কিছু বাঁশ আমেরিকায় এক্সপোর্ট করতে পারলে ইউভিএতে পিএইচডি করার জন্য আমার বোধহয় আর কোন স্কলারশিপের দরকার পড়তোনা। আমরা সমানে তাদের বাজনার প্রশংসা করে যাচ্ছি দেখে ম্যাডিলিনও একটা ভায়োলিন নিয়ে এসে সেটাতে করুণ সুর বাজানোর চেষ্টা শুরু করল। সুরটি বাস্তবিক ভাবেই আমাদের কাছে বেশ করুণ মনে হল।

একটু পর ওদের বাবা হুইট একটা ঝুনঝুনি ওয়ালা তবলা জাতীয় বাদ্য বাজানো আরম্ভ করল। উপায়ান্তর না দেখে, নিজেদের অসহায়ত্ব চেপে, অথচ চোখে-মুখে উৎসাহ নিয়ে, আমরা একসাথে অনেকগুলো বাদ্যযন্ত্রের কর্কশ কোরাস হজম করলাম। মনে হল, এটা যখন হজম হয়েছে, আমরা এখন সবকিছুই হজম করতে পারব। ক্রিস যখন তাই- 'কে কে পিকশনারিতে আগ্রহী' বলে সবার মতামত চাইল, আমি তখন কোন উচ্চবাচ্য না করে কিছু না বুঝেই রাজি হয়ে গেলাম। পিকশনারী হচ্ছে এক ধরনের বোর্ড গেম।

খেলাটা মোটামুটি এরকম- একজন প্লেয়ার এক প্যাকেট কার্ড থেকে একটা কার্ড ড্র করবে এবং সেখানে যে শব্দটি লেখা আছে, সেটা একটা কাগজে আঁকা শুরু করবে। বাকিদের মাঝে যে সবার প্রথমে বলতে পারবে সে কি আঁকছে, সে হবে সেই রাউণ্ডের বিজয়ী। সাথে একটা বোর্ড আছে যেটাতে ছক্কা মেরে গুটি চালার মাধ্যমে কে নেক্সট রাউন্ডে আঁকাআঁকি করবে সেটা নির্ধারণ করা হয়। ছোট বাচ্চাদেরকে শব্দ এবং ড্রয়িং শেখানোর জন্য ভাল একটি খেলা, অথচ এই বয়সে এটাকে খেলতে হচ্ছে। কোন সমস্যা নেই আমার, আমি এখন কাঁচা টার্কিও হজম করতে পারব, আর এ তো ছেলেখেলা।

খেলা শুরু হলো। সবার প্রথমে মার্থা কোন একটা পাখি আঁকলো, যেটা আমি চিনতে পারলাম না। পরে বোঝা গেল উটপাখি। এরপর লিলিয়ান কিছু একটা আঁকা শুরু করতেই চিৎকার করে গ্রেচেন উত্তর বলে দিল, কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই। তৃতীয়বার হুইটের আঁকাবার পালা।

এবারে আমি মহা সিরিয়াস, কিছুতেই মিস হতে দেব না। হুইট একটা হৃদয়ের ছবি আঁকতেই- কেউ হার্ট, কেউ ভালোবাসা, কেউ হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট, কেউ হার্ট এ্যাটাক বলে চিৎকার শুরু করলো। সাদা কাগজে হুইটের আঁকা হৃদয়টার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা মনে পড়ে গেল। এরপর আর কিছুতেই খেলায় মন বসাতে পারলাম না। রাত প্রায় দশটার মত বেজে গেছে।

আমরা যাব যাব ভাব করছি। কিন্তু ডেজার্ট পর্ব তখনও বাকি। খুব সংক্ষেপে সেটাকে শেষ করা হলো। প্রায় দশ-বারো রকমের 'পাই' তৈরি করেছে আমাদের জন্য। আমেরিকানদের বোধহয় সবচেয়ে পছন্দের জিনিস এই 'পাই'।

এগুলো খেতে খুব বেশি মিস্টি। কারো কারো কাছে সহ্যের অতিরিক্ত মিস্টি মনে হতে পারে। হাল্কা একচিমটি খেয়ে বুঝতে পারলাম আমি এখনও সেই দলেই আছি। এখানে একটা প্রবচন আছে- 'এ্যজ অ্যামেরিকান এ্যজ এ্যাপল পাই'। অর্থটা ঠিক সিওর না হলেও অনেকটা এরকম- 'কে কতটুকু আমেরিকান সেটা বুঝতে হলে, তাকে এ্যাপল পাই খাইয়ে দিয়ে তার মুখের অভিব্যক্তি দেখে নির্ণয় করা যেতে পারে'।

আমার আরো হাজার বছর লাগবে সেই পর্যায়ে যেতে। আপাতত হাতে অত বেশি সময় নেই। রাত বারোটার আগেই বাড়ি ফিরতে হবে। কারণ এখনও রাতের অভিযান বাকি। অভিযানের ব্যাপারটা পরে ব্যাখ্যা করা হবে।

এখন বিদায় দৃশ্যের সামান্য বর্ণনা না হলেই নয়। ক্রিসকে ইশারা করতেই সে বলল, 'চালো'। ক্রিস বেশ কিছুদিন ইণ্ডিয়ায় ছিল, তাই কিছু কিছু হিন্দি শব্দ সে জানে। সে এই বাড়িতে প্রায়ই আসে। আজকে তার দায়িত্ব ছিল আমাদের ডিনারে নিয়ে আসা এবং আবার বাড়ি পৌঁছে দেয়া।

পরিবারের সবার কাছ থেকে আমরা একে একে বিদায় নিলাম। 'খুব ভালো লাগলো', 'আবার আসবেন', 'অবশ্যই আসব', 'মনে থাকবে'- এধরনের অনেক প্রতিশ্রুতি বিনিময় হলো। মার্থা ভেতর থেকে আমাদের ওভার কোট এনে দিলে বুকের ভেতর থেকে একটা টেনশন দূর হয়ে গেল। যাবার আগে হোস্টদেরকে গিফট দেবার নিয়ম। এদেশে সামান্য কিছু দিতে গেলেই দশ-বিশ ডলার খরচ হয়ে যায়।

তাই বুদ্ধি করে বাংলাদেশ থেকেই আমি বেশ কিছু গিফট এনেছিলাম। আজ সেগুলো কাজে লাগছে। বিদেয় বেলায় চার মেয়ে এবং তাদের মাকে বাংলাদেশ থেকে আনা পাঁচটি রঙ-বেরঙের 'গামছা' উপহার দিলাম। গামছাগুলো পেয়ে তারা তাদের আনন্দ প্রকাশের ভাষা হারিয়ে ফেলল। ছোট তিন মেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে গামছাগুলোকে পরার তিনটি ভিন্ন ভিন্ন স্টাইল বের করে ফেলল।

তাদের দেখে আমার কেন জানি মনে হতে লাগল, আজ থেকে বছর খানেক পর আমেরিকায় যদি কখনও গামছা ফ্যাশনের প্রচলন হয়, তবে সেটার সাথে আজকে রাতের এই ঘটনার যোগসূত্র থাকার সম্ভাবনা শত ভাগের কাছাকাছি। আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়লাম আমাদের নিজেদের পথে। আসার সময় ক্রিসের সাথে অনেক গল্প হলো। সে হারভার্ড ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্সে সিকিউরিটির ওপর পিএইচডি করছে। ব্লগ লিখে সে টাকা উপার্জন করে এবং নিজের টাকায় দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ায়।

কথার এক ফাঁকে জানতে পারলাম, সিনেট ডট কমের সিকিউরিটি বিভাগে যে বিখ্যাত ফ্রী-ল্যান্স ব্লগার 'ক্রিস্টোফারের' আর্টিক্যাল আমরা পড়ি, সে-ই হচ্ছে এই ক্রিস। আমি যে নিজেও ব্লগিং করি, সেটা চান্স পেয়ে তাকে একটু শুনিয়ে দিলাম। ক্রিসকে মনে হলো বেশ ঝানু ব্যক্তি। আসার পথে সারারাস্তায় সে আমাদের নানান বিষয়ে হরেক রকম তথ্য দিল। যেমন, কোন পদ্ধতিতে কি করে টাকা বাঁচানো যায়, এক ডলার খরচ করে কি করে অন্য শহরে যেতে পারি, বিনে পয়সায় সে কিভাবে আগামীকাল ইন্দোনেশিয়া যাচ্ছে, গাড়ি না কিনে কি করে কাজ চালানো যায়, ফ্রী খাবার কি করে পেতে হয়, সুপারভাইজারকে কি করে 'নো' বলতে হয়- সব সে বুঝিয়ে দিল।

আধা ঘন্টার রাস্তা, অথচ জ্যামের কারণে সিগন্যালে সিগন্যালে আমরা আটকে পড়ছি বারবার। আমেরিকার রাস্তায় জ্যাম শুনে অনেকেই অবাক হতে পারে, কিন্তু ছোট-খাট ট্রাফিক শারলোটস ভিলের ব্যস্ত রাস্তায় হরদমই থাকে। তারপরও সে রাতের ব্যাপারটা কেমন যেন একটু অস্বাভাবিক লাগছিল। মনে হচ্ছিল, গাড়ির পরিমাণ রাস্তায় যেন একটু বেশি-ই। ক্রিসকে কথাটা বলাতে সে বলল, 'আজ রাতে যে ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেটা জানোনা?' আমরা হালকা জানলেও পুরোটা ঠিকমত শোনার উদ্দেশ্যে তাকে না-সূচক জবাব দিলাম।

সে বলল, 'ব্ল্যাক ফ্রাইডে হচ্ছে আমেরিকায় কেনাকাটার জন্য সবচেয়ে মোক্ষম দিন। এ রাতে ঠিক বারোটার পর থেকে বড় বড় শপিং মলে নামমাত্র মূল্যে জিনিসপত্র বিক্রি করা হয়। ' কারণ জিজ্ঞাসা করাতে সে বলল, 'ব্যবসায় লালবাতি কথাটা তো শুনেছ নিশ্চয়ই। ব্যবসার বেলায় 'লাল' হচ্ছে নেগেটিভ, আর 'কালো' হচ্ছে পজিটিভ। ব্ল্যাক ফ্রাইডে হচ্ছে ক্রিসমাসের আনুমানিক এক মাস আগের একটি শুক্রবার রাত, যেদিন থেকে সবাই কেনাকাটা শুরু করবে এবং ক্রিসমাসের আগ পর্যন্ত জমজমাট ব্যবসা হবে।

এটার শুরুতে 'কিকঅফ'-টা যেন ভালোমত হয় তার জন্যই এ আয়োজন। ' ক্রিস আমাদেরকে পরামর্শ দিল, আজকে রাতেই যা যা পার কিনে নেবার, জলের দামে সব পাওয়া যাবে। তবে বুদ্ধি করে সব করতে হবে। রাত বারোটায় অনলাইনে প্রথমেই যা যা পারা যাবে কিনে ফেলতে হবে, এরপর বাকি জিনিস স্টোরে গিয়ে কিনতে হবে। বিভিন্ন স্টোর সাধারণতঃ রাতের বিভিন্ন টাইমে ওপেন হবে।

ওয়েবসাইটে গিয়ে সেসব লিস্ট করে দোকান খোলার অন্তত এক ঘন্টা আগে গিয়ে লাইন দিতে হবে। যেসব দোকানে খুব বেশি আকর্ষণীয় সেল থাকে, সেখানকার লাইনে মারামারি-ফাটাফাটি হতে পারে, তাই সেটার জন্যেও প্রস্তুত থাকার পরামর্শ দিল সে। ক্রিসের কাছে পুরোটা শোনার পর আজ রাতে যে আমরা 'যাচ্ছি' সেটাতে আর কোন সন্দেহ রইল না। 'কিন্তু এত রাতে যাব কি করে?'- প্রশ্নটা যেমন একই সাথে আমার এবং এনামুলের দু'জনেরই মাথায় এসেছে, উত্তরটাও তেমনি একই সাথেই দু'জনের মুখ থেকেই বেরোল- 'তানিয়া আপা'। (চলবে)


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।