বাস্তবতা ফেরী করে বেড়াচ্ছে আমার সহজ শর্তের সময়গুলোকে
পড়ালেখায় আগের চেয়ে মনোযোগী হয়ে উঠেছি। অবশ্য এর পিছনে কারন আছে। নিজে থেকেই পড়ালেখায় মনোযোগী হবো এমন ভালো ছাত্র আমি নই। ইউনিভার্সিটির থার্ড ইয়ারে ছাত্রছাত্রীরা পড়ালেখায় এমনিতেই একটু মনোযোগী হয়। তাছাড়া সেকেন্ড ইয়ার ফাইনালে একটু বেশি ভালো রেজাল্ট করে ফেলায় শিক্ষকদের উচ্চ ধারণা হয়ে গেছে আমার উপর।
ক্লাসে এমনি এমনি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে বসে। ভালো ফলাফলের কারনে একটা লাভ হয়েছে অবশ্য। এখন আশেপাশে অনেক বন্ধু। বিশেষ করে আগে ক্লাসের যে মেয়েগুলো আমাকে গ্রামের ছেলে মনে করে কথা বলতো না তারা নিজেরাই এসে কথা বলে। পড়ার ব্যাপারে পরামর্শ চায়।
আমি বিষয়গুলো বেশ এনজয় করি।
এখন ক্লাস শেষেই বাসায় ফিরে আসি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনের সামনেই একটা মাঠ রয়েছে। সেখানকার নিয়মিত আড্ডায় অংশ নেই। আগে এই ধরনের আড্ডায় যেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম না।
এখন আমি আড্ডায় অংশগ্রহণ করলে সহপাঠীরাও খুশি হয়। এর কারন আমার ভালো রেজাল্ট কিনা ধরতে পারি না। এই বয়সীদের আড্ডার মূল অনুসঙ্গ হিসাবে অবধারিত হিসাবে চলে আসে সম্পর্কের বিষয়টি। আমিও সাবলীলভাবে আমার মত দেই। ইদানিং লক্ষ্য করছি ভালোবাসার সম্পর্ক নিয়ে বলা আমার কথাগুলো সহপাঠী বন্ধুরা খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে।
বিষয়টা পরিস্কার করে বুঝতে পারলাম যখন ক্লাসের একটা ছেলে তার সম্পর্কের ব্যাপারে আমার কাছে পরামর্শ চাইলো। ক্লাসের একটা মেয়েকে সে ভালোবাসে। মেয়েটাও সেটা জানে। তবে সমস্যা হচ্ছে মেয়েটা তাকে নানাভাবে ঘোরাচ্ছে। এই ঘোরানো অবস্থা থেকে মুক্তি পেতেই আমার শরণাপন্ন হয়েছে সহপাঠী বন্ধুটি।
সে জানে মেয়েটার সাথে আমার ভালো পরিচয়। আমি কথা বলবো সিমিনের সাথে, এমনটা বলে ছেলেটাকে আশ্বস্ত করলাম।
একদিন একটু আগে ক্লাস শেষ হয়ে গেল। সিমিন তাড়াতাড়ি করে ক্লাস থেকে বের হচ্ছে। আমিও একসাথেই বের হচ্ছিলাম।
আমি আগ বাড়িয়ে বললাম-
সিমিন তুমি কি কোথাও যাচ্ছো?
কেনো বলতো?
তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। এখন কি বলা সম্ভব?
তুই আবার আমার সাথে কি কথা বলবি যে এভাবে বলছিস? মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো সিমিন।
সহপাঠীদের অনেকেই এখন আমাকে তুই সম্বোধন করে। তবে আমি এখনো তুমি সম্বোধনের অর্গল পেরিয়ে তুই-তে পৌছাতে পারিনি। ফর্সা, একহারা গড়নের স্মার্ট মেয়ে সিমিন অবলিলায় আমাকে তুই সম্বোধন করে, অথচ আমি তাকে তুমি তুমি করে বলি।
ডিপার্টমেন্টের বারান্দা পেরিয়ে মাঠের এককোনে গিয়ে বসলাম দুজনে। বসেই সিমিন বললো-
আজকের ওয়েদারটা অনেক সুইট না? শীতের সকালগুলো বেশ ভালো লাগে। সকাল হয়েছে অনেকক্ষণ হলো। এখন একটু একটু মিস্টি রোদ, শীতল বাতাস, সবমিলিয়ে দারুন এক ওয়েদার।
সিমিনের হাত নাড়ানো দেখতে দেখতে তার কথা শুনছিলাম।
কথা বলার সময় মেয়েটা প্রচুর হাত নাড়ায়। তার এতোগুলো কথার জবাবে শুধু সংক্ষেপে বললাম, হুমমম।
আচ্ছা এখন বল, কি এমন ঘটনা হলো? কিংবা কি এমন বিশেষ কথা যে আমাকে ডেকে এনে মাঠে বসালি?
কিভাবে শুরু করবো তাই ভাবতাছি।
কিরে? তোর লক্ষণতো ভালো মনে হচ্ছে না। প্রেমের প্রস্তাব দিবি নাকি আমাকে? বলেই হাসতে লাগলো সিমিন।
ধুর, সবকিছুতে তোমার দুষ্টুমি! আসলে তারেকের ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলার জন্যই তোমাকে ডাকলাম।
সঙ্গে সঙ্গেই সিমিনের উৎসাহ চলে গেল। তারপরেও আমি সামনে বসে আছি, কথা বলতে হবে এমন ভাব নিয়ে সে বললো- আচ্ছা বল, কি বলতে চাস তার সমন্ধে?
কেন তুমি জানো না? সবকিছু কি আমাকে নতুন করে শুরু করতে হবে?
দেখ, বিষয়টা নিয়ে অনেক ভেবে আমি আজকের অবস্থানে আছি। আমার কাছে তারেকের ব্যাপারটাকে ভালোবাসার মোহ মনে হয়। ইউনিভার্সিটির শুরুর দিকে হঠাৎ একদিন আমাকে দেখে ভালো লেগে গেল।
এটা মোহ ছাড়া আর কিইবা হতে পারে? সে আমার সমন্ধে কতোটুকুইবা জানে?
কিন্তু যদি মোহই হতো তাহলে কি ছেলেটা তিন বছর ধরে তোমাকে ভালোবাসার কথা শুনিয়ে যেতো?
এই ব্যাপারটা নিয়ে আমিও ভাবি। তবে কি করবো বল? কিছু বিষয়ের কাছে আমি বন্দী।
মানলাম কিছু বিষয়ের কাছে তুমি বন্দী। তাই বলে এইসব উদ্ভট প্রস্তাব দিয়েছ কেন? আবাসিক হলের পাশের পুকুরে শীতের সকালে লাফিয়ে পড়তে হবে। এইসবের মানে কি?
এইটা ভালোবাসার তীব্রতা বোঝার পরীক্ষা।
কেউ একজন আমাকে ভালোবেসে শীতের সকালে পুকুরে লাফ দিয়েছে, এমনটা ভাবতেই ভালো লাগে। বলেই হাসতে লাগলো সিমিন।
এইটা তোমার স্রেফ পাগলামি। ভালোবাসার তীব্রতা বোঝাতে একটা ছেলে শীতের সকালে লাফ দিয়ে পুকুরে পড়ে যাবে। তাছাড়া সে সাতারও জানে না।
মরে গেলে ভালোবাসার তীব্রতা প্রমাণ হবে, তাই না?
ভালোবেসে কেউ কারো জন্য মরে যাচ্ছে এইটা অনেক তীব্র ভালোবাসা না তোর কাছে?
চুপ করো তুমি। তুমি তারেকের ইমোশন নিয়ে খেলছো।
ওকে। আর কিছু বলতে চাস তুই? নাহলে আমি উঠি। বলেই উঠতে যাবে এমন সময় বললাম-
আচ্ছা সিমিন, তোমার ব্যাপারটা আরেকটু পরিস্কার করে বলোতো।
দেখ! একটা ঘটনার বাইরে থেকে সেই ঘটনা নিয়ে অনেকভাবেই সমালোচনা করা যায়, ঘটনার অনেক ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। কিন্তু ঘটনার ভিতর থেকে বলতে গেলে কার্যকরণ অনেক কমে যায়।
হুমম।
তাহলে তোকে বলি আমার জীবনের কিছু কথা। এই কথাগুলো আগে কাউকেই বলিনি।
ঠিক আছে বলো।
তখন আমি ক্লাস সেভেনের ছাত্রী। ওই বয়সটাতে প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে এতো তীব্র জ্ঞান ছিল না। তবে সেই বয়সে বাড়িওয়ালার ছেলেটাকে খুব ভালো লাগতো। পড়া বুঝে নেওয়ার বাহানা করে তার কাছে গল্প করতে যেতাম।
তার সঙ্গে সময় কাটাতে খুব বেশি ভালো লাগতো। সেই বয়সে এটা ঠিক ভালোবাসা নাকি মোহ ছিল এখনো বুঝতে পারি না। প্রায় দিনই তার সাথে দেখা হতো। আমরা এক রুমে বসে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতাম। ছেলেটিও আমাকে পছন্দ করতো।
যদিও সে তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়তো তারপরেও আমি গেলেই স্বাচ্ছন্দ্যে গল্প করতো নানা বিষয় নিয়ে। মাঝেমধ্যে ভালোবাসার কথা বলতো। আমি হ্যাঁ না কিছু না বলে মুগ্ধ হয়ে গল্প শুনতাম। সব কিছু ঠিকঠাক মতো চলছিল। এক বিকালে গল্প করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল।
আকাশ কাপিয়ে বৃষ্টি নামলো হঠাৎ। ইলেকট্রিসিটিও চলে গেলো সেই সময়টাতে । অন্ধকারে ভয় হতে লাগলো। তখনো সেই ভয় আসলে কিছুই ছিল না। কিছুক্ষণ পর ভয়ে কুকড়ে গেলাম যখন শরীরে একটা হাতের স্পর্শ পেলাম।
সেই বয়সেই বুঝে গিয়েছিলাম হাতের স্পর্শটা অন্যরকম। কিন্তু সেই সন্ধ্যায় আমার চিৎকারের শব্দ বৃষ্টি আর বাঁজ পড়ার শব্দকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। সেই সন্ধ্যা আমার জন্য নির্মম সন্ধ্যা হয়ে উঠেছিল। তবে আমি সেই কথা কখনোই কাউকে বলনি, বলতে পারিনি। পরে সেই ছেলেটির সাথে দেখা হলেই অন্যদিকে চলে যেতাম।
মনের ভিতর ছেলেদের নিয়ে ভয় বাসা বেধে গেল। তারপর থেকে আমি ভালোবাসার সম্পর্কে স্বাভাবিক হতে পারি না। সত্যি বলতে কি জানিস, আমার কাছে এখন সব ছেলেকেই প্রতারক মনে হয়। জানি অনেক ছেলেই ভালো। তারপরেও ভয়টাকে আমি কাটাতে পারি না।
চুপ করে সিমিনের কথা শুনছিলাম। তার কথাগুলো শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলাম। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে বললো-
আমার একটা জরুরী কাজ আছে। আমি আজ যাই। এই বলেই সে চলে গেল।
আমি আরো কিছুক্ষণ মাঠে বসে রইলাম শূণ্য বোধ নিয়ে। মানুষের জীবনে কতো রকমের ঘটনা যে অন্তরালে থেকে যায়! বাসায় ফেরার সময়ও বিষয়টা নিয়ে ভাবলাম। হঠাৎ সময় দেখতে গিয়ে ঘড়ির দিকে তাকাতেই মনে পড়লো বেশ কিছুদিন ধরে অবন্তীদের বাসায় যাওয়া হচ্ছে না। একদিন যাওয়া দরকার।
(চলবে......)
প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
পঞ্চম পর্ব
ষষ্ঠ পর্ব
সপ্তম পর্ব
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।