আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যেদিন হিরোশিমা পরিনত হয়েছিলো নরকে

বিচ্যুত যৌবনে জোছনা আমায় করেছে উম্মাদ আ্যটম বোমা বর্ষনের ছেষষ্টি বছর পর, মৃত্যু ও ধংস্সের একটি দিন বর্ননা করছেন বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শী কেইজিরো মাতসুশিমা লিখেছেন: সাসা উইকস্ট্রম প্রকাশিত: আলজাজিরা.নেট অনুবাদ: উপপাদ্য পারমানবিক বোমার আঘাতে ধংস্সাবশেষের সাক্ষি আ্যটম বোম্ব ডৌম ছেষট্টি বছর পূর্বে আমেরিকানদের নিক্ষিপ্ত আ্যাটম বোমা জাপানি শহর হিরোশিমাকে পরিনত করেছিলো জলন্ত নরকে। একদিনের এই ধংস্স উন্মত্ততায় প্রায় এক লক্ষ মানুষের জীবন হারানোর সাক্ষি কেইজিরো মাতসুশিমার বয়স তখন ছিলো মাত্র ১৬ বছর। তিনি বলেন, ৬ অগাস্ট ১৯৪৫ সাল ছিলো একটি সুন্দর দিন, আকাশ ছিলো নীল। বছর দেড়েক তিনি ও তার সংগীরা মিলিটারীদের জন্য পোষাক বানানোর কারখানায় কাজ শেষ করার পর মাত্র এক সপ্তাহ পূর্বে ফিরে এসেছেন স্কুলে। সকাল ০৮:১৫ মিনিট তার ক্লাস মাত্র শুরু হয়েছে।

তিনি শুনছেন তার শিক্ষক ডিফারেন্সিয়াল ও ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাসের উপর একটি প্রশ্নের ব্যাখ্যা করছেন। ' আমি জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিলাম এবং দুটি আমেরিকান বি-২৯ বোমারু বিমান দেখতে পেলাম। আমি শুধু ভাবছিলাম ''আবারো আমেরিকান বিমান'' ধারনা করলাম রুটিন ওয়ার্কের জন্য সম্ভবত তারা বাইরে এসেছে। বিকট শব্দে বিষ্ফোরনটা ঘটলো তখনই যখন খালি বাইরে থেকে বইয়ের দিকে মুখটা ফিরিয়েছেন। সেখানে খুব শক্তিশালী একটা স্ফুরন ও তাপ প্রবাহ বইছিলো।

পুরো বিশ্বটাকেই মনে হলো কমলার মতো কিছু একটাতে পরিনত হয়ে গেছে। আমার মনে হচ্ছিলো আমাকে কিছুক্ষনের জন্য একটি গরম চুল্লীতে নিক্ষিপ্ত করা হয়েছে। পরবর্তীতে জেনেছেন হাইপোসেন্টারের(১) কাছাকাছি ভূপৃষ্ট যা তার স্কুল থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে পৌঁছে গিয়েছিলো কমপক্ষে ৩০০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে। সাহায্য করুন ভগবান বুদ্ধা স্ফুরন শুরু হয়েছিলো বিকট আওয়াজের পরপরই। মাতসুশিমা এখনো জানেন না বিকট শব্দগুলো বিষ্ফোরনের ছিলো নাকি দালানকোটা ধস্সে পড়ার ছিলো।

আমি আমার চোখ-কান বন্ধ করে লাফ দিয়ে ডেস্কের নিচে ঢুকে পরি। তিনি বলেন এটা ছিলো গভীর কৃষ্ণবর্নের, আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। অনেক ছেলেরা ছিলো রুমের মধ্যে কিন্তু কারো মুখেই আওয়াজ ছিলোনা। সেখানে বইছিলো একটা দানবীয় নিরবতা। আমি হামগুড়ি দিচ্ছিলাম চারপাশে আর চিন্তা করছিলাম '' আমাকে সাহায্য করো মা, আমাকে সাহায্য করো প্রভু বুদ্ধা'', আর এটাই ছিলো আমার জিবনে প্রথম ইশ্বর বুদ্ধার কাছে সাহায্য চাওয়া।

মাতসুশিমা নিজেকে বেঁচে যাওয়া সৌভাগ্যবানদের একজন বলে মনে করেন। তার শরীরে টুকরো টুকরো গ্লাসের কেটে যাওয়া দাগ ছাড়া বড় ধরনের কোন আঘাতপ্রাপ্ত হননি। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম এটা ছিলো একটি মাত্র বোমা। কিন্তু যখন বাইরে বের হয়ে আসলাম তখন দেখলাম বাইরের সব দালান-কোটা, ঘর-বাড়িগুলোকে আঘাতপ্রাপ্ত। আমি ভাবছিলাম দুটি বোমারু বিমান কি করতে পারে? তার এক বন্ধু মাথায় বেশ বড় আঘাত পেয়েছেন।

মাতসুশিমা তার মাথায় কাপড় দিয়ে বেঁধে তাকে আস্তে আস্তে হাঁটিয়ে পাশের রেডক্রস হাসপাতালে যেতে সাহায্য করছিলেন। প্রেতাত্মাদের মিছিল দালানগুলোতে আগুন জ্বলছে, দুটি ছেলে মিলিতভাবে শহরের ধংস্সস্তুপ থেকে বাঁচার জন্য ট্রাম লাইন ধরে হেঁটে যাওয়া আহতদের সংখ্যা গুনছিলো। মাতসুশিমার মনে পড়ছে, তাদের চুল খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। অনেকেরই মাথার সমস্ত চুল পড়ে গিয়েছিলো। অনেকের শরীরের মাথা থেকে পা পর্যন্ত আগুনে পুড়ে গিয়েছিলো।

তাদের চামড়া মাথা থেকে খসে পড়ছিলো। তাদের পরনের কাপড়গুলো পুড়ে গিয়েছিলো। অনেকেই ছিলো সম্পূর্ন উলঙ্গ। আমি আমাকেই বলছিলাম 'হিরোশিমার মৃত্যু আসন্ন। ' আমি তাদের অনেকেরই চামড়ার নিচে রক্ত বর্নের মাংশ পেশী দেখতে পাচ্ছিলাম।

তারা সবাই তাদের বাহুগুলো সামনের দিকে ধরে রাখছিলো সম্ভবত ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার কারনে। তারা লম্বা লাইন ধরে ধীরে ধীরে হাঁটছিলো। শত শত মানুষের এমন হেঁটে যাওয়া দেখে মনে হচ্ছিলো এ যেনো প্রেতাত্মাদের মিছিল। কিন্তু অসংখ্য মানুষ বেশীদূর হাঁটতে পারেনি। মাতসুশিমা হিরোশিমায় ফিরে গিয়েছিলেন বোমা বর্ষনের তিন বছর পর এবং এখনো সেখানেই বসবাস করছেন মানুষগুলো হামাগুড়ি দিয়ে নদীর দিকে যাচ্ছিলো, তারা হাহাকার করছিলো পানির জন্য যেন তাদের পুড়ে যাওয়া শরীরকে ঠান্ডা করা হয়।

তাদের অনেককেই মৃত্যুবরন করতে হয় নদী তীরে অথবা নদীতে ডুবে। নদীটি পরিপূর্ন হয়ে পরেছিলো মানুষের অসংখ্য দেহে। মাতসুশিমা বলেন বিষ্ফোরনের কারনে রেডক্রস হাসপাতালও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কয়েকজন ডাক্তার ও নার্স, যারা নিজেরাও আহত তারা আপ্রান চেস্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন শত শত মানুষের শুস্রুষা করতে। সাহায্যের আশা এখানে নেই বলে মাতসুশিমা তার আহত বন্ধুকে নিয়ে বের হয়ে এলেন।

সৌভাগ্যবশত উদ্ধারকারী ট্রাক এসে তার বন্ধুটিকে নিয়ে যায় শহরের বাইরের এক হাসপাতালে। হাইপোসেন্টারের ২ কিলোমিটারের ভিতরে প্রায় সকল দালানকোটা ও ঘরবাড়ি ধংস্স ও পুড়ে গিয়েছিলো। কৌশলগত শহর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সেনাদের গৃহ সংস্থান, সাপ্লাই ও কিছু হেডকোয়ার্টার থাকার কারনে হিরোশিমা কৌশলগতভাবে গরুত্বপূর্ন ভুমিকায় অবতীর্ন হয়। যখন হিরোশিমায় বোমা ফেলা হয় তখন সেখানে চার লক্ষ মানুষের বসবাস ছিলো। বেশীরভাগ বসবাসকারী ছিলো বাইরে থেকে যুদ্ধের জন্য সমবেত করা শ্রমিক যারা কাজ করতো কোরিয়ান ও অন্যান্য ফোর্সড লেবারদের(২) সংগে মিলিটারী ফ্যাক্টরীগুলোতে।

বছরের শুরুর দিকে স্বামীর মৃত্যুর পরে মাতসুশিমার মা স্থানান্তরিত হয়ে গ্রামে চলে গিয়েছিলেন। মাতসুশিমা যে ডরমিটরিতে থাকতেন তা ধংস্স হয়ে গিয়েছিলো। পায়ে হেঁটেই তিনি হিরোশিমা ছাড়লেন। কিছুদূর যাওয়ার পরে কোন মতে একটি উদ্ধারকারী ট্রেনে উঠে অবশেষে তার মায়ের গ্রামের বাড়ীতে পৌঁছাতে পারলেন। তার মা শহরের আকাশে মেঘের দলার মতো ধোঁয়ার বিরাট বিরাট কুন্ডলী দেখতে পেয়েছিলেন এবং ধরনা করেছিলেন তার ছেলে বুঝি এতক্ষনে মৃত্যুবরন করেছে।

জ্বর ও ডায়রিয়ার প্রকোপে মাতসুশিমা পরেরদিন খব অসুস্থ হয়ে পরলেন। কিন্তু সপ্তাহখানেকের ভেতরে আবার সুস্থ হয়ে উঠলেন। তিনি মনে করেন বিষ্ফোরনজনিত বিপর্যয়ের পর শহর থেকে ও বেশীরভাগ তেজস্কৃয়তা থেকে দূরে থাকতে পারার কারনে দ্রত সুস্থ হতে পেরেছেন। অনেকেই ঝুঁকি সম্পর্কে না জেনে উদ্ধারকারী প্রচেস্টাকে সহযোগীতা করতে অথবা আপনজনকে খুঁজে পেতে হিরোশিমাতে থেকে গেছেন নিজেকে অসংরক্ষিত করে। আমি সময়ে সময়ে অনেকবারই অসুস্থ হয়েছি।

কিন্তু ইশ্বর বুদ্ধাকে ধন্যবাদ যে আমি এখনো বেঁচে আছি, বললেন মাতসুশিমা। পূন:নির্মিত শহর প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে গরমের সময়ে আ্যটম বোমা নিক্ষেপ করার কারনে নিরাময় প্রক্রিয়া শ্লথ গতিতে হচ্ছিলো। একারনে অনেকেরই ক্ষত দ্রুত ছড়িয়ে পরে। তাদের অনেকেরই ক্ষতস্থানে কীট ও লার্ভা ছড়িয়ে পরে এবং এগুলোকে চপস্টিক দিয়ে বের করে আনতে হচ্ছিলো। এভাবে রোগাক্রান্ত হয়ে একজন একজন করে মারা যাচ্ছিলো।

মাতসুশিমা তার জীবনের সবচেয়ে বেদনাদায়ক স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে মাতা নাড়াতে নাড়াতে বলছিলেন কথা গুলো। হিরোশিমা আক্রমনের মাত্র তিনদিনের মাথায় আরো একটি আ্যটম বোমা আঘাত হানলো নাগাসাকি শহরে। ১৫ ই অগাস্ট জাপান আত্মসমর্পনের পরই কেবল জানতে পারলো আমেরিকা আসলে কি ধরনের বোমা ব্যবহার করেছিলো। বছরের শেষে বোমার আঘাতে, বিষ্ফোরনজনিত তেজস্ক্রিয়তার কারনে এবং আহত হয়ে হিরোশিমায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো এক লক্ষ চল্লিশ হাজারে। অন্যদিকে প্রায় আশি হাজার মানুষ নিহত হলো নাগাসাকিতে।

আজ হিরোশিমা প্রায় দশ লক্ষ মানুষের সম্পূর্ন পুন:নির্মিত এক আধুনিক শহর। শুধুমাত্র তথাকথিত আ্যটম বোম্ব গুম্বুজটি ভয়াবহ ধংস্সাবশেষের সাক্ষি হয়ে আছে। দালানটি ব্যবহৃত হয়েছে প্রদর্নীর জন্য এবং প্রায় সরাসরি নিক্ষিপ্ত বোমার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ এ ভবনটির শক্তিশালী স্ট্রাকচারটিই কেবল মাত্র পরে রয়েছে। বোমার আঘাতে ভোগা সত্বেয় মাতসুশিমার কোন ক্ষোভ নেই আমেরিকানদের প্রতি। মানুষ যুদ্ধের সময় উম্মাদ হয়ে পড়ে, তারা চায় শত্রুকে শেষ করে দিতে।

যদি জাপানের আ্যটম বম্ব থাকতো তাহলে আমরাও হয়তো এটি ব্যবহার করতাম। অতীত নিয়ে তর্ক করা নির্বুদ্ধিতা। এখন আমাদের সকলকে সহযোগীতা করতে হবে সব ধরনের পারনামবিক অস্ত্র নির্মূলে। টিকা: ১. হাইপোসেন্টার: যে মূল বিন্দু বা স্থানে বিষ্ফোরিত হয়েছে। ২. ফোর্সড লেবার: অন অর্থে আন ফ্রি লেবার বা বন্দি শ্রমিক।

সাসা উইকস্ট্রম এর এ লেখাটি প্রকাশ করে ৬ই অগাস্ট ২০১১ আলজাজিরা.নেট। মুল লেখাটি পড়তে হলে এখানে ক্লিক করুন। [লেখাটির অর্ধেক অনুবাদ করেছিলাম ৬ অগাস্টেই কিন্তু কাজের চাপে পুরোটা করা হয়ে উঠেনি। ৬ অগাস্টে বন্ধুদের হাতে পৌছাতে পারলে খুব ভালো লাগতো সাসা উইকস্ট্রম এর এ মর্মস্পর্শী প্রতিবেদনটি। আপনাদের ভালো লাগলে কৃতজ্ঞ হবো।

আসুন যুদ্ধ ও ধংস্সকে না বলি, সকল প্রকার মানব বিধ্ধংসী অস্ত্রকে না বলি। ধন্যবাদ। ] আমার নিজের ওয়ার্ডপ্রেস ওয়েবসাইট টি এখানে ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।