আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হুদাই

অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা

মাত্র ১০ বছর পুরোনো ছবির মানুষগুলোকে দেখলেও আশ্চর্য লাগে, অথচ ছবির মানুষগুলোকে আমি প্রতিদিনই দেখি। একই সাথে বসবাস করছি, আড্ডা দিচ্ছি, আমাদের চেহারায় ক্রমশ বয়েসের ছাপ পড়ছে, এই শাররীক পরিবর্তনগুলো আসলে অবাক করে না। বাসায় রাখা পুরোনো এলবাম খুলে ছবি দেখা একটা সময় প্রিয় ছিলো। একটা সময় বাসায় ক্যামেরা ছিলো না, লোকজন স্টুডিও থেকে ছবি তুলে আসতো, কিংবা বাসায় কোনো অনুষ্ঠান হলে স্টুডিও থেকে পরিচিত মানুষদের ডেকে এনে একটা দুইটা ছবি তুলে রাখাটাই বিশাল একটা বিষয় ছিলো। যাদের ক্যামেরা ছিলো কিংবা যেইসব বাসায় ক্যামেরা ছিলো, তাদের অনুরোধ করে একটা দিনের জন্য ক্যামেরা নিয়ে আসার লজ্জা অনেক দিন পোহাতে হয়েছে আমাদের।

অভাবের সাথে নিত্যবসবাস ছিলো সুতরাং এইসব বিলাসিতা ছিলো না। মোস্তাক মামা তখন সদ্য সৈদি আরব থেকে ফিরেছেন সাথে বিস্ময়কর অটোম্যাটিক ক্যামেরা নিয়ে এসেছেন। সেখানে ফোকাসের ঝামেলা নেই, লুক এন্ড শুট ক্যামেরা। মোস্তাক মামারা তখনও থিতু হয় নি পাড়ায়, বাসার সামনের ছোটো একটা ঘর ভাড়া করে থাকে, তার পাশের ঘরে থাকে জয়েনউদ্দিন মামা, তাদের পাশে ঢাকাইয়া রিপনদের বসবাস। অভাবি মহল্লার সামনের অংশটুকু দুই চৌধুরীর বসবাস।

এক চৌধুরী বাসার সৌখিন চৌধুরী দাদু বাসার পেছনে করমচা, আঙ্গুর, নাশপাতি, পেয়ারা বাগান করেছেন, তাদের বাসার পেছনের বাগান গাছে গাছে অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে থাকতো সারাটা বছর। অন্য চৌধুরী বাসায় ৩ ছেলে, তবে উত্তর প্রজন্মে কোনো ছেলে নেই তখনও। তিন ভাই সমান উৎসাহে ছেলের প্রত্যাশায় কয়েক দিন পরপরই গর্ভবতী করে ফেলছেন তাদের বৌদের। মোশতারি, লাকি, সীমা, ফেরদৌস, তানভীর, কবির নানার কোনো ছেলে মেয়ে নেই। চৌধুরী বড় মা'র বাজখাই গলা, বিশাল বাসায় অনেকগুলো ফলের গাছ, মোশতারিদের বাসার পাশেই কামরাঙ্গা আর আমড়া গাছ দেয়াল টপকে পাশের বাসায় ঢুকেছে।

মাঝের অংশতে হঠাৎ করেই বিশাল দালান উঠে গেলো, নবরুপী- মহল্লার নাম বদলে গেলো এর পরেই, আমরা নবরুপীর গলির পেছনের বাসিন্দা হয়ে গেলাম। মহল্লার আকারটা অদ্ভুত, এনএ মার্কেট থেকে সোজা উল্টো দিকে চৌধুরীর বিশাল বাড়ী, সেই বাড়ীর পাশে হোটেল নবিনা, আর অন্য পাশটাতে নবরুপীর গলি। সেই গলি থেকে শেষ পর্যন্তই চৌধুরীর বাসা, গলির অন্য পাশটাতে আকবরদের বাসা, আকবরদের সীমানা শেষ হলে নবরুপির চত্ত্বর, সেটা শেষ হলে গলির মাথা শেষ, এরপর আমাদের মহল্লার শুরু, খুব বেশী হলে ৪০০ গজ একটা চৌকোনা ক্ষেত্রের একপাশে ফাঁকা জমি, হেরিংবোন রাস্তা- যদিও অনেকটা সময় আমি ও আমরা সেই রাস্তাকে হিরিমবোম বলতাম। অন্তত ইটের আড়াআড়ি সজ্জ্বা অনেকটা হেরিং মাছের কাঁটার মতো এই সত্য জানবার আগপর্যন্ত আমাদের বয়সী সবার কাছেই দিনাজপুরের এইসব ইটের রাস্তার নাম ছিলো হিরিমবোম। এই রাস্তা সোজা উত্তর দক্ষিণে গিয়েছে ৬০ গজ, সেটা শেষ হলেই আবার আরেক চৌধুরীর সীমানা শুরু।

সেটা সেখান থেকে ঘুরেছে পশ্চিমে, এই কোণটাতেই চৌধুরীদের গেট, সেই গেট আর রাস্তার কোণা শেষ হলে লিটনদের বাসা, তাদের পাশে একটা বাসায় ভাড়া থাকে গার্ড সাহেব। এই রাস্তাটাও মোটামুটি ৪০ গজ গিয়ে সোজা থেমেছে রানাদের বাসার সামনে। রানাদের পাশের বাসাটা আজাদদের। রানাদের বাসার পেছনে রায়হানদের বাসা। অবশ্য এই বাসায় কতজন মানুষ একটা সময়ে বাস করে বলা মুশকিল, গোলাম মোস্তফা- এই বাসার বড় ছেলে সৌদি আরবে ড্রাইভার, প্রতি দুই বছর পর পর বাসায় আসে, কোনো ছেলে মেয়ে নেই, ভীষণ ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হয় সে বাসায় আসলে, নিয়মিতই বৌয়ের সাথে এইসব বিষয়ে ঝগড়া লাগে, মাঝ রাত্তিরে উঠে পাড়ার মুরুব্বিরা মোস্তফাকে সামলান, ব্যাটা এই রকম করে না, এত রাতে মেয়েটা যাবে কই? মোস্তফার এক জবাব ওর সাথে আর সংসার করবো না আমি, পর দিন সকালে কাঁদতে কাঁদতে তার বৌ চলে যেতো, আবার সপ্তাহ খানেক পরে উজ্জল মুখে ফিরে আসতো।

রানাদের বাসার পাশের জায়গাটা ফাঁকা। এই ৬০ গজ বাই ৪০ গজ জায়গাটা ফাঁকা, জলা ভুমি কিংবা ময়লা ফেলবার জায়গা। সেখান থেকেই ড্রেন দিয়ে পানি যায় বাইরে, রায়হানদের বাসার পাশের বাসাটাই আমাদের শরিক পরিবারের । জায়গা সব মিলিয়ে মনে হয় চৌদ্দ কাঠা। শরিক বিবাদে টুকরো টুকরো হওয়ার আগে কোনো দেওয়াল ছিলো না, তবে আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন আলাদা আলাদা তিনটা টুকরা হয়ে গেছে, তিনটা দেয়াল উঠেছে।

একপাশে শহীদদের বাসা, তাদের দেয়াল লাগানো অংশটায় আমরা থাকি, আমাদের পাশের অংশে থাকে অপুরা। তাদের বাসার পূর্বে থাকে স্বাধীন মুন্না, সেই বাসাতেই ৪টা ঘর, একটাতে থাকে জয়েনউদ্দীন মামা, অন্যটাতে ঢাকাইয়া রিপন, তার সাথে থাকে মাসুদরা, মোস্তাক মামা প্রথম বার সৌদি থেকে ফিরবার পরে নবরুপীর ঠিক পাশের জায়গাটাতেই বাসা বানিয়ে উঠে গেলো তারা। এই সময়েই মোস্তাক মামা ক্যামেরা নিয়ে হাজির হলো পাড়ায়। জয়েনউদ্দীন মামার ঘরটা গলির পাশেই, বলা যায়, বয়েস তখনও ২৫এর কোঠায়। খাস বিহারী, মোস্তাক মামার স্ত্রী মোটকি মামীও বিহারী।

তাদের পেছনে থাকা আকবররাও খাস বিহারী, অবশ্য দিনাজপুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক বিহারীর বাস। ভারত ভেঙে পাকিস্তান হওয়ার সময় বিহার থেকে অনেকেই পূর্ব বঙ্গে এসেছিলো, এরাই সম্ভবত তাদের পূর্বপুরুষ। মোস্তাক মামার ক্যামেরা অদ্ভুত একটা হীনমন্যতার বোধ তৈরি করলো এখানে। অবশ্য এখানে আমরা যারা থাকি তাদের ভেতরে অর্থনৈতিক বিবেচনায় তেমন তফাত নেই, বড় চৌধুরীর বাসার অর্ধেক মানুষ বাইরে থাকে, বিশাল বাসার চৌধুরী বড় বাবা একলাই থাকেন, সেখান থেকেই একদিন দেশে ফিরলো কাজল দাদা, সাথে তার বিদেশী বৌ এবং অর্ধ বিদেশী দুই ছেলে মেয়ে- এবং তাদের বড় নাতি, আমাদের শৈশবের নায়ক, সেই বিদেশী ছেলে মেয়ে আবার শখ করে ঘোড়ায় চড়ে, তাদের ঘোড়া চলবে এই জন্যই বাগানের অর্ধেকটা কেটে ফেলা হলো। আমাদের নিয়মিত ফলের জোগান চলে গেলো মাত্র দুটো বিদেশী ছেলে মেয়ের ঘোড়া দৌড়ের আলাদা জায়গা তৈরির জন্য।

আমি শালার তখন থেকেই বিদেশীদের ঘৃনা করতে শিখে গেলাম মনে হয়। তাদের ফুটফুটে চেহারা, তারা কেতা করে ইংরেজী বলে, আমাদের হাফ মাদ্রাসায় পড়ে উঠা পাড়াবাসী বালকদের সবাই লজ্জায় লাল হয়ে হাই হ্যালো বলতে শিখে, কি সুন্দর গুন মরনিং, গুড ইভিনিং বলছে তারা। বিদ্বেষ তৈরি হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিলো অবশ্য, আমরা তখনও টিভিতেই ঘোড়া দেখেছি, হাতি দেখেছি, সার্কাসের বৃদ্ধ হাতি, সেই হাতির পিঠে মাহুত চেপে সার্কাসের প্রচারপত্র বিলি করছে, এই ছিলো উৎসাহব্যঞ্জক দৃশ্য। সেখানে জলজ্যান্ত একটা স্ট্যালিয়ন, সেটাও ঢাকা থেকে ভাড়া করে আনা হয়েছে, আমরা সব ছেলে মেয়েরা দল বেধে গিয়ে ঘোড়ার চারপাশে ঘুরে হজ্জ্বের সওয়াব সঞ্চয় করি। এই সব সময়েই পুরোনো এলব্যামের কথা মনে পড়ে, মোস্তাক মামার অটোম্যাটিক ক্যামেরার সাথে সাথেই এলো তাদের পোলারয়েড ক্যামেরা, ক্লিক করা মাত্রই ছবি প্রিন্ট হয়ে বের হয়ে আসে, আমরা অদ্ভুত হয়ে কারিগরি দেখি, প্রযুক্তির প্রতি সীমাহীন ভক্তি আমার তখন থেকেই, তবে আমাদের পক্ষে যে এই বিদেশী ক্লিক করলেই ছবি বাহির হয়ে আসে ক্যামেরা হাতানো সম্ভব না এটা আমরা বুঝে যাই।

সেইসব ক্যামেরার দাম আকাশ ছোঁয়া, খুব সহজেই সেই ক্যামেরার দাম আমাদের কাছে লাখ টাকার অঙ্ক ছুলো। যা কিছু দুস্প্রাপ্য সেসবের সাথে লাখের অঙ্কটা চমৎকার যায়। আমাদের কাছে তখনও দিনে ২ টাকা মানে বিশাল একটা অঙ্ক। আমরা বাসা থেকে ২ মুঠো চাল আর ১টাকা নিয়ে এসে চড়াইভাতি করি তখন, সেই সময়ে লাখ টাকা কেনো হাজার টাকার অঙ্কও আমার কাছে গোলমেলে লাগতো। বাসায় পুরোনো ছেড়া একটা স্যুটকেস ছিলো, তার চাবি বেশীর ভাগ সময়েই থাকতো আম্মার কাছে, মাঝে মাঝে কোনো কোনো বিকেলে আম্মা খালার সাথে বাইরে গেলে সেই চাবি খুঁজে বের করে আমি স্যুটকেস খুলতাম আর প্রথমেই দেখতাম ছবির এলব্যাম।

আম্মার বিয়ের ছবি মাত্র ২টা, তার সাথে মামাদের ছবি, জাহাঙ্গীর মামার সাথে বড় মামার একটা ছবি, স্টুডিওতে গিয়ে তোলা, তার সাথে বড় মামার বিয়ের একটা দুইটা ছবি, নানীর পুরোনো পাসপোর্টের ছবি, আব্বার পাসপোর্ট সাইজের ছবি একটা। সেইসবের ভেতরে প্রধান আকর্ষণ ছিলো, ফুপু খালা আর মায়ের একটা গ্রুপ ছবি, দিনাজপুর স্টুডিওতে তোলা। সেখানে শর্ট কামিজ পড়া তিনজন চুল বেঁধে একটা ছবি তুলেছে। আম্মার চোখে টানা কাজল দেওয়া, ছবিটা তোলার সময়কাল মনে হয় ১৯৭৩ ৭৪, কিংবা সেই সময়ের কোনো একটা ছবি। আম্মা তখনও এইচএসসির ছাত্রী।

তখন বাংলাদেশের ফ্যাশন ঘুরতো ববিতা আর সুবর্ণ মোস্তফা ক্যামেলিয়াদের ঘিরে। ববিতার স্লিভ লেস ব্লাউজ আর জর্জেট শাড়ী তখনও ফ্যাশনদুরস্ত হয়ে ছিলো। চিত্রালীর পাতা কেটে মেয়েরা জামা বানাতে যেতো, এইসব দিনের ছবিগুলো দেখে অদ্ভুত লাগতো আমার। অবশ্য তখনও আমাদের এইসব বুঝবার বয়েস হয় নি। তখন কেলব হাফপ্যান্ট পড়ছি আমি, স্কুলে যাই হাফপ্যান্ট, বাসায় হাফপ্যান্ট, ছোটো একটা লুঙ্গি কিনে দেওয়া হয়েছে, সেটাও পড়বার চেষ্টা করি, তবে বিশেষ সুবিধা করতে পারি না, মাঝ রাতে ঘুম ভাঙলে আর লুঙ্গি খুঁজে পাই না বিছানায়, অনক ঘাঁটাঘাঁটি করে লুঙ্গি উদ্ধার করতে গিয়ে রাতের ঘুম বরবাদ হয়ে যায়।

সেই সময়ের কাছাকাছি সময়েই জয়েনউদ্দীন মামারা বাসা করে চলে গেলো নিউটাউন, আর সংস্কারের অভাবে এই ঘরটা, যেটা ছিলো আজাদদের মাছের আড়ত ছিলো সেটাও ধ্বসে পড়লো, আজাদের বড় ভাই সালাম মামা, এবং আমাদের উপরের প্রজন্মের মানুষেরা যেই ঘরে বসে আড্ডা দিতো আর ওরে সালেকা ও রে মালেকা গাইতো রাতভর, সেটা ভেঙে যাওয়ার পরে সেখানেই ছোটো পরিসরে আমাদের খেলার শুরু। মানে বাংলাদেশের নিয়মিত খেলা তখন ফুটবল, ছেলে বুড়ো সবাই ফুটবল খেলে, ঢাকার লীগ মোহামেডান আবাহনীর খেলার দিন সমস্ত পাড়াই নিস্তব্ধ হয়ে যায়। সবাই কানে রেডিও ঠেকিয়ে বসে থাকে, আর মাঝে মাঝে বাংলাদেশে এশিয়া কাপ ক্রিকেট খেলে, জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ, দুলু, রকিবুল, সান্টু খেলছে, আলতো ছোঁয়ায় বল মাঠের বাইরে, দৌড়ে আসছেন দুলু - এইসব সংবাদ শুনি আর ক্রিকেটের উত্তাপ সংগ্রহ করি। সেখানেই ১৯৮৫তে একটা বিপ্লব হয়ে গেলো, দিনাজপুরে একটা ক্রিকেট লীগ শুরু হলো, অবশ্য অনিয়মিত হলেও দিনাজপুরে ক্রিকেটের প্রচলন ছিলো, তবে সেটা কারা খেলতো এবং কারা খেলতো না এই সংবাদ অন্ত্যজ পাড়ার বাসিন্দা হয়ে আমরা জানতাম না। এই বছর আমাদের এলাকা থেকে ৪ জন সেই লীগে খেলতে যাচ্ছে, অনু মামা, ভানু মামা ফনু মামা আর উজির মামা খেলবে লীগে, আমাদের উৎসাহের সীমা নেই, ভানু মামা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন, সেখান থেকে এসেছেন, তিনিই মূলত আমাদের জন্য একটা বিনোদন নিয়ে আসলেন।

আমরা বাস্তবে ক্রিকেট দেখলাম। বাঁশের কাঞ্চি চেঁচে তিনটা স্ট্যাম্প বানানো হলো, মাঝের পীচ ব্যাট দিয়ে গুনে গুনে ২২ ব্যাট, সেখানে একটা স্ট্যাম্প লাগানো হলো। বল করতে শিখলাম না তখনও, আমি তখনও কিলাশ ফাইভে, দুবলা পাতলা মানুষ, বল জোরে ছুড়েও পীচ পার করতে পারি না, তবে আমার উৎসাহ কম নয়, হিরিমবোম রাস্তার বাউন্ডারিতে ফিল্ডিং দেই, দৌঁড়ে দৌঁড়ে বল নিয়ে আসি, টেনিসের বল বয়ের ক্রিকেটিয় সংস্করণ বলা যায় আমাকে। অফ স্ট্যাম্পের ঠিক পাশেই মুন্নাদের বাসার দেয়াল, বেড়ার বাসা, একটু জোরে অফ কাট করলেই বাসার বেড়া ভেঙে বল ঢুকে যায়, মুন্নার মা বিকট সুরে চিৎকার করে, খেলার দিন আমরা পাড়ার সব ছেলেবুড়ো দল বেধে বড় মাঠে গেলাম, একালার ছেলেদের খেলা বলে কথা, মনে আছে সেইবার আমাদের পাড়ার ছেলেরা যেই টিমে খেললো সেই টিম অল আউট হলো ৩৯ রানে, ফনু মামার একটা চার আর উজির মামার দুইটা চার ছিলো বিশাল সংগ্রহ। বিসিসির সাথে খেলায় এমন পরাজয়ের পরেও আমাদের উৎসাহ কমলো না, অন্তত বড় মাঠে বিশাল জায়গা নিয়ে একটা খেলা হয়, খেলার মাঠের বাউন্ডারীতে দাঁড়িয়ে খেলা দেখতে হয়, সে এক বিশাল বিষয় বটে।

হেরে যাওয়ার পরেও অবশ্য মামাদের উৎসাহে ভাটা পড়ে নি। বরং আমরাই ছোটো ছেলে মেয়েরা পাড়ার মাঝ খানের জলাটা ভরাট করে একটা মাঠ তৈরির প্রাথমিক কাজ শুরু করলাম। এই করতে করতেই আমার সিক্সে উঠবার সময় হয়ে গেলো, মোস্তাক মামা পুনরায় ফিরে আসলো সৌদি আরব থেকে, সাথে টিভি, সেই টিভির এন্টেনা লাগানো হলো, আমরা প্রবল উৎসাহে দেখতে যাই টিভি, বিকালে থান্ডার ক্যাটস আর সুপার ম্যান দেখার অনেকটাই এই টিভিতেই সমাপ্ত হয়েছে। মোস্তাক মামাদের পাশেই চৌধুরীদের দেয়াল, সেই দেয়াল বেয়ে উঠে আমরা চৌধুরীর আমড়া পাড়ি, চৌধুরি বড় মা বাজখাই গলায় চিল চিৎকার দিয়ে ছুটে আসে, আমরা টিভির ঘরে শান্ত সুবোধ হয়ে বসে থাকি। এই ভাবেই সময় যায়, পাশের বাসায় মেয়েদের সংখ্যাধিক্যেই মনে হয় মোস্তাক মামার পর পর দুই ছেলে হলো, একটা মেয়ের প্রত্যাশায় তৃতীয় বার পুনরায় একটা ছেলে হলো।

পাড়ার জনসংখ্যা বাড়ছে গুণিতক হারে, রানার ছোটো ভাই হলো, রনি, গার্ডের বাসায় ৫ কিংবা ৬টা মেয়ে, বিউটি, কাকলি, শেফালী, ইতি জবা, গার্ডের বাসার মেয়েরা বিকেল বেলা সেজেগুঁজে বাইরে আসে, একটু সন্ধ্যা নামলে তারাই গল্প শোনায়। লোড শেডিংয়ের অন্ধকারে আমরা টিলোএকপ্রেস না খেলে মুগ্ধ হয়ে গল্প শুনি। কাকলী খালার গল্প বলবার ঢংটা চমৎকার ছিলো। শীত শেষ হয়ে যাওয়ার পরেই আমাদের ক্রিকেট উৎসাহে ভাটা পড়ে, আমরা পুনরায় ফুটবলমুখী হয়ে উঠি, তার উপরে সেটা বিশ্বকাপের বছর। আমরাই চাঁদা দিয়ে একটা ৫ নাম্বার ডিয়ার বল কিনে ফেললাম।

এর মাঝেই শারজাহ কাপের শেষ ওভারে জাভেদ মিয়ানদাদ ছক্কা মেরে দলকে জিতিয়ে দিলো, রায়হানদের বাসায় প্রথম দেখলাম টেপ রেকর্ডার। ভিসিআর দেখলাম তখনই। বাংলাদেশ প্রযুক্তিবহুল যুগে প্রবেশ করা শুরু করলো তখনই। শীতের সময়ে ইস্টিমিটার সাহেব চৌধুরীদের পাশের জায়গাটাতে ঘেরা দিলো। আমাদের টারজান আর রাজা বাদশাহ খেলার মাঠটাও ছোটো হয়ে গেলো।

সেখানে বড়রা ব্যাডমিন্টন কোর্ট কাটলো, চাঁদের হাটে ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট শুরু হলো , একই সময়ে শুরু হলো রুপালী কাপ। সেই রুপালী কাপেই প্রথম দেখলাম শ্রিলঙ্কার ক্রিকেট খেলোয়ারদের। ঢাকা থেকে বুলবুল আর নান্ন খেলতে আসলো দিনাজপুরে। আমাদের উৎসাহ বাড়লো আরও বেশী। টিভিতে যাদের নাম শুনি তারা দিনাজপুরের মাটিতে খেলতে আসছে , তাদের দেখা যাচ্ছে এটাই বা কম কি।

আমি তখন অফ স্পীনার, অফ স্পীনার হওয়ার বুদ্ধিটা কেনো আসলো তাও জানি না আমি , তবে শাররীক দুর্বলতায় আমি জানতাম আমার পক্ষে খুব জোরে পীচের ঐপারে বল ফেলানো সম্ভব হবে না। সুতরাং অফস্পীনার হয়ে আস্তে আস্তে বল করবো, এটাই ভালো। এই শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ক্রিকেট খেলছি, নিয়মিতই খেলছি বলা যায়, মাঝের ৩ বছর বাদ দিলে এটাই মূলত এখন পর্যন্ত আমার প্রিয় খেলা, তবে যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, সেখানেই ফিরে যাই, মাত্র ১০ বছর আগের ছবি দেখলেও নিজেকে এখন ক্ষ্যাত মনে হয়। অথচ মনে হয় সেটাই সবচয়ে চালু পোশাক ছিলো আমরা যখন পড়ছি। ফ্যাশন ট্রেন্ড এত দ্রুতই বদলে গেলো , চুলের ছাট আর পোশাকের ছাঁট বদলে এতই প্রাচীন হয়ে গেলো মাত্র ১০ বছর আগের ছবির পোশাকের ছাট দেখে মেলানো যায় না নিজেকে বর্তমানের সাথে।

তার আগের পোশাকরে ছাটের কথা নাই বা বললাম, ভিসিআরএর কল্যানে মিঠুনের চিপা প্যান্ট যখন সবার পড়নে তখনই সামান্য ব্যাগী প্যান্টের চল হলো, সেখান থেকে স্ট্রেইট, ব্যাগী, বেলবটম হয়ে এখন ঠিক কোন ছাঁট চলছে আমি জানি না। হিপ্পী ফ্যাশন থেকে রক আর হেভী মেটাল যুগ হয়ে ছেলেদের পোশাক দিন দিন হিফপ হয়ে উঠলো, এখন পাছার অর্ধেক ভাজ না দেখা গেলে ঠিক ফ্যাশনেবল হয়ে উঠে না পোশাক, তবে অর্ধেক পাছা বের করে কিভাবে প্যান্ট আটকে রাখা সম্ভব এই গুরুতর প্রশ্নের উত্তর কেউ আমাকে দিলো না। আজ প্রিয় একজনকে দেখলাম এই ছাঁটের পোশাক পড়তে, দেখে বুঝলাম আমি আদতেই পরিবর্তন তেমন একটা পছন্দ করি না, তবে বিষয়টা হলো যার পাছা সে যদি দেখিয়ে বেড়ায় তবে আমার কিছুই করার নেই। যার পাছা তার মাথা ব্যথা।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।