আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টাঙ্গুয়ার হাওর-২:সরকার ও আইইউসিএন'র যৌথ ব্যবস্থাপনা: সুবিধাভোগীদের দাবি রক্ষণাবেক্ষণের নামে কমিউনিটিকে খন্ডিত করা যাবেনা

দাগ খতিয়ান নাইতো আমার/ঘুরি আতাইর পাতাইর...

নয় কুড়ি কান্দার ছয় কুড়ি বিলের কারণেই টাঙ্গুয়া মাদার ফিশারিজ হিসেবে পরিচিত। টাঙ্গুরা ইজারাদাররা এসব বিল থেকে এক সময় প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার মাছ বিক্রি করতো। ইজারাদাররা হাওরের কান্দায় হিজল করচ গাছ লাগিয়েছিলেন। কিন্তু প্রশাসনের রক্ষণাবেক্ষণে আসার পর আর নতুন গাছ লাগানো হয়নি। বর্তমানে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন আনসার পুলিশ ও বিডিআরের সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর মাধ্যমে হাওর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছে।

নানা কারণে যৌথবাহিনীর কাজ বিশেষজ্ঞ মহলে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। দেশের বৃহওম জলাভূমি টাঙ্গুয়াকে বিশেষজ্ঞ মহল মাদার ফিশারিজ এরিয়া হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বিস্তীর্ণ এ জলাভূমিতে নানা প্রজাতির মাছ ও জলজ উদ্ভিদের পাশাপাশি বিলুপ্তপ্রায় সোয়াম্প ফরেস্টের অস্তিত্ব রয়েছে। নলখাগড়া, হিজল করচ, পাতুরি চাইল্যাসহ নানা প্রজাতির বনজ সম্পদ হাওরকে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে। আর এতাসব বৈচিত্র ও সম্ভাবনার কারণেই বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে টাঙ্গুয়া রক্ষণাবেক্ষণে।

এখন পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের হয়ে বেসরকারি সংস্থা আইউইসএন ১৫ বছর মেয়াদী প্রজেক্টের ১৮ মাস মেয়াদী প্রথম পর্যায়ের পরীক্ষামুলক পাইলট প্রকল্পের কাজ করছে। সুইস দাতা সংস্থা এসডিসিরি অর্থ সহায়তায় প্রাথমিক পর্যায়ের পাইলট প্রজেক্টের কাজ শেষ হওয়ার পথে। এই প্রকল্প মেয়াদ শেষের পরে সাথে সাথেই আরো ৫ বছর মেয়াদী প্রজেক্টের কাজ শুরু হবে। এই ৫ বছর মেয়াদী প্রকল্প শুরুর পর আবারো আরো ৫ বছর মেয়াদী কাজ শুরু হবে। এভাবে তিন পর্যায়ে ভাগ হয়ে আইইউসিএন পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় কাজ করবে।

আইইউসিএন সূত্রে জানা গেছে, জীববৈচিত্র সমৃদ্ধ টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্রর কথা বিবেচনা করে পরিবেশ ও বনমন্ত্রলায় বেসরকারি সংস্থা আইইউসিএনকে রক্ষেণাবেক্ষণের জন্য ডোনার খুঁজতে অনুরোধ করে। আইইউসিএন দীর্ঘদিন হাওরে এসে অবস্থান করে তাদের এ সংক্রান্ত গবেষণার পরিকল্পনা জমা দেয় সুইস দাতা সংস্থা এসডিসিকে। এসডিসি হাওরের সম্ভাবনা, জীববৈচিত্রের সংশি¬ষ্ট রিপোর্ট পেয়ে তাদের খ্যাতিমান গবেষক পিটার হিসলেয়ারকে ২০০৫ সালে টাঙ্গুয়ায় পাঠায়। পিটার হেসলেয়ার হাওরের উপর নির্ভরশীল স্থানীয় জনগোষ্ঠির সঙ্গে কথা বলে গৎবাধা প্রস্তাব না দিয়ে দীর্ঘ ১৫ বছর মেয়াদী পরীক্ষামূলক প্রকল্পের প্রস্তাব দেন। ১৮ মাস মেয়াদী প্রাথমিক পরীক্ষামূলক প্রস্তাবে বলা হয়েছে এটি প্রস্তুতিমূলক পর্যায়।

এই পর্যায়ে হাওরের ভৌগোলিক, আর্থ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ডাটা সংগ্রহ করবে। স্থানীয় লোকদের পেশা, জীবনজীবিকার উপায়, তাদের কালচার, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, লোকাল নলেজসহ তাদের নিজস্ব বিষয় ঠাই পাবে। হাওরের উপর নির্ভরশীল জনগোষ্টিকে সংগঠিত করা, তাদের আয় বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রমের পরীক্ষা, বিদ্যমান জ্ঞান ও সংস্কৃতিকে জানা, গবেষণা পরিচালনা করা, আদম শুমারি, আর্থ সামাজিক জরিপ, জীববৈচিত্র গবেষণা, প্রাপ্ত বিষয়কে কাজে লাগানো, সম্পদ আহরণ প্রক্রিয়া, প্রকল্পশেষে প্রকল্প পরিচালনার ব্যায় নির্বাহের নির্দেশনা, সংগঠনের রূপরেখা ইত্যদি থাকবে এই প্রাথমিক পর্যায়ে। এই পর্যায়ের কাজ গত বছরের ডিসেম্বরে শুরু করার কথা থাকলেও দেশে জরুরি অবস্থা ও অস্তিতিশীলতার কারণে দেরী হয়ে যায়। যার ফলে এই কাজ আরো আগে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও শেষ হচ্ছে আগামী আগস্ট মাসে।

এই পর্যায়ের কাজ শেষের পর ৫ বছর মেয়াদী দ্বিতীয় প্রজেক্ট শুরু হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রজেক্টে পিটার প্রস্তাব করেছেন সমাজভিত্তিতক ব্যবস্থাপনার উপর। তার প্রস্তাব টাঙ্গুয়ার হাওর সমাজ ভিত্তিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিচালিত হবে। কমিউনিটির লোকজন নির্দিষ্ট নিয়মে উন্মুক্তভাবে মাছ ধরবে নির্দিষ্ট সময়ে। পরের ৫ বছর হলো সংহতি পর্যায়।

এই পর্যায়ে কমিউনিটির সংগঠনের মাধ্যমে সরকার যৌথ ব্যবস্থাপনায় কাজ করবে। গত সপ্তাহে হাওরপাড়ের তিনটি ইউনিয়নের সমন্বয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর সমাজভিত্তিক টেকসই ব্যবস্থাপনা প্রকল্প কমিটি গঠিত হয়েছে। এভাবে ১৫ বছর মেয়াদী পরীক্ষামূলক কার্যজক্রম চলবে। এখন কমিউনিটির লোকদের নিয়ে নিয়মিত মিটিং ট্রেনিং চলছে। তাদের কথা শোনা হচ্ছে।

আর তাদের কাছ থেকেই প্রস্তাবনা তৈরী করা হচ্ছে বলে আইইউসিএনসংশি¬ষ্টরা জানিয়েছেন। জানা গেছে আইইউসিএন ইতোমধ্যে টাঙ্গুয়ার হাওরের ৮৬ টি গ্রামের লোকদের সঙ্গে নিয়মিত আলাপ আলোচনা করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৩০ টি গ্রামে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। এই গ্রামের সাধারণ লোকজন তাদের প্রতিনিধি নিজেরাই নির্বাচিত করেছেন। নিয়মিত আলাপ আলোচনা ও মতবিনিময়ে স্থানীয় লোকদের সিদ্ধান্ত থেকেই এখন ৩০ টি গ্রামের লোকজনকে টাঙ্গুয়া রক্ষণাবেক্ষণে সংগঠনের আওতায় আনা হচ্ছে।

২০ টি গ্রামে এডহক ইউনিয়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে এই প্রক্রিয়ায়। গত মার্চ মাস থেকে এই সংগঠনের লোকজন পরীক্ষামূলক মৎস্য আহরন সমাজভিত্তিক কার্যক্রমের উম্মুক্ত মাছ আহরণ শুরু হয়েছে। লেচুয়ামারা বিল থেকে এই কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে ৮৮ গ্রামের মধ্যে মাত্র ২৫ গ্রামের লোকজন এই কার্যক্রমে আওয়তায় মাছ ধরা কার্যক্রম ও সংগঠনের আওতায় এসেছে পুরোদমে। ধীরে ধীরে সবাইকেই এর আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে।

আইইউসিএন সংগঠন এর কাঠামো তৈরী করে দিলেও স্থানীয় লোকজন এখনও টাঙ্গুয়া রক্ষণাবেক্ষণ ও তাদের প্রতিনিধিত্ব বিষয়ে বিশেষভাবে ওয়াকিফহাল নন। তারা এখনো আইইউসিএন এর মতিগতি বুঝতে সক্ষম হননি। দারিদ্র্যপীড়িত এসব লোকদের বিভিন্নভাবে লোভ দেখানো হচ্ছে বলে হাওর এলাকার সচেতন লোকজন জানান। গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইউসিএন ও স্থানীয় প্রশাসন কমিউনিটির লোকদের নিয়ে হাওর পাড়ের প্রত্যেকটি গ্রামে মিটিং করে তাদের পরামর্শ নেয় ও তাদের তাদের দাবিদাওয়া চাহিদা ইচ্ছা অনিচ্ছার কথা শোনে। তাদের কাছ থেকে জোর দাবি উঠে আসে রক্ষণাবেক্ষণের নামে টাঙ্গুয়াকে ভাগ করে কমিউনিটিতে বিভক্তি আনা যাবে না।

এতে দখল প্রতিষ্ঠা নিয়ে সংঘর্ষ দেখা দিতে পারে বলে তারা সাফ জানিয়ে দেয়। কমিউনিটির লোকজন জানান, ৫১ টি বিলকে সংরক্ষন, আহরণ এর নামে কখনো ভাগ কার যাবে না। বিল ভাগ করলে লোকজন তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। তারা পরামর্শ দেয় পুরো হাওর চষে মাছ মারলেও যদি রউয়া, রুপাবই, তেকুইন্না, বাইর‌্যাডুবা ও আলমের ডোয়ারকে সংরক্ষণ করার জন্য জোর দেন তারা। তারা জানান, এই ৫ বিল সংরক্ষিত হলে টাঙ্গুয়ার মাছ কখনো কমবে না।

বরং বৃহত্তর সিলেটের চার জেলা চাহিদা মিটিাতে পারবে এই হাওরের মাছ । তারা তাদের কর্মসংস্থানের জন্য আয় বৃদ্ধিমুলক কার্যক্রম হাতে নেওয়ার অনুরোধও জানায় আইউইসিএনকে। তবে কর্ম সংস্থানের নামে বাহির থেকে চাপিয়ে দেয়া কর্মসংস্থানের সুযোগ তারা প্রত্যাখানের ঘোষণা দেয়। তাদের নিজস্ব কর্মসংস্থানের যেসব সুযোগ রয়েছে সেগুলোকেই উন্নয়ন করার জন্য তারা বলেন। তাই তারা কৃষি, ক্ষুদ্র ব্যবসা, কুঠির শিল্প, গরু বর্গা ও হাস মুরগি পালন পেশাকে উন্নত করার অনুরোধ জানান।

টাঙ্গুয়ার হাওর সমাজভিত্তিক টেকসই ব্যবস্থাপনা প্রকল্প কমিটির সদস্যরা বর্তমানে বিষয়ে প্রতিমাসে তাদের অগ্রগতি ও কর্ম পরিকল্পনা বিষয়ে নিয়মিত মিটিং করে যাচ্ছেন। মিটিংয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও আইইউসিএন এর লোকজনও উপস্থিত থাকেন। সংগঠনের লোকজন এসব মিটিংয়ে জানান, হাওরপাড়ের প্রত্যেকটি গ্রামে সংগঠন ছড়িয়ে দিতে হবে। তাদের দাবি এলাকার যারা এই সংগঠন ও রক্ষণাবেক্ষণে উৎসাহী তাদের আনতে হবে। জানা গেছে মিটিং ছাড়াও এডহক কমিটির নেতাদেরকে শ্রীমঙ্গল, টাঙ্গাইল ও ভারতে নিয়ে বিভিন্ন প্রজেক্ট দেখিয়ে আনা হয়েছে।

গত বছরের নভেম্বরে এসব এলাকায় তাদের পরিদর্শনে পাঠানো হয়েছিল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.