আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

থাইল্যান্ড ভ্রমন ১৯৯০ (প্রথম পর্ব)

.... তবুও আমি স্বপ্ন দেখি ... (স্বপ্ন, বাস্তব এবং ব্লগের সর্বস্বত্ব ব্লগার কতৃক সংরক্ষিত)

চিন্তাটা হঠাৎ করে মাথায় আসলো। আমার সব বিদেশ ভ্রমনের উপর একটা করে ব্লগ বা ব্লগ সিরিজ লিখলে কেমন হয়? এমন নয় যে আমি খুব বিদেশ ভ্রমন করি। আমার ২৬ বছরের জীবনে হাতেগোনা কয়েকটা দেশে যাবার সুযোগ হয়েছে। অতএব লেখার মত যে খুব বেশি কিছু রয়েছে তাও নয়। তবুও ইচ্ছেটা পেয়ে বসলো এবং এক সময় অনেকটা নিজের অজান্তেই ল্যাপটপের সামনে এসে বসলাম।

এবার নুতন সমস্যা দেখা দিল। কোথা থেকে শুরু করবো? ১৯৯০? সেটা কি একটু বেশি পুরোনো হয়ে যায় না? তাছাড়া আমার বয়স তখন মাত্র আট বছর। স্মৃতি হাতড়ে কতটুকুইবা আর খুঁজে আনতে পারবো? সে যাই হোক, চেষ্টা করতে দোষ কি! অতএব চিন্তা করা শুরু করলাম। অল্প কিছু সময়ের মধ্যে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আমার স্মৃতিতে ঝরঝরে হয়ে জমে আছে বেশ কিছু দাগ কেটে যাওয়া ঘটনা। সম্ভবত আমৃত্ত্বু মনে থাকবে এমন কিছু ঘটনা।

এ লেখাটা হয়তো ঠিক ভ্রমন কাহিনী হবে না, খানিকটা সুখ-স্মৃতি কল্পনাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। তবে সে স্মৃতিগুলো আট বছরের এক বালকের চোখে স্ববিস্ময়ে পৃথিবীকে আবিষ্কার করার স্মৃতি হবে। ১৯৯০ সন। সেবার আম্মু-আব্বু এবং আমার ছোটবোন সহ আমরা স্বপরিবারে শ্বেতহস্তির দেশ তথা থাইল্যান্ড দর্শনে গিয়েছিলাম। আব্বু জাপানে গিয়েছিল একটা ট্রেনিং-এ অংশ নিতে।

আব্বু-আম্মু পরিকল্পনা করে ট্রেনিং-এর পর থাইল্যান্ড ঘুরে আসার। আব্বু জাপান থেকে ব্যাংকক যাবে, আর এদিকে আম্মু, আমার ছোটবোন পিংকী এবং আমি বাংলাদেশ থেকে রওনা হয়ে আব্বুর সাথে ব্যাংককে মিলিত হবো - এই ছিল আমাদের পরিকল্পনা। ঠিক কোন মাসে গিয়েছিলাম সেটা আজ আর মনে নেই, হয়তো আম্মুর পাসপোর্ট দেখে বের করা যাবে, তবে সেটাও এই মুহুর্তে সম্ভব নয় যেহেতু আমি এখন বাংলাদেশ থেকে অনেক অনেক দূরে। সেটার খুব একটা দরকারও নেই। ধরে নিচ্ছি কোন এক শুভক্ষনে আমরা রওনা হয়েছিলাম থাইল্যান্ডের উদ্দেশ্যে।

এয়ারপোর্টে এসে যখন থাই এয়ারওয়েজের বোইং এয়ারক্রাফ্টটাকে দেখলাম, তখন প্রথম যে চিন্তাটা মাথায় এসেছিল সেটা হলো, এত বড় যন্ত্রটা উড়বে কি করে? বলাইবাহুল্য, সেবারই আমার প্রথম আকাশে ওড়ার অভিজ্ঞতা। জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অবস্থা তখন তথৈবচ। টার্মিনাল থেকে সরাসরি প্লেনে ওঠা যেতো না। বাসে করে প্লেনের কাছে গিয়ে তারপর সিড়ি দিয়ে উঠতে হতো। আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে আমাদের ফ্লাইট ছিল সন্ধা সাতটায়।

চার দিক অন্ধকার হয়ে এসেছে। আমি দুরুদুরু বুকে প্লেনে উঠলাম। দেখতে দেখতে দরজা বন্ধ হয়ে গেলো। বিশাল শরীর নিয়ে থাই এয়ারওয়েজের বোইংটা নড়তে শুরু করলো। সিটবেল্ট লাগিয়ে আমরা বসে আছি।

অনুভব করলাম ধীরেধীরে গতি বাড়ছে প্লেনের। এরপর দপ! আমার দুকান বন্ধ হয়ে গেলো। আঠারো বছর আগের সেই কান বন্ধ হয়ে যাওয়ার স্মৃতি যেন আজও আমি অনুভব করি। চোখের পলকে এতবড় শরীর নিয়ে লৌহগোলকটি আকাশে উঠে পড়লো। এরপর সিটবেল্ট খুলে রিলাক্সড হয়ে বসলাম।

তরুনী এয়ারহোস্টেজ ড্রিংস নিয়ে আসলো। আমি যারপরনাই চেষ্টা করলাম নার্ভাসনেস ঢেকে হাসার। সম্ভবত আমার অতি স্মার্ট সাজার বিষয়টা তিনি আঁচ করে নিয়েছিলেন। তাই হেসে আমাকে অভয় দিয়ে অরেঞ্জ জুস ধরিয়ে দিয়ে গেলেন হাতে। আমি যখন জুস খাচ্ছিলাম, তখন আমার মধ্যে অন্য এক নার্ভাসনেস কাজ করতে শুরু করে।

গ্লাসটা আমি নেয়ার জন্য কি করে বলবো? "আমার গ্লাসটি নিয়ে যান", "আমার খাওয়া শেষ, এবার আপনি গ্লাসটি নিতে পারেন" ইত্যাদি বাংলা বাক্যকে আমি প্রানপণ ইংরেজীতে অনুবাদ করার চেষ্টা করছিলাম। তবে আমার ক্লাস টু-এর বিদ্যায় সেটা বড্ড বেশি কঠিন অনুভুত হচ্ছিল। একসময় হাল ছেড়ে ভদ্রমহিলার দিকে গ্লাসটি বাড়িয়ে দিলাম, যাতে খাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ায় নিয়ে যান। কিন্তু বিধিবাম! আমার গ্লাসটা আরো জুস দিয়ে ভরিয়ে দিয়ে গেলেন তিনি। কি আর করা; বসে বসে দ্বিতীয় গ্লাসও শেষ করলাম পরবর্তি কিছু সময় ধরে।

রাতে রওনা হওয়াতে বাহিরে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে শুধু মনে হচ্ছিল আমরা যেন উড়ে চলেছি দূর থেকে বহুদূরে, কোন নাম না জানা অজানার উদ্দেশ্যে। তবুও দেখতে দেখতে সময় যে কিভাবে কেটে গেলো নিজেই বুঝিনি। কিছু সময় পর আমাদের ফ্লাইট ব্যাংকক এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করলো। এয়ারপোর্টে নামার সময় আরেক দফা অবাক হলাম।

কী সুন্দর! প্লেন থেকে সরাসরি টার্মিনালে চলে যাওয়া যায়, যেন পথ নিজ থেকে এসে প্লেনের সাথে মিশে গিয়েছে! পাঠক হয়তো হেসে ফেলেছেন। তবুও বলবো, আজও যখন আমার শৈশবের এসব ছোটছোট বিস্ময়ের কথা মনে পড়ে, আমি পুলকিত হই। হয়তো অনুভুতিগুলো নিতান্তই ছেলেমানুষী, তবুও কেন যেন আমাকে ভিষন ভাবে আন্দোলিত করে যায়। আম্মু বলেছিল দুই ঘন্টা লাগবে ব্যাংকক পৌছাতে। ক্যাপ্টেনও জানিয়ে ছিল ফ্লাইট যথাসময়ে পৌছেছে।

কিন্তু এয়ারপোর্টে নেমে দেখি ঘড়িতে বাজে এগারোটা। সাতটায় রওনা হয়ে এগারোটায় পৌছালাম, অথচ সবাই বলছে দুইঘন্টার জার্নি ছিল! বিষয়টা মাথার মধ্যে যন্ত্রনা দিতে শুরু করলো। আমার হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আরো অবাক হলাম। আমার ঘড়িতে নয়টা বাজে অথচ এয়ারপোর্টের ঘড়িতে এগারোটা। নিজের চুল নিজে ছেড়ার মত অবস্থা।

হঠাৎ দেখলাম আব্বু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। দৌড়ে ছুটে গেলাম অব্বুর দিকে। কিন্তু মাথায় তখনও সময়ের গন্ডগোলের বিষয়টা ঘুরছে। লাগেজ নিতে নিতে আব্বুকে জিজ্ঞেস করলাম। আব্বু হেসে ফেললো।

এরপর সুন্দর করে বুঝিয়ে দিল সময়ের তারতম্য এবং বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মাঝের দুই ঘন্টার পার্থক্যের বিষয়টা। আজও মনেপড়ে, দেশে ফেরার পর এ প্রশ্ন আমি অসংখ্য মানুষকে করেছিলাম। অবাক করা বিষয়, বড়রাও অনেকে বোকা হয়ে যেত এ প্রশ্নে। তবে তাদের দোষ না দেয়াই ভালো; জুলভার্নের এ্যারাওন্ড দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ-এর মূল রহস্যইতো এটা। অতএব কেউ কেউ না পারার দলে থাকাই ভালো! আমরা যখন এয়ারপোর্ট থেকে বের হই তখন মধ্যরাত।

অথচ পুরো ব্যাংকক শহর যেন জেগে ছিল। রঙিন আলোয় পুরো শহরটা ঝকঝক করছিল। টেক্সিতে চড়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম হোটেলের দিকে। আজও স্পষ্ট মনে আছে হোটেলের নাম - বেভার্লি কফি হাউজ। (চলবে) ৩ নভেম্বর ২০০৮ ডবলিন, আয়ারল্যান্ড।

২য় পর্ব - Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।