আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পথের গল্প ০৬

অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা

প্রায় প্রতিদিনই একই দৃশ্য চোখে পড়ে, বাসের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, চার পাশে অধৈর্য্য মানুষ রাস্তায় আশার নয়ন মেলে তাকিয়ে আছে। তবে প্রতীক্ষিত বাস আর আসে না। পাশের কাউন্টারের বাস আসলো, যাত্রী নিয়ে চলে গেলো, আবারও আসলো, আবারও যাত্রী উঠিয়ে চলে গেলো। বাসের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে, আরও নতুন নতুন মুখ যুক্ত হচ্ছে আশেপাশে। প্রতি ১৫ মিনিটে একটা বাস আসবে এমন প্রতিশ্রুতির পরেও ৩০ মিনিট বেকুবের মতো লাইনে দাঁড়িয়ে দেখছি আমার পেছনে লোঙরখানার লাইন।

ঐ দুরের লাইটপোস্ট ছাড়িয়েছে। বাস উপস্থিত হলো, সেই সাথে কাউন্টারের সামনে দাঁড়ানো সুযোগসন্ধানী মানুষেরা কন্ডাকটরের পাশে দাঁড়ানো, তারাও ভেতরে ঢুকতে চায়। আমার পেছনে তখন আরও ৩০ জন, এবং সবাই কমবেশী ১০ থেকে ১৫ মিনিট দাঁড়ানো। বাঙালীর এই অদ্ভুত স্বভাব যাবে না এমনটা সিদ্ধান্ত নিয়ে দেখি আরও অদ্ভুত অবস্থা। প্রায় সব বাসেই এটা চোখে পড়বে, সস্তার সবিরতি বাস কিংবা বিরতিহীন সিটিং সার্ভিস কিংবা কাউন্টারের বাস, সব বাসেই একদল মানুষ উঠে যারা মনে করে বাসের পেছনের দিকে দাঁড়ানো মানে পরাজয়।

তারা বেঁকেচুড়ে তবুও গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকবে, তাদের পেছনে ঠেলে যেতে হবে বাসের পেটের ভেতরে, এবং যাকেই জিজ্ঞাসা করা হবে ভাই কতদুরে যাবেন, একটু ভেতরে ঢুকেন না? ভাই সামনেই নামবো। সুতরাং আমি দুরের যাত্রী কষ্ট করে হলেও যাকে তাকে স্পর্শ্ব করতে না চেয়েও ঘষ্টাঘষ্টি করেই ভেতরে ঢুকতে থাকি, আর চোখ রাখি সামনে, কখন নামে বেচারা। এবং আমার অনুমাণ কোনোদিন ভ্রান্ত হয় নি, যারা গেটের সামনে মন্ডপের কলাগাছ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তারা হয়তো আমার স্টপেজে কিংবা তার পরের কোনো স্টপেজে নামে। প্রশ্নটা মনে খচখচ করে, কেনো মানুষ বাসের ভেতরে ঢুকতে চায় না, এমনিতেই বাসগুলোর সুনাম কিংবা দুর্নাম যাই হোক, কোনো যাত্রী নামতে চাইলে তারা প্রায় অনন্তকাল বাসটিকে রাস্তার পাশে রেখে যাত্রী ডাকাডাকি করে, আগুয়ান যাত্রীদের আবারও সেই একই প্রশ্ন করতে হয়। ভেতরে তো বাস ফাঁকা হগ্গলডি মিল্যা ক্যান খাঁড়ায়া আছে বাসের গেইটের সামনে? সবারই বাসায় যাওয়ার তাড়া থাকে, আমার, তোমার সবারই একই আগ্রহ, কোনোমতে এই বাসটিতে উঠে পড়তে পারলে ক্রমাগত ট্রাফিকের ভীড় ঠেলে অবশ্যই বাসায় পৌঁছানো যাবে একটা সময়ে।

তবে বেদের মেয়ে জোসনার মতো বাস একবার আসলে এরপরে আসি আসি বলে আর আসে না। সুতরাং সবাই মরিয়া হয়েই একে তাকে ঠেলে ভেতরে ঢুকতে চায়। এবং তখনও স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে, এই সামনেই নামবো যাত্রীরা। তারা পেছনের সীট খালি থাকলেও সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। এই ম্যানিয়ার কোনো কারণ আমি খুঁজে পাই না, তবে নিয়মিত এই দৃশ্যই চোখে পড়ে।

অনেক কষ্টে উপরে উঠে দেখলাম মাত্র একজনের জন্য আমি সীট পাই নি, আমি বাসের পেছনের প্রথম যাত্রী যে দাঁড়িয়ে আছি। প্রায় ৪ মিনিট লাগলো বাসটা সম্পূর্ণ ভর্তি হতে। এরপর গেটের কাছে এত সামনে নামবো মানুষ যে কন্ডাকটর বেচারাই বাসে উঠতে পারছে না। সে উঠলো, বাস ছাড়লো। তখনই চিরচারিত অন্য দৃশ্যটা দেখলাম।

বাস ছেড়ে দেওয়ার পরপরই একজন কাউন্টারে এসে টিকেট নিবে এবং ছেড়ে যাওয়া বাসের পেছনে দৌড় দিবে। বাসটা একটুর জন্য ছেড়ে যাবে তাকে, নিস্ফল আক্রোশে সে বাতাসে হাত ছুড়বে। দৃশ্যটা আর একটুর জন্য হলো না'র আক্ষেপ আর শালার ড্রাইভার আমাকে নিলো না এই দুই হতাশার মিলিত অনুভুতির প্রকাশ। বাস চলতে থাকবে, এবং বাসের ভেতরে নানা রকম কথা চলতে থাকবে, ঐ মিয়ারা তোমার মালিকরে বইলো বাস বাড়াইতে, এমনে আর কতদিন চালাইবো। মিয়া তোমাগো মালিকরেতো জেলের ভিতরে হান্ডাইয়া থুইছে, তোমাগোরেও সেইহানে পাঠানো দরকার।

এত লোক উঠাও ক্যান, এইটা কি লোকাল গাড়ী পাইছো, নাম দিয়া থুইছো সিটিং সার্ভিস। কি যে কন না ভাই, এইটা সিটিং গেইটলক না, এইটা চিটিং গেইটলক। প্রায় ১০ বছর পুরোনো এই সংলাপ শুনেও, চমৎকার একটা কৌতুক করা গেলো ভাব নিয়ে বক্তার মুখে গম্ভীর অভিব্যাক্তি। আমি স্ট্যান্ড আপ কমেডির নতুন মুখ, আমাকে সবাই একটু সম্মান করো। এবং প্রশংসার হাসি তার পাশ থেকেই আসে, ভালোই কইছেন ভাই।

আমি নিশ্চিত হই এই বেচারাও কোনো একদিন বাসের ভেতরে এইটা সিটিং সার্ভিস না চিটিং সার্ভিস বলে বেশ একটা কৌতুক হলো ভাব নিয়ে চারপাশে তাকাবে একদিন। বাসের ভেতরে কিছু যাত্রী থাকবেই যাদের বক্তব্য উস্কানিমূলক, তারা ক্রমাগত বাস ড্রাইভারকে উপদেশ দিয়ে যাবে কিভাবে বাস চালাতে হয়। মিয়া বামে লইতে পারো না, ধুরো মিয়ে ডাইনে চাপাইয়া যাইবা না। রকশাডিরে ডলা দিয়া যাইতে পারলা না। শালার ড্রাইভারের জাতটাই খারাপ।

ড্রাইভার আশেপাশে সমর্থনের জন্য তাকাবে, কোনো দিন সমর্থন পেলে পাল্টা ঝাড়ি দিবে ,মিয়া এত কথা না কপচাইয়া এইখানে আইয়া চালান, দেখুম নে কেমন চালান। অফ যান মিয়া। বক্তার আত্মসম্মানে ঘাঁ লাগবে তখন, পাশের যাত্রীকে শুনিয়ে বলবে, শালার ছোটো লোকের সাথে কথা কইতে গেলেই বিপদ। তবে সব সময়ই এই সুযোগটা ড্রাইভারের হয় না। বেচারা সমস্ত যাত্রাপথেই উপদেশ শুনতে শুনতে যায়, শুনতে শুনতে ফেরত আসে।

অন্য ধরনের উস্কানিও আছে, যেমন আজকে লাল বাতি জ্বললো। বাসের সামনে একটা রিকশা, আর আড়াআড়ি রাস্তা থেকে উপদেশে জর্জরিত ড্রাইভার সোজা চালিয়ে দিলো বাস, হার্ড ব্রেক কষে সবাইকে ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেলো আমাদের বাস। তখনই সামনের একজন বললো, মিয়া তুমি ইচ্ছা কইরাই আমাদের লালবাতিতে থামাইয়া রাখলা। পাশের যাত্রীর কানের কাছে মাথা নিয়ে খুকখুক হাসি। যেকোনো শ্রেণীর ড্রাইভারই বোধ হয় তুমি আর তুই ছাড়া অন্য কোনো সর্বনামে সম্বোধিত হয় না।

কিছু কিশোরী এবং মধ্যবয়সী মাহিলা ব্যতিত বাসে উঠে আমি কাউকেই অন্তত ড্রাইভারকে আপনি বলতে শুনি নি। এইসব নিয়মিত জীবনযাপনে হাস্যরসের উপাদান হয়ে আসে সহযাত্রীরা । সেদিন এক মহিলা উঠলো বাসে। সাথে তার নাতি কিংবা ছেলে। বাসে কোনো মতে উঠেই তার এমন অস্থিরতা শুরু হলো, অন্তত আমার বিরক্তি চরমে উঠলো।

মহিলার কণ্ঠ রিনরিনে, কানে খোঁচা দেয় এসে। মহিলা বোধ হয় এই প্রথম এই বাসে উঠলো। অন্তত আমি গত ১ বছরে তাকে দেখি নি এ তল্লাটে। বাবা তুমি বসো। ভাই একটু সরে বসেন, আপা আপনি এই দিকে আসেন, ভাই আপনি ভিতরে যান বাবা তুমি না বসলে আমার কি যে কষ্ট লাগে।

বাবা বসো বাবা। আচ্ছা এইটা কোন রাস্তা দিয়ে যায়? এই বাসটাই তো নামিয়ে দিয়ে যাবে। কোথায় যাবেন আপনি? ধানমন্ডি, এইটা দিয়ে গেলে আপনাকে সামনে নেমে রিকশা নিতে হবে। ড্রাইভারকে বললে নিয়ে যাবে না। আমার কানের কাছে এই ভাষিক উৎপাত সহ্য হয় না।

আমি মুখ ফিরিয়ে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না বাবা বসো বাবা। ঠিক আছে তুমি সামনে গিয়ে বসো, তুমি না বসলে কিভাবে হবে। ছেলে এবার বিরক্ত হয়। তুমি ঠিকমতো বসো, আমি ঠিক আছি। ছেলেটার বয়েস খুব বেশী হলে ১৪।

এই বয়েসটাতেই যত ঝামেলা। নতুন এখটা ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠছে এবং বাংলাদেশে যেহেতু টিনএজ হয়ে উঠবার বালাই নেই, সুতরাং সে না শিশু না কিশোর না তরুন অবস্থায় পড়ে আছে এখানে। কথা শুনে বুঝতে পারলাম বেচারারা গাড়ী নিয়েই চলা ফেরা করতো। তবে মরমে মরে যাচ্ছে বাসে উঠে। আমরা যারা বাসে যাতায়ত করি, তারা প্রাইভেট কারের অন্দর মহল দেখি নি কোনোদিন।

মাঝে মাঝে বাতিল কালো ক্যাবের ভাঙাচোরা অভ্যন্তর দেখেই নিজের গাড়ী চড়ার শখ মিটিয়েছি। সুতরাং এইসব মানুষের ভীড়ে তাদের অসস্তি প্রবল। মহিলা পাশে যাত্রীকে উকিল ধরে বললো, আপা আপনি বসতে বলেন না, ও না বসলে আমার খারাপ লাগবে। মহিলা একটু সরে বসে জায়গা বের করে বললো তুমি এখানে এসে বসো। আমি ঠিক আছি, তুমি বসো।

তখনই সামনের সীটে বসা লোকটি বাসায় ফোন করে বললো তুমি ড্রাইভারকে বলে দুপুরে গাড়ীটা অফিসে পাঠিয়ে দিয়ো। আর ড্রাইভারের হাতে ২০ টাকা ধরিয়ে দিয়ো যেনো ও বাসে ফিরে যেতে পারে। আমি অফিস থেকেই যাবো গাড়ী নিয়ে। তার ছেলেকে স্কুল থেকে তুলে লোকটা গাড়ী নিয়ে বাসায় আসবে- এই কথাটুকু শুনবার পরে মহিলা শান্ত হয়ে বসলো। যাক এ নেহায়েত ছোটো লোক গরীবগুর্বাদের আস্তানা না, এখানেও গাড়ী থাকা মানুষও চড়ে যায়।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।