আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হৈমন্তীর সিঁদুরে সংক্রান্তির বিন্দু বিন্দু মেঘ..২

আত্মবিশ্বাসহীনতায় প্রকট হচ্ছে আত্মার দেউলিয়াত্ব, তবুও বিশ্বাস আগের মতই নিশ্চল..

প্রথম পর্ব-১ এর পর থেকে মেধা আর আন্তরিকতার সমণ্বয় যে কোন কর্মক্ষেত্রে সাফল্যের পূর্বশর্ত ; আমার নিজের জীবনীই ইহার যথার্থ দৃষ্টান্ত হইতে পারে: সাংবাদিকতার সূত্র ধরিয়া ক্রমে ক্রমে আমি আরোহণ করিতেছি অভিষ্ট লক্ষ্যের সোপানে _বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করিয়া বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেলের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান গ্রন্থনার ভুরিভুরি প্র¯ত্তাব পাই, পাশাপাশি তরুণমহলে রম্যলেখক হিসেবেও যথেস্ট সমাদৃত হইতেছি আর সাংবাদিকতার ইতিবৃত্ত বলাই বাহুল্য ,অর্থাৎ আমার “স্বপ্ন মানচিত্রের” প্রতিকোণে অর্জনের কর্কটক্রান্তি-মকরক্রান্তি রেখা অঙ্কিত ; ইহার মধ্যস্থলটিই কেবল বিসর্জনের বিষুবরেখা দ্বারা কলঙ্কিত_আজ ৫বৎসর সে দৃষ্টির অন্তরালে ! সম্প্রতি আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ু–য়া শ্যালকের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানিলাম “ হৈমন্তী বন্দোপধ্যায়” নাম্নী জনৈকা মোহময়ী শিক্ষিকার ক্লাসে ছাত্ররা নাকি তাহাদের হাতঘড়ি বন্ধ রাখে!সেই মোহের মোহেই হয়তবা ৫বৎসর বাদে আমার বিশ্ববিদ্যালয় পরিমণ্ডলে পুনরাগমন ঘটিল। বিনাক্লেশে তাহার নিজস্ব কক্ষ সনাক্ত করিয়া সকল শিষ্টাচার ভুলিয়া সরাসরি তাহাতে ঢুকিয়া দেখিলাম পুস্তকের সায়রে সে নিরন্তর সন্তরণরত, কিন্তু আমার অবাধ্য দৃষ্টি তাহার সিথির সন্ধিস্থলে স্থির হইয়া রহিল_ এখনও তাহা সফেদ বর্ণের, যে সিঁদুড়ের আহ্বানে এই সণœ্যাসী গৃহ অণ্বেষণ করিত তাহা অদ্যাবধি হৈমর সিথিবঞ্চিত! এই বহুবিধ ভাবনার ইত্যবসরেই হৈমর ধ্যান ভঙ্গ হইলÑ এতদিন পর আমায় দেখিয়া তাহার সামান্যতম প্রতিক্রিয়াও হইল কিনা বোঝা মুশকিল কেননা ভীষণ স্বাভাবিক কণ্ঠে সে আমায় বসিতে বলিল ; ইহার পর কক্ষজুড়িয়া মহাকালের পিনপতন নীরবতা , দুজনার নিশ্চুপ বসিয়া থাকা! .....দীর্ঘ নীরবতা ভঙ্গ করিয়া আমি প্রস্থানোদ্যত হইতেই ভিসুভিয়াসের পুনরুত্থান ঘটিল : নিঃসঙ্কোচে তাহার অঙ্গুলি স্পর্শ করিয়া বলিলাম “ আমি চিনিয়াছি , আমি চিনিয়াছি। ” হৈম আলতোভাবে আমার করতল স্পর্শ করিয়ামাত্র হস্ত সরাইয়া জীবনে প্রথমবার আমার নাম উচ্চারিল- “ অচেনা থাকাই আমাদের নিয়তি অপু; তাই যাহাকে “চিনি” বলিয়া ভাবিতেছো হইতে পারে তার পুরোটাই প্রহেলিকা!” “ আমি সে নিয়তিকে অপদস্থ করিয়া এই মুহূর্তে তোমায় আমার মহিষী করিব ;শঙ্খ না-ই বাজুক,শাখা-সিঁদুড় পড়িয়া থাকÑ তোমার এই কক্ষেই স্বয়ং ব্রহ্মা পুরত হইয়া আমাদের দাম্পত্যের মন্ত্রপাঠ করাইবে”- - বক্তব্যের এরূপ চরম মুহূর্তে বিদ্যুৎ চলিয়া গেলে আমরা বাহিরে আসিয়া দেখি অঝোরে ঝরিতেছে বারিধারা! আমি তাহার কয়েকফোটা হস্তে ধরিয়া হৈমর সিথিতে লেপন করিয়া বলিলাম_“দেখ, ব্রহ্মা তোমার সিঁদুড় হিসেবে নারদ দেবকে বৃষ্টিরূপে প্রেরণ করিয়াছে। অতএব, বিবাহকার্য সম্পণ্ন,এইবার একত্রে গৃহে প্রত্যাবর্তন...!”- এ বাক্যের প্রেক্ষিতেই ধরণীর বিরলতম দৃশ্য উপভোগের সেীভাগ্য হইল : হৈমর স্মিত হাস্যÑ যাহার সম্মোহন নারদ দেবকেও ক্ষণকালের তরে আপন কর্তব্যচ্যুত করিল বোধহয় ! আমি তাহাকে পাইলাম ; যেন সহস্র সীজার-নেপোলিয়ন-আলেক্সান্দার নতজানু হইয়া আমায় সেলাম জানাইল, সাতশত সাতাত্তরখানা হিমালয়ের সম্মিলিত উচ্চতাকেও আমাদের পাশে বনসাই ঠেকিল!! আমাদের এ বালখেলা ব্যাপক নিন্দিত হইবে অনুমিতই ছিল ; তাই ধর্মীয় রীতিতে আমাদের দ্বিতীয়বার জায়া-পতি সাজিতে হইল পারিবারিক চাপে । উভয়ই ইহাতে অসম্মত হইলেও মুরুব্বিদের ভাষ্যমতে আমরা যা করিয়াছি তাহা বিবাহ নহে, বিবাহের নামে স্রেফ “সহবাসের” ব্যভিচার! অতএব শঙ্খ-সাঁনাই-উলুধ্বনির হুলস্থূলে হৈম-আমি তথাকথিত “সহবাসের” প্রায়শ্চিত্ত করিলাম বৈধতার“সাতপাকে”বাধা পড়িয়া!কিন্তু “বৈধতা” সর্বক্ষেত্রে বিধাতার সমর্থনপুষ্ট হয়না বলিয়াই হয়ত কোন কোন বৈধতার “ছায়াসঙ্গী” অবৈধতার গুপ্তহন্তা ! : আমাদের য্ৌথ পরিবারে মা-জ্যেঠিমা’দের বিদ্যের দৌড় সর্বসাকুল্যে মাধ্যমিক পর্যন্ত ; তাই সঙ্গত হেতুতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাহাদের বিবেচনায় পুত্রবধু হইবার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি প্রকার অযোগ্য, আর বিবাহের বাজারে আমার দাম হাকাইবার সুযোগবঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভতো তাহাদের ছিলই, সঙ্গে হৈমর বয়স লইয়াও তাহাদের নিঃসীম অভিযোগ_ এত বয়স্কা বউয়ে নাকি বংশরক্ষা হইবে না! যদিও হৈমকে সরাসরি কিছু বলিবার দুঃসাহস তাহাদের ছিলনা, তবুও আমাদের বাড়ির অন্তঃপুরীতে সে যে অপাঙক্তেয় ইহা বুঝিবার মত মগজ ঈশ্বর তাহাকে দান করিয়াছেন ।

অবশ্য এইসব সাংসারিক সংকীর্ণতা লইয়া ভাবিবার অবকাশও তাহার সামান্যই : ক্লাসের প্রস্তুতি- পড়াশোনার যোগফলে তাহার প্রতিটি মুহূর্ত এতই মূল্যবান যে নিশীথ রাত্রি ব্যতীত আমাদের মধ্যেই সাক্ষাৎ ঘটিত কদাচিৎ! শৈশব হইতেই হৈমর জগত পুস্তকের মাঝে আশ্রয় লওয়ায় বাস্তবতার বহু সূক্ষ্ন কারচুপির সঙ্গে তাহার জানাশোনা নাই , যার সদ্ব্যবহার করিত আমার মা-জ্যেঠিরা : রন্ধনশালায় প্রবেশের কোনরূপ অভিজ্ঞতা না থাকিলেও ছুটির দিনগুলোয হৈম নিজে রাধিবার আগ্রহ প্রকাশ করিলে মা-জ্যেঠিরা তাহাকে সাহায্য করিবার ছলে এমন খাদ্য তৈরি করাইতো যাহাকে অখাদ্য বলিতেও রসনা সতেরোবার ভাবিবে! হৈমর এরকম সাংসারিক অর্বাচীনতা-সার্বক্ষণিক ব্যস্ততা আমার মাঝেও ক্রমে বিতৃষ্ণার সঞ্চারিল ; তাছাড়া স্যাটেলাইটে অনুষ্ঠান গ্রন্থনাসূত্রে এত অত্যাধুনিক রমণীর সান্নিধ্য পাই যে তাহাদের সাপেক্ষে হৈমকে ইদানীং নিতান্ত অকালবৃদ্ধা মালুম হয় ; এমনকি তাহার যে নিরবতাকে একদা শিল্প ভাবিতাম , তাহাও সহসাই বিরক্তির খোরাক হইয়া উঠিল _ আমার আবেগাপ্লুত আলিঙ্গনের বাহুডোরে সে কেবল ছোট্ট নিঃশ্বাস লয়, দশ কথা বলিলে হয়ত তিনটের জবাব পাই যার দুটিই থাকে দুর্বোধ্য! গাম্ভীর্যও দৈবাৎ বিনোদন খুঁজে রঙ্গরসে, কিন্তু হৈমর গাম্ভীর্য যেন চীনের প্রাচীর হইয়া সকল রম্যতাকে প্রতিরোধে ব্যাপৃত! সর্বোপরি হৈমর শৈল্পিক বুদ্ধিবৃত্তি, যোগ্যতার মাত্রা আমার মধ্যে ঈর্ষার জন্ম দিল , তাহার তুলনায় দিনেদিনে নিজেকে ভীষণ তুচ্ছ-ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মনে হইতে লাগিল, তাই “জ্ঞানের দেউলিয়াত্ব” লুকাইতে বিবাহের ৩মাসের মধ্যেই সংস্কৃতিমনা-প্রেমিকপুরুষ (!) “অপু রায়” স্বামীত্বের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ব্যাকুল হইয়া পড়িল যেন! কিন্তু পরনের মালকোচা খুলিয়া সেটি দিয়া উদল গা ঢাকিতে গেলে তাহাতে লজ্জাস্থান যে আরও উন্মুক্ত হয় সেই বোধ আমার বোধ্যাতীত! তাই আমাদের পাশাপাশি শয্যাগ্রহণ,দাম্পত্যের জৈবিকতা নিয়মমাফিক চলিলেও এগুলোকে যে নিজের সঙ্গে নিরর্থক প্রবঞ্চনা ঠেকিতেছে তাহা হৈমকে কড়া ভাষায় জানাইয়া কর্কশতম কণ্ঠে তাহাকে সংসারমনা হইবার নির্দেশ দিলাম, এমনকি প্রয়োজনে চাকুরি ছাড়িতে হইলেও! শেষ বাক্যটি আদতেই আমার উক্ত কিনা সেই ঘোর কাটিবার পূর্বেই “ঘোরের বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে” নিপতিত হইলাম হৈমর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় : নিবেদনের হাসি ! সেক্ষণে আমিই বোধহয় জগতের অসহায়তম মানুষ , কারণ এধরনের কটুবাক্যের প্রেক্ষিতে এমন পরিশোধিত হাস্যের মর্মার্থ উপলব্ধিতে আমি পুরোপুরি ব্যর্থ!তবে সকল দুর্বোধ্যতার সরল গদ্যে রূপান্তর ঘটিল যখন পরদিন বিশ্ববিদ্যালয় হইতে হৈম আর ফিরিল না ; তাহার মুঠোফোন বন্ধ পাইয়া দিনান্তে বিশ্ববিদ্যালয়ে দুরালপনী করিয়া জানিলাম হৈম সেখানে যাইবামাত্র ১মাসের ছুটি লইয়া দ্রুত বাহির হইয়া গিয়াছে ; অত:পর শ্বশুরালয়ে .... না সেখানেও তাহার সন্ধান মিলিল না, থানা-হাসপাতাল... কোথাও না!! একবার ভাবিলাম স্বীয় পত্রিকাসহ সর্বত্র হৈমন্তীর অন্তর্ধানের সংবাদ প্রচার করিলে যদি কোন প্রতিকার হয়, কিন্তু পরমুহূর্তেই সেটি খারিজ করিলাম এই আশঙ্কায় যে ইহাতে আমার খ্যাতির কুখ্যাতি রটিবে! অনুষদের শ্রেষ্ঠ ছাত্রী, আমার সহিত সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সর্বসাকুল্যে ৫বার আলাপ হইয়াছে, এমতবস্থায় আমার প্রতি কিরূপে তাহার অনুরুক্তি জন্মিল, কেনইবা আমার প্রতীক্ষায় সুদীর্ঘকাল অনুঢ়া রহিল, আবার একবাক্যেই কেন প্রস্থান করিল"- হৈমন্তীর মনস্তত্ত্ব বোধকরি রবিঠাকুরেরও কল্পনার আধার”। অচানক ভাবনায় বিঘ্ন ঘটিল হৈমর মুঠোফোনে আমায় স্মরিলে_ “ আমাদের দাম্পত্যের রেল বগিচ্যুত হইয়াছে অপু, ইহা মেরামত অযোগ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে তোমার প্রতিভার প্রখরতায় আমাদের সম্বন্ধের অদৃশ্য সৌধ নির্মিত হইয়াছিল নিজেদের অজ্ঞাতসারেই ; তবে মানসিক উৎকর্ষ আর প্রতিভা ভিন্ন বস্তু ; তাই প্রতিভায় তুমি যতটা স্বকীয় মানসিকতার ক্ষেত্রে ঠিক সমপরিমাণ আটপৌরে। কিন্তু মানসিকতার দুইটি সমান্তরাল লাইন ব্যতীত সম্বন্ধের রেল দুর্ঘটনাকবলিত হইবে ইহাইতো চিরন্তন সত্য! সুতরাং আমাদের যুগলবদ্ধতারএখানেই রহিত ঘটুক। যদি কখনো বোধ হয় আমরা পুনরায় সহযাত্রী হইতে প্রস্তুত সেদিনই কেবল দুজনে এককাপে চা ’পান করিব।

অদ্য হইতে দুরত্বের কালিতেই রচিত হউক আমাদের দাম্পত্যের সরল ধারাপাত ;নীলিমায় মেঘ জমিছে ; আলাপনের এখানেই যতি টানিলাম ; আধুনিক হয়ো” হৈমর শেষবাক্যটিই আমার ব্যক্তিত্বের দৈন্যতাকে পরিহাসে যথেষ্ট ; বুঝিলাম পুরুষে-পুরুষে পৃথিবী সয়লাব হওয়া সত্ত্বেও হৈমন্তীর মত রমণীদের স্বামী হইবার মত পুরুষ একপ্রকারে বিলুপ্তপ্রায় ; আমার ব্যক্তিমানুষের ব্যর্থতা এই যে আমি নীলিমাকে চারদেয়ালে বাধিতে উন্মুখ ছিলাম, কিন্তু নীলিমাতো স্পর্শ কিংবা বন্ধনের বহু ঊর্ধ্বে ; তাহাকে দূর হইতে দর্শনেই কেবল পরিতৃপ্তি। হে ঈশ্বর , আপনার নিরপেক্ষতা প্রশ্নাতীত ; শুধু হৈমদের সৃষ্টির প্রাক্কালে অপুদের প্রতিও একটুখানি সদয় হইবেন দয়া করিয়া!!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।