আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রেমিক নজরুলের সাতকাহন ~ফজিলতুন্নেসা পর্ব-১~

আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
নার্গিস পর্ব || প্রমীলা পর্ব-১|| প্রমীলা পর্ব-২ || প্রমীলা পর্ব-৩ নজরুলের প্রেমিক জীবনে ফজিলতুন্নেসা পর্ব একটু জটিল। কারন মাত্র তিনজন ব্যক্তি এই ঘটনার সাথে সম্পর্কিত প্রথম জন ফজিলতুন্নেসা, দ্বিতীয় জন অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন এবং তৃতীয় জন স্বয়ং কাজী নজরুল ইসলাম। অন্যকেউ নজরুল-ফজিলতুন্নেসা সম্পর্কে জানতেন না। তাছাড়া ১৯২৪ সালে নজরুল ইসলামের প্রমীলা দেবীর সাথে বিয়ে হয় আর ফজিলতুন্নেসার সাথে তার দেখা হয় ১৯২৮ সালে। স্থুল দৃষ্টিতে, নজরুল ফজিলতুন্নেসার সম্পর্কের ব্যাপারটা তেমন জটিল কিছু না।

কাজী মোতাহার হোসেনের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তাদের যোগাযোগ হয়। নজরুল ফজিলতুন্নেসাকে প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখাত হন। দুই/তিন বছর নজরুলের অনুরাগ টিকেছিল। পরে ফজিলতুন্নেসা বিদেশে পড়তে গিয়ে খান বাহাদুর আহসানউল্লাহের ছেলে সলিসিটর জনাব শামসুজ্জোহাকে পছন্দ করেন, পরবর্তিতে তাদের বিয়ে হয়। এক পর্যায়ে নজরুলের জীবনে ফজিলতুন্নেসা পর্বের ইতি ঘটে,এতটুকুই।

আবার ঘটনা এতটা সরলও নয়। ফজিলতুন্নেসার প্রতি নজরুলের অনুরাগের কথা আমরা জানতে পারি অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের কাছ থেকে। এই বিষয়ে গভীরে যাবার আগে কাজী মোতাহার হোসেন এবং ফজিলতুন্নেসা সম্পর্কে কিছু বলে নেওয়া আবশ্যক। কারন আমরা অনেকেই এদের দুজনকেই তেমন চিনি না বিশেষ করে অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনকে। ব্যাপারটা খুবই দুঃখজনক।

আরো উল্লেখ করতে চাই, নজরুলের জীবনের এই অধ্যায়ের খবর পাওয়া যায় তার চিঠিপত্র, এবং মোতাহার হোসেনের নিজের লেখাগুলো থেকে। এই ঘটনা স্বয়ং কাজী নজরুল ইসলাম তার চিঠি পত্রে এবং কাজী মোতাহার হোসেন তার প্রবন্ধে এত মোহনীয় করে তুলে ধরেছেন যে, নিজের ভাষায় সেগুলো সম্পর্কে লিখে তার রস নষ্ট করবার সাহস করলাম না। ফজিলতুন্নেসা পর্বের বেশির ভাগ অংশই নজরুলের চিটিপত্র ও মোতাহার হোসেনের প্রবন্ধ হতে সরাসরি তুলে হবে। ----------------------------------------------------------------- আজকের বাংলাদেশ ও বিভাগপূর্ব তৎকালীন পূর্ব-বাংলার একশত বছরের ইতিহাসে বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শিক্ষার জগতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধাপক কাজী মোতাহার হোসেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি নাম। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক এবং এই অঞ্চলের প্রথম একাডেমিকালি শিক্ষিত পরিসংখ্যানবিদ।

১৯২৬ সালে কাজী আব্দুল ওদুদ, সৈয়দ আবুল হোসেন ও আবুল ফজলের সাথে তিনি "মুসলিম সাহিত্য সমাজ" গড়ে তোলেন। তিনি একজন শক্তিশালী প্রবন্ধকারও বটে, এসএসসিতে আমরা কাজী মোতাহার হোসেনের ‘শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব’ প্রবন্ধটি পড়েছি। নজরুলের সাথে কাজী মোতাহার হোসেনের পরিচয় হয় ১৯২০-২১ সালের দিকে কলকাতায়। তারা প্রায় সমবয়সী, মোতাহার হোসেন নজরুল হতে দুই বছরের বড় ছিলেন। ১৯২৭ সালের আগে তাদের মধ্যে তেমন ঘনিষ্টতা গড়ে উঠে নি, সেইবার নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রথম অধিবেশনে যোগ দিতে ঢাকা আসেন।

এরপর ১৯২৮ সালে দ্বিতীয় অধিবেশনে যোগ দিতে এসে নজরুল কাজী মোতাহার হোসেনের বাসায় উঠেন। কাজী মোতাহার হোসেন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বর্ধমান হাউসের (বর্তমান বাংলা একাডেমী ভবন) হাউস টিউটর হিসেবে সপরিবারে ঐ বাড়িতে থাকতেন। সেখানেই তাদের মধ্যে অত্যন্ত ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠে। বেগম ফজিলতুন্নেসা ১৯০৫ সালে তৎকালীন পূর্ববাংলার ময়মংসিংহের করটিয়াতে জন্ম গ্রহন করেন। সেই হিসেবে তিনি নজরুল হতে ছয় বছরের ছোট।

অত্যন্ত ভাল ছাত্রী ফজিলতুন্নেসা কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে বি. এ পাশ করে ১৯২৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্কে এমএ পড়তে ভর্তি হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়র প্রথম মুসলমান ছাত্রী। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী ছিলেন লিলা নাগ। সেই ১৯২৩ সালে ঢাকাতে ফজিলতুন্নেসা একা পুরান ঢাকার দেওয়ান বাজার রোডে (বর্তমানে খুব সম্ভবত নাজিমুদ্দিন রোড) একটি বাসায় থেকে লেখাপড়া করতেন। এখন ফজিলতুন্নেসা ও কাজী মোতাহার হোসেনের সম্পর্কটাও পরিস্কার করা জরুরি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ পড়বার সময় একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক কাজী মোতাহার হোসেনের সাথে ফজিলতুন্নেসার পরিচয় হয়। বিকেল বেলা প্রায় প্রতিদিন ফজিলতুন্নেসা বর্ধমান হাউসে মোতাহার হোসের স্ত্রী ও শাশুড়ির সাথে আড্ডা দিতে আসতেন। আড্ডা দিতে দিতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে পড়লে তিনি ফজিলতুন্নেসাকে বাড়ি পৌছে দিয়ে আসতেন। তিনি ফজিলতুন্নেসাকে সর্বদা নিজের ছোট বোনের মতই দেখতেন। এই ব্যাপারে আমি আর বেশি কিছু না বলে, কাজী মোতাহার হোসেনের ‘মরহুমা ফজিলতুন্নেসার সঙ্গে আমার পরিচয়’ (১৯৭৭ সালে ইত্তেফাকে প্রকাশিত, ১৯৭৬ সালে ফজিলতুন্নেসা মৃত্যুবরণ করেন)প্রবন্ধের কিছু অংশ তুলে ধরছি, ‘প্রতিদিন প্রত্যুষে উঠে ঘুম টুটে গেলেও ফজিলতের কপট ঘুমটা থেকেই যেত- তাই আমাকেই এসে তার দু’হাত ধরে টেনে তুলে বিছানায় বসিয়ে দিয় ঘুম ভাঙাতে হত।

এবারও একবার গিয়ে দেওয়ানবাজারের ঘরগুলো দেখে এসেছি। তার স্মৃতি-জড়িত ঘরগুলো এখনও পূর্বস্মৃতি ধারণ করেই চুপ করে রয়েছে। দেখতে পেলাম কোন্‌ ঘরটায় তার অসুখের সময় তার রাতুল চরণ যুগল কোলে তুলে নিয়ে আমি গরম পানিতে ভিজানো তোয়ালেটা নিংড়িয়ে নিয়ে আলগোছে ওর পায়ে সেঁক দিয়ে দিতাম। তখন কি সুন্দর হাসিটাই না ফুটে উঠত ওর চোখে-মুখে। ও যে আমার চিরজীবনের আপন বোন ............................................... ...............................................এই সব ব্যাপার লক্ষ্য করলে স্পষ্টই বোঝা যায় আমার ও আমার ফতুল ভগ্নীটার মধ্যে কেমন অসাধারণ সহজ সম্পর্ক ছিল।

যইদ একে অন্যকে সম্যক বুঝতে পারে তবেই শুধু এরূপ হওয়া সম্ভব। মনে দ্বিধাদ্বন্দ, সন্দেহ বা কলুষ থাকলে এমন গভীর সৌহার্দ জন্মাতেই পারে না। .................................................................................... আমি ফজিলতকে চেয়েছি এবং পেয়েছি অতি পবিত্র বান্ধবিরূপে। ফজিলতও আমাকে পেয়েছে অনাবিল বান্ধব রূপে। আমরা আমাদের বান্ধব-বান্ধবী সম্পর্ক পূর্ণমাত্রায় বজায় রেখেছি।

আমাদের দুজনের হৃদয়বৃত্তি সমতুল ছিল বলেই আমরা সযত্নে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যেই আমাদের পবিত্র সম্পর্ক সংযত ও সংহত রাখতে পেরেছি। ................................................................................... অনেকেই হয়ত মনে মনে প্রশ্ন তুলবেন, “আচ্ছা কাজী সাহেব, সত্যি করে বলেনত আপনার মুখে পাতানো ভগ্নীর সঙ্গে এত মাখা মাখি (বা দহরম মহরম) আপনার ঘরণী (সাজেদা বিবি) কেমন করে বরদাশত করতেন?” আমি বলি, “আমার সাজুরানী আমাকে ভাল করেই চেনেন। তার পারিবারিক পরিবেশ সম্পূর্ণ আল্লাময়”। ফজিলতুন্নেসা পর্ব -২ দেখুন সূত্র: ১. 'মরহুমা ফজিলতুন্নেসার সঙ্গে আমার পরিচয়' - কাজী মোতাহার হোসেন; স্মৃতিকথা-প্রবন্ধসংকলন ২.'স্মৃতিপটে নজরুল' - কাজী মোতাহার হোসেন; স্মৃতিকথা-প্রবন্ধসংকলন (ছবি উৎস- ব্লগার অ্যামেটারের পোস্ট )
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.