আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধর্মীয় বিয়ে ও নাগরিক বিয়ে

পর্যটক

গত কিছুদিন ধরে "লোডশেডিং" নিক নামের এক লেখকের এই শিরোনামে Click This Link পোষ্টে একটা হালকা তর্ক চলছি। পোষ্টের নাম, "হিন্দু আইনে তালাক নাই"। শিরোনাম যাই থাকুক, তর্কটা ধাবিত হয় বিয়ের মুসলিম আইনের দিকেও। এক পর্যায়ে লক্ষ্য করলাম লেখক "বিয়ে মানেই ধর্মীয় বিয়ে" - এরকম একটা ধারণার মধ্যে আলোচনাকে জবরদস্তি আটকে ফেলতে চাইছেন। আসলে ওটাকে বিয়ে নিয়ে হাল্কা চালে কথাবার্তা মনে হলেও কথা হচ্ছিল কিন্তু আইন নিয়ে - এটা লেখকসহ অনেকেই ধরতে পারেন নাই।

আইনের প্রশ্ন - মানে রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রের (constitution) সাথে যা সম্পর্কিত। অথচ হাল্কা চালে অসর্তকভাবে হওয়ার কারণে, এক পর্যায়ে আলোচনাটা বিয়ের ব্যাপারে কোন্‌ ধর্মীয় আইন ভালো - এই সংকীর্ণ পথ ধরেছিল। কিন্তু তারপরেও, কোন কাবিননামায় মেয়েকে তালাকের অধিকার না দেয়া থাকলে তাঁর কী হবে এই প্রশ্নে এসে প্রায় মৃত ঐ আলোচনায় আমার অংশগ্রহণ ঘটে। আমি কেবল একটা তথ্য যোগ করে আমার অংশগ্রহণ অতটুকুতেই সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছিলাম। তথ্যটা ছিল এরকম - কাবিননামায় মেয়ের তালাকের অধিকার না দেয়া থাকা সত্ত্বেও পরবর্তীতে মেয়েটা তালাক কার্যকর করতে পেরেছিল সিভিল ল এর মাধ্যমে হাইকোর্টের সহায়তায়, অর্থাৎ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে নাগরিক অধিকার বলে - এরকম উদাহরণ আছে।

কিন্তু লেখকের গোয়ার্তুমি আমাকে এতদূর নিয়ে এসেছে। প্রতিক্রিয়ায়, বিয়ে আর নাগরিক রাষ্ট্রের সম্পর্কটা দেখানোর জন্য এই রচনাটার অবতারণা করতে হয়। একটা প্রসঙ্গ লেখকের বলছিলেন,"ধর্মীয় বিধিবর্হিভূত বিয়ে আর ধর্মীয় বিধি-মোতাবেক বিয়ে সবই নাগরিক অধিকার বলে বিয়ে। সেটা নিয়া পার্থ্ক্য করার কি আছে?"। এর উত্তর থেকেই লেখা শুরু করছি।

হ্যাঁ আছে। ধর্মীয় বিধি-মোতাবেক বিয়ে মানে ওখানে আপনি একইসাথে রাষ্ট্রের নাগরিক পরিচয় আছে কী না সেটা বিবেচনায় নিয়ে ঐ বিয়েটা ঘটছে না; বলা যায় রাষ্ট্রের নাগরিক কী না সে প্রসঙ্গ ওখানে উহ্য। আর বিপরীতে, নাগরিক অধিকার বলে বিয়ে মানে ঐ বিয়ের আইনী উৎস, সেভগার্ড, আইনী প্রক্রিয়া, সার্টিফিকেশন ইত্যাদি সবকিছু রাষ্ট্র নাগরিক অধিকার সংরক্ষণের যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজে গঠিত হয়েছে সেই অধিকার বলে নাগরিকের বিয়ে। ফলে, সবই নাগরিক অধিকার বলে বিয়ে - কথাটা খাটছে না। কথাটা এবার ব্যাখ্যা করে বলি।

আমি ব্যক্তি, রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রের (constitution) উপাদান (constituent), নাগরিক। আমার মত আমাদের সমাজের আর সব নাগরিক মিলে আমরা পরস্পরের কী কী বিষয়, স্বার্থ রক্ষা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হচ্ছি তা লিপিবদ্ধ করে রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিয়েছি - এর প্রয়োগ, পালন, রক্ষা করা ও তা ঠিকমত হচ্ছে কী না তা তদারক করার জন্য। এজন্য প্রত্যেক নাগরিকের ক্ষমতা তাদের হয়ে প্রয়োগের জন্য রাষ্ট্রকে ক্ষমতাও দিয়েছি। প্রয়োজনে ঐ ক্ষমতায় আরো বিস্তারি প্রতিষ্ঠান (সংসদ, বিচারালয়, নির্বাহী প্রশাসন ইত্যাদি) গড়ে নেবার ক্ষমতাও দিয়েছি। এই হলো আমি আর আমার রাষ্ট্রের মধ্যেকার সম্পর্কের মূলকথা।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র আমাদের নাগরিক অধিকার রক্ষার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রে (constitution) ১৯৭২ সাল থেকেই PART III FUNDAMENTAL RIGHTS শিরোনামে ২৬ থেকে ৪৭ ধারায় লিখে কবুল করে রাখা আছে। লেখক এক সময় দাঁত খিচিয়ে তেঁড়ে এসে আমাকে বলেছিলেন, "এত যে অধিকার অধিকার করছেন। এখন আপনে বলেন অধিকার বলতে আপনে নিজে কি বুজেন?" - আমি সুন্দর করে বলছি, এটা হলো এর উত্তর । তবে, এই যে নাগরিক বললাম, রাষ্ট্রের কাছে আবার ঐ নাগরিক মানে - আপনি কোন ধর্মের, দেখতে কেমন গায়ের রং সাদা না কালো, কোন জেলা শহরের না আদিবাসী, নারী না পুরুষ, ইসলামিষ্ট না স্যেকুলারিষ্ট ইত্যাদি - পরিচয় ছাপিয়ে, নির্বিশেষে সকলে। রাষ্ট্র এনিয়ে কোন বৈষম্য বা ভেদাভেদ করা অথবা এরকম কোন ভেদ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী করতে আসবে না।

এখন নাগরিক পরিচয়ে কেউ বিয়ে করতে চাইলে রাষ্ট্র তা আমলে নিবে, ব্যবস্হা করবে, এমনকি প্রতিষ্ঠান (ম্যারেজ রেজিষ্টার অফিস) না হয়ে থাকলে তাও গড় নিতে সে বাধ্য। এখানে ম্যারেজ রেজিষ্টার অফিস বলতে ঠিক কাজী অফিস নয়। এদুয়ের মূল তফাৎটা হলো, ম্যারেজ রেজিষ্টার অফিস নাগরিক পরিচয়ে ব্যক্তির বিয়ের রেজিষ্টার। ফলে - আপনি কোন ধর্মের, দেখতে কেমন গায়ের রং সাদা না কালো, কোন জেলা শহরের না আদিবাসী ইত্যাদি - জিজ্ঞাসা না করে কেবল নাগরিক গণ্য করে সব সম্ভাব্য দম্পতির বিয়ে রেকর্ড বা রেজিষ্টার করাই এর কাজ। প্রচলিত কাজী অফিসে এই সুযোগ নাই।

ওখানে, কেবল ইসলাম ধর্মীয় মতে বিয়ে হলেই তা সে রেকর্ড বা রেজিষ্টার করতে পারে। ম্যারেজ রেজিষ্টার অফিসের বিয়েকে আমার নাগরিক বিয়ে বলতে পারি। তবে নাগরিক বিয়ে আর কাজী অফিসের বিয়ের মধ্যে আবার একটা মিলের দিকও আছে। মিলটা হলো দুটোই কোর্ট-কাছারির অর্থে আইনের বিয়ে বা বলা যায় বিয়ের আইনী দিক সম্পন্ন হয় ওতে, ওটাই ওখানে মুখ্য। দুই জায়গাতেই তাই স্বীকৃত কাগুজে রেজিষ্টি খাতা ও একজন ব্যক্তি রেজিষ্টার থাকে।

কিন্তু বিয়ে মানে আবার কেবল আইন নয়, এর একটা সামাজিক দিকও আছে। সে প্রসঙ্গে যাবার আগে কিছু কথা বলে নেই। গঠনতন্ত্র-য়ালা (constitution) নাগরিক রাষ্ট্র থাকলেই নাগরিক বিয়ে করার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্হা ওখানে জন্ম নিয়ে ফেলবে ব্যাপারটা এমন নয়। যেমন বাংলাদেশে সেরকম কিছু ব্যবস্হা নাই বললেই চলে। গঠনতন্ত্র (constitution) সায় দেয় কিন্তু এখনও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্হা ম্যারেজ রেজিষ্টার অফিস তৈরি নাই - এরকম হলে বুঝতে হবে ঐ রাষ্ট্র কায়েম হয়েছে বটে তবে নাগরিক রাষ্ট্র গড়ার কোন আন্দোলনের ফসলে ঐ রাষ্ট্র কায়েম হয়নি।

অন্য কোন কারণে ঘটে গেছে। এরা দেশকে ভালবাসে হয়তো। তবে, রাজাকার বাদে আমি সবাইকে ভালবাসি - এধরণের কথাবার্তার উর্ধে চেতনার বিস্তার ঘটে নাই। রাষ্ট্র গড়ার প্রাতিষ্ঠানিক ভাবনা, নাগরিক রাষ্ট্রের ভাবনা ওখানে এখনও অনুভুত হয় নাই। কাজীর গরুর মত, গরু খাতায় আছে গোয়ালে নাই।

আবার গোয়ালে যে গরু থাকতে হবে - এই ব্যাপারটা এখনও বোধ ভিতরে আসে নাই। গঠনতান্ত্রিক (constitution) রাষ্ট্রের আবির্ভাবের আগে অর্থাৎ সমাজে নাগরিক রাষ্ট্র রূপ হাজির হওয়ার আগে থেকেই বিয়ের ব্যবস্হা ছিল সামাজিক, সেই অর্থে একে ধর্মীয়ও বলতে পারি। সামাজিক বিয়েতে লোকজন খাওয়ানো, উপহার, ধুমধাম, ঢাকঢোল পেটানো ইত্যাদি থাকার কারণে ওটাকে সামাজিক বলছি না। সমাজকে সাক্ষী মেনে ঐ বিয়ে হওয়ার কারণে ওটা সামাজিক। ওটাই ওর ভিত্তি।

যেটাকে আমরা বাইরে থেকে বিয়ের দাওয়াত বলি ওটাই সমাজকে জানানোর, জানিয়ে অনুমতি গ্রহণ (inform consent) এর প্রথম ধাপ। এরপর দাওয়াতি জানা লোকের প্রত্যক্ষ উপস্হিতিতে অর্থাৎ সকলকে স্বাক্ষী রেখে বিয়েটা হয়। সাদা চোখে যেটাকে বিয়ের দাওয়াত খেতে আসা লোক মনে হয়, আসলে ওটাই সমাজের হয়ে উপস্হিত লোকেদের দেয়া বিয়ের সামাজিক স্বীকৃতি। মুসলিম বিয়ে হলে কোন কাগজপত্র নয় মুখে মুখে দেনমোহর ধার্য করে বিয়ে আর হিন্দু বিয়ে হলে ওসবের বালাই নাই। - তবে পুরোহিতের দ্বারা অনুষ্ঠান সম্পন্ন বিয়ে অথবা মসজিদের মোয়াজ্ঝিন বা ধর্মীয় গুরুত্ত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ত্বের দ্বারা পড়ানো বিয়ে - এই ধর্মীয় আচার অংশসহ সবটাই সামাজিক বিয়ে।

পরবর্তীতে, সমাজে কোন বিচার সালিস দরকারে, কারও সাথে কারও বিয়ে হয়েছে কী না, কে কার সন্তান কী না বা সম্পত্তি বিষয়ক জটিলতাও কাটানো যেতো সহজে কারণ, ঐ ছোট্ট সমাজ জানতো বিয়েতে প্রত্যক্ষ উপস্হিত লোকজন ও সেই স্বাক্ষের ভিত্তিতে। ফলে দেখা যাচ্ছে বিয়ের আইনী দিকটাও সম্পন্ন হতে পারতো ঐ সামাজিক বিয়েতে। অতএব, এককথায় বিয়ের ধর্মীয়, আইনী দিকের প্রয়োজন মিটিয়েই ঐ বিয়ে হয়ে উঠতো সামাজিক বিয়ে। এই অর্থে বিয়ে যে ধর্মেরই হোক মূলসুরটা সামাজিক যার মধ্যে ধর্মীয়, আইনী দিকটা অবিচ্ছেদ্দ অনুসঙ্গে একাকার। আমরা নগর ভিত্তিক বসবাসের সভ্যতার দিকে যতই অগ্রসর হয়েছি এই পরিস্হিতির ক্রমশ বদল ততই ঘটতে থাকে ।

মোঘল রাষ্ট্র, কলোনি ধরণের রাষ্ট্র থেকে আজকের রাষ্ট্র পর্যন্ত বিয়ের বিশেষত মুসলিম বিয়ের সামাজিক প্রসঙ্গে তাই স্বভাবতই অনেক বদল আমরা দেখতে পাব। তবে এই বদলের মধ্যে বিয়ে মানে এর আইনী দিকটা বেশী উজ্জ্বল হতে শুরু করে, কারণ ওর সাথেই জড়িয়ে আছে সম্পত্তি বিষয়ক প্রশ্ন। ফলে সামাজিক বিয়ে আচার অনুষ্ঠানের ঠাটবাটে গিয়ে ঠেকে। তুলনায় হিন্দু বিয়ে সামগ্রিক অর্থে সামাজিক হয়েই থেকে যায়। বিয়ে প্রক্রিয়ার মধ্যে তালাক বা বিয়ে বিচ্ছেদের প্রসঙ্গটা সমাজে প্রথম সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের ইস্যু হয়ে হাজির হয়।

দেনমোহরের কিছু সম্পত্তি পাক বা না পাক স্বামীর ঘর ত্যাগ মানে বাপের বাড়ীতে ঠাই, কারণ একা মেয়েটার পক্ষে নতুন পরিবার ইউনিট হিসাবে দাড়ানোর জায়গা করে দেবার জন্য সমাজ তখন কত অপ্রস্তুত ছিল তা আজকের সমাজ দেখলেই বুঝা যায়। পরিবার বলতে সম্পত্তি-কেন্দ্রিক একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙন যেখানে সম্পন্ন হয় নাই, বাপ ছেলের পরিবার ভিন্ন হওয়া দূরে থাক, দাদা, চাচাতো দাদা, বাবা, চাচাসহ ছেলে বউ মিলে তিন প্রজন্ম যখন একএকটা পরিবার তখন, তালাকের চেয়ে সতীনের সাথে ঘরই ভাল। আমাদের বাপ দাদাদের স্মৃতিতে বা সিনেমা গল্পে সবারই ছোটবেলায় বিধবা বা তালাকপ্রাপ্ত ফুফু বা খালা বা বড়বোনের মত একটা চরিত্রের সান্নিদ্ধে বড় হওয়া তো সবচেয়ে স্বাভাবিক ঘটনা। এই পরিস্হিতিতে দেনমোহর বা কাবিননামা মেয়েদের জন্য অবস্হার খুব কিছু অদলবদল করতে পেরেছিল বলা যাবে না। তবে নিয়মটা থাকা অবশ্যই মন্দের ভালো; এখন যার কিছুটা সুফল আছে বৈকি।

তবে সমাজের প্রস্তুতিটাই দেখা যাচ্ছে এখানে আসল, যে বিচারে আমাদের আরও অনেক পথ পারি দিতে হবে, বুঝা যাচ্ছে। এত দূরের ঘটনায় আর বেশী না থেকে একটু কাছে আসি। পাকিস্তান আমলে, বিয়ে বিষয়ক আইনে রাষ্ট্রের সর্বপ্রথম গুরুত্ত্বপূর্ণ হস্তক্ষেপ আনেন আইয়ুব খান ১৯৬১ সালে, Muslim Family Laws Ordinance of 1961। এর আগে বৃটিশরা কাজীর বিচার ব্যবস্হা ভেঙ্গে দেবার পর The Muslim Personal Law (Shariat) Application Act, 1937 - এটাই ছিল সম্ভবত মুসলিম পারিবারিক আইনের সাথে রাষ্ট্রের প্রথম মুলাকাত এবং কলোনী অর্থে ও সূত্রে নাগরিক রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ। সে যাই হোক, ১৯৬১ এর সংস্কারে, মূলত একের বেশী বিয়ে করতে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি, ও তালাক ইত্যাদি প্রসঙ্গে কিছু আইনী সংস্কার ছিল এর মূল বিষয় বলে মনে হলেও উৎসাহটা কিন্তু এসেছিল বাইরে থেকে; আমেরিকান বৈদেশিক নীতির কল্যাণে যখন, বিশ্বে ধনী দেশের চেয়ে বিপদজনকভাবে বেড়ে যাওয়া গরীব দেশের জনসংখ্যা কমানো, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বাসনাকে পরিবার পরিকল্পনা নামে চালানোর কাজ দেখভাল করা ওর নীতির অংশ হয়।

গরীব দেশ তো বটেই তাছাড়া মুসলমানেরা বেশী বিয়ে করে, বেশী বাচ্চা পয়দা করে ফলে গরীব মুসলমান দেশের দিকে নজর বেশী ফেরাতে হবে; বিয়ে তালাকের আইনে সংস্কার করলে এর সুফল আসবে বেশী। এই আগাম অনুমান ছিল ঐ সংস্কারের ভিত্তি। মওলানা মান্নান ও শর্ষিনার পীরের সাথে আইয়ুব খানের সম্পর্কের গাটছাড়া সূত্র এখান থেকে। আইয়ুব খানের সংস্কারের পক্ষে পরিবার পরিকল্পনায় উদ্বুব্ধ করতে মাদ্রাসা শিক্ষকদের মাধ্যমে সমাজকে সংগঠিত করতে, শিক্ষক সমিতি গঠন করতে শর্ষিনার পীরের তরফে প্রতিনিধি ছিল মওলানা মান্নান। এই সম্পর্কের সূত্র ধরেই মাঝখানে ৭১ সালে পাকিস্তানের নিপীড়ক শাসককে সমর্থন করে বসতে হয়।

তবে আবার জিয়াউর রহমানের আমল পর্যন্ত আমেরিকান বৈদেশিক নীতিতে একই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতি অভিমুখ তখনও বজায় ছিল ফলে, মওলানা মান্নান আবার গুরুত্ত্বপূর্ণ হয়ে উঠে, কাজ পায় এমনকি মন্ত্রীত্ত্বও। তবে এবার বন্ধুসাথী এমন অনেকের সাথে কাজ করে যারা মুক্তিযুদ্ধেও আস্হা রাখে আবার মনে করে আমেরিকান বৈদেশিক নীতি সঠিক। বাংলাদেশের সব দুঃখের মূল কারণ আমাদের গন্ডায় গন্ডায় বাচ্চা পয়দা করা। ফলে ধর্মীয় বিয়ে তালাকের আইনে সংস্কার নয়, মেয়েরা বিয়ে তালাক আইনে সংস্কারের অভাবে কষ্ট পাচ্ছে তাও নয়। মেয়েরা ওখানে গুরুত্ত্বপূর্ণ এজন্য যে ওরা পেট কেটে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতিটা বাস্তবায়ন করবে।

এটা করতে গিয়ে বিয়ে তালাকের সংস্কার পড়ে পাওয়া একআনা পায়ে গেলেও পাইতে পারে। পাঠক লক্ষ্য রাখবেন, বিয়ে, যেটা আমাদের কাছে নিরুপদ্রব ধর্মীয় বিষয়, ধর্মীয় কিছু আইন পালন বলে মনে হয় - এটা মোটেও তা নয়। এর সাথে সমাজ, রাষ্ট্রের সমস্ত আইনকানুন, স্বার্থ জড়িয়ে আছে। এমনকি বিদেশী রাষ্ট্রের নীতি, স্বার্থও এখানে সমান জড়িত। এই পরিস্হতিতে আমাদের মুসলিম বিয়ে তালাকের বিধি নিয়মের অন্যদের চেয়ে খুবই ভালো - এতটুকু ভেবেই আমরা আত্মতুষ্টিতে বিভোর থাকতে পারি, পাবোও হয়ত।

কিন্তু সমাজে রাষ্ট্রের আইনকানুনের, বিদেশী নীতির ভিতরে এটা কিভাবে ফাংশন করে, সম্পর্ক করে টিকে আছে - এদিকটা তাতে আড়ালেই থেকে যায়। এই আড়াল আরও কিছুটা উন্মোচন করার জন্য আমরা এখন পরের গল্পে যাব। এরপর উল্লখযোগ্য, দ্বিতীয় সংস্কারটাও এসেছিল অনির্বাচিত শাসকের হাত ধরে ১৯৮৫ সালে এরশাদের আমলে। এসব সংস্কারের সবচেয়ে বড় দূর্বলতা হলো দেশের কোন সামাজিক আন্দোলনের দাবীর ফলশ্রুতিতে এই সংস্কারগুলো ঘটেনি। প্রায় নিশ্চল, নিথর সমাজে কারণে বিদেশের ক্ষমতা ও প্রভাব আর দেশের অনির্বাচিত শাসক - এই দুইয়ের মহাযোগই হয়ে উঠে একমাত্র ও সহজ উপায়।

যাই হোক, এরশাদের আমলে নারীদের দিক থেকে ইস্যুটা ছিল সমাজে তালাকের হার কমানো। আর শাসক এরশাদের দিক থেকে, নারী উন্নয়ন খাতে দাতাদের অনুদান ও মঞ্জুরীর অর্থের স্রোত কিছুটা বাংলাদেশমুখী করা। ওদিকে তালাকের যথেচ্ছাচার, এর হার কমানোর উপায় কী? তালাক প্রক্রিয়া দীর্ঘ করা, মধ্যস্ততা ও বুঝানোর সুযোগ বাড়ানো। কিন্তু তালাক যেখানে আনরেজিষ্টার্ড কেবল মুখে বলে তা কার্যকর করা হয়েছে সেখানে তালাক হয়ে গেছে ধরে নেবার পর আর তা নিয়ে কী করার বাকি থাকে। ফলে তালাক রেজিষ্টার করতে হবে আগে।

তালাক রেজিষ্টারের প্রক্রিয়াটা লম্বা করতে পারলে কথা বলার সুযোগ বাড়বে। কিন্তু বিয়েই যদি রেজিষ্টারে না থাকে তবে কোন বিয়ের তালাক রেজিষ্টার করবে। অতএব বিয়ে রেজিষ্টী বাধ্যতামূলক করতে হবে। আবার তা শুধু অধ্যাদেশের হুকুম জারি করে করলে হবে না, মেকানিজম মানে, প্রশাসনিক কাঠামো ও লোকবল লাগবে। এইবার প্রথম আমরা বিয়ে রেজিস্টেশনের একটা প্রয়োজন, প্রশাসনিক কাঠামো ও লোকবল দরকার বলে রাষ্ট্রকে উতলা হতে দেখছি।

এই কঠিন কাজটা সহজে করতে গিয়ে রাষ্ট্রকে একটা আপোষের রাস্তা নিতে হয়। আপোষ, কারণ সমাজ আন্দোলিত না করে সংস্কার করতে গেলে আপোষের পথ ছাড়া উপায় কী? রাষ্ট্রের উদ্যোগে বিয়ের রেজিষ্ট্রেশনের কাঠামো গড়ার সুযোগ তো নাগরিক বিয়ের রেজিষ্ট্রেশন ব্যবস্হা হবার কথা। কিন্তু তা হয়ে গেল মুসলিম বিয়ের রেজিষ্ট্রেশন ব্যবস্হা। কারণ ইতোমধ্যে বিয়েতে রেজিষ্ট্রশন বাধ্যবাধকতামূলক না হলেও এক ধরণের 'কাজি অফিস' সমাজে সচল ছিল। বড় সম্পত্তি রক্ষার বিবেচনা থেকে বা যারা বিদেশে আনাগোনা থাকার প্রয়োজনে ম্যারেজ সার্টিফিকেট, সন্তান বা স্ত্রীকে বিদেশে নিয়ে যাওয়া, সম্পত্তি হস্তান্তর বিষয়ক জটিলতা নিরসন - ইত্যাদির চাহিদার কারণে সমাজের কিছু লোকের চাহিদা ঐ সব কাজী অফিসের মক্কেল (সেবা ক্রেতা) হবার জন্য তৈরী ছিল।

ফলে কাজী অফিসই সমাজে দূর্বল হলেও একমাত্র একটা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্হা হিসাবে বিরাজ করত। সরকার ঐ প্রতিষ্ঠানকে তার প্রশাসনিক কাঠামো ও লোকবল ব্যবস্হাপনার সমস্যা লাঘবের সহজ উপায় মনে করলো। কিন্তু এরপরেও একটা সমস্যা ছিল। সরকার কেমনভাবে ঐ রেজিষ্ট্রেশন নিয়ম চালু করতে চায় তা নিয়ে মটিভেশন, গাইড লাইন ও ট্রেনিং এর ব্যবস্হার একটা ব্যাপার ছিল। দাতাদের টাকায় সরকারের ঐ প্রজেক্ট বাস্তবায়নে এই অংশটা মহিলা আইনজীবী সমিতি সহ অন্যান্য নারী সংগঠনের সহযোগিতায় ও প্রভাবে সম্পন্ন হয়েছিল।

কাজীদের সংগঠিত করে কাজী সমিতি ঢেলে সাজানো হয় যাতে সরকারের ঐ প্রজেক্ট বিষয়ে আলাপ আলোচনায় রফা নিগোশিয়েট করার জন্য একদল প্রতিনিধি সামনে পায়। এর নীট ফলাফলে কাজী অফিস একটা স্বীকৃত ট্রেড হিসাবে আবির্ভূত হয়। এখানে লক্ষ্যণীয়, কাজী- মোয়াজ্জিন, মওলানা বা মাদ্রাসার শিক্ষক এসব সামাজিক পটভূমিতে যাদের সামাজিক বিকাশ ও ব্যাকগ্রাউন্ড - এদের নতুন রেজিষ্টসশন নিয়মে মটিভেট বা অভ্যস্ত করাবার ট্রেনার হলো সমাজের নারী সংগঠনের নেত্রীরা। আজকের সমাজে যেটাকে আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব মনে হতে পারে তাই ঘটানো সম্ভব হয়েছিল ওখানে। একদিকে মোয়াজ্জিন, মওলানা বা মাদ্রাসার শিক্ষক ব্যাকগ্রাউন্ডের কাজী অন্যদিকে নারী নেত্রী - সমাজের বিয়ে আইন সংস্কারে এই উভয় পক্ষের এনগেজমেন্ট, সংশ্লিষ্টতাএই উভয়ে ঐ সীমিত সংস্কারকে সম্ভব করে তুলেছিল।

তবে, কাজী পেশার একটা ট্রেড হিসাবে আবির্ভাব ঘটা, সরকারি অনুমোদন, লাইসেন্সিং ও এর নিয়ন্ত্রণ চালু ইত্যাদি মেটিরিয়াল ইনসেনটিভ এখানে একটা ভুমিকা রেখেছে অবশ্যই। যেমন আগে কারও বিয়ে করানোর দরকার হলে পাড়ার মসজিদের মোয়াজ্জিনকে ডেকে নিয়ে আসা এখন আর আইনের বিবেচনায় যথেষ্ট বলে মনে করার সুযোগ থাকলো না। ফলে বিয়ে রেজিষ্টেশন দরকার - সমাজের এই চাহিদা মেটাতে এক বিপুল সংখ্যক সেবা ক্রেতা, কাজীর দিক থেকে যা মক্কেল তাঁর দুয়ারে হাজির পাওয়া নিশ্চিত হয়েছিল এতে। এছাড়া, সরকার নির্ধারিত ফি এর হিসাবে এর অর্থকরী দিকটা কাজীদের কাছে উপেক্ষিত হবার কথা নয়। এরপরের আরও ঘটনা আছে।

কিন্তু আর যাবো না। ঘটনা বর্ণনা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি যেটা দেখাতে চেয়েছি তা হলো - ১। বিয়েটা কেবল ধর্মীয় ব্যাপার নয়, সামগ্রিক অর্থে এটা সামাজিক, যার ভিতরে আইনী দিকও আছে। ২।

বিয়ে বিষয়টা বিচার করতে বসা, মানে এটাকে কেবল একটা ধর্মীয় ঘটনা বলে সাব্যস্ত করে কোন ধর্মীয় বিয়েটা ভালো এনিয়ে শ্রেষ্ঠত্ত্বের আলোচনায় নয়। ৩। যাকে ধর্মীয় মতে বিয়ে বলে স্হির কিছু একটা বলে মনে হচ্ছে ওটা তা নয়, সবসময় সবকালে এর রূপের ভিতর বদল ঘটছে। সমাজের চাহিদা, প্রয়োজনের সাথে সাথে ওর ভিতরেও ধর্মীয়, আইনী বা সামাজিক রূপের মধ্যে বদল ঘটছে। স্হির বলে কোন কিছু নাই।

৪। আমার ধর্মের বিয়েটা সবচেয়ে ভালো একথা বলে আত্মপ্রসাদে তুষ্ট হয়ে বসে থাকা মানে চিন্তার একেবারে কাঁচা স্তরে বসবাস করা। এর চেয়ে বিয়ে তালাকের সাথে জড়িয়ে পেচিয়ে থাকা সামাজিক সমস্যাগুলোর দিকে নজর দেয়া, সমাধানের লক্ষ্যে চিন্তা ভাবনা করা মানে সামাজিক ন্যায়বিচারের লক্ষ্যে একধাপ আগানো, সম্ভবনা। ৫। সমাজের শাসন কাঠামো-ব্যবস্হার সাথে বিয়ের আইনকানুন সামাজিক রূপ কেমন হবে তার সম্পর্ক আছে, যতই তাকে বাইরে থেকে সেই পুরানো ধর্মীয় বিধির বিয়ে মনে হোক না কেন! ৬।

গঠনতান্ত্রিক (constitution) রাষ্ট্রে অর্থাৎ সমাজে নাগরিক রাষ্ট্র রূপ হাজির হওয়ার পর বিয়েকে যদি আইনের দিক থেকে দেখি তবে দেখবো তা ক্রমশ রাষ্টীয় মৌলিক আইন-কানুনের সাথে নিজেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে নেবার একটা সংস্কার প্রক্রিয়ার অন্তর্গত। এখন এ'সম্পর্কে সচেতনভাবে ভাবনা চিন্তা করে এই সংস্কারে গতি আনতে পারি। তবে চিন্তা ভাবনা না করে নকলবাজ হলে সমস্যা জটিল হবে। যে তথ্য যোগ করে লেখক "লোডশেডিং" এর প্যাচালি থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিলাম পারিনি সেটা উল্লেখ করে রচনায় ইতি টানবো। আমার স্মৃতি আমাকে প্রতারণা না করলে, সেটা ছিল '৮০ দশকের প্রথমার্ধে রুনা লায়লার প্রথম বিয়ের বিচ্ছেদ নিয়ে হাইকোর্টের মামলা।

মূল বিষয়টা স্মৃতি থেকে বয়ান করার চেষ্টা করছি। কাবিননামায় রুনা লায়লার তালাকের অধিকার উহ্য রেখে বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল। পরবর্তীতে তালাকের কারণের উদ্ভব ঘটলে রুনা লায়লা তালাক চাইলে ধর্মীয় বিধিতে অর্থাৎ কাজী অফিসের মাধ্যমে তা কার্যকর করতে সমস্যা দেখা দেয়। রুনা লায়লা হাইকোর্টের দারস্হ হন। কোর্ট রুনা লায়লার অধিকার বলবৎ আছে বলে রায় দেয়।

ঐ রায়ের পিছনের মূল যুক্তি ছিল, যেহেতু তালাকের কারণের উদ্ভব ঘটেছে এবং বাদী ক্ষতিগ্রস্হ হয়েছেন, যেহেতু ক্ষতিগ্রস্হ কোন নাগরিক নাগরিক অধিকার বলে সুবিচার চাওয়ার অধিকার রাখে ফলে কোর্টে এই আবেদন আমলে নিয়ে রুনা লায়লার পক্ষে রায় দিয়েছে। এথেকে ধর্মীয় বিয়ে ও নাগরিক আইনের সম্পর্ক যদি আমরা ধরতে পারি তবে অনেক দূর আগাতে পারবো।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.