আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঘুরোঘুরি ১: নোয়াখালী বিপর্যয়



আমার সবক'টা ঘুরাঘুরিই যে শেষমেশ কেন বিচিত্র রকমের একটা রূপ নেয় সেটা মাঝে মাঝেই ভাবি। সিলেট ঘুরতে গিয়ে ঝগড়া করে আলাদা হয়ে যাওয়া, হিমছড়িতে ঝামেলা, সেন্টমার্টিন্সে খাসি কেলেংকারি, আর এবারেরটা? মনে হয়, নোয়াখালি বিপর্যয় বলাই ঠিক হবে। সিনিয়র ইন্ঞ্জিনিয়ার যখন জানালেন যে নোয়াখালিতে সাইট দেখতে যাওয়া লাগবে,বিশেষ গা করলাম না,শুধু বাসায় জানালাম, নোয়াখালী যাচ্ছি। আব্বার জিজ্ঞাসা,নোয়াখালীর কোথায়? বললাম, নোয়াখালী টাউনেই হবে। আব্বা খানিক তাকিয়ে থেকে জানালেন, বাংলাদেশে নোয়াখালী বলে কোন শহর নেই,এটাই জানো না আর তুমি দেশ ঘুরবা? প্রতিবাদ করলাম না,ভূগোল বাবদে যে আমি উঁচুদরের মূর্খ সে প্রমাণ দু'দিন আগেই রেখেছি,পরীক্ষার খাতায় লিখে এসেছি মহাস্থানগড় তিস্তা নদীর পারে আর চলনবিল পাবনা সীমান্তে।

যা হোক,আমার সাথে আরেকজন ডিপ্লোমা ইন্ঞ্জিনিয়ার যাচ্ছে,ভাবলাম সে ব্যাটার উপর দিয়েই চালিয়ে দেব ঝামেলা। রওনা দেবার কথা দুপুর ১২টায়, সায়েদাবাদ থেকে। ১১টায় যখন ফোন করলাম,সে লোক জানালো,বাড়ি থেকে আসছে,ফেরি পার হবার জন্য অপেক্ষা করছে এখন। এরপর ১ ঘণ্টা পরপর ফোন,আসছি আসবো বলে আর খবর নেই। অবশেষে জানালো সে ঢাকায়,বাসা থেকে বের হয়ে যখন সায়েদাবাদ পৌঁছালাম তখন সন্ধ্যা ৬টা,রাস্তায় দাঁড়িয়ে দু'টো কলা আর পানি দিয়ে ইফতারি সারলাম,তখনো জানিনা যন্ত্রণার মাত্র এই শুরু।

জনাবের আমদানি হলো আরো ১ ঘণ্টা পর,আর এসেই অত্যন্ত বিনয়ের সাথে জানালেন তিনিও আগে সেখানে যাননি,ঠিক কোথায় যেতে হবে বা সাইট টা ঠিক কোথায় হতে পারে তার সঠিক ধারণা নেই। ব্যাটা বলে কি? ধাতস্থ হয়ে বললাম,সাইটের লোককে ফোন দেন। দিল,সে ছোকরা জানালো,আগে ফেনীর টিকেট করে মহীপাল নামেন,তারপরে দেখা যাবে। এ-মাথা ও-মাথা ঘুরে টিকেট করলাম,বাস ছাড়লো সাড়ে সাতটায়। পথটা নির্বিঘ্নেই গেল,শুধু অন্ধকারে আম্মার দেয়া খাবার খেতে গিয়ে বুঝলাম আপনারে চিনতে পারলে অচেনারে কেমনে চেনা যাবে,অন্ধকারে নিজের হাত আর মুখের সংযোগ ঘটানো যে এত ঝক্কি সেটা লালনজী ছাড়া আর কে ভেবেছিলেন! মহীপাল নামলাম,রাত তখন সাড়ে দশটা।

ভাবলাম,রাতটা এখানেই থাকি। আমার বরাবরই মনে হতো আমার চেহারায় সন্দেহজনক কিছু আছে,সেটাকে সত্যি প্রমাণ করতেই কিনা,২-৩টা বোর্ডিং ঘুরেও 'সিট নেই' বাণী শুনতে হলো। দূর থাকবোই না এখানে,একটা বাস ছাড়ছিল,কই যাবে,সোনাপুর,আচ্ছা উঠে পড়া গেল। বাস তো সোনামুখ করে আমাদের রাত ১২টায় সোনাপুর নামিয়ে দিল,এখন সেখানে থেকে যেখানে সাইট সেই কবিরহাট কিভাবে যাই? সাথের জন জানালেন,না খেয়ে তিনি এখন স্বর্গেও যাবেন না। ভাল,হোটেলে ঢুকে নবাবী চালে ডিম-পরোটা অর্ডার দিলাম,সেখানেও ঝামেলা,ডিম নেই।

সঙ্গী করুণ মুখ করে বললেন, এইটা একটা জায়গা হইলো যেইখানে ডিমই ভাজে না? দৃষ্টি দিয়ে ভস্ম করে দেয়ার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করলাম,শ্যালক তোমার কারণে রাতটা রেলস্টেশনে কাটাতে হয় কিনা ঠিক নেই আর তুমি কিনা ডিম ভাজার শোকে কাতর! কোনমতে সব্জি আর দারুণ লবনাক্ত পানি দিয়ে রাতের খাওয়াটা শেষ করলাম। এবার আশ্রয় খোঁজার পালা। সঙ্গী ভদ্রলোক বললেন,আসার পথে নাকি হোটেল দেখেছে। আমি ঠিক সেরকম কিছু মনে করতে পারলাম না কিন্তু করবোই বা কি,ভরসা করে হাঁটা দিলাম পেছন পানে। একটু পরেই যখন বাজারের আলো কমে গিয়ে পুরোপুরি অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হাঁটা শুরু হলো তখন পুরোই নিশ্চিত হলাম এই লোক যা বলবে তার উল্টোটা করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

বাসস্ট্যান্ডটা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি,শুনি কে যেন ডাক দিচ্ছে ও ভাই ঐদিক যাইয়ন ন ধরবোয়নে। তাকিয়ে দেখি, যা বাসে এসেছি সেটার হেলপার। বলে আহহারে মেওমান মানুষ,আইয়ন বোর্ডিং দেহাই দি। সঙ্গী আবারো মিনমিন করে বলার চেষ্টা করছিল ওদিকে হোটেল আছে,পাত্তা দিলাম না,দেয়ার সময়ও না,রাত বাজে ১টা। বাসওয়ালা দেখি আবার বাজারের দিকে হাঁটা দিল,স্বস্তি পেলাম।

হেলপার এসে বোর্ডিং নামের যে লম্বা টিনের বাড়িটার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল,সেটা দেখে আমার সাথী বলে উঠলেন,এইটা দেখি "চিৎ-কাইত" বোর্ডিং! মানে কী?? মানে হলো,কোনমতে চিৎ হয়ে শোয়া যায় আর কাইত হয়ে বসা যায়। লম্বা ঘরটাতে পার্টিশন ওয়াল দিয়ে কয়েকটা ভাগে ভাগ করা হয়েছে,উপরে পাটির চালা, ৭ ফিট বাই ৬ ফিট রুমে (মেপে দেখেছি) দু'টো শিশুদের বিছানা পাতা, সোজা দরজা থেকে উঠতে হয়। ঢোকার সময় দেখি আমাদের সাথে একটা মোটাসোটা ব্যাংও লাফাতে লাফাতে ঢুকে গেল,বাধা দিলাম না, থাকুক, রাতটা ঠোলাদের হাতে নয়তো স্টেশনে কাটাতে হবে না আমি তাতেই খুশি। মশারি টানিয়ে শুয়ে তো পড়লাম,ঘুম আসে না,চরম গরম। সেহরি পর্যন্ত ঘুমানো গেল না, একে তো গরম, আবার বোর্ডিংয়ের চাচা মিয়া খুবি কর্তব্যপরায়ন, সেহেরির সময় ডাকতে বলা হয়েছিল, তিনি ৩টা বাজতেই দুমদাম ধাক্কা দিয়ে তন্দ্রারও ১২টা বাজিয়ে দিলেন।

শেষমেশ মশারি উঠিয়ে ফেললাম,আর উঠাতেই দেখি তোষকের নিচে থেকে বিশাল গোবদা কালো এক পোকা বের হচ্ছে,সাইজে ২টা তেলাপোকার চেয়ে বড় বৈ ছোট না। লাফিয়ে উঠে স্যান্ডলের বাড়ি দিয়ে ফেললাম বিছানা থেকে, সাথের জন জানালেন,গুবরে পোকা। কামড়ায়? জানি না। এরপরে ঘুম আসা কঠিন,কোনমতে সকালের জন্য অপেক্ষা। সকাল হতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম,উঠে রওনা দিলাম গন্তব্যের দিকে।

সেটাও খুব সহজে গিয়েছিলাম তা না,কোথায় নামবো বলতে না পারায় ৩ রাস্তার মোড় ছেড়ে ১ মাইল দূরের আরেক মোড়ে নিয়ে ফেললো সিএনজিওয়ালা, সেখান থেকে টেম্পুর পাদানীতে ঝুলে সাইটে পৌঁছালাম। সারাদিন কঠিন খাটুনি এরপর,শেষে বিকালবেলা বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরা। এবার আর ঝামেলা হলো না,সোজা এক বাস ধরে মহীপাল,সেখান থেকে শেয়ারের মাইক্রোবাসে ঢাকা। পথে ঘটনা বলতে শুধু জাতিসংঘের মার্কামারা একটা দাঁতাল (অ্যান্টেনা মনে হয় রেডিওর,আমার কাছে লাগে গণ্ডারের দাঁতের মত) জিপের সাথে বারবার আগুপিছু পাল্লা,গতির যে একটা নেশা আছে সেটা তখন টের পেলাম,কিছুতেই অন্যকে এগিয়ে যেতে দেয়া যাবে না,হোক সেটা জীবনের বিনিময়ে,নিজে মরে,নয়তো অন্য কাউকে মেরে। এই এগিয়ে থাকার নেশা থেকেই কি আমরা মানুষরা নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছি না? [পুনশ্চ: মানুষ দেখি খালি দেশ-বিদেশ ঘুরে আর তা নিয়া রংচঙওয়ালা ব্লগ লিখে,আমার হাত,বা বলা ভালো,পা এত লম্বা না,তাতে কি,ভাবছি দেশেই কয়েকটা আউলা ঘুরান দিয়েছিলাম সেগুলো এখানে তুলে রাখবো।

আর হ্যাঁ,আমার সঙ্গী ভদ্রলোক আমার সাথে ঢাকা ফেরেননি,তাকে সেখান থেকেই কোন এক চর এ পাঠানো হয়েছিল,কে জানে তিনি সেখানেও রাস্তা হাতড়ে বেড়াচ্ছেন কিনা,খোঁজ নিতে হবে]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।