আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

২০০৪ সালের ২১শে অগাষ্টে, এই আমি

বাংলাদেশ ব্লগারস এসোসিয়েশন সদস্য নং: ১০ । facebook.com/milton3d

তখন অফিস ছিল মতিঝিলে। সকালে বাসা থেকে বের হতাম প্রায় সাড়ে সাতটা থেকে পৌনে আটটার মধ্যে। আমাদের এলাকা থেকে ডাইরেক্ট বাস ছিল। দৈনিক বাংলা মোড়ে নেমে যেতাম।

ওখান থেকে একটু হেঁটেই অফিসে যাওয়া যেত। আর অন্য সকালের মত সেই সকালটিও একই রকম ছিল। তবে যতদুর মনে পড়ে মনে হয় দিনটা একটু বৃষ্টিস্নাত ছিল। আমাদের অফিস থেকে আড়াআড়ি ষ্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ বেশী দুরে না। পায়ে হাঁটা পথ।

আগেই জানতাম সেদিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এর আওয়ামীলীগের সমাবেশ ছিল। আমরা লাঞ্চ করতাম প্রায়ই অফিসের বাহিরে হোটেলে। দুই একসময় যেতাম ষ্টেডিয়ামের কাছে, ওখানে একটা ছোট তেহেরীর দোকান ছিল। লাঞ্চ টাইমে দেখতাম অনেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্লেট হাতে নিয়ে তেহেরী খেতো। আমরাও মাঝে মাঝে দল বেঁধে যেতাম।

খুব ভালো তেহেরী হতো ঐ হোটেলটায়। কি মনে হলো, সেদিন আরেক কলিগকে সাথে নিয়ে রওনা দিলাম ওখানে। খেয়ে ফিরে আসছিলাম। দেখলাম দলে দলে লোক যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এর দিকে মিছিল নিয়ে। প্রচুর লোক সমাগম হয়েছে।

দেখলাম অনেক পুলিশ আর পুলিশের গাড়ী। আমাদের অফিসটি ছিল তিনতলায়। ঐ বিল্ডিং এর নীচে অনেক দোকান পাট ছিল। মূলতঃ ষ্টেশনারী আইটেমের দোকান ছিল ওগুলো। হঠাৎ বিকেল বেলা শুনি নীচের দোকানগুলো শার্টার বন্ধ করার শব্দ কিন্তু সেটা কেন যেন অস্বাভাবিক লাগলো।

একটু নীচে খেয়াল করে দেখলাম। সবাই দৌড়াদৌড়ি করছে। কে কোন দিকে দৌড়াচ্ছে যে কেউ বলতে পারছে না। কি জন্য দৌড়াচ্ছে তাও কেউ জানেনা। নীচে নেমে গেলাম।

গিয়ে দেখি দারোয়ান কোলাপসিবল গেট বন্ধ করে দিয়েছে। সে বলল, "বোম ফুটছে”। " কিন্তু কোথায়, কিভাবে কিছুই বুঝতে পারলাম না। মুহুর্তে রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেল। একবার শুনলাম, শেখ হাসিনা মারা গেছেন।

আমাদের সাথের এক কলিগ আওয়ামীলীগের ঘোরতর সমর্থক হওয়ায় সে একেবারে চিৎকার করে উঠলো। আমরা বিভিন্ন জায়গায় ফোন করছি কি হয়েছে জানার জন্য। কিন্তু কোথাও ফোন যাচ্ছিল না। পুরো ঐ এলাকাতে নেটওয়ার্ক সম্ভবতঃ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। আমরা ততক্ষণে শুনেছি যে, শেখ হাসিনার মিটিং এ বোমা হামলা হয়েছে।

বিডিনিউজ২৪ চেক করার চেষ্টা করছি কিন্তু কানেকশন পাচ্ছি না। সম্ভবতঃ অনেকে একসাথে লগইন করার জন্য এমনটা হয়েছিল। যাইহোক, বেশ দুঃচিন্তায় ছিলাম, পুরোপুরি সঠিক খবর জানতে পারছিলাম না। আর আমরা অবরুদ্ধ হয়ে ছিলাম অফিসে। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা হয়ে এলো।

আমরা অফিস থেকে বের হলাম। চারিদিকে ফাঁকা। হঠাৎ দুই একটি লোক দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। মেইন রোডের দিকে এগিয়ে গেলাম। শুধু পুলিশের গাড়ী আর এম্বুলেন্স রাস্তায়।

রক্তার্ত একটি লাশ দেখলাম ভ্যানে করে নিয়ে যাচ্ছে। বুঝলাম, বড় কোন দুর্ঘটনা হয়েছে। কিন্তু এত কাছে থেকেও সত্য খবরটা পাচ্ছিলাম না। ফিরে এলাম অফিসে। যে করেই হোক এখন বাসায় ফিরতে হবে।

কিন্তু বস বার বার বলছিলেন, কোনকিছু না জেনেই আগে রওনা দেওয়া ঠিক হবে না। সবার সাথে আইডি কার্ড নিতে বললেন তিনি। আর কখনও যেন কাউকে না ছাড়ি, সবসময় একসাথে যেন থাকি। কারণ চারিদিকে গুমোট পরিস্থিতি। ল্যান্ড ফোন থেকে বাসায় ফোন করলাম, জানলাম আসল ঘটনা।

টিভিতে ট্রেলারে দেখাচ্ছে "বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে শেখ হাসিনার মিটিং গ্রেনেড হামলা হয়েছে। অনেক হতাহত হয়েছে। আহতদের হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। " আমরা সাহস করে বের হলাম কারণ কিছুক্ষণ পরেই রাত হয়ে যাবে। আমরা কয়েকজন।

রাস্তায় কোন গাড়ী নেই। তাই হেঁটেই বাসায় যেতে হবে। মতিঝিলের ভিতরের চিপা গলি দিয়ে আমরা রওনা দিলাম। এভাবে আমরা হাঁটতে হাঁটতে রমনার কাছে এসে তার পাশ দিয়ে শেরাটনের সামনে দিয়ে বাংলা মোটরের দিকে হাঁটা ধরলাম। দুইতিনজন লোক একসাথে হাটছে কিন্তু জোড়ে জোড়ে।

দেখলাম একটা পুলিশের গাড়ি থেকে মাইকে বলছে, "সবাই চলে যান, কেউ দাঁড়াবেন না। " এরমধ্যে আমাদের এক কলিগের নীচপেটে ব্যথা উঠলো। তার সম্ভবতঃ একটা টিউমার ছিল। হাঁটতে পারছিল না সে। ওহ! সেকি কষ্ট।

তার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। ব্যথায় কুঁকড়ে আসছিল তার শরীর। যে করেই হোক তাড়াতাড়ি এলাকা ছাড়তে হবে। তাকে কোলে নিয়েও হাঁটা সম্ভব না। সে হাঁটতেও পারছে না।

আবার ঐ এলাকা দ্রুত পার হতে হবে। কোথাও কোন রিক্সা, ভ্যান কিছু নেই। পুরো এলাকাটা একটা ভুতুড়ে এলাকা হয়ে গিয়েছে। কি যে কষ্ট করে ঐ কলিগকে নিয়ে ফার্মগেটে পৌঁছালাম তা মনে পড়লে এখনও শিউরে উঠি। ফার্মগেটে লোকে লোকারণ্য।

কিন্তু কোন গাড়ী নেই। মানুষের চেহারায় ভয়ের ছাপ। কারণ শুনলাম ধরপাকড় নাকি শুরু হয়ে গেছে। পুলিশ যাকে পাচ্ছে সন্দেহ হলেই গাড়ীতে তুলে নিচ্ছে। অসুস্থ কলিগটাকে ব্রিজের (কারওয়ানবাজার থেকে ফার্মগেটের দিকে প্রথম) নীচে বসিয়ে রাখলাম।

ওকে নিয়ে তো বাসেও ওঠা যাবে না। কারণ যে দুই একটা বাস আসছে তাতে মানুষ এমন ভাবে আক্রমন করছে যে বাসের চেহারাই দেখা যাচ্ছে না। এদিকে রাতও হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি বাসায় যাওয়া দরকার। কিন্তু কোন উপায় নাই।

আমাদের জন্য কোন চিন্তা করছিলাম না কারণ এতদুর যখন হেঁটে আসতে পেরেছি আরো দশ কিলোমিটার হাঁটতে পারবো কোন সমস্যা নাই। কিন্তু ঐ কলিগকে রেখে কিভাবে যাই? হঠাৎ মসজিদের গলির ভিতরে একটা বাসের ষ্টার্ট দেয়ার শব্দ পেলাম। দৌড়ে গেলাম বাসের কাছে। বাসের লোকেরা ওটা ছাড়ার সাহস পাচ্ছে না। ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলাম, বললাম, একজন অসুস্থ মানুষ আছে কিন্তু মানুষের ভীড়ে ওকে নিয়ে বাসে উঠতে পারছিনা।

সে রাজী হলো, আমরা ওকে কোলে নিয়ে বাসে গিয়ে উঠলাম। তারপর বাসটা বের হয়ে আসলো রাস্তায়। কত লোক যে ওটাতে উঠলো তার ইয়ত্তা নেই। কেউ কোন কথা বলছে না। বাসের একজনের মোবাইলে খবর এলো শেখ হাসিনার অবস্থা আশংকাজনক।

অনেক লোক মারা গেছে। আর আহত হয়েছে কয়েকশ। এভাবে একসময় বাসার কাছে গিয়ে পৌঁছালাম। ঐ কলিগের বাসায় পৌছানোর ব্যাবস্থা করে আমি রওনা দিলাম বাসার দিকে। বাসায় পৌঁছালাম তখন প্রায় সাড়ে দশটা বাজে।

মাথাটা কেমন ঘুরছিল। কিছুই মনে করতে পারছিলাম না। হাতমুখ ধুয়ে খবর দেখতে বসলাম। ওহ! সেকি বিভৎস সব দৃশ্য। এই গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন মারা গিয়েছিল আর প্রায় ৪০০ লোক আহত হয়েছে।

এখন অনেক লোক পুঙ্গ হয়ে আছে। এমন ঘটনা এই দেশে আর ঘটেনি। ঐ দুর্ঘটনার দুঃসহ সব সৃত্মিচিহ্ন বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে অনেকে। তাদের একজন সয়ং শেখ হাসিনা। তার একটা কান আর চোখ প্রায় নষ্টের পথে এখন।

এই ঘটনার নিন্দা জানানোর কোন ভাষা নেই। যুগে যুগে ওরা জিতে যায়। ওরা মানবতাকে ধ্বংশ করে। ওদের কোন বিচার হয় না। সন্ত্রাসীর কোন দল নেই।

আমি চাই রাজনীতি হোক সত্য, সুন্দর, সাবলীল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.