আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আসুন সাম্প্রদায়িকতার মূল খুঁজি

পথে থাকি, পথেই ঘুমাই, পথেই কাটে সারাবেলা পথভোলারা পথ পুছিলে নেই না কোন অবহেলা ৩য় পর্ব : এ পর্বে আমরা সাম্প্রদায়িতার শেষ সম্ভাব্য অর্থগুলো উল্লেখ করে একটি সারাংশে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করব- +সাম্প্রদায়িকতার তৃতীয় অর্থ : নিজ ধর্মকেই একমাত্র মুক্তির পথ বলে ভাবা। হ্যাঁ, সাম্প্রদায়িকতার এমনও একটি অর্থ টানার চেষ্টা করা হয়। নিজ ধর্মটাকেই ইহলৌকিক, বিশেষত পারলৌকিক একমাত্র মুক্তির পথ বললে অনেকেই এতে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ পান। এক অযৌক্তিক অস্থিরতায় অস্থির হয়ে ওঠেন। বিষয়টা যেমন অযৌক্তিক তেমিন অনেকটা হাস্যকরও বটে।

নিজ ধর্ম বা মতাদর্শের উপর আস্থা সংকটের কারণেই এমনটা হয়ে থাকে। তা না-হলে আমার ধর্মটা যদি সত্য হয় তাহলে সে ধর্মের পক্ষ থেকে স্বর্গ-প্রাপ্তির আশ্বাসই আমার জন্য যথেষ্ট। অন্য ধর্ম আমাকে স্বর্গ-না-নরক দিল তাতে আমার কিছু আসে যায় না। তাহলে সব ধর্ম থেকেই স্বর্গপ্রাপ্তির আশ্বাস পেতে অযৌক্তিক এই চেষ্টা কেন? হ্যাঁ, আমার ধর্ম গ্রহণ না করার কারণে, কেউ নরকে যাবে বলে মনে হলে, তার জন্য দুনিয়াতেই আমার পক্ষ থেকে আমি নরক তৈরি করতে পারি না। এমন কোন আচরণও আমার জন্য সঙ্গত নয়।

এটা সাম্প্রদায়িকতা। নরক দান স্রষ্টার কাজ। মৃত্যুর পর স্রষ্টাই যার ব্যবস্থা নিবেন। এ কারণে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হল- প্রতিটি অমুসলমানও তার মানবিক প্রাপ্যগুলো মুসলমানদের থেকেও পাওয়ার অধিকার রাখে, এবং সে অধিকার পূরণের নির্দেশ ইসলাম মুসলমানদেরকে দেয়। তাছাড়া ইসলামের কাছে একজন অমুসলমানের মৃত্যু পর্যন্ত ঈমান আনার সম্ভাব্যতাও সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

সবধর্ম থেকে স্বর্গলাভের আশ্বাস পাওয়ার চেষ্টা যেমন অযৌক্তিক, অদ্ভুত; এরচে’ আরও অদ্ভুত হল, সব ধর্মকে এক সঙ্গে মিলিয়ে একীভূত করে নতুন আরেকটি ধর্ম চালু করার চেষ্টা করা। বড় অদ্ভুত ও অযৌক্তিক বলেই এমন প্রচেষ্টা একাধিকবার হলেও, কখনোই তা খুব একটা পানি পায়নি। অনেকে এটাকে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বলে চালানোর চেষ্টা করেন। ফলে ভিন্ন মতাবলম্বীদের সাম্প্রদায়িক বানাতে গিয়ে নিজেরাই সাম্প্রদায়িক আচরণ শুরু করে দেন। এই কাজটা সর্বপ্রথম বাদশাহ আকবর ব্যাপকভাবে করতে চেয়েছেন।

এর পেছনে যতটা-না-ছিল মানবিকতা, তারচে বেশি ছিল অজ্ঞতা, আর যতটা-না-ছিল অজ্ঞতা, তারচে বেশি ছিল রাজনৈতিক চাল। এরপর অনেক ভাববাদীরাই ভাবোন্দলন ইত্যাদি নামে কাজটি করার চেষ্টা করেন। সর্বশেষের ‘লালন-হাছন’ এ ধারারই অন্তর্ভুক্ত। দেশের বাম ও নাস্তিকরা এ চিন্তাটিকে বড় সমাদর করে, আর এর বিরোধিতাকে মনে করে সাম্প্রদায়িকতা। এই চিন্তাধারাটির পেছনেও কার্যকর নিজ ধর্মের প্রতি আস্থাহীনতা।

তাই ধর্মহীন নাস্তিক-কমিউনিস্টদের নিকট বাদশাহ আকবরের এত কদর। লালন-হাছনের এত সমাদর। হ্যাঁ, কিছু কিছু ধর্মের উপর আস্থা রাখা বড়ই কঠিন। তাই শিক্ষিত হিন্দুরাও এ চিন্তাটিকে গ্রহণ করে এবং হিন্দু সাধু স্বামী বিবেকানন্দ এ চিন্তাটিকেই আরেকটু অগ্রসর করে বলেন- ‘সকল ধর্মই সত্য, একই সাগরে গিয়ে মিলিত হওয়ার একাধিক নদীপথ। ’ এ অর্থেই হয়তো নোবেলজয়ী অর্থনীতিবীদ অমর্ত্য সেন কিছুদিন আগে বলেছিলেন- ‘হিন্দুধর্ম অসাম্প্রদায়িকতার ধর্ম।

অসা¤প্রদায়িক তথা ধর্ম নিরপেক্ষ হতে হলে মুসলমানদেরকেও হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করা উচিৎ!’ আমাদের দেশে সংস্কৃতির নামে কিংবা বাঙালির নিত্য নতুন ঐতিহ্যের নামে নানা ধর্মের নানা কিছু নিয়ে উৎসব-আয়োজন যা কিছুই হয়, সবই রাম-বাম আর ধর্মহীনদের এ ধারারই অসাম্প্রদায়িক হওয়ার নানামাত্রিক চেষ্টা মাত্র। এ কারণেই তাদের এসবে কোন বিরোধিতা দেখলে তারা সরাসরি ‘সাম্প্রদায়িক’ ‘গোঁড়া’ ‘ধর্মান্ধ’ ইত্যাদি শব্দগুলো বলে দেয়। বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশের নামে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার যে তোড়জোড়, সেটা এ অর্থেই চলে। এ জন্যই দেশের আলেম সমাজ এর বিরোধিতা করেন। বলেন- ‘ধর্ম বিসর্জন কিংবা নিজ ধর্মকে পর ধর্মের সাথে গুলিয়ে ফেলার যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ তা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়’।

দেশের প্রধানমন্ত্রী অসাম্প্রদায়িকতার তৃতীয় এই অর্থটি চালু করার প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয় অর্থটি টেনে তাঁদের বুঝ দেন-‘ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা নয়। বরং প্রত্যেককে আপন আপন ধর্ম নিরাপদে পালনের সুযোগ দেওয়া। ’ আসল কথা হল- নিজ ধর্মের উপর আস্থাশীল থাকা, নিজ ধর্মকেই একমাত্র সত্য মনে করা সাম্প্রদায়িকতা নয়। বরং সাম্প্রদায়িকতা হল সেই ‘সত্য মনে করাটাকে অপরের কাঁধে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া। কিংবা সম্প্রদায়গত অন্ধত্বের শিকার হয়ে মনুষ্যত্ব ও মানবতার সীমা লঙ্ঘন করা।

এ সূত্রে অসাম্প্রদায়িকতার নামে ‘সকল ধর্মই সত্য’ নিজেদের এই ‘সত্য মনে করা’টাকে অপরের ঘাড়ে চাপানোর জন্য রাম-বামদের অতিমাত্রায় বাড়াবাড়িটাই উল্টো সাম্প্রদায়িকতার পরিণত হয়। +যে কারণে বে-শরা পীর-ফকির বিশেষকরে কাদিয়ানীদের মুসলমানরা গ্রহণ করতে পারে না। পূর্বেই বলেছি পরমত-সহিষ্ণু হওয়াই মুসলমানদের ধর্ম। যে কারণে মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রে যে কোন ধর্মের লোক নিজ নিজ ধর্ম পালনের অবাধ সুযোগ লাভ করে। তথাপি কেন কাদিয়ানী বা বে-শরা পীর ফকিরদের মুসলমানরা গ্রহণ করতে চায় না? নিশ্চয় এখানে ভীন্ন একটি কারণও বর্তমান।

ধরুন- আপনি নির্দিষ্ট একটি নামে একটি পণ্য বাজারজাত করেছেন। সারাদেশে এর বিপুল কাটতি এবং এ নামেই আপনার পণ্যের বিশ্বব্যাপী সুনাম ও পরিচিতি। তখন কেউ যদি আপনার পণ্যের নাম ও লোগো ব্যবহার করে তার থেকে আরেকটি পণ্য বাজারজাত শুরু করে তাহলে আপনি কি বলবেন- এটা তার ব্যবসায়িক স্বাধীনতা? দেশীয় ও আন্তর্জাতিক যেকোন আইনেই এটি কি অপরাধ নয়? আসুন আরেকটি উদাহরণে- আপনি দেশের শীর্ষ সারির একজন ব্যক্তি। আপনি ‘একটি কথা’ বলেননি। যে কথার সাথে আপনার কিংবা দেশের বিশালাকারের লাভ-ক্ষতি সম্পৃক্ত।

এমন একটি কথা অন্য কেউ আপনার নামে চালিয়ে দিল। আপনি কি বলবেন, এটা তার বাক স্বাধীনতা? এটা তার মৌলিক বা মানবিক কোন অধিকার? কাদিয়ানী বা বে-শরা পীর-ফকিরদের ব্যাপারটাও মুসলমানদের নিকট এরকম। তারা যদি ভীন্ন লেভেলে, ভিন্ন নামে তাদের মতাদর্শ প্রচার করত তাহলে হয়তো মুসলমানদের এতটা উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ ছিল না। কিন্তু তারা তাদের কাজ পুরোটাই করে ইসলামের লেভেলে। এতে বিভ্রান্ত হয় ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ।

পণ্য নকলের বিষয়টি সকলেরই জানা থাকলে যেমন ক্ষতি হয় না তেমনি মুসলমানরা সকলেই আলেম হলে কিংবা ইসলাম সম্পর্কে পর্যাপ্ত জানাশোনা রাখলেও এখানে ক্ষতির কিছু ছিল না। কিন্তু কোন একটি বিষয়ে সকলেরই ভাল জানাশোনা থাকা তো কঠিন বিষয়। তথাপি মুসলমানরা দাঙ্গা-হাঙ্গামা নয়; চায় একটি সমাধান। কাদিয়ানীরা তাদের মতাদর্শের যৌক্তিকতা প্রমাণ করুক। (অর্থাৎ খতমে নবুওয়াতের ব্যাপারে কোন সন্দেহ সৃষ্টি করেও যে ‘মুসলমান’ থাকা যায় তা তারা প্রমাণ করুক) আর বে-শরা পীর-ফকিররা কুরআন-হাদীসে আছে বলে যেসব কথা বলে বেড়ায়, তা তারা কুরআন হাদীসে দেখাক।

শেষকথা- এক. মানুষে মানুষে মতভীন্নতা থাকবেই। মতভীন্নতা আছে বলেই এ দুনিয়া ‘বৈচিত্র্যময়’। সেই ভীন্নতার কারণে ‘নানা দল ও সম্প্রদায়ে’ নানা বিভক্তিও আসতে পারে। সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়া অন্যায় নয়; অন্যায় ‘সাম্প্রদায়িকতা’। যে সাম্প্রদায়িকতা ভিন্ন মতাদর্শীদের।

নিষ্ঠুর প্রক্রিয়ায় দমনে উৎসাহ যোগায়। মানুষ ও মানবতার নির্মম দলনে কখনো কুণ্ঠিত করে না। দুই. ধর্মনিরপেক্ষতা নামে কথিত যে মতাদর্শ অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় সেটা ধর্ম নিরপেক্ষতা নয় বরং সেটিও একটি ধর্ম। এ ধর্মের রূপ- কখনো হয় ধর্মহীনতা, কখনো হয় ধর্ম-বিকৃতি, আবার কখনো হয় নিজ ধর্মকে পরধর্মের সাথে গুলিয়ে ফেলা। এ ধর্ম না-মানলে প্রতিপক্ষের উপর সাম্প্রদায়িকতার যে লেভেল এঁটে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, সেটা ‘সাম্প্রদায়িক’ শব্দটির ভুল প্রয়োগের পথ ধরেই।

শব্দটিকে যথার্থরূপে প্রয়োগ করে নয়। তিন. সাম্প্রদায়িকতা যেমন অন্যায়, তারচে’ বড় অন্যায় সাম্প্রদায়িক শব্দটির ভুল ব্যবহার। কারণ, তখন তা আরো জঘন্য রূপ পরিগ্রহ করে। তখন মানুষের সামনে আর কোন বাধা-নিষেধই থাকে না। কেননা পিঠে তখন সাম্প্রদায়িকতা নির্মূলের মত এক মানবিক কর্মের মহৎ লেভেল।

এজন্যে আমাদের উচিৎ যেমন সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় না-দেওয়া, তেমনি সাম্প্রদায়িকতা নির্মূলের নামে তারচে’ বড় সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির সুযোগও কাউকে না দেওয়া। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.