আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক, জ্যোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই



[যারা কবিতা ভালোবাসেন, এই পোস্টটি তাদের প্রতি উৎসর্গ করা হলো। ] কোনো কোনো কবি তাঁর জীবনকালেই মিথিক্যাল চরিত্র হয়ে ওঠেন। যেমন নির্মলেন্দু গুণ বা আবুল হাসান। আমাদের তারুণ্যের সময়ে তেমনি রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ হয়ে উঠেছিলেন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে প্রথম সারিতে থেকে, অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করে, তসলিমা নাসরীনের সঙ্গে প্রেম, বিয়ে, স্বল্পকালীন সংসার করে এবং সংসার ভেঙে তিনি হয়ে উঠেছিলেন তরুণদের নিত্য আলোচনার বিষয়বস্তু।

তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় হয়ে ওঠেনি কখনো। তখন যেচে পড়ে পরিচিত হওয়ার সাহসও ছিলো না। আমি তখন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি, আর তিনি বিখ্যাত কবি। কিন্তু কাছ থেকে অনেকবার দেখেছি তাঁকে, কথা শুনেছি। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে, একবার কেউ একজন-- 'কেমন আছেন, রুদ্রদা'-- জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন-- 'জীবন প্রতিশোধ নিচ্ছে! 'জীবন প্রতিশোধ নিচ্ছে!!' খুব মনে পড়ে তাঁর ওই কথাগুলো।

তিনি তখন বেশ অসুস্থ, হয়তো অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের দিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন ওই কথাগুলো দিয়ে। তো ওই সময় দ্রোহে ও প্রেমে বারবার তিনি উচ্চারিত হতেন। মনে পড়ে, এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের সময় তাঁর একটি কবিতার কথা-- রোদ্দুরে শুকিয়ে যাবে। আর যদি বৃষ্টি নামে অঘ্রানের পড়ন্ত বেলায় ধুয়ে যাবে রক্তের দাগ, বুলেটে ছিটকে পড়া হলুদ মগজ... পুরোটা উদ্ধৃত করলাম না, শুধু এটুকু বলি-- 'এক্সরে রিপোর্ট' শিরোনামের কবিতাটির ছত্রে ছত্রে ছিলো আপোসকামীতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ। তাঁর 'মানুষের মানচিত্র' সিরিজও দারুণ নাড়া দিয়েছিলো পাঠককে।

একেক সময় মনে হতো-- কেবল দ্রোহের জন্যই তাঁর জন্ম হয়েছে। কিন্তু তাঁর মধ্যে যে গভীর বেদনাবোধ ছিলো, ছিলো অসামান্য রোমান্টিকতা, তার প্রমাণ পেতেও দেরি হয়নি আমাদের। তরুণদের মুখে মুখে ফেরা তাঁর অভিমানের খেয়া কবিতাটির কথা এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে। পুরোটা তুলে দিচ্ছি। 'এতোদিন কিছু একা থেকে শুধু খেলেছি একাই পরাজিত প্রেম তনুর তিমিরে হেনেছে আঘাত পারিজাতহীন কঠিন পাথরে প্রাপ্য পাইনি করাল দুপুরে, নির্মম ক্লেদে মাথা রেখে রাত কেটেছে প্রহর বেলা_ এই খেলা আর কতোকাল আর কতোটা জীবন! কিছুটা তো চাই- হোক ভুল হোক মিথ্যে প্রবোধ, অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক, জ্যোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই কিছুটা তো চাই, কিছুটা তো চাই।

আরো কিছুদিন, আরো কিছুদিন-- আর কতোদিন? ভাষাহীন তরু বিশ্বাসী ছায়া কতোটা বিলাবে? কতো আর এই রক্ততিলকে তপ্ত প্রণাম! জীবনের কাছে জন্ম কি তবে প্রতারণাময়? এতো ক্ষয়, এতো ভুল জমে ওঠে বুকের বুননে, এই আঁখি জানে, পাখিরাও জানে, কতোটা ক্ষরণ কতোটা দ্বিধায় সন্ত্রাসে ফুল ফোটে না শাখায় তুমি জানো নাই-- আমি তো জানি কতোটা গ্লানিতে এতো কথা নিয়ে, এতো গান, এতো হাসি নিয়ে বুকে নিশ্চুপ হয়ে থাকি বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে বলি এই তো জীবন, এইতো মাধুরী, এই তো অধর ছুঁয়েছে সুখের সুতনু সুনীল রাত। তুমি জানো নাই-- আমি তো জানি মাটি খুঁড়ে কারা শষ্য তুলেছে, মাংসের ঘরে আগুন পুষেছে যারা কোনোদিন আকাশ চায়নি নীলিমা চেয়েছে শুধু, করতলে তারা ধরে আছে আজ বিশ্বাসী হাতিয়ার পরাজয় এসে কণ্ঠ ছুঁয়েছে লেলিহান শিখা, চিতার চাবুক মর্মে হেনেছো মোহন ঘাতক তবুও তো পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে মুখর হৃদয়, পুষ্পের প্রতি প্রসারিত এই তীব্র শোভন বাহু। বৈশাখী মেঘ ঢেকেছে আকাশ পালকের পাখি নীড়ে ফিরে যায়-- ভাষাহীন এই নির্বাক চোখ চোখ আর কতোদিন? নীল অভিমানে পুড়ে একা আর কতোটা জীবন? কতোটা জীবন?' 'কিছুটা তো চাই-- হোক ভুল হোক মিথ্যে প্রবোধ, অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক, জ্যোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই কিছুটা তো চাই, কিছুটা তো চাই... ' (অভিমানের খেয়া/ রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ) ওই সময়ে খুব কম তরুণই ছিলো, যারা এই কবিতাটি পড়েনি। বিশেষ করে-- কিছুটা তো চাই-- হোক ভুল হোক মিথ্যে প্রবোধ, অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক, জ্যোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই লাইন দুটো তো নিত্য সহচরই হয়ে উঠেছিলো আমাদের। না পাওয়ার বেদনা, প্রেমহীনতা, নিঃসঙ্গতা, আর হাহাকারের এমন নিপুণ চিত্র কজনই বা আঁকতে পারেন? আর এই লাইনগুলো?-- 'তুমি জানো নাই-- আমি তো জানি কতোটা গ্লানিতে এতো কথা নিয়ে, এতো গান, এতো হাসি নিয়ে বুকে নিশ্চুপ হয়ে থাকি' মনে কি হয় না, এ তো আমারই মনের কথা? কবি তো তিনিই- যিনি অগুনিত পাঠকের মনের কথা কোনো এক অলৌকিক উপায়ে বলে দিতে পারেন।

কিন্তু এটা ছাড়াও, তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত বা কম পঠিত একটি কবিতাও আমার কাছে অসামান্য মনে হয়েছে। আবার পুরোটা উদ্ধৃত করি-- 'হাত বাড়ালেই মুঠো ভরে যায় ঋণে অথচ আমার শস্যের মাঠ ভরা। রোদ্দুর খুঁজে পাই না কখনো দিনে, আলোতে ভাসায় রাতের বসুন্ধরা। টোকা দিলে ঝরে পচা আঙুলের ঘাম, ধস্ত তখন মগজের মাস্তুল নাবিকেরা ভোলে নিজেদের ডাক নাম চোখ জুড়ে ফোটে রক্তজবার ফুল। ডেকে ওঠো যদি স্মৃতিভেজা ম্লান স্বরে, উড়াও নীরবে নিভৃত রুমালখানা পাখিরা ফিরবে পথ চিনে চিনে ঘরে আমারি কেবল থাকবে না পথ জানা-- টোকা দিলে ঝরে পড়বে পুরনো ধুলো চোখের কোণায় জমা একফোঁটা জল।

কার্পাস ফেটে বাতাসে ভাসবে তুলো থাকবে না শুধু নিবেদিত তরুতল জাগবে না বনভূমির সিথানে চাঁদ বালির শরীরে সফেদ ফেনার ছোঁয়া পড়বে না মনে অমীমাংসিত ফাঁদ অবিকল রবে রয়েছে যেমন শোয়া হাত বাড়ালেই মুঠো ভরে যায় প্রেমে অথচ আমার ব্যাপক বিরহভূমি ছুটে যেতে চাই-- পথ যায় পায়ে থেমে ঢেকে দাও চোখ আঙুলের নখে তুমি। ' (খতিয়ান/ রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ) শষ্যের মাঠ ভরে আছে, অথচ মুঠো ভরে যায় ঋণে; দিনের রোদ্দুর নেই, অথচ রাত ভেসে গেছে আলোতে; হাত বাড়ালেই মুঠো ভরে উঠছে প্রেমে, অথচ বিরহ, কেবলি বিরহ। কারণ-- 'ছুটে যেতে চাই-- পথ যায় পায়ে থেমে ঢেকে দাও চোখ আঙুলের নখে তুমি। ' কেউ কেউ বুঝি এমন করেই আঙুলের নখে চোখ ঢেকে দেয়! আর তাই-- 'ডেকে ওঠো যদি স্মৃতিভেজা ম্লান স্বরে, উড়াও নীরবে নিভৃত রুমালখানা পাখিরা ফিরবে পথ চিনে চিনে ঘরে আমারি কেবল থাকবে না পথ জানা' রুদ্রর তাই ঘরে ফেরা হয়নি আর। আমাদের কারো কারো কখনোই ফেরা হয় না!


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।