আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেদিন আমি স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখেছিলাম (চতুর্থ ও শেষ খন্ড)

.... তবুও আমি স্বপ্ন দেখি ... (স্বপ্ন, বাস্তব এবং ব্লগের সর্বস্বত্ব ব্লগার কতৃক সংরক্ষিত)

(এটি একটি চলমান লেখার চতুর্থ এবং শেষ খন্ড। তৃতীয় খন্ড পড়তে ক্লিক করুন ) দুরুদরু বুকে ফাইনাল পরীক্ষা শুরু করলাম। ইস্টওয়েস্ট জীবনের শেষ ফাইনাল। প্রথম পরীক্ষা ছিল হারুন স্যারের কোর্সের। একটা স্বপ্নময় পরীক্ষা হলো।

মনেমনে বললাম একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ মনে হয় না এই কোর্সে আমার A আটকাতে পারবে! কিন্তু আমার এই অতি-আত্মবিশ্বাস কাল হয়ে দাড়ালো। পরের পরীক্ষাতে গিয়েই সব এলোমেলো করে ফেললাম। শরীফ স্যার আমাকে ফাইনাল ভালো করে দিতে বলে ছিলেন। কিন্তু আমি ফাইনাল দিলাম অতি জঘন্য। জঘন্য এই জন্য বলছি, কারন একটা প্রশ্ন আমি ঠিক মত মেলাতেই পারিনি।

এর প্রভাবে অন্য প্রশ্নের উত্তর যেগুলো আমার ভালো জানা ছিল সেগুলোও মোটামেটি রকমের হলো। কথায় বলে যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধা হয় - আমার হয়েছে রিতীমত মধ্যরাত। এ যেন কূলে এসে তরী ঢোবার মত অবস্থা। স্যারের সাথে যে গিয়ে আবার দেখা করবো সেই মুখও আর নেই। এদিকে আকতার স্যারের সাথে যে রিডিং কোর্সটা ছিল, সেটার ফাইনাল পরীক্ষার পরিবর্তে একটা বড় টার্ম-পেপার জমা দিতে হলো এবং একটা বিষদ ভাইবা পরীক্ষাও নেয়া হলো।

ফলে গ্রেডের ব্যপারে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। লিখিত পরীক্ষা হলে অন্তত ধারনা করা যায় কেমন হয়েছে, কিন্তু ভাইবা হওয়ায় সামান্য অনুমানও করা যাচ্ছিল না। চরম দুঃশ্চিন্তা হচ্ছিল। এমন সময় মড়ার উপর খড়ার ঘা হয়ে আসলো আরেকটা সংবাদ। আমাদের ব্যাচ থেকে একজনও থিসিস শেষ করতে পারছে না।

অতএব থিসিস সাবমিশন এবার আর হচ্ছে না। শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। বলে কি? আমাকে এবার থিসিস জমা দিতেই হবে। তা না হলে সব কোর্সে 4.00 পেলেও কোন লাভ নাই। এজন্যই প্রধানত আমি দিন রাত কাজ করে থিসিস গুছিয়ে নিয়ে এসেছিলাম।

দ্রুত আকতার স্যারের সাথে দেখা করে ব্যাপারটা বললাম। স্যার শুনে রেগে গেলেন। বললেন থিসিস জমা স্নাতক পর্যায়ের প্রজেক্ট জমার মত নয়। এর জন্য ভিসি থেকে চিঠি ইস্যু করতে হয়, এক্টার্নাল রিভিউয়ার নিয়োগ করতে হয় এবং সব শেষে বদ্ধ কামরায় থিসিস ডিফেন্স। নিয়ম হচ্ছে ছাত্র ডিপার্টমেন্টকে কিছুদিন সময় হাতে রেখে জানাবে যাতে ডিপার্টমেন্ট সব আয়োজন করতে পারে।

আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম স্যারের দিকে। তার পর আমতা আমতা করে জানালাম আমার এখনও সিজিপিএ 4.00 এবং এবারও যদি সব বিষয়ে A পাই তাহলে গোল্ড মেডেল পাবার সম্ভাবনা আছে। প্রথম বারের মত স্যার আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকালেন। ডিপার্টমেন্ট আশা করছিল তিথি অথবা তানজিলা গোল্ড মেডেল পাবে। কিন্তু ওরা আগেই সে দৌড় থেকে ছিটকে গিয়েছিল।

আমি যে একটু একটু করে এত কাছে চলে এসেছি এটা কেউই লক্ষ্য করেনি এতদিন (একজন বাদে, যথা সময়ে বলা হবে)। ধীরে ধীরে স্যারের গলার স্বর নরম হয়ে আসলো। পরীক্ষা কেমন হয়েছে জানতে চাইলেন। প্রকৃত অবস্থাই স্যারকে জানালাম। সব শুনে স্যার আমাকে থিসিস জমা দেয়ার প্রস্তুতি নিতে বললেন।

পরবর্তি দুইদিন স্যার অনেক খাটাখাটি করে আমার থিসিস জমা নেয়ার ব্যাবস্থা করলেন। সৌভাগ্য বোধয় একেই বলে, এক্সটার্নাল পড়লেন শরীফ স্যার। আকতার স্যার শরীফ স্যারকে বিশেষ ভাবে অনুরোধও করলেন যাতে আমার থিসিসটা দ্রুত রিভিউ করে ইন্টারভিউ-এর জন্য তারিখ দেন। উল্লেখ্য যে থিসিসের ক্ষেত্রে এক্সটার্নালের ক্ষমতা ব্যাপক। যতদিন পর্যন্ত তিনি সন্তুষ্ট না হবেন, ততদিন পর্যন্ত তারিখই পড়বে না।

আমি জানি না আকতার স্যার গোল্ড মেডেল পাবার সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন কিনা, তবে শরীফ স্যার সেদিনই আমাকে রুমে ডেকে থিসিসে আমি কি করেছি সেটার বিস্তারিত জানতে চাইলেন এবং থিসিসের কপিও সাথে নিয়ে গেলেন। পুরো রাত জেগে স্যার থিসিসটা পড়েছিলেন এবং বিভিন্ন জায়গায় পরিবর্তন করতে বললেন। আমি পরবর্তি দুই দিনে বারবার পরিবর্তন করে স্যারকে দেখানোর পর স্যার সন্তুষ্ট হলেন। ফলে আমার ইন্টারভিউ-এর তারিখ নির্ধারিত হলো পরদিন সকাল সাড়ে নয়টা। আকতার স্যার, শরীফ স্যার এবং আমার সুপারভাইজার এরশাদ স্যারের সমন্বয়ে গঠিত তিন জনের বোর্ড বদ্ধ রুমে আমার ইন্টারভিউ নিতে শুরু করলো।

প্রজেন্টেশন এবং প্রশ্ন সহ প্রায় দুই ঘন্টা চললো আমার ইন্টারভিউ। এসির তিব্র ঠান্ডায়ও আমি আমার শার্টের নিচে ঘাম অনুভব করছিলাম। অতঃপর সামান্য পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়ে বোর্ড আমার থিসিস গ্রহন করলো। আকতার স্যার যখন উঠে এসে আমার সাথে হ্যান্ডশেক করছেন তখনও আমি একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। সেদিন সন্ধাতেই ফলাফল প্রকাশ শুরু হলো।

প্রথমে হারুন স্যারের কোর্স। কোনরকম চিন্তা বা চাপ ছাড়াই গ্রেড দেখতে গেলাম এবং আকাঙ্খিত ফলই হলো - A। কিন্তু ভয়টা শুরু হলো এর পর যখন শরীফ স্যারের গ্রেড দেবার পালা আসলো। যখন দেখলাম A পেয়েছি, মনে হলো গোল্ড মেডেলটা বুঝি কেউ আমার হাতে দিয়েই দিল। বাকি আর একটা কোর্স, আকতার স্যারের ক্রিপ্টোগ্রাফি।

রাত বাজে সাড়ে নয়টা, স্যার তখনও গ্রেড দিচ্ছেন না। ডিপার্টমেন্টে ইমরান স্যার (ডিপার্টমেন্ট সেক্রেটারী), আমি এবং আকতার স্যার ছাড়া আর কেউ নেই। স্যারের রুমের সামনে দিয়ে হাটছিলাম। হঠাৎ স্যার দেখতে পেয়ে জানতে চাইলেন এত রাতে কি করছি। বললাম স্যারের গ্রেডের জন্য অপেক্ষা করছি।

স্যার হেসে বললেন, "আপনি A পেয়েছেন"। মনে হলো এত মধুর বাক্য যেন এক জীবনে আমি কোন দিন শুনিনি। আমি স্যারকে পা ছুয়ে সালাম করতে গেলাম, স্যার সাথে সাথে আটকে দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, "আপনার জায়গা এখানে"। অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে গেল মনটা। স্যারের রুম থেকে বের হয়ে দ্রুত ডিপার্টমেন্ট অফিসে গিয়ে ইমরান স্যারকে জানালাম ফলাফল।

শুনে তিনি হেসে বললেন "শেষ পর্যন্ত আপনি পারলেন"। আমি যে একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, এটা ইমরান স্যার ছাড়া পুরো ডিপার্টমেন্টে আর কেউ জানতো না। মজার ব্যাপার হলো, আমি কোন দিন এটা নিয়ে তার সাথে কথা বলিনি কিন্তু আমি জানতাম তিনি সব বুঝতে পারছেন। আবার তিনিও কোনদিন এ প্রসঙ্গে কথা বলেননি কিন্তু সাহায্য করে গিয়েছেন সবদিক দিয়ে। তাই যখন সংবাদটা তাকে দিলাম, তিনি উত্তরটা এমন ভাবে দিলেন যেন এটা নিয়ে গত কিছু মাস আমরা নিরবে পরষ্পরের সাথে কথা বলেছি বহুবার।

যাইহোক, আমি লক্ষ্য ঠিক করেছিলাম একটা অর্জনকে কেন্দ্র করে, কিন্তু ফলাফলে দেখা গেল সাথে অপ্রত্যাশিত আরো কিছু অর্জন চলে আসলো। প্রথমেই স্প্রিং ২০০৭ এর ডিনস্ লিস্টে নাম আসলো এবং একই সাথে বিশ্বাবিদ্যালয়ের মেরিট স্কলারশীপও পেলাম। এই স্কলারশীপটার প্রতি আমার একটা বিশেষ দুর্বলতা ছিল সব সময়। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়ামে এই স্কলারশীপ যারা পেয়েছে তাদের সবার নাম দেয়ালে টাঙানো আছে যা দেখলেই আমার আফসোস হতো। ২০০৩ সনের জানুয়ারী মাসে অল্পের জন্য (আমার ঠিক আগের ব্যাক্তি পর্যন্ত পেয়েছিল) আমি এটা পাইনি; এমন কি আমার থেকে কম সিজিপিএ নিয়েও অন্য ব্যাচ থেকে ছাত্ররা পেয়েছিল কিন্তু কোটা পদ্ধতির প্যাচে পড়ে আমার আর এ লক্ষ্যটা ছোঁয়া হয়নি সেদিন।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে যাবার ঠিক আগ মূহুর্তে এই অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তি আমাকে বেশ আবেগতাড়িত করেছিল। পরবর্তিতে বিশেষ সংবর্ধনা দেয়া হলো যা অতীতে কেবল দেখেই ছিলাম, প্রথমবার নিজে পেলাম। আতঃপর ২০০৭ সনের মে মাসের ১৪ তারিখ আসলো সেই বিশেষ দিন। একই দিনে আমি স্নাতক (আন্ডারগ্রাজুয়েট) এবং স্নাতকত্তর (পোস্টগ্রাজুয়েট) পর্যায়ের ডিগ্রী সার্টিফিকেট গ্রহন করি। ন্যাম সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সমার্তনে বহু মানুষের করতালির মাঝে সেদিন আমি গিয়ে দাড়িয়ে ছিলাম গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতির সামনে।

সে এক অদ্ভুত অনুভুতি। রাষ্ট্রপতি যখন আমাকে স্বর্নপদক পরিয়ে দিচ্ছিলেন, মনে হচ্ছিল যেন সময় ক্ষনিকের জন্য থমকে গিয়েছে। আমি বাস্তব থেকে হারিয়ে গিয়েছিলাম স্বপ্নের জগতে, এক বহুল আকাঙ্খিত স্বপ্রে জগতে। আমার মা তখন দর্শক সারিতে বসে আমাকে দেখছিল। আমি যেন তাঁর গর্বিত দৃষ্টির প্রতি বিন্দু অনুভব করছিলাম।

মনে মনে আমি আমার পরলোকগত বাবাকে কল্পনা করে বলছিলাম - "বাবা, এ অর্জন আমি তোমায় উৎসর্গ করলাম"। সমাবর্তনের দ্বিতীয় অংশে যখন শিক্ষামন্ত্রী সনদ তুলে দিচ্ছিলেন গ্রাজুয়েটেদের হাতে তখন স্ব স্ব ডিপার্টমেন্ট চেয়ারম্যানরা তাদের ছাত্রদের নাম ঘোষনা করছিলেন। আকতার স্যার উচ্ছসিত ভাবে আমার নাম ঘোষনা করলেন এবং স্বর্নপদকের কথা উল্লেখ করলেন। আমি যখন সনদ নিচ্ছিলাম তখন ফরাস স্যার, যিনি সব সময় খুবই মৃদুভাষী, প্রায় চিৎকার করে বললেন "কনগ্রাচুলেশনস নিয়াজ"। সবার প্রশংসা আর অভিনন্দনে সিক্ত হয়ে সেদিন যেন আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম অন্য কোথাও! বাসায় আসার পর আমার ছোট বোন বলল রাষ্ট্রপতি যখন আমাকে পদক পরিয়ে দিচ্ছিল, আম্মু তখন কাঁদছিল।

শুনে মনেমনে বলেছিলাম, এইতো আমার শ্রেষ্ঠ অর্জন - আমার মায়ের অনন্দ অশ্রু। আরও পরে আমি আমার বিছানায় বসেছিলাম। জ্বরে আমার গা পুড়ে যাচ্ছিল। সারা দিনের এত উত্তেজনা আমার নার্ভের জন্য সম্ভবত একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল, তাই সম্পূর্ন সুস্থ আমি হঠাৎ করে জ্বরে পড়লাম। সে অবস্থায় আমার উত্তপ্ত হাতের মাঝে স্বর্নপদকটি নিয়ে আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম।

এ যে শুধু স্বর্নপদক নয়, এ এক স্বপ্ন। গত কয়েকমাস ধরে একটু একটু করে বোনা আমার এক স্বপ্নময় স্বপ্ন। কিন্তু কি আশ্চর্য, সেদিন আমার হাতের মুঠোয় আমি স্বপ্নের স্পর্ষকে অনুভব করছিলাম। সেদিন আমি স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখেছিলাম! ২৯ এপ্রিল ২০০৮ পোস্টে সংযুক্ত ছবিটির স্বত্ব দৈনিক প্রথম আলোর ফটো সাংবাদিক পারভেজ সাহাদাতের এবং ১৫ মে ২০০৭ - এ প্রকাশিত।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.