আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লাখের বাতি

জাদুনগরের কড়চা
এক লাখ টাকা মানে কত্তো টাকা? আমার ছেলেবেলাতে বড়লোক বোঝাতে লক্ষপতিরই চল ছিলো। আশির দশকে এক লাখ টাকায় অনেক কিছু হয়, সরকারী চাকুরের ২০ মাসের বেতন, একটা গাড়ির দামের পুরোটা না হোক, ৮০-৯০%, শহরের এখানে সেখানে বেশ খানিকটা জমি, -- এক লাখ টাকায় সব এসে যেতো হাতের নাগালে। সিনেমার নায়িকার বাবা পাইপ-হাতে ড্রেসিং-গাউন-পরে সিঁড়ি-দিয়ে-নামা চৌধুরী সাহেবরা হতেন সব সময়ে লাখ পতি। লাখ টাকা তাই সেই শৈশবের আমার চোখে ছিলো এক অভাবনীয় সম্পদ। দিন যায়, টাকার দাম কমতে থাকে।

নব্বইয়ের দশকে এসে লাখ টাকার দাম পড়ে যায়, সরকারী চাকুরের ছয় মাস-বছরখানেকের বেতনে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু আশির দশকে বড়ো হওয়া আমার প্রজন্মের কাছে লাখ টাকার মোহ রয়ে যায় অপরিবর্তিত। নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে যখন কারিগর হওয়ার পাঠশালাতে নাম লেখাই, লাখ টাকার মীথ রয়ে গেছে সবার মাঝে। হলবাসী আমরা খেটে খাওয়া, ঢাকাবাসী বাসার ছেলেমেয়েদের মতো টাকার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত না থেকে টিউশনি বা অন্য উপায়ে চলতে হয়, পারলে উলটো বাড়িতে টাকা পাঠানোর ব্যাপার এসে যায়। এহেন সময়েও লাখ টাকার কথা হাতছানি দেয় আমাদের।

হুমায়ুন আহমেদের লেখা উপন্যাস তখনো জনপ্রিয়, সেরকম এক গল্পে পড়েছিলাম আমরা, গ্রামাঞ্চলে লাখ টাকার মালিক হলে "লাখের বাতি" জ্বালাতে হয়। সেই বাতির শিখা দেখে সবাই বোঝে, এখানে রয়েছে এক লাখপতি। আড্ডায় আড্ডায় আমাদের বন্ধুদের মধ্যে এই কথাটা এসে যায়। আমার এক বন্ধু বেশ গুরুত্বের সাথেই নেয় এটাকে ... জানপ্রাণ পণ করে ঠিক করে, লাখের বাতি জ্বেলেই ছাড়বে। টিউশনি থেকে শুরু করে বিভিন্ন পন্থায় লেগে থাকে এজন্য।

৫০, ৬০, ৭০ হাজারে পৌছে অবশ্য আর আগায় না। তখন ব্যাটা নিলো নতুন কৌশল ...এক সময় দেখি ওকে সবাই এড়িয়ে চলছে, দূর থেকে দেখলেই গায়েব হয়ে যেতে চায়। ব্যাপারটা কী? কাছে যেতেই পরিষ্কার হলো, ও এখন লাখ টাকা ব্যাংকে বানানোর জন্য ধার করে চলেছে... সেভাবে চলতে চলতে এক সময় লাখের গণ্ডি পেরিয়ে গেলো, আমাদের কাছ থেকে দেখা হাতের নাগালের প্রথম লাখপতি ... বিশাল ছিল দেয়ার চেষ্টা পুরোটা না হলেও কিছুটা সার্থক হলো। কিন্তু লাখের বাতি? তার কী হবে? পাঠশালার ছাত্রাবাসে কখনোই বিদ্যুৎ যায় না ... (গোপন সূত্রে শুনেছি, বঙ্গভবন আর প্রধানমন্ত্রীর অফিসের পরেই নাকি আমাদের পাঠশালার গুরুত্ব দিয়ে রেখেছে , হয়তোবা আমাদের পাঠশালায় পড়া বৈদ্যুতিক কারিগরেরাই), কাজেই হারিকেন বা অন্য বাতি তো নেইই। কী আর করা, খুঁজে পেতে বের করা হলো একটা LED, (রেডিও টিভিতে মিটমিটে যে লাল আলো দেখেন, সেই আলোর বাতি)।

গোটা দুয়েক দেড় ব্যাটারি বের করে সেই LED লাগিয়ে দিলাম আমরা নব্য লাখপতির জানালায়। বারান্দায় রাতের আলো আঁধারে লাখের বাতি দেখতে সবাই এলো ... হাজার হলেও লাখপতিকে হাতের কাছে পাওয়া তখনো ছিলো অনেকটাই অচিন্ত্য!! ---- পাদটীকা দলে দলে ছাত্রদের গণকচালনবিদ্যা পড়িয়ে পড়িয়ে আমিও লাখের বাতি জ্বালি মাস খানেক পরে, কিন্তু আমার লাখপতি জীবনের মেয়াদ ছিলো সপ্তাহ খানেক। বাবার হার্টের অপারেশন, আর বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের খরচে এক লহমাতেই লাখপতি আমি নেমে আসি দশ-হাজারীদের দলে। আর এখন? লাখ টাকার আর মূল্য নেই। আমাদের সবাই এখন লাখপতি ... মাস দুমাসেই লাখটাকা বেতন পায় দেশে পরিচিত অনেকেই।

তবু বন্ধুর জানালায় লাখের বাতি জ্বেলে যে আনন্দ পেয়েছিলাম, সেই আনন্দ দেখিনা লাখপতিদের দুচোখে। হাতি মরলে আজ আর লাখ টাকা হয় না ... লাখ টাকার, লাখপতিদের দিন শেষ।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.