আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঘোরাঘুরি ব্লগ: উত্তর মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জ/ সমুদ্র যেখানে মা (১০ম অংশ)

যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

[সবাইকে বাংলা নববর্ষ ১৪১৫ এর শুভেচ্ছা। নতুন বছর কাটুক বিগতে বছরের চেয়ে অনেক বেশী আনন্দে, অনেক বেশী প্রত্যয়ে] ১২. টিনিয়ান থেকে সাইপান পোর্টে এসে নামতেই দেখি পার্কিংয়ে তপনদা, গাড়ীসহ। টিনিয়ানে থাকতেই ফোনে বলেছিলাম একটার লঞ্চ ধরছি। তপনদা একদম সময়মতো হাজির! আমার ধারনা ছিল, মাত্র এক ঘন্টার নোটিশে হয়ত তপনদা ঠিক সময়ে এসে পৌঁছাতে পারবেনা, পোর্টে বসে থেকে কিছুটা সময় কাটাবার মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই আমরা লঞ্চে উঠি। তবে তপনদা এসে পড়ায় বেঁচে গিয়েছিলাম, কারণ লঞ্চের ঝাঁকুনি আমাদের সেই মানসিক প্রস্তউতিকে একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।

এত ভয়াবহ যে সমুদ্র হতে পারে, আমার ধারনায় ছিলনা! আরো অবাক হলাম আকাশ দেখে, বৃষ্টি কোথায় চলে গেছে কে জানে, এই পরিস্কার আকাশ দেখে এখহন আর বোঝার উপায় নেই যে এই দ্বীপ আজ সারাসকাল গুমোট ছিল। তপনদা আবারও স্মরণ করিয়ে দিলেন, "এই হলো সাইপান। " এর আগে জাপানের ছোটখাট শান্তশিষ্ট উপসাগর বা লেকে লঞ্চে চড়েছি, সবসময়েই যেখানে স্রোত বলতে কিছু দেখিনি। একই সাথে প্রায়ই লঞ্চের ভেতরে বসে জানালা দিয়ে পাখি, দ্বীপ, সাগরের জল এসব দেখে সময় কাটিয়েছি। সেজন্যই, সাইপান টু টিনিয়ানের এই লঞ্চে উঠে একটু চমকেছিলাম।

কারণ ডেকে যাওয়া যায়না, সীটে বসতে হয় এবং সবাইকে বলে দেয়া থাকে যাতে সীটবেল্ট বেঁধে নেয়, প্লাস, সীটের পাশের জানালাগুলো ঘোলা। বাইরে অস্পষ্ট কিছু দেখা যায় কি যায়না -- এরকম। টিনিয়ানে যাবার সময় খটকা লেগেছিল, বিরক্তও হচ্ছিলাম কারণ এমনভাবে সাগরের উপরে দাপিয়ে যাচ্ছে আমাদের জাহাজ, আর সেই সাগরের কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা। তাও ঝাঁকুনি টাকুনি না হওয়াতে ঘুমিয়ে টুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু ফেরার সময় কড়ায় গন্ডায় বুঝে গেলাম কেন এত নিয়ম! ফেরার সময় জাহাজের ঝাঁকুনি ছিল এ্যামিউজমেন্ট পার্কের রাইডগুলোর মতো।

ঘসাকাঁচ দিয়ে বাইরে দেখতে পাইনি, তবে আমি নিশ্চিত বিশাল বিশাল ঢেউয়ের ঝাঁকুনিতে জাহাজ বারবার শূণ্যে লাফ দিয়ে আবার পানিতে পড়ছিল। ফেরার সময় যাত্রী তেমন বেশী ছিলনা, জাহাজের পাঁচ ভাগের একভাগও হবেনা; কিন্তু সবাই সন্ত্রস্ত, কিছু জাপানী মেয়ে চীটকার চেঁচামেচি শুরু করে দিল। জাহাজের চামোরো এ্যাটেন্ডেন্ট দৌড়ে এসে অভয় দেয় তাদের, প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে এ্যআটেন্ডেন্টদের ছুটোছুটি বেড়ে যায়। আমি টের পাই, প্রত্যেকবার জাহাজ শূণ্যে লাফ দিয়ে উঠছে, আর পেটের ভেতর সব খালি হয়ে যাচ্ছে; মনে হচ্ছিল, এ্যাবডোমেন পুরোটাই বুঝি বেরিয়ে আসবে! প্রথমে মিনিট পাঁচেক সহ্য করলাম, ভাবলাম, হয়ত সাগরের কোথাও ঢেউ বেশী, তাই এমনটা হচ্ছে। পাঁচ মিনিট তো গেলই, দশ, পনের মিনিট যেতেও থামার কোন লক্ষণ নেই।

পরে জানলাম, সাগরের ঝড় ভয়াবহ, এত সহজে থামেনা। শুনেছি, তখন বাতাস নাকি ছিল খুব বেশী, ঢেউ কেটে কেটে আমাদের জাহাজকে আসতে হয়েছে পুরোটা পথ। মিনিট পনের পরে গা এললিয়ে দিলাম সীটে, চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকি কখন পৌঁছাবো সাইপানে। মোনার অবস্থাও তথৈবচ, আমারা দুজনেই নির্বাক পাশাপাশি অপেক্ষায় আছি কখন শেষ হবে এই ভয়যজ্ঞ! পুরোটা পথ এভাবে চলল, টানা চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। পোর্টের কাছাকাছি আসতে যখন জাহাজ ল্যাগুনে ঢুকে গেল, ঝাঁকুনি থেমে গেল।

মিনিট পাঁচেক পেলাম জাহাজের সীটে বসে জিরিয়ে নেবার জন্য, তবে যখন বের হচ্ছি তখন মনে হলো সেই আশির দশকে বাসে করে ঢাকা থেকে লক্ষ্নীপুর গিয়েছি যেন। সকাল সাতটায় রয়ানা দিতাম, পেট্রলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে আর হাজার রকমের গ্যাস গিলতে গিলতে সন্ধ্যা সাতটা/আটটায় পৌঁছাতো বাস। যাত্রীদের একেকজনকে দেখলে মনে হতো হাসপাতাল থেকে বেরুচ্ছে। সেদিন জাহাজের চল্লিশ মিনিটের ঝাঁকুনিই একই কাজ করে ফেলল, সাইপানে পা রাখতেই মনে হলো, এক্ষুণি হোটেলে যেতে হবে, শুতে হবে। সেকারণেই সম্ভবতঃ তপনদাকে দেখে হাঁফছেড়ে বাঁচি।

মেয়েরা বিয়ের পর নাকি অটোমেটিকই সংসারী হয়ে যায়, আমি যখন তপনদাকে দেখে ভাবছি হোটেলে গিয়েই ঘুম দেব, মোনা তখন ভাবছিল আমাদের দুপুরের খাবারের কি হবে? হোটেলের রেস্টুরেন্ট তো শুধু সকালের খাবার সার্ভ করে, কাজেই পথেই কোথাও খেয়ে নিতে হবে। তপনদাকে বললাম, পথে কোন খাবারের দোকান, ম্যাকট্যাক হলেও চলবে, এরকম কোথাও যেন থামায়। তপনদা বললেন, "গাড়ীতে একটু জিরাইয়া লন, তারপর আপনেগোরে নিয়া যামুনে এক ফিলিপাইনের দোকানে। " "ফিলিপাইনের দোকান?" আমি অবাক হয়ে তাকাই। এমনিতেই সাইপানে এসে রেস্টুরেন্টের খাওয়া দাওয়াটা তেমন জুতের হচ্ছেনা, তারওপর আবার এই ফিলিপাইনের দোকান কেমন হয় কে জানে! তপনদা হাসিমুখে বলে, "এক্কেবারে আমাদের দেশের মতো খাবার, ভাত আর তরকারী, হ্যাঁ, শুধু একটু মিষ্টি মিষ্টি লাগব।

অসুবিধা নাইতো!" তাড়াতাড়ি খাওয়া দরকার। খানিকটা মিষ্টি মিষ্টি লাগলে কোনই অসুবিধা নেই। বললাম, "চলুন। " দেখি গাড়ী যাচ্ছে উল্টোদিকে, মানে হোটেলের দিকে না গিয়ে গারাপানের দিকে। ভেবে দেখলাম, আসলেই সাইপানে গারাপান ছাড়া আর কোথাও কিছু নেই।

কেনাকাটা, খাওয়া দাওয়া, ম্যারিন স্পোর্টস থেকে শুরু করে সবকিছুই গারাপানে। কেউ যদি সাইপানে বেড়াতে যান, তাহলে অবশ্যই হোটেলটা নেবেন গারাপানের কাছে। বিশেষ করে খাওয়াদাওয়া আর কেনাকাটা উপভোগ করতে চাইলে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আমাদের গাড়ী চলে এলো সেই ফিলিপিনো দোকানটায়। নামটা মনে রেখেছিলাম, পরে কেউ বেড়াতে আসলে সাজেস্ট করবো বলে।

"এলিগ্যান্স ক্যাফে"। বাঙালী যারাই সাইপানে বেড়াতে যাবেন, আমি বলবো প্রত্যেক বেলা এলিগ্যান্স ক্যাফেতে খেতে পারবেন, কোন সমস্যাই হবেনা। একেবারে আমাদের দেশের স্টাইলে, ভাতের সাথে এক/দুই/তিন যত পদ ইচ্ছা তরকারী নিতে পারবেন। আমরা ঢুকে প্রায় দশপদের তরকারী দেখলাম, কাউন্টারের শোকেসের ভেতর সাজানো। কি নেই! গরুর মাংসের ভুনা তো আছেই, আরেকটা আছে মটরশুটি দিয়ে গরুর মাংসের ঝহোলের কতো, আবার চিকেন ফ্রাই, চিকেন কারীটা পুরা আমাদের মায়েদের রান্না আলু-মুরগীর ঝোল; আরো দেখতে পেলাম রুই মাছের মতো একটা মাছ, নাম জিজ্ঞেস করতেই এমন বিদঘুটে একটা নাম বলল যে নেবার সাহস পেলামনা।

তবে তার পাশেই তেলাপিয়ার ঝোল, বোঝাই যাচ্ছে ভাজামাছের কারী-- এটার লোভ কি সামলানো যায়! শুয়োরের মাংসের বড় বড় চাক দিয়েও এক জবরদস্ত জিনিস সাজানো আরেক ট্রেতে, দেখে বুকটা হু হু করে উঠল। কত ত্যাগ স্বীকার করছি আল্লাহ, মনে মনে বললাম। সত্যি বলতে কি, আমার জিহবা লকলক শুরু করল, মনে হলো কতদিন খাইনা দেশী খাবার!! কারণ অবশ্য আছে -- সাইপান আসার আগেই আমরা চারদিনের ট্রিপে গিয়েছিলাম জাপানের দুটো শহর ওসাকা-কিয়োতোতে ঘুরতে। ওখান থেকে টোকিও ফিরেই দুটো নিউ-ইয়ার পার্টি ছিল, আর তারপরেই তো চার তারিখে সাইপানে উড়াল; সত্যিই এমন সোয়াদের তরকারী চোখে দেখিনা দিনদশেক হয়ে গেছে। আমি পারলে সব তরকারীই নিই, কিন্তু তপনদা বললেন যে এককেটা পদ বেশ ভালো পরিমাণ দেয়।

তেলাপিয়া মিস করা যায়না, গরু-মটরশুটিটাই কিভাবে বাদ দেই। গিন্নীর ক্রমাগত সাবধানবানীর কারণে দুটো রেডমিট নেয়া এ্যালাউড হলোনা, মুরগীর ফ্রাইয়ের বিনিময়ে গরুর ভুলা বাদ দিলাম। সাথে আরেকটা ফাটাফাটি ফিলিপিনো আইটেম পেলাম, বিশাল সাইজের বেগুনের ভেতর মিন্সট টুনা -- অমৃতের মতো হবে। জাপানে থেকে থেকে একটা বিষহেষ জাপানীজ অভ্যেস হয়ে গেছে, কোন দোকানের ভেতরের ছবি তোলাকে কেমন যেন দোকানীর ব্যবসায়িক স্বার্থের পরিপন্থী ভেবে বসি। এখন মনে হচ্ছে খাবারগুলোর ছবি তোলা উচিত ছিল, আসলেই লোভনীয়।

ডিএফএস গ্যালেরিয়ার সাউথ এক্সিট দিয়ে বের হয়ে বাঁয়ে হাঁটা দেবেন, দেখবেন একটু পরেই হাতের বাঁয়ে কতগুলো দোকান সারিব্দ্ধ। ওগুলোর শেষটাই এ্যালিগ্যান্স ক্যাফে। মিস করবেননা। দাম ভীষন সস্তা। ভাত দুই ডলার, প্রত্যেকটা কারী দেড় ডলার করে।

পাঁচ ডলাড়ে উড়াধুড়া খাবার। খাবার নিয়ে হোটেলে ফিরতে ফিরতে বেলা আড়াইটা পার হয়ে গেছে। তপনদা যখন বলেছিলো যে ট্যাক্সি নিয়ে উনি আমাদের পোর্টে আসা যাওয়াতে হেল্প করতে পারবে, তখন তিনি এটা বলেছিলেন যে, "আপনি যাই দেন অসুবিধা নেই। " এ ধরনের পরিস্থিতি বিব্রতকর, কারণ এখানে আমি আসলেই বুঝতে পারছিনা কত দেয়া উচিত হবে। হোটেলের ফ্রন্টে একবার জিজ্ঞেস করে নিয়েছিলাম পোর্টে যেতে ট্যাক্সিতে কত লাগতে পারে, সেভাবে হিসেব করেই তপনদাকে ট্যাক্সির ভাড়া দিলাম।

ভয়ে ভয়ে ছিলাম, কারণ, এই দুইদিনে এমন একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে উনাদের সাথে যে, এখন যদি আমি খুব কমও দিই, উনি কিছু বলবেননা। শুধু আমার কিপ্টেমীতে মনে কষ্ট পাবেন। তবে সেই ভয়টা তপনদাই কাটিয়ে দিলেন, হোটেলে নেমে ভাড়াটা দিয়ে দিতেই উনি বললেন, "মুকিত ভাই আজকে, কালকে যখন দরকার হয় আমারে খালি একটা কল দিবেন। তাইলেই চলে আসব। " আমি আস্বস্ত হই, তখনও আমি পুরোপুরি নিশ্চিত না আসলেই আমাদের আর ট্যাক্সি লাগবে কিনা।

তাই তপনদাকে "হ্যাঁ"ই বলতে হলো, যদিও মনে হচ্ছিলো আর দেখা হচ্ছেনা। তপনদা, বঙ্গদা এদের কাউকেই বলে আসা হলোনা। সেদিন দুপুরে ভালোমতো খেয়েদেয়ে জাহাজের ঝাঁকুনীটা পুষিয়ে নিয়েছিলাম, সেজন্যই রাজকীয় এক ঘুম দিয়ে বিকেল কাবার করে ফেলি; উঠে দেখি প্রায় সন্ধ্যা! আমাদের ডিনারের কথা আজ, হানিমুনের এক্সক্লুসিভ ডিনার। উদ্দেশ্য আর কিছুইনা, আমি রিবস্টেক খাওয়ার জন্য ছোঁক ছোঁক করছিলাম প্রথমদিন হার্ডরক ক্যাফের মেন্যু দেখার পর থেকেই। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখি সারা শরীর ব্যাথা, জাহাজের ঝাঁকুনি স্মৃতিটা ভোলা যাচ্ছেনা।

মোনারও শরীর ভালোনা, বলল, "আজ ডিনার বাদ দিই। " আমিও দেখলাম, রিবস্টেক খেতে হলে আরেকটু চনমনে মুডে যাওয়া চাই, ঠিক করলাম আজ বিকেলটা সাগরের পাড়ে কাটিয়ে দিই। আমি ভালো রোমান্টিসিজম পারিনা, না কাজে, না মুখে, না লেখায়। পারলে সেই সুন্দর বিকেলটার একটা বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করা যেত। শুধু এটুকু বলতে পারি, সেই বিকেলটা বহুকাল ধরে মনের মধ্যে গেঁথে একটি প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিয়েছে, প্রশ্নটা ছিল, "মানুষ হানিমুনে যায় কেন?" আমার জবাব আমি পেয়ে গেছি, সেটা বলে বোঝানো যায়না, বুঝতে হলে হানিমুনে গিয়ে দেখতে হবে -- শুধু এটুকুই বলতে পারি।

এমন বিকেল, এমন সন্ধ্যা জীবনে বারবার আসুক, নানা রঙে আসুক; শুধু আমাদের না, যারা পড়ছেন বা যারা পড়ছেননা তাদের সবার জীবনেই বারবার আসুক ঘুরেফিরে -- এখন লিখতে বসে এই অনুভূতিটাই সবচেয়ে বেশী হচ্ছে। ১৩. সাইপানে বেড়াতে গিয়ে প্রথম দুদিন যে একটা বিষয়ে অপূর্ণতা বোধ করেছিলাম সেটা হলো, লোকাল চামোরোদের সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা হয়নি। সাগর দেখা হলো, ম্যারিন স্পোর্টস করা হলো, ক্যাসিনো দেখা হলো -- তবে সেটা তো হাওয়াই গেলেও হতো, ক্যারিবিয়ানেও হতো। সেদিন দুপুরে ফিরতে ফিরতে তপনদার সাথে টুকটাক কথা হচ্ছিল চামোরোদের নিয়ে। তার আগ পর্যন্ত আমাদের একটা ধারনা ছিল যে চামোরোরা হয়ত পাহাড়ের ওপাশে থাকে, খুব একটা শহরে আসেনা, এই ট্যুরিস্ট সিটি থেকে নিজেরা বিচ্ছিন্ন থাকে।

তবে এয়ারপোর্ট আর পোর্টের কর্মচারী প্রায় সবাই চামোরো, যেখান থেকে মাথায় এব্যাপারটা ঢুকে যায় যে সরকারী কাজকর্মে মনে হয় এরাই অগ্রাধিকার পায়। কথায় কথায় তপনদা যেটা বললো, তার সারমর্ম হলো এরকম, সাইপানের সত্তর ভাগ লোকই ফিলিপিনো, এরাই সারা শহর জুড়ে কাজকর্ম করে দেশটাকে টিকিয়ে রেখেছে। কথা সত্য, গারাপান এলাকায় যত দোকান, হাইফাই ডিএফএস গ্যালেরিয়ার ব্র্যান্ডের দোকান থেকে শুরু করে টুকটাক পুঁতির মালা বিক্রীর ওয়াগন, সব কিছুর সামনেই বসে আছে একজন ফিলিপিনো। এমনকি খাবারের দোকানগুলোতেও তাই, ওয়েইট্রেস বলুন আর ক্যাশিয়ার বলুন, সেই ফিলিপিনোই। তপনদার মতে চামোরোরা খুব অলস, কোন কাজকর্ম তো করেইনা, সারাদিন নাকি বসে বসে বীয়ার খায়।

সরকার থেকে ফুডস্ট্যাম্প শুধু চামোরোরাই পায়, সেগুলো দিয়েই নাকি ওরা চলে। বোঝা গেল সবখানেই বিদেশীদের নেটিভদের উপর একটা ক্ষোভ থাকে, সেটা হয়ত একভাবে ভাবলে যথার্থই। একটা স্থানে কয়েকমাস থাকার পরই মনে হতে থাকে সবকিছুতে আমার অধিকারও আছে, যেমন আমি যে সেনদাই শহরে সাড়ে নয় বছর কাটিয়েছি, সেখানে বছর চারেকের মাথায়ই আমার মনে হওয়া শুরু করেছিল যে আমার ভোটাধিকার থাকা উচিত। আমিও অন্যদের মতো ট্যাক্স দিচ্ছি, শহরের জন্য সবই করছি, তবে কেন আমার মতামত থাকবেনা সরকার গঠনে। আমার কিঞ্চিৎ ধারনা, এই কিছু অধিকারকে দাবিয়ে রেখেই মানুষকে বিদেশ ভালোবাসতে দেয়া হয়না, সবসময় একটা পর পর অনুভূতি নিয়ে মানুষ সময় কাটায় বিদেশে।

যেজন্য মাত্র উনিশ বছর বয়েস পর্যন্ত কাটানো ঢাকা আমার কাছে বিশের দশক পুরোটা কাটানো সেনদাই'র চেয়ে অনেক অনেক প্রিয়। যাই হোক, চামোরোদের ব্যাপারে তপনদার এরকম ঈর্ষামিশ্রিত মন্তব্য আমার কাছে অমূলক মনে হয়নি। তাও চমোরোদের গ্রামীণ জীবন দেখার ইচ্ছে, তার ওপর পাহাড়ের ওপাশে ইস্ট সাইপান এখনও দেখাই হয়নি! চতুর্থ দিন ব্যয় করব ইস্ট সাইপান দেখতে, ঠিক করে ফেললাম তৃতীয় দিন সন্ধ্যায়। পাউপাউ ট্যুরের একটা প্যাকেজ আছে, নাম হলো "সাইপান, জাঙ্গল ট্যুর" -- একদিনে তিন/চার ঘন্টা ধরে আপনাকে সাইপানের পাহাড়, পূর্ব উপকূল আর জঙ্গল ঘুরিয়ে দেখাবে। তৃতীয়দিন সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে ঠিক করলাম কাল এই ট্যুরটা নেব।

ভয়ে ভয়ে ছিলাম, যদি বলে কাল খালি নেই। কপাল ভালো, ফোন করতেই ওপাশের মেয়েটি জানালো কোনো সমস্যা হবেনা, সকাল সাড়ে ন'টায় আমাদের নিতে চলে আসবে পাউপাউ ট্যুরের গাড়ী। নাকে তেল দিয়ে ঘুম দেয়া যেত, কিন্তু তখনও অনেক তাড়াতাড়ি। সবে রাত আটটা, কি করা যায়, কিভাবে এই অফুরন্ত সময় কাটানো যায়? আসলেই, সাইপানে ঐ গারাপান ছাড়া আর কিছু নেই সময় কাটানোর। আমরা আটটা তিনের গারাপানের বাসেই চড়ে বসি।

এই বাসে এত বেশী চড়েছি যে বাসের ড্রাইভার এখন আমাদের চেনে। প্রত্যেকবার লোকটাকে দেখে আমিও খানিকটা মিইয়ে যাই, কারণ এখন পর্যন্ত শুধু উইন্ডোশপিংই করেছি, বলতে গেলে কিছুই কেনা হয়নি। নিশ্চয়ই লোকটা ভাবছে, এই ইন্ডিয়ান দুটো প্রতিদিন কি করতে যায় গারাপানে? যাই হোক, আপাতথ যেহেতু মুখে কিছু বলছেনা, বরং তাকিয়ে না হাসলেও একটু মাথাটা বাঁকিয়ে বাউ করছে, কাজেই বাসে চড়াই যায়। তবে এদিন বেশ কিছু গিফট আইটেম কেনা হলো, খুব সুন্দর সুন্দর হাতে বানানো কয়েকটি জিনিস। মোনা কিনল কিছু হাতে বানানো অলংকার, বেশ কিছুক্ষণ একটা কাঁচের তৈরী সুন্দর শোওপিস নেড়েচেড়ে দেখল।

কিন্তু অমন ভারী জিনিস কে বইবে -- এরকম একটা অজুহাতে ওটা কেনার হাত থেকে বাঁচলাম। সত্যি বলতেই তাই, ঐ ভারী জিনিসটা কিনলে সেদিন শপিংয়ের সারাপথ, তারপর এয়ারপোর্টে হাঁটাহাঁটির পথ, আবার নারিতা থেকে দুঘন্টা লাগিয়ে ইয়োকোহামায় যাবার পথ, সবখানেই আমাকেই ওটা বইতে হতো। আমার পছন্দ হয়েছিল একটা রেডইন্ডিয়ান হ্যাট, দেখতেও সেরকম, দাম লেখা আড়াইশো ডলার! শখের সাথে বোঝাপড়া করলাম পকেট বাঁচিয়ে। পুরো সাইপান জুড়ে স্যুভেনির বলতে রেডইন্ডিয়ান কালচারের প্রভাব খুব বেশী; যাবতীয় জিনিস কোন না কোন ভাবে রেড ইন্ডিয়ানদের সাথে সম্পর্কিত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে রেডইন্ডিয়ান পুরুষ আর নারীর কাঠের মূর্তি -- এটা পাওয়া যায় বিভিন্ন সইজের।

সম্ভবতঃ এটা সবচেয়ে বেশী বিক্রী হয় এদেশে। মোনা তার হোস্ট মাদারের জন্য একটা কিনবে, সব ঠিক ঠাক -- হঠাৎ আমি প্যাঁচ লাগাই। বলি, "যা অবস্থা দেখছি এজিনিসের, তোমার হোস্ট মাদার যদি এদেশে এসে থাকে, তবে তার বাসায় এরকম একটা আছেই আছে। " যুক্তিটা কাজে দিল, তবে বুঝলাম এখন অন্যগিফট খুঁজতে ঘুরতে হবে পিছু পিছু। তখনই চমৎকার একটা জিনিস পেলাম, একেবারে গাছের পাতা-ছাল-বাকল দিয়ে তৈরী একটা ডায়েরী।

ডায়েরীর কাগজ আসলে কি দিয়ে তৈরী জানিনা, তবে দেখলে আপনার মনে হবে সেটা প্যাপিরাসের চেয়েও প্রাগৈতিহাসিক। এমন এ্যান্টিক গিফট ছাড়ি কিভাবে! পাশেই দেখি, একই আদলের একটা ফটোফ্রেম, সেটাই বা ছাড়ি কিভাবে। তার আশেপাশে আরো কিছু এরকম হাতে তৈরী জিনিস পাওয়া গেল, দেখতে দেখতে এরকম টুকটাক জিনিসে শপিং ব্যাগ ভরে যায়। খুব সুন্দর করে পুতুলের আদলে কাটা মোমবাতি পাওয়া গেল, ঘরে সাজিয়ে রাখার জন্য গিন্নীর সেটা দারুণ পছন্দ হয়েছে। আরেকটা ইন্টারেস্টিং জিনিস ছিল বাঁশের তৈরী ছোট ছোট বাটির সেট, ওগুলোতে নাকি সস সাজায়।

ঠিক আছে, কিনে ফেলো। কেনাকাটা শেষে গিন্নীরও মনে শান্তি, আমরাও ডিএফএস গ্যালেরিয়ার প্যাকেট হাতে বাসে উঠতে পারলাম। একুল, ওকুল দুকুলই রক্ষে হলো যেনো। বাসে উঠে শুনতে পাই এক মজার কাহিনী। জাপানীরা সাধারণত বেড়াতে এলে ধুমসে কেনাকাটা করে।

বলা হয়, ইতালী আর ফ্রান্সের ব্র্যান্ডের জিনিসের দোকানদাররা নাকি সারাদিন ধরে একটা জাপানীজ কাস্টামরের জন্য বসে থাকে। একজন আসলেই নাকি সেদিনের হিসাব-কিতাব চুকে যায়। জাপানী টিভির অনুষ্ঠানগুলোতে বলতে শুনেছি, ইউরোপের ব্র্যান্ডের দোকানগুলো জাপানী কাস্টমারদের ঠকায়, জাপানী পেলে নাকি বেশী দাম ধরে। কতটা সত্য জানিনা, তবে জাপানীদের ব্র্যান্ডের প্রতি দূর্বলতাটা যে কারুর চোখেই পড়বে। ডিএফএস গ্যালেরিয়ার মূল দোকানটার শেষমাথায় একটা চওড়া করিডোর, করিডোরের দুপাশে লাইন ধরে বিশ্বের সবচেয়ে দামী ব্র্যান্ডের দোকানগুলো দাঁড়ানো।

সাজসজ্জা আসলেই গর্জিয়াস, হিসেব করে দেখেছি মোট দশটা ব্র্যান্ডের দোকান সেখানে। কি নেই? গুচ্চি, কার্টিয়ে, এরমেস, বুলগারি, শ্যানল, লুই ভিটন, প্রাডা, ডিওর -- আরো কি কি যেন? গিন্নী যখন সারা গ্যালেরিয়া জুড়ে এটা ওটা দেখে, আমি করিডোরের সোফায় বসে বসে খেয়াল করলাম কারা কেনে এসব দোকান থেকে। সব জাপানীজ। আমরাও একবার করে ঢুঁ মেরেছিলাম, সবগুলো দোকানে। মেয়েদের হ্যান্ডব্যাগ সবচেয়ে সস্তা যেটা সেটার দাম চারলাখ ইয়েন।

কতগুলো বাচ্চার পোলিও টিকা কেজানে, এসব হিসেবের সময় কি আমাদের ছিলো? বা এখনও আছে? তো যেটা বলছিলাম, বাসের মজার কাহিনী। আমাদের সীটের পেছনেই মাথার কাছেই এক জাপানী দম্পতির কথোপকথন, চুরি করে শুনিনি, উত্তেজিত কথোপকথন, আশেপাশে বাতাস ছিল বলে এমনি এমনিই কানে এসে ঢুকেছে। ভদ্রলোক বলছেন, "কি!!! কি বলছো এসব!" মহিলা বলছেন, "আরে আমি বুঝিনিতো!" "বুঝনি মানে? একটা ব্রার দাম কিভাবে আড়াইশো ডলার হয়?" "চুপ করো, মানুষ শুনছে। " অন্য কোথাও হলে হাসির রোল পরে যেত, জাপানী ভাষা দেখেই মনে হয় সবাই মিটিমিটি হেসেছে। আমার হাসি চাপতে দম বেরোবার উপক্রম, এদিকে বউকে এটা শোনানোর লোভও সামলাতে পারছিনা।

জানি এখন শোনানোর সাথে সাথে আমরা দুজনেই হাসিতে ফেটে পড়তে পারি, সে এক বিতিকিচ্ছিরি কান্ড। পরে লোকটা দমে যায়, তবে নিচুস্বরে যে আলাপটা করে লোকটার ভাষায় তার মর্মার্থ হচ্ছে, "আমরা পুতুপুতু জাপানীরা সারাজীবন এরকম ঠকানিই খাবো। কিভাবে একটা ..." ভাগ্যিস ব্র্যান্ডের জিনিস কিনতে হয়না, আমি আত্মতৃপ্তিতে ভুগি।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.