আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফেলানীদের হত্যার বিচার অমনই হয়

এই উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ যুক্তিবাদী ছিলেন ইসমাইল হোসেন সিরাজী। অমন পণ্ডিত মুসলিম সমাজে খুব একটা খুঁজে পাওয়া যেত না। তার সময়ে তার মতো সুবক্তা খুব বেশি ছিল না। তার কোনো বক্তব্য অন্যকে খণ্ডন করতে হতো না। তার নিজের বক্তৃতা প্রয়োজন হলে নিজেই খণ্ডন করতেন।

বর্তমানে তেমন একজন জনাব আবদুল গাফফার চৌধুরী। তিনি লেখায় পারেন না এমন কোনো কিছু নেই। বছর দুয়েক আগে হাওয়ায় বসে লিখেছিলেন, কাদের সিদ্দিকী গন্কেস, তার সম্পর্কে কিছু লেখা মানে কালি-কাগজ নষ্ট করা। তারপরও তিনি প্রায় তিন হাজার শব্দ লিখে কালি-কাগজ নষ্ট করেছিলেন। দুই-আড়াই বছর আমাকে নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করেননি।

আবার সেদিন দৈনিক জনকণ্ঠে সর্বশেষ খুবই দুর্বল একটি লেখা লিখেছেন। কতজন কতভাবে কত করে এ ক'দিন বলেছে, লেখাটির জবাব দিতে হবে। তার লেখালেখি লা-জবাব। জনাব মৃত ব্যক্তিকে সাক্ষী রেখে লেখালেখি করেন। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীকে সারা জীবন গালাগাল করেছেন।

এই প্রথম গলাগলি করতে চেয়েছেন। কেন গলাগলি তাও স্পষ্ট করেছেন। তিনি যদি প্রধানমন্ত্রী হতেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূসকে জেলে রাখতেন। আর যারা হরতাল ডাকে তাদের ঘরে ঘরে গিয়ে হত্যা করতে বলেছেন। জনাব গাফফার চৌধুরী যাকে সারা জীবন না-হক গালাগাল করেছেন এ দুই কাজের জন্য গলাগলি করতে চেয়েছেন।

কোনো সুস্থ মানুষের এমন বিবেচনা হতে পারে না। আমি যে তার কাছে কিছুই না, এটা অনেক আগেই জানি। যিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যার রাস্তা প্রশস্ত করেছেন 'ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু' লিখে ঘাতকদের উৎসাহিত করেছেন- তার কাছে আমি কোনো মর্যাদা আশা করি না। তবুও ভেবেছিলাম, তার লেখার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু দলিল-দস্তাবেজ দেশবাসীর সামনে তুলে ধরব। কিন্তু ফেলানীকে নিয়ে বিএসএফের প্রহসনে হৃদয় খানখান হয়ে গেছে।

আরও কষ্ট লেগেছে বিএনপির কোনো নেতা, যার নাকে টিপ দিলে এখনো হয়তো দুধ বেরুবে তিনি লতিফ সিদ্দিকীকে জঘন্য ভাষায় গালি দিয়েছেন। তার যে বয়স, তার যে রাজনৈতিক হাইট তাতে তার এ রকম একজন নেতা সম্পর্কে ওই ধরনের নিম্নমানের শব্দ প্রয়োগ করা সাজে না। স্বাধীনতার পরপরই বগুড়ার সাতরাস্তায় এক বিশাল সমাবেশে হুজুর মওলানা ভাসানী সম্পর্কে সমালোচনা করেছিলাম। সেখানে সব থেকে কঠিন শব্দ ছিল 'মওলানা ভাসানীর ভীমরতি ধরেছে'। বয়স ছিল কম, রক্ত ছিল গরম।

কেবলই দেশ স্বাধীন হয়েছে। আর সেই স্বাধীনতায় অনেকটা জায়গাজুড়ে ছিলাম। তাই হয়তো কিছুটা বেসামালও ছিলাম। বগুড়ার করতোয়া আট কলামের শিরোনাম করেছিল। পরদিন ফেরার পথে বাঘাবাড়ীর কাছে হুজুর মওলানা ভাসানীর সঙ্গে দেখা।

হুজুর বলেছিলেন, 'খুব সফর করলা। ভালো করে দেশের মানুষের খেদমত করো। ' পত্রিকার জ্বলজ্বলে শিরোনাম তার হাতে দেখে মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিলাম। হুজুরকে সালাম করে গাড়িতে উঠে উপলব্ধি করেছিলাম, অমন একজন বিশাল মানুষ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করার যোগ্যতা অর্জন করিনি। যারা করেছেন তারা করবেন।

আমার কি দরকার অমন একজন বিশাল মানুষ সম্পর্কে না-হক সমালোচনা করে আল্লাহর দরবারে গুনাহগার হওয়ার? সেই থেকে শিক্ষা নিয়েছিলাম আজো সে শিক্ষা ধারণ ও পালন করছি। তা হলো মাপের বাইরে কারও সম্পর্কে অতিরিক্ত না বলা। কারও প্রশংসা করতে না পারলে অপ্রয়োজন সমালোচনা না করা। বিএনপি নেতারা শক্ত কথাকে কতটা মূল্য দেন তা তারাই জানেন। কিন্তু গালাগাল করে এ পর্যন্ত কেউ জয়ী হয়নি।

লতিফ ভাইর রাজনৈতিক জীবন কখনো কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। আজ যারাই যেখানে তাদের মতো কিছু মানুষের অবদানেই সেখানে। বঞ্চনার কশাঘাতে অনেকেই হয়তো অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেননি। সে জন্য কারও কারও কথা শক্ত লাগতেই পারে। দুধ খেতে হলে দুই-একবার গরুর লাথিও খেতে হয়।

রাজনৈতিকভাবে শুদ্ধ ভাষায় আরও হাজার কথা বলতেন আমি কিছু মনে করতাম না। কিন্তু আদব-কায়দা নিয়ে যে ভদ্রলোক কথা বলেছেন, বাংলাদেশ না হলে তাকে খুঁজে পাওয়া যেত না। লতিফ সিদ্দিকীকে আদব-কায়দার পরিচয় দিতে হবে এ ধরনের মানুষের কাছে, তা কখনো কোনোদিন চিন্তাও করিনি। তিনি একটি দল করেন, দলের মতে কথা বলেন। সে কথা শক্ত হতেই পারে।

আজকে যেমন সরকারি দল অন্যের সমালোচনা গ্রাহ্য করে না, সরকারে না গিয়েই লোকজনকে এভাবে আদব-কায়দা শিখালে আল্লাহর মেহেরবানিতে সরকারে গেলে তো অন্যদের হয়তো বাঁচতেই দেবেন না। আমরা মারাত্দক এক অসহিষ্ণুতার অসুখে ভুগছি। মাথা ঠাণ্ডা করে সুস্থভাবে সবাইকে এসব নিয়ে একটু চিন্তা করতে বলছি। আগামী কোনো পর্বে গাফফার চৌধুরী এবং এসব নিয়ে আলোকপাত করব। হৃদয়জুড়ে আছে ফেলানী।

এবার ফেলানীকে নিয়েই মনের দুঃখ ব্যক্ত করে বুকে চাপা ভারী পাথরটা সরানোর একটু চেষ্টা করি।

যার নামই চিরদুঃখী ফেলানী, তার ভাগ্যে এর চেয়ে আর বেশি কিছু কি হবে? সীমান্ত পেরুতে গিয়ে কাঁটাতারের বেড়ার উপর কয়েক ঘণ্টা ঝুলে থেকে মরেছে। বিএসএফের আদালতে গুলি খেয়ে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে মরায় তারই যে মরণোত্তর ফাঁসি হয়নি সেটাই তো পরম ভাগ্য। রেলে কাটা পড়লে বরং মৃতের আত্দীয়-স্বজনকে লাশ নিতে জরিমানা দিতে হয়। বিএসএফের আদালতে বিএসএফের বিচার, সে কখনো হয়? ভারত সরকার এবং ভারতবাসী খুব বেশি আবেগে চলে না।

তারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কূটনৈতিক চানক্যের দেশের মানুষ। তারা ভেবেচিন্তে কাজ করেন, মেপে মেপে পা ফেলেন। তাদের গজ-ফুট-ইঞ্চিতে কোনো ভুল হয় না। আমরা হলাম আবেগি মানুষ। সকালে যাকে বাবা বলি, কোনো বিচার-বিবেচনা না করেই বিকালে তাকে জঘন্য ভাষায় গালাগাল করতে পিছপা হই না।

ক'দিন আগে যখন ফেলানী হত্যার বিচারের আয়োজন হচ্ছিল, তখন আমাদের কত আশা, কত ভরসা জেগেছিল। ফেলানীর দরিদ্র মা-বাবাকে সরকারি খরচে ভারতে নিয়ে সাক্ষ্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এসব মানবিক গুণাবলীর জন্য কত সাধুবাদ জানানো হয়েছিল। মামলায় যখন আত্দস্বীকৃত খুনি বেকসুর খালাস পেয়েছে, তখন আমাদের অনেকেই হতাশ হয়েছেন। ভারতকে দেদার গালিগালাজ শুরু করেছেন।

এটা আমাদের দীর্ঘদিনের স্বভাব। প্রবাদ আছে 'ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না। ' আমরা তার ধারেকাছেও নেই। আমরা কাজ করি আগে, ভাবাভাবি করি পরে। তা না হলে এটা বুঝতে তো কষ্ট হওয়ার কথা নয়, বিএসএফের বিচারে বিএসএফের কোনো সদস্য অপরাধী হতে পারে না।

তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হলে, নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষা করা না হলে, সেটা ছিল আলাদা কথা। আমি বিএসএফের সদস্য শ্রী অমীয় ঘোষকে তার কর্তব্য পালন অবস্থায় আইনের মধ্যে থেকে কোনো কাজের জন্য কোনো মতেই অপরাধী বলতে পারি না। আমি এ লেখার শুরুতে শ্রী অমীয় ঘোষকে খুনি বলেছি, বিএসএফের সদস্য অমীয় ঘোষকে বলিনি। কারণ জানি কর্তব্যরত অবস্থায় সরকারি বন্দুক দিয়ে সরকারি গুলি খরচ করেছেন। তিনি যে নিয়মের বাইরে গুলি খরচ করেননি সেটা বিচার-আচার করে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রমাণ করে দেওয়া হয়েছে।

ক'দিন আগে শুনেছিলাম, বেআইনি জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে বিএসএফ গুলি চালিয়েছিল। তার আগে শুনেছিলাম, আত্দরক্ষার জন্য গুলি চালানো হয়েছে। যুক্তির কোনো শেষ নেই। একটা ১৪-১৫ বছরের অসহায় মেয়েকে আত্দরক্ষার জন্য যদি বিএসএফকে গুলি চালাতে হয়, তাহলে একদিকে চীন অন্যদিকে পাকিস্তান তারপর ইরান, দক্ষিণে ভূমধ্য এবং বঙ্গোপসাগর, গা ঘেঁষে আমরা এবং মিয়ানমার। ভারত রক্ষা পাবে কি করে? ১৪ বছরের একটি শিশু বিনা অস্ত্রেই যদি ভারতের জন্য হুমকি হয়, তাহলে আমার দেশে বর্তমানে সশস্ত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা তৈরির যে প্রয়াস চলেছে, আগামী কিছু দিন-বছর পর সত্যিই যখন মেয়েরা হাতে অস্ত্র নেবে, তখন ওই ধরনের প্রতিরক্ষার দেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? হিন্দি সিনেমায় মাঝে-মধ্যে দেখি বা শুনি কাপুরুষদের নিয়ে বলা হয় 'চুল্লু মে ডুব মরো'।

তখন তো তাদের ডুবে মরারও জায়গা থাকবে না। তখন কি হবে? বিএসএফ সদস্য শ্রী অমীয় ঘোষ বেকসুর খালাস হওয়ায় ফেলানীর মা-বাবা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কিন্তু আমাদের নতজানু সরকার ক্ষুব্ধ হয়নি। তাদের ব্যথা লাগেনি। আরও দু'চার দশ-বিশ হাজার ফেলানীর জীবন গেলেও তাদের কিছু যায় আসে না।

তাদের নীতি ভারত তোষণ। বর্তমান সরকার বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্যও যেমন উপযুক্ত নয়, বিদেশি বন্ধুদের কাছ থেকে সমমর্যাদা পাওয়ার যোগ্যও নয়। বর্তমান সরকার চতুর্দিক থেকে অসফল, ব্যর্থতায় নিমজ্জিত এক বিকলাঙ্গ সরকার।

এবার ফেলানীর বিচার নিয়ে আলোচনা করা যাক। বিএসএফের যে আইন-কানুন-বিধান আছে তাতে কোনো না কোনো সময় বিএসএফ সদস্যের গুলি চালানোরও সুযোগ আছে।

সীমান্ত প্রতিরক্ষা আইন যখন করা হয়েছে, তখন কোনো না কোনো পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সীমান্তরক্ষীদের নিশ্চয়ই গুলি চালানোর বিধান রাখা হয়েছে। আমার এখনো বিএসএফ আইন ভালোভাবে পড়া নেই। তাই আইন-কানুনের খুঁটিনাটি তর্কে যাচ্ছি না। লম্বা মানুষ সোজাসুজি যাচ্ছি। যে যাই বলুন, যেভাবে ব্যাখ্যা করুন_ একটা নিরীহ অবলা মেয়ে সীমান্তে অশান্তি সৃষ্টি করেছে, এরকম অজুহাত তুলে গুলি করার বিধান বিএসএফ আইনে দেখানো যাবে না।

হুজুর মওলানা ভাসানী তার শেষ জীবনে ফারাক্কা অভিযানের কর্মসূচি নিয়েছিলেন। তিনি অনেকদূর এগিয়েও ছিলেন। আফ্রো এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকার নিরন্ন মানুষের মুক্তির দূত ছিলেন তিনি। তিনি আমার মতো গর্দভ ছিলেন না। উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীদের একজন ছিলেন।

তিনি খুব ভালো করে জানতেন তখনকার বাংলাদেশের ৭-৮ কোটি মানুষ সবাই ফারাক্কায় একত্রিত হয়েও ফারাক্কা ভেঙে চুরমার করতে পারত না। এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী ফারাক্কা বাঁধের এক কিউবিক মিটার কংক্রিট খসানোর ক্ষমতা খালি হাতে জনতার ছিল না। কিন্তু তারপরও হুজুর মওলানা ভাসানী ফারাক্কা অভিযান করেছিলেন। তিনি সবকিছু জেনেশুনে বুঝেই অভিযানটি করেছিলেন। তার অভিযানের মধ্যদিয়ে ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে ফেলার কোনো ইচ্ছা ছিল না।

তার ইচ্ছা ছিল সারা পৃথিবীর সামনে ফারাক্কা সমস্যাটি তুলে ধরা। ফারাক্কার ওপর যে বাঁধ হয়েছে সে বাঁধ কিয়ামত পর্যন্ত থাকলেও বাংলাদেশের কি ক্ষতি? বাঁধটি সেতু হিসেবে ব্যবহার করলে আমাদের কোনো ক্ষতি নেই। আমাদের সমস্যা বা ক্ষতি সেতুটি যখন বাঁধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়, স্লুইসগেটের মাধ্যমে পানির প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সব গেট খুলে দিলে আগের মতো মুর্শিদাবাদের ভাগীরথীতে এক ফোঁটাও পানি যাবে না। কলকাতার গঙ্গা তার নাব্যতা হারিয়ে ফেলবে।

বন্দর হয়ে পড়বে ব্যবহারের অনুপযোগী। সেই ফারাক্কা অভিযানে যদি লাখ লাখ লোক সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যেত, তাদের ওপর যদি বিএসএফ গুলি চালাত_ গুলি চালানোর জন্য সেই বিএসএফকে ভারতবাসী, ভারত সরকার নিন্দার বদলে প্রশংসা করত। তারা হয়তো মেডেলও পেত। তবে লাখ লাখ লোক সীমান্ত অতিক্রম করে ফারাক্কা সেতু দখল নিলে সেখানে ভারত নির্বিচার গুলি চালিয়ে লোকজন হত্যা করলে জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ সেনাপতি ব্রিগেডিয়ার ডায়ার গুলি চালিয়ে যেমন কুখ্যাত হয়েছিল, ব্রিটিশের পক্ষে ব্রিটিশ হয়ে গণহত্যার জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল, ঠিক তেমনি বিশ্ব আদালতে মানবতার দরবারে ভারত অভিযুক্ত হতো। লাখো মানুষের অগ্রযাত্রাকে ট্যাংক-কামান-বন্দুক দিয়ে প্রতিহত করা যায় না।

তাকে বুদ্ধি দিয়ে প্রতিহত করতে হয়। যারা পারেন তারা ইতিহাসে স্মরণীয় হন। আর যারা পারেন না তারা হন কলঙ্কিত। ফেলানীর ক্ষেত্রে কিন্তু তেমন ঘটনা ঘটেনি। ফেলানীকে যেখানে গুলি করা হয়েছিল, সেখানে সীমান্তের এপার-ওপার দশটা লোকও ছিল না।

শ্রী অমীয় ঘোষ বিএসএফের বিচারে মুক্ত হতে পারেন, বিএসএফ নিজেদের ঝরঝরে ভাবতে পারে। কিন্তু মানবতার বিচারে তারা সবাই দোষী। বিচারের নামে আদালত বসিয়ে প্রহসন করে তারা তাদের অপরাধ আরও বৃদ্ধি করেছেন। ফেলানী শুধু বাংলাদেশের নয়, ফেলানী জন্মসূত্রে ভারতেরও নাগরিক। ফেলানীর বাবা-মায়ের জন্ম বাংলাদেশে।

কিন্তু ফেলানীর জন্ম তো ভারতে। এই পৃথিবীতে জন্মের অধিকার কেউ হরণ করতে পারে না। একজন নাগরিককে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী গুলি করে হত্যা করতে পারে না। সেখানে হাজার হাজার দাঙ্গাকারী থাকলে অস্ত্রশস্ত্র থাকলে বিএসএফের আইনে গুলি চালানোর একটা অজুহাত হয়তো থাকত। কিন্তু একেবারে একা ফেলানীর ওপর গুলি চালানোর আইনানুগ কোনো সুযোগ বিএসএফের ছিল না।

আগেই বলেছিলাম, বিএসএফের বিচার বিএসএফ কি করবে? কি করবে বা করতে পারবে? যে স্তরের আদালত তার ক্ষমতাই বা কি? বড়জোর দেড়-দুই বছর জেল। যথার্থই রায় দিয়েছেন। সরকারি কর্তব্য পালনের সময় গুলি চালিয়েছে। বিএসএফকে বন্দুক দেওয়া হয়েছে গুলি চালাতে, বন্দুকে চুমু খেতে নয়। সে যদি বলে অবৈধ পারাপার হওয়ায় হৈ-হুল্লোড় শুনে গুলি চালিয়েছে।

কি জবাব হবে? আমার বাবা মৌলভী মুহম্মদ আবদুল আলী সিদ্দিকী খুব মজলিসী স্বভাবের ছিলেন। প্রায় সময়ই আমাদের সঙ্গে মজার মজার গল্প করতেন। আমরা তখন সবাই ছোট। আমার ১০-১২ বছর হবে। ভাই-বোনেরা আরও ছোট।

বাবা ফিরেছিলেন বড় চওনা-বাঘের বাড়ি পাহাড় থেকে। সকালে বাড়ির বাইরে পুকুরপাড়ে বসেছিলেন। আমরা তিন-চারজন তার পিঠ চুলকাচ্ছিলাম। বাবার সারা জীবনের পিঠ চুলকানোর স্বভাব ছিল, যার কিছুটা আমারও আছে। আমরা ছোট ছোট হাত দিয়ে কাড়াকাড়ি করে বাবার পিঠ চুলকাচ্ছি।

হঠাৎ বাবা বললেন, 'জানিস, কাল যখন ফিরছিলাম, বাঘের বাড়িতে ১০টা বাঘ আমাকে আক্রমণ করেছিল। ' আমার চাইতে রহিমা, শুশু ছিল চটপটে। ওরা সমস্বরে কলরব তুলেছিল, 'বাবা, এটা কি করে সম্ভব? বড় ১০টা বাঘের সঙ্গে আপনি একাই পারলেন?' আমরা সবাই মাকে তুমি, বাবাকে আপনি বলতাম। মনে হয় বাবা বুঝতে পেরেছিলেন সংখ্যাটা একটু বেশি হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, 'না না, গুনে দেখিনি।

অতগুলো বাঘ, ১০টা না হোক পাঁচটা তো হবেই। ' আবার সমস্বরে চিৎকার, 'না না, পাঁচটা হতেই পারে না। পাঁচটা বাঘে ধরলে আপনি পারতেন না। ' বাবা আবার বললেন, 'ঠিক বলেছিস। তোদের বুদ্ধি পরখ করলাম।

১০টা-পাঁচটা না, বাঘ ছিল দুইটা। ' এবার বাবা যায় কোথায়! আমরা একেবারে চেপে ধরলাম, 'না বাবা, আপনার কথা ঠিক না। মাঐই সাহেব বলেছেন, এক বনে দু্ই বাঘ থাকে না। দুই বাঘ একসঙ্গে কাউকে আক্রমণ করে না। ' বাবা আরও উৎসাহী হয়ে বললেন, 'ঠিক বলেছিস, এক বনে দুই বাঘ থাকে না এটাই তো সত্য।

তোদের বুদ্ধি পরীক্ষা করলাম। বাঘ দশ-পাঁচটা না, দুইটাও না, আসলে একটা বাঘ আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেই বাঘের সঙ্গে পাছড়াপাছড়ি করে তাকে জঙ্গলে ছুড়ে ফেলে চলে এসেছি। কাল যদি বাঘের সঙ্গে না পারতাম তাহলে তো তোরা আর আমার পিঠ চুলকাতে পারতি না। বাঘের পেটে চলে যেতাম।

বুঝেছিস আমার কত শক্তি?' সঙ্গে সঙ্গে আমরা চিৎকার করে উঠলাম, 'বাঘের সঙ্গে পাছড়াপাছড়ি করলে বাঘের বড় বড় নখ, আপনার গায়ে নখের অাঁচড় লাগেনি?' বাবা বললেন, 'কেন লাগবে না ওই যে পায়ে, পাখনায়, যে পিঠে। ' উকুন বাছার মতো খুঁজলাম, কোথাও কোনো অাঁচড় পেলাম না। এক সময় হতাশ হয়ে সবাই বললাম, 'কই, কোথাও কোনো অাঁচড় খুঁজে পাচ্ছি না?' বাবাও হতাশ হয়ে বললেন, 'সত্যিই তো বাঘের সঙ্গে পাছড়াপাছড়ি করলে দুই-একটা অাঁচড় তো থাকবেই। বাঘ দশটা, পাঁচটা ছিল না, না হয় একটাও ছিল না। কিন্তু আমি আসার সময় রাস্তার পাশে যে জঙ্গলে খচখচ করল সেটা তো আর মিথ্যা না! তাহলে সেটা করল কিসে?' বিএসএফের সদস্য কি তেমন বলতে চাইবেন, বেআইনি পারাপারের কথা চিন্তা করে তিনি গুলি চালিয়েছেন, যা কাঁটাতারের ঝুলন্ত ফেলানীর গায়ে লেগেছে? ঝুলন্ত ফেলানীকে উদ্ধার না করে গুলি করায় তো আরেক মামলা হবে।

আরও বেশি অপরাধ হবে।

বিপদে পড়া মানুষকে উদ্ধার করা এক মানবিক ধর্ম। এখানে তো মানবতা হত্যারও অভিযোগ আসবে। আর মই দিয়ে সীমান্ত পারের সময় গুলি করে থাকলে সে গুলিতে আহত হয়ে ফেলানী কাঁটাতারে আটকে গিয়ে সেখান থেকে উদ্ধার করে চিকিৎসা না করায় আরেক ধরনের অপরাধ হয়েছে। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধে মহান ভারত আমাদের পাশে দাঁড়ানোয় পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে রক্তের হোলিখেলায় সঙ্গী হয়ে আমাদের মনে আপনজন হিসেবে যে ঠাঁই করেছিলেন, নির্দয় ব্যবহারে সে আস্থা হারানোর অপরাধ থেকেও তো মুক্ত হওয়ার পথ নেই।

সার্বিকভাবে ফেলানীকে হত্যা করে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখা ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। আমাদের কত শোক সইতে হয়। মৃত্যুশোকও সইতে হয়। শোক সইবার ক্ষমতা দিয়েই জগৎস্রষ্টা দয়াময় আমাদের সৃষ্টি করেছেন। ফেলানী হত্যা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা যদি মানবিক হতাম, তাহলে হয়তো দুই দেশের সম্পর্কে খুব একটা বড় দাগ পড়ত না।

কিন্তু কি কারণে যেন একটা হত্যার পর আরও নির্দয় আচরণ করে মর্মান্তিক বেদনা আরও বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।

লেখক : রাজনীতিক। ।

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।