আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

"তিরিশ লাখ শহীদ, নাকি কয়েকটি লাশ?" বিজয়ের দিনে এই কলঙ্কিত সংলাপ কি লজ্জা দেয় আমাদের?

সময়, কবিতা, ছোটগল্প, দেশ, দেশাচার

"তিরিশ লাখ শহীদ, নাকি কয়েকটি লাশ?" । বিজয়ের দিনে এই আলোচনা আমাদের মানবিক দৈনতাকেই পুরো উলঙ্গ করে তুলে। আমাদের অনেকেরই রক্তের পরতে পরতে মীরজাফরের উত্তরসুরী, বিশ্বাসঘাতকেরই বীজ, তা অতি উৎকটভবে প্রমানিত হয় বার বার। আমরা সে বীজ ও তার ফসলের সামনে দাড়িয়ে আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখে শিউরে উঠি। ৩৭ বছর আগের স্বাধীনতা, খুব বেশীদিনের কথা নয়, কিন্তু কারো কারো কাছে বড় পুরোনো মনে হয়।

তারা সে সময়কে বিবর্ণ, বিকৃত করে ধিকৃত করে বারবার। কিন্তু পৃথিবীটা এখনও গোলাকার, কাহিনী ঘুরে ঘুরে আসে বারবার, তাই হারানো সন্মান আর বোধ একদিন পুরনুদ্ধার হয়ে বিজয়ীর হাসি হাসবে আমাদেরই সামনে। ২৪ শে জানুয়ারী নিউইয়র্ক টাইমস্ এ ছাপা হয় এই প্রতিবেদনটি। Sydney H. Schanberg নামে এই পত্রিকার এক প্রতিনিধি এই প্রতিবেদনটি লিখেন। "তিরিশ লাখ না গুটি কয়েকজন মৃতমানুষ", এই বিতর্কের উপর অনেকটাই আলোকপাত করতে পারবে এই লেখাটি।

সেই সাথে আরো প্রমান করবে, কতোটা বিকৃতি আর পশুত্ব নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিল হানাদারের দল এ দেশের সাধারণ মানুষের উপর। লেখাটির বেশীরভাগ প্রয়োজনীয় অংশই অনুবাদ করেছি। মুল লেখাটি (ইংরেজ) ছবি হিসেবে সংযুক্ত করে দিলাম। ____________________________ Bengalis’ Land a Vast Cemetary By Sydney H. Schanberg DACCA, Pakistan, Jan. 23 "এই কবরের উপরেই আমরা আমাদের সোনার বাংলা গড়ব। ", লেখা ছিল খুলনা শহরের একটি পতাকার বাঁশের উপর, একটি সাধারণ হার্ডবোর্ডে।

তার সামান্য দুরেই রাস্তার পাশে আবর্জনায় কুকুর ও শকুনের থাবায় ইতস্তত: ছড়ানো ছিটানো মানুষের গলিত লাশ ও হাড়গোড়। এখানেই পাকিস্তানী সৈন্য ও ওদের সহযোগিরা খুন করেছে বাঙ্গালীদের। এসব বধ্যভুমিতে ছড়ানো ছিটানো রক্তাক্ত পোষাক ও মাথার চুল। সাংবাদিকরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে জানান যে, প্রতিটি ছোট ছোট শহরের একটি বা তারও বেশী এ ধরণের বধ্যভুমি রয়েছে। গত নয় মাসের যুদ্ধে সেখানে প্রতিদিনের নিয়মিত হত্যাজজ্ঞে একশ'হাজারের মতো বাঙ্গালী খুন করেছে পাকি সেনারা।

গতমাসে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে চৌদ্দদিনের এক যুদ্ধে পরাজিত হবার আগ অবধি চলেছে এই হত্যাজজ্ঞ। বাঙ্গালী নেতা শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তানের বন্দীদশা থেকে ঢাকায় ফিরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান মন্ত্রীর দ্বায়িত্ব গ্রহন করেছেন। তিনি মৃতের সংখ্যা আনুমানিক তিন মিলিয়ন হবে বলে জানিয়েছেন। বিদেশী কুটনীতিক ও পর্যবেক্ষকদের দল তাদের অভ্যাবশত:ই মৃতের সংখ্যা এতো উঁচুতে না তুলতে চাইলেও কয়েকশ হাজার বা এক মিলিয়নের মতো হতে পারে বলে ধারনা করেছেন। তারপরও এসব পর্যবেক্ষকরা পাকিস্তানী হত্যাচারে যে দশ মিলিয়ন মানুষ ভারতে পালিয়েছেন, তাদের নানা ধরণের দুর্যোগ ও পুর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে নানা গোলযোগে যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের সবাইকে মিলিয়ে শেখ মুজিবের অনুমানকে সঠিক বলেই ধারণা দিয়েছেন।

বাংগালীদের নেতা প্রতি বাড়ীতে আদমশুমারী করে মৃতের সংখ্যা আরো সঠিকভাবে নির্ণয় করার নির্দেশ দিয়েছেন। খুলনা শহরের এক বধ্যভুমি থেকে ট্রাকভর্তি কংকাল সরিয়ে নিয়ে যাবার পরও রাস্তার পাশে একমাইল এলাকা জুড়ে এখনও হাড়গোড় ছড়িয়ে রয়েছে। খুলনায় বসবাসরত বাংগালী ও বিদেশী, সবারই ধারনানুযায়ী এখানেই দশ হাজারেরও বেশী মানুষ খুন করা হয়েছে। এসব বধ্যভুমিকে সাধারণ লোকদের চোখের বাইরে রাখা হতো। রাস্তার একশো গজ দুরেই খুলনা বেতার কেন্দ্র।

ওখানকার কর্মীরা জানান, তাদেরকে অস্ত্রের মুখে কাজ করতে বাধ্য করা হতো। বেতার কেন্দ্রের সামনে ও জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে তারা এই হত্যাজজ্ঞ দেখতে পেয়েছেন। মোখলেসুর রহমান নামে এক বেতার কর্মী বলেন, "তারা প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে খুন করতো। কোনদিন ৫/৬ জন, কোনদিন ২০ জন। একদিন ওরা ৫০০ জনকে খুন করেছে।

একদিন তারা একহাজার লোককে হত্যা করেছে। তিন ঘন্টা ধরে একনাগাড়ে শোনা গেছে মেশিনগানের আওয়াজ। অনেক লাশ ওরা নদীতে ফেলেছে। সে লাশ ভেসে গেছে সাগরে। এক প্রকৌশলী জানান, তারা অনেক সময় গোলাবারুদ খরচ কমানোর জন্যে একই লাইনে সাত/আট জনকে দাঁড় করিয়ে এক গুলিতে সবাইকে হত্যা করতো।

অনেককে বেয়োনেটে খুঁচিয়েও হত্যা করা হয়েছে। মাজেদুল হক নামে আরেক প্রকৌশলী জানান, ২৫শে জুলাইএ ৫০০ মানুষ খুন করেছে ওরা। প্রথমে গুলি করার পর বেয়োনেট ও বড় বড় ছুরি দিয়ে গলা কাটা হয়েছে। "ওরা আমাদেরকে ডেকে বাইরে নিয়ে যায়। বলে, দেখ! তোমাদের লোককে কি ভাবে খতম করি।

আমাদের সামনেই পাথরে ছুরি ধার দেয়, আমাদেরকে মানসিকভাবে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে। " "এই পুরো নয়মাসের সময়ে হাজার হাজার শকুন উড়তো এই এলাকায়। এখন তারা আর নেই। " বলেন মজেদুল হক। প্রতিটি জায়গাতেই এই হত্যাজজ্ঞের বর্ণনা ভয়ংকর থেকে আরো বেশী আরো ভয়ংকর বর্ণনায় পরিনত হয়।

যশোরে বারো বছর বয়েসের বালক হাবিব রহমতুল্লা জানায় যে, জেলা আদালতের সামনে এক লোককে পায়ে বেঁধে গাছে ঝুলিয়ে পরে গুলি করে হত্যা করা হয়। হাইকোর্টের এক বিচারক এই দৃশ্য দেখে হৃদপিন্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। বিদেশী সংবাদদাতা ও অন্যান্য পর্যবেক্ষকরা আজ অবধি যে সব বিবরণ দিয়েছেন, প্রত্যক্ষদর্শীদের এই বিবরণ তার চেয়েও অনেক বেশী লোমহর্ষক ও ভয়ংকর। নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানা যায় যায় যে, প্রায় প্রতিটি সেক্টরেই পাকি সৈন্যরা বাঙ্গালী মেয়েদেরকে তাদের যৌনদাসী হিসেবে বন্দী করে রেখেছে পুরো সময়ে। তাদেরকে নগ্ন অবস্থায় বাংকারে আটকে রাখা হতো।

১৬ই ডিসেম্বরে পাকি বাহিনী আত্মসমর্পণ করার পর এসব মেয়েদের বিকৃত দেহ উদ্ধার করা হয়। বেশীরভাগ ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদেরকেও হত্যা করে তাদের মৃতদেহকে বিকৃত করা হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর চতুর্থ পদাতিক বাহিনীর কমান্ডার মেজর জেনারেল এস এস ব্রার তার বাহিনীর কিছু সেনাকে খুঁজে না পেয়ে আত্মসমর্পনকারী পাকি জেনারেল আনসারীর সাথে কথা বলেন। আনসারী যুদ্ধবন্দী হত্যার কথা অস্বীকার করায় তিনি বলেন যে, "আপনি, হয় একজন চরম মিথ্যেবাদী! নয় আপনার বাহিনীর উপর আপনার কোন নিয়ন্ত্রণই ছিল না। " ময়মনসিং জেলার এক বাপ্টিষ্ট মিশনারী, আয়ান হৌলী জানান যে, ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধা গেরিলাদের কাছে আত্মসমর্পনের আগে পাকি সেনারা হাসপাতালে তাদের আহত সেনাদেরও হত্যা করে।

একই জেলার আরো কিছু মিশনারী জানান যে, পাকি সেনারা আত্মসমর্পনের আগে কয়েকশ' রাজাকারকেও হত্যা করে। খুব কম হলেও কিছু কিছু এলাকা ছিল, যেখানে কিছু কিছু পাকি সেনা-অফিসাররা এই হত্যাকান্ড সমর্থন করতেন না। ফরিদপুরের ভারপ্রাপ্ত মেজর আতা আহমেদ ওখাকার বাসিন্দাদের মতে ছিলেন তাদেরই একজন। কিন্তু উপরের অফিসাররা তার মতো ছিল না। ফরিদপুর শহরের উপকন্ঠে একটি মন্দিররে অর্ধেকটা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়।

বাকী মন্দিরের দেয়ালের গায়ে শুকিয়ে যাওয়া কলো রক্তের ছোপ। এই মন্দিরে অনেককেই হত্যা করা হয়েছে, তারই চিহ্ণ এই রক্ত। হিন্দু ও মুসলিম মিলে বারবার ধুয়েও এই রক্তের দাগ দুর করা যায়নি। __________________________________ বিশ্বাসঘাতকের রক্তের দাগ মুছে যায় সহজেই। তাদের প্রতিদিনের বিষে নিজেদের রক্তেই ভেজালের জন্জাল।

কিন্তু তাদের বিশ্বাঘাতকতার দাগ রয়ে যায় বহুদিন। সচেতন না হলে তাদের উত্তরসুরীরাও সে দাগ বয়ে বেড়ায় অনেক অনেক বছরের পথে পদে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.