আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমরা সবাই রাজা

‘হীরক রাজার দেশে’ চলচিত্রটি প্রথম মুক্তি পায় ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরে। যতদূর মনে পড়ে ১৯৮৫ সনে সার্ক সম্মেলন চলাকালে বিটিভিতে সার্কের অন্যান্য দেশের চলচিত্র প্রদর্শনের ফাঁকে আমার ভাগ্যে প্রথম উল্লেখিত চলচিত্রটি দেখবার সুযোগ ঘটে। বলাই বাহুল্য ঐ কাঁচা বয়েসে ছবির মূল বক্তব্য কিছুই বুঝিনি, বুঝবার ধারও ধারিনি। তবে ছবিটি আগাগোড়া মনোরঞ্জনে ঠাসা। পায়ে নাগরা গলিয়ে যেখানে খুশী সেখানে চলে যাওয়া যাচ্ছে, ইচ্ছে হলেই কালিয়া কোপ্তা আর ইচ্ছে হলেই আঙ্গুর বেদানা খাওয়া যাচ্ছে, আমার ঐ বয়েসের একটি প্রিয় খেলা ছিল স্ট্যাচু; গান গেয়ে সবাইকে তেমন বাকরুদ্ধ স্ট্যাচু বানিয়ে দেয়া যাচ্ছে; এমন মজার একটি ছবি সেই সময়ের আগে কখনও দেখিনি।

এর আর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল ডায়লগ, যার প্রায় সবই ছন্দে ছন্দে গাঁথা। উফ, কি সরেস আর ঝরঝরে। রাজা মন্ত্রী উজির নাজির আর প্রজা সকলেই কবিতার ছন্দে কথা বলে।
বয়েস বাড়ার পর ‘হীরক রাজার দেশে’ আবার দেখেছি, বারকয়েক দেখেছি আর বারবারই মুগ্ধ হয়েছি। তবে ঐ শিশুসুলভ যাদু মন্তর, ছন্দ গীতের জন্যে নয়; বরং চলচিত্রের মূল বক্তব্যটি অনুধাবন করে।

ঘটনাটি সাজানো হয়েছে একজন স্বৈরাচারী রাজার স্বৈরাচারবৃত্তি নিয়ে। যে কিনা তার প্রজাদের সদা শক্ত হস্তে নির্যাতন করে। চাষির সাধ্যের সবটুকু ব্যাবহার করিয়ে শস্যের অংশের সবটুকু কেড়ে নেয়, শ্রমিকের ষোলোআনা সামর্থ্যকে খাটিয়ে নিয়ে খনি থেকে উত্তোলিত হীরক সব নিজের ভাণ্ডারেই জমা রাখে, রাজ্যে কেউ যেন কখনও শিক্ষিত হতে না পারে সেকারনে পাঠশালা আজীবনের জন্যে বন্ধ ঘোষণা করে দেয়। কেননা রাজা ভাল করে জানে চাষি আর শ্রমিক একত্রিত হয়ে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে না; কেউ যদি রুখে দাঁড়ায় কিংবা নির্যাতিতদের রুখে দাঁড়াতে সংগঠিত করে তা কেবল শিক্ষিত গোষ্ঠী। আর যদিওবা দু’একজন প্রতিবাদ করেছে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে যন্তর মন্তর ঘরে, যেখানে মস্তিস্ক প্রক্ষালনের যন্ত্র ব্যাবহার করে প্রতিবাদীর মস্তিস্ক থেকে প্রতিবাদ ও আন্দোলনের বীজকে সমূলে উৎপাটন করা হয় আর রাজার শেখানো বুলি তাদের মস্তিস্কের কোষে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে।

তারা তখন আওড়াতে থাকে- ‘যায় যদি যাক প্রাণ হীরকের রাজা ভগবান’, অন্নাভাবে নাহি খেদ বেশী খেলে বাড়ে মেদ’, ‘ভর পেট নাও খাই রাজকর দেয়া চাই’, ‘জানার কোনো শেষ নাই জানার চেষ্টা বৃথা তাই’, ‘লেখাপড়া করে যারা অনাহারে মরে তারা’; এভাবে রাজা তার একনায়কতন্ত্র বিরাজ করে গোটা রাজ্যে।
এবার একটু সেই ছান্দিক সংলাপের বিষয়ে আসা যাক। বালক বয়েসে যখন প্রথম এই ছায়াছবিটি দেখেছিলাম তখন একটা খটকা লেগেছিল। হীরক রাজার রাজ্যে রাজার মতই সবাই ছন্দে ছন্দে কথা বলে। শুনতে বেশ মিষ্টি লাগে।

কেবলমাত্র পাঠশালার শিক্ষক উদয়ন পণ্ডিত ছিলেন ব্যাতিক্রম। তিনি কথা বলেন স্বাভাবিক ভাবে, ছন্দে নয়। সেই ৮৫ সনে আমার কাছে ব্যাপারটা খুবই বিরক্তিকর লেগেছিল, কিছুটা বেসুরো। পরে, অনেক পরে বুঝেছিলাম ছন্দের বিপরীতে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলার হেতু। উদয়ন পণ্ডিত ছিলেন শিক্ষিত, মুক্তচিন্তক, সুস্থ মস্তিস্কের প্রতিবাদী এক ব্যাক্তি।

হীরক রাজ্যের স্বৈরাচারী শাসক যখন রাজ্যজুড়ে সবাইকে পোষা তোতার মতন কথা বলা শিখিয়েছে তখন সেই গড্ডালিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে উদয়ন পণ্ডিত স্রোতের বিপরীতে সাঁতরে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। এরপরের ঘটনা অত্যন্ত স্বাভাবিক। উদয়নের পাঠশালা চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হলো, তাঁর নামে হুলিয়া জারি হলো, তাঁকে ধরতে দিকে দিকে সসস্ত্র সৈন্য পাঠানো হলো। বেচারা উদয়ন পাহাড়ে পর্বতে অনাহারে ফেরারী জীবন যাপন করতে লাগলেন। রাজার ইচ্ছে নতুন প্রজন্মের ছাত্রদের কান ভারী করা দুষ্টুমতি উদয়নকে ধরে যন্তর মন্তর ঘরে নিয়ে আচ্ছা মতন মগজ ধোলাই করা।

সেও যেন পথে ঘাটে রাজার সভাকবির লেখা সেই শ্লোকগুলো আওড়ে বেড়ায়।
ঘটনার প্রবাহে রাজার সভায় এক গায়েনের প্রবেশ ঘটে। গানের শুরুতে গায়েনের সুরেলা কণ্ঠে মুগ্ধ হয়ে রাজা বলে ওঠেন- ‘বাহ, কি ভাষা!’ আর সাথে সাথেই রাজার তোষামোদকারী শ্যালক পাশ থেকে বলে ওঠেন- ‘একদম খাসা’; গান দু’লাইন গড়াতেই রাজার হাস্যজ্জল চেহারা থমথমে হয়ে যায়। গান থামিয়ে গায়েনকেও যন্তর মন্তর ঘরে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়। গানটি ছিল এরকম-
কত রঙ্গ দেখি দুনিয়ায় ও ভাইরে ও ভাই কত রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়; আমি যেই দিকেতে চাই দেখে অবাক বনে যাই অর্থ কোনো খুঁজে নাহি পাই রে ভাইরে ভাইরে কত রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়।

দেখি ভাল মানুষ থাকে ভাঙ্গা ঘরে মন্দ যে সে সিংহাসনে চড়ে; সোনার ফসল ফলায় যে তার দুই বেলা জোটে না আহার হীরার খনির মজুরের কানাকড়ি নাই নাইরে ভাইরে কত রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়।
গান গাওয়ায়, কথা বলায় মূলত রাজার নিষেধাজ্ঞা নেই যতক্ষণ না তা রাজার বিরুদ্ধাচরণ করছে। এখানে স্বৈরাচারের একটি স্বচ্ছ সংজ্ঞা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আজ আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা সংক্রান্ত খবরটি জানার পর কেন জানি আমার বারবার সেই ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচিত্রটির কথাই মনে পড়ছে। যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হবে তাদেরকে সেই উদয়ন পণ্ডিতের মত কর্মহারা, গৃহহারা, মুক্ত চিন্তার চর্চাহীন এক জীবন কাটাতে হবে।

বলা কওয়া আর লেখায় নিষেধাজ্ঞা নেই, যতক্ষণ না তা নেতাদের স্বার্থে আঘাত করছে। অর্থাৎ চাপিয়ে দেয়া অযৌক্তিক একটি মাত্রা বজায় রাখতে হবে, নইলে সেই গায়েনের মত তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হবে কালো আইনের যন্তর মন্তর ঘরে, তাদের মগজ ধোলাই করা হবে; তাদেরকে শেখানো হবে আধুনিক সমকালীন কিছু শ্লোক, যেই শ্লোকের বাইরে তাদের কিছু বলা নিষেধ, লেখা নিষেধ। কেমন হবে সেই নতুন শ্লোক গুলো? ‘দুনিয়াদারী চুলায় যাক ৫৭ ধারা বজায় থাকা’, ‘লিখতে গেলে হাতে ব্যাথা গুটিয়ে রাখো কলম খাতা’, ‘মুক্তচিন্তা দুধভাত ধর্মব্যাবসা জিন্দাবাদ’, ইত্যাদি জাতীয় কিছু হয়তো। এতে যখন যে দল সরকারে থাকবে, যে দল বিরোধীতে থাকবে অর্থাৎ সকল সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদ এবং আমলারা মসৃণ পথে হেঁটে যেতে পারবে। প্রতিবন্ধকতাহীন সুগম একটি পথ নিশ্চিত করণেই এমন আইনের উদ্ভব হয়েছে।


যাইহোক, আবার উদয়ন পণ্ডিতের গল্পে ফিরে আসি। উদয়নের পলায়নে রাজা কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো বটে। এমন অকুতোভয় শিক্ষিত যুবকদের পৃথিবীর সব রাজা রানীরাই ভয় পায়। কিন্তু ঘটনা অন্যরকম; উদয়ন পালিয়ে পালিয়ে জীবন কাটাচ্ছে সত্য, তবে তাঁর স্বপ্নটিকে মরে যেতে দেয়নি। সুক্ষ রণকৌশল তৈরী করে সে আবার ফিরে এসেছে।

তাঁর ছাত্রদের গোপনে সংগঠিত করেছে, তাদের ভেতর সত্যের বীজ বুনে দিয়েছে। সেই নতুন প্রজন্মের শক্তিতে অবশেষে হীরক রাজ্যের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রাজাকে কুপোকাত করেছে। রাজার ছন্দ রাজাকে ফিরিয়ে দিয়ে নতুন শ্লোক গেঁথেছে- দড়ি ধরে মারো টান রাজা হবে খানখান।
শাসন, আইন আর ধারা যখনই কালো বর্ণের হয় তার স্থায়িত্বও ততই দুর্বল হয়; কেননা দিনশেষে একথা ধ্রুব সত্য- সত্যের শক্তি অসীম।


সোর্স: http://www.sachalayatan.com/     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.