আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জায়গীরনামা- এক

ভালোবাসার ঊর্বশী বুকে লেখা আছে এক নাম- সে আমার দেশ, আলগ্ন সুন্দর ভূমি- বিমূর্ত অঙ্গনে প্রতিদিন প্রতিরাত জেগে ওঠে তার উদ্ভাসিত মুখ

ঊনিশ শ' পচাত্তর সাল। সবেমাত্র ক্লাস সিক্সে উঠেছি। বাড়িতে ভাতের অভাব। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের রেশ এখনও কাটেনি। অনাহারে, অর্ধাহারে আমার পড়ালেখার ব্যাঘাত হয়।

বাবা ঠিক করলেন-আমাকে জায়গীর করে অন্যের বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন। আমাদের গ্রামদেশের ভাষায় জায়গীর মানে লজিং থাকা। স্কুল থেকে যতোটুকু দূর আমাদের বাড়ি তার তিনগুণ দূরে চলে গেলাম লজিং থাকতে। হাটকয়েড়া গ্রামের মাজম মেম্বারের বাড়ি। বড়ো গেরস্থ, খাবারদাবারের অভাব নেই।

তার উপর নামী দামী লোক, গ্রামের মেম্বার। দশ-এগারো বছর বয়সের আমি অন্যের বাড়িতে জায়গীর থাকি। তিনবেলা পেট ভরে খাবার খেতে দেয় আমাকে। বিনিময়ে মাজম মেম্বারের মেয়ের ঘরের নাতিনাতনিদের পড়াই। প্রথমদিকে পেট ভরে খাবার সহ্য হতো না।

রাতবিরেতে পায়খানা আসতো খুব বেগে। কাঁচা ঘুমে ব্যাঘাত হওয়ায় মাজম মেম্বার বিরক্ত হতেন। তবে মাজম মেম্বারের বউ বেশ ভালো ছিলেন। রাতে অন্ধকারে বাইরে যেতে আমি ভয় পেতাম। তিনি কূপি বা হারিকেন হাতে আমাকে পায়খানার কাছে নিয়ে যেতেন।

এ ঝামেলা অবশ্য বেশি দিন সহ্য হয়নি মাজম মেম্বারের। তিনি আমাকে নির্দেশ দিলেন বাড়ির বারোমাসি কামলার সাথে থাকতে। তখনকার দিনে জায়গীর থাকার আরও কিছু বাড়তি ঝামেলা ছিলো। শুধু যে কামলাঝামলাদের সাথে থাকতে হতো তা নয়, রীতিমতো তাদের মতোন কাজ করতে হতো প্রতিদিন। ভোরবেলা গরুছাগল গোয়াল থেকে বের করে খড়-ঘাস কেটে খেতে দেয়া, তারপর মাঠে চরাতে দেয়া, কামলাদের খাবার নিয়ে যাওয়া।

এমন কি প্রথমবার জমিতে লাঙল দেয়ার পর বড়ো বড়ো ইটা-ঢেলা পিটানো, ধান-পাট-গম কাটা, বোরো-ইরি-রোপা ধান লাগানোর শক্ত কাজও করতে হতো। এর জন্য মাঝে মাঝে স্কুল কামাই দিতে হতো আমাকে। সারাদিনে এক কামলার কাজও করে ফেলতাম সে সময়। মাজম মেম্বার সে সময়কার তিন নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত মেম্বার ছিলেন। তিনি নিজ হাতে গ্রামের মানুষদের মাঝে সরকারি রিলিফ বিলি করতেন।

মাঝে মাঝে মেরে দেয়া আটা, চিনি, দুধ নিজের বাড়িতে নিয়ে আসতেন। ছোটোবেলায় চিনি বা মিষ্টি জিনিসের প্রতি আমার লোভ ছিলো খুব। আর রিলিফের গুঁড়োদুধটা খেতে ছিলো বেশ মজার। হাতে নিয়ে চেটে খেতে খুব মজা হতো। আমরা সেই দুধকে বলতাম 'বিলেতি দুধ'।

আমাদের স্কুলের টিফিনেও মাঝে মাঝে এরকম দুধ দেয়া হতো। একবার সাইটশৈলা গ্রামের রিলিফ বন্টন শেষে মাজম মেম্বার আমাকে কিছু বাড়তি মাল বাড়িতে নিয়ে যেতে বললেন। সাথে ছিলো তার মেয়ের ঘরের বড়ো নাতি আনিস। নিয়ম মাফিক আমার মাথায় উঠলো আটার বস্তা আর আনিসের হাতে চিনি, দুধের ব্যাগ। আমাদের দুজনকে প্রায় দেড় মাইল হেঁটে আসতে হবে হাটকয়েড়া গ্রামে।

মাঝে শুকিয়ে যাওয়া খালের মতো নদী। নদীতে পানি বেশি ছিলো না, হেঁটে পার হওয়া যায়। নদী পর্যন্ত আসতেই বেশ হাঁপিয়ে গেলাম। মাথা থেকে বস্তা নামিয়ে ধপাস করে বসে পড়লাম নদীর পাড়ে। পেটে বেশ ক্ষুধাও ছিলো।

মিষ্টি চিনির লোভে আমার জিহ্বায় পানি ঝরতে লাগলো। বুদ্ধি খাটিয়ে আনিসকে পটিয়ে দুজন মিলে আরাম করে চিনি খেলাম। ধারেকাছে টিউবওয়েল না থাকায় কোনোমতে মুখ মুছে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। আমার ভাগ্য খারাপ। বাড়িতে পৌঁছেই ধরা খেতে হলো চিনিচোর হিসেবে।

কারণ মুখে তখনও কিছুটা চিনি লেগেছিলো দুজনের। চোরের সাক্ষী হলো আনিস, যে নিজেও আমার সাথে চিনি চুরি করে খেয়েছিলো। সে বললো- আমি চুরি কইরা খাই নাই, জাগীর ভাই আমারে জোর কইরা খাইতে দিছে। বিচারে শাস্তি হলো আমার। অবশ্য শারীরিক কোনো শাস্তি নয়।

তবে বাড়িশুদ্ধ লোকের সামনে মাজম মেম্বার আমাকে যে অপমানসূচক কথা বললেন মনে খুব আঘাত লেগেছিলো সেদিন। বকার ভাষা প্রকাশের মতো ছিলো না। রাগে, অপমানে আমার চোখ ছলছল করতে লাগলো। সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম- কোনেদিনও আর পরের জিনিস চুরি করে খাবো না। আমাদের বাড়ির একেবারে কাছের স্কুলে ক্লাস করতে যাই প্রতিদিন।

আমার বাড়ির জন্য মন পোড়ে। ধারেকাছে বাড়ি হলেও বাড়িতে যেতে আমার মানা। পাছে বাড়ির প্রতি মায়া জন্মে যায়। তবু মাঝে মাঝে বাবার চোখ এড়িয়ে মাকে দেখে আসি। জায়গীর বাড়িতে পেট ভরে খেতে পেলেও আমার মন ভরে না।

কারণ দুনিয়ার কাজ, ফুটফরমাস আর মাজম মেম্বারের নাতিনাতনিদের পড়ানোতে আমার মন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। বাবার প্রতি আমার ভীষণ রাগ হয়। আর শুধু মরে যেতে ইচ্ছে করে। আমাদের কেন অনেক জমিজমা হলো না! তাহলে তো আর ভাতের অভাব হতো না। সম্ভবত সেদিন স্কুল বন্ধ ছিলো।

একদিন নদীর পাড়ে মাজম মেম্বারের জমিতে মুগুর দিয়ে মাটির ঢেলা পিটাচ্ছি। ঢেলাগুলো ছিলো বেশ বড়ো বড়ো। আর আমি ছিলাম হাড় লিকলিকে ভাতেমরা ছোট্ট বালক। তাছাড়া মুগুরের সাইজ ছিলো আমার চেয়েও লম্বায় বড়ো। সেটা মাথার উপরে তুলে ঢেলার উপর ফেলতে খুব কষ্ট হচ্ছে তখন।

সকালবেলা যেটুকু নাস্তা খেয়ে এসেছি পেটে তার একটুও অবশিষ্ট নেই। পেট মোচড়াতে লাগলো আমার। সূর্য প্রায় মাথার উপর উঠে এসেছে। সকালের মিষ্টি রোদ হারিয়ে গিয়ে কড়া রোদ দিচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে হাতের মুগুর ফেলে দিয়ে আমি বসে পড়লাম ক্ষেতের আইলে।

হঠাৎ করেই আমার নাম ধরে ডাক। মিষ্টি একটা কোমল ডাক শুনতে পেলাম পাশের ক্ষেত থেকে। আমাদের গ্রামের স্কুলের গণি মাস্টার। পাশের জমিতে লাঙলে জমি চাষ করছেন। হায়রে, সেদিকে এতোক্ষণ আমি খেয়ালই করিনি।

স্যার বললেন- গ্যাদা, তুই এখানে কী করিস? এইটা কার ক্ষেত? তোদের তো কোনো ভাইদের জমিতে কাজ করতে দেখি নাই! আমি বললাম- স্যার আমি মাজম মেম্বরের বাড়িত জাগীর থাকি। এইডা তার জমি। আমি ইটা পিটাইতে আইছি। গণি স্যার অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। চেয়ে দেখলেন বিশাল সাইজ মুগুরটার দিকেও।

তারপর কাছে এসে আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন-আহারে, কস্ কি? তোর না বৃত্তির রেজাল্ট বার অইছে। তুই তো আমাগো অবাক কইরা দিছস। সারা টাঙ্গাইল জেলায় তুই ফার্স্ট অইছস। এতো খুশির খবর আর তুই এখনও বইসা রইছস? যা বাড়ি যা। স্কুল বন্ধ থাকলেও জায়গীর হিসেবে সারাদিন মাজম মেম্বারের বাড়ির কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকি।

আসলেই আমি প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষার রেজাল্টের খবর জানতাম না। গণি মাস্টারের কাছেই প্রথম শুনলাম খুশির খবরটা। আমার কী যে আনন্দ হচ্ছে তখন! মা-ও কাছে নেই যে আনন্দে তার গলা জড়িয়ে ধরবো কতোক্ষণ। আমার ভীষণ কান্না পেতে লাগলো। দুচোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগলো।

সে জল শুকিয়ে যেতে লাগলো জমির শুকনো ঢেলার উপরে পড়ে পড়ে। আমার বাড়ির কেউই দেখলো না আমার চোখের জল! আশেপাশের উষ্ণ হাওয়া আর মাটির ঢেলা শুষে নিলো চোখের সব জল। আমার আর নিজের বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করলো না। মুগুর কাঁধে নিয়ে রওনা হলাম মাজম মেম্বারের বাড়ির দিকে। এর বেশ ক'বছর পর আমাদের সংসারের স্বচ্ছলতা ফিরে আসে।

গণি মাস্টার তখনও ঐ স্কুলের টিচার। আমি অন্য স্কুলে ভর্তি হই। পুরনো স্কুলে আমার ভাই-ভাতিজারা পড়ে। পড়াশোনায় তারা অমনোযোগী হলে গণি স্যার গল্প শোনায় কষ্ট করে আমার পড়ালেখার কথা। আর সে খুশির খবর, অবাক করা ভালো রেজাল্টের কথা।

০৫.০৩.২০০৮

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।