আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জায়গীরনামা- শেখ জলিল

অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা

শেখ জলিলের জায়গীরনামা পড়া শেষ হলো একটু আগেই। জায়গীরনামা মূলত শেখ জলিলের নিজের জীবনের প্রাইমারী বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার পর থেকে তার ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার আগের জীবনের ট্রেলার। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত সময়ের আখ্যান জায়গীরনামা হয়তো ব্যক্তি শেখ জলিলের শেখ জলিল হয়ে উঠবার বৃত্তান্ত। দারিদ্রের শেকল ছিড়ে মধ্যবিত্ত হয়ে উঠবার সিঁড়ির প্রথম ধাপরে পা রাখবার গল্প এই স্মৃতি কথা। সুতরাং জায়গীরনামা হয়তো অন্যসব লজিং মাস্টারের গতানুগতিক গল্প নয়, যেসব গল্পে অবধারিত ভাবেই লজিং মাস্টার ছাত্রীর প্রেমে পড়তো এবং ছাত্রাবস্থাতেই বিবাহিত হয়ে তাদের উচ্চশিক্ষা কার্যক্রমের ইতি ঘটাতো।

সহৃদয় কিছু মানুষ সব সময়ই রয়ে যায়, যাদের প্রশ্রয় ও আশ্রয়ে মানুষ মানুষ হয়ে উঠবার প্রেরণা পায়। বইটুকুতে প্রাপ্তি বলতে স্বল্প পরিচিত শেখ জলিলের শৈশবের সামান্য ছবি দেখতে পাওয়া। ঘটনার সময়কাল ১৯৭৫, ঠিক তার আগে আগেই বিশাল এক দুর্ভিক্ষ বাংলাদেশে হানা দিয়েছিলো, এবং এই অভাবের কড়াল থাবা মানুষকে শ্রেণীচ্যুত করেছিলো। তবে শেখ জলিলের স্মৃতিকথায় এই অংশটুকু স্বাভাবিক ভাবেই নেই, প্রাইমারী বৃত্তি পরীক্ষা দিতে যাওয়া একজন ছেলে এইসব অভাব দারিদ্র এবং ক্ষুধাকে আলাদা করে চিনতে শিখে না। পরিপাশ্বিকের সংবেদ থেকেও এই ধারণাও পায় না, ঘরে খাওয়ার থাকা এবং না থাকার ভেতরে শ্রেণীচ্যুত হওয়া, মানুষের রাজনীতি এবং রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া মানুষেরা কতটা নিপূন ভাবে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে, মানুষকে গ্রামছাড়া, শহর ছাড়া করতে পারে, এইসব আখ্যানের নেপথ্যের গল্প বুঝবার মানসিকতাই সে বয়েসে তৈরি হয় না।

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব রুখতে জন্ম হয়েছিলো রক্ষী বাহিনীর, এবং রক্ষী বাহিনী জাসদ নির্মূলের কাজ করতো, গণবাহিনী মুক্তিযুদ্ধ ফেরত কিছু রোমান্টিক মানুষের বাংলাদেশকে প্রকৃত সমাজতান্ত্রিক দেশে রুপান্তরের স্বপ্নের বাইরেও সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির উন্মুক্ত ব্যবস্থাতেও পরিণত হয়েছিলো সেই সময়টাতে। অস্ত্র সব সময়ই হঠকারিতা ডেকে আনে, এমন কি অস্ত্র মানুষের রোমান্টিকতাকে খুন করে তাকে অর্থসন্ধানী শকুনে পরিণত করতে পারে। কোনো আদর্শই মানুষের লোভের আগুণকে নেভাতে পারে না। সুতরাং গণবাহিনী একটা আদর্শের উপরেই অন্য একটি লোভের আগুণ জ্বালিয়ে ফেলে এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের। জোতদার বিরোধিতার বাইরে গিয়ে কিছু অপরাধীর আশ্রয়স্থল হয়ে উঠে, তারাই ডাকাতি করে, তারাই ডাকাতি করতে গিয়ে জনরোষের মৃত্যু বরণ করে, এইসব রোমান্টিক হঠাকারী বিপ্লবীরা রাষ্ট্রের বেতনভুক সন্ত্রাসীদের হাতে মারা যায় কয়েক হাজার।

তাদের হেনেস্তা হওয়ার কিছু ঘটনাও এই স্মৃতিকথাতে উপস্থিত- তবে সময় ও কাল বিন্যাস আমাকে বিভ্রান্ত করে, গণবাহিনীর সক্রিয়তা কি জিয়াউর রহমানের সময়ে প্রকট ছিলো, কিন্তু বর্ণনার ধারাবাহিকতা দেখে মনে হয়, গণবাহিনী জিয়াউর রহমানের সময়েও প্রবল প্রতাপেই টিকে ছিলো। এই বিষয়ে আদতে যারা বয়স্ক এবং অভিজ্ঞ তাদের মতামত চাওয়া যেতে পারে। আপত্তির জায়গাটা মুলত রাজনীতির বাইরে গিয়ে, কখনই বর্ণনাটা সেই সময়ের শেখ জলিলের হয়ে উঠে না, বরং সেটা পরিশীলিত বর্তমানের শেখ জলিলকে ধারণ করে। আমি জানি না জায়গীর নামা এর আগে ব্লগে অংশ হিসেবে ছাপা হয়েছিলো কি না, তবে শেখ জলিলের পর্ববিন্যাসের ভেতরে এমন একটা অলিখিত বিভাজন দেখা যাচ্ছে, এবং কিছুটা হলেও নিজেকে জাহির করবার প্রবণতাও দেখা গেছে সময়ে সময়ে। সুশীল মানুষ নিজের ভেতরেই শব্দজনিত সংকোচ ও শব্দজনিত সংকট তৈরি করে।

শেখ জলিলের বর্ণনাতেও তার সুশীলত্ব প্রকট হয়ে উঠে। ব্লগে কিছুটা বাহবা পাওয়া, একটু বেশী মন্তব্য পাওয়ার লোভটা গ্রন্থসংকলন কালে এড়াতে পারলে আরও ভালো হতে পারতো হয়তো প্রকাশনা। আমার আপত্তির জায়গা- প্রথমত,পাট কাটার মৌসুমে শ্রমিকদের জন্য খাওয়া নিয়ে যাওয়ার বর্ণনা- " সাথে থাকতো বারোমাসী কামলাদের কেউ। যাওয়ার পথে ওদের সাথে গল্প জমতো বেশ। বেশীরভাগই ছিলো সেক্স সম্পর্কিত" এই বর্ণনায় সেক্স শব্দটা সুশীলতার পরিচায়ক- যেখানে সচেতনভাবেই মোটা দাগের ব্যবহৃত শব্দটা লুকিয়ে এমন একটা শব্দ ব্যবহার করবার মানসিকতার পেছনে সুশীলতা লুকিয়ে থাকে।

যদিও সঙ্গম, চলতি বাংলায় চোদাচুদি শব্দটির বদলে সেক্স শব্দটা ব্যবহার করে সঙ্গম কিংবা শাররীক সম্পর্ককে ড্রইংরুমের আলোচনায় নিয়ে আসা যায়। - এই ছলনাটুকুই আমাদের মধ্যবিত্ত্ব কবি এবং স্বশিক্ষিত জলিলের অর্জনের জায়গা। সাধারণ মানুষের বুলি থেকে বাইরে আসবার সচেতন প্রয়াস থেকেই মধ্যবিত্ত অন্য সব শ্রেনী থেকে নিজেকে আড়াল করতে চায়। পৃষ্টা ১৪- নতুন জায়গীর বাড়ীতে রাত কাটানোর বর্ণনা- ঘুমানোর আগে পাশের খাটে খচখচ, উহ আহ টের পাই। কিশোর মন অনুসন্ধিৎস্যু হয়ে উঠে।

শেখ জলিল ঠিক এই সময়টাতে ক্লাশ সেভেন পাশ করেন নি। যদিও বয়েসের সীমারেখে টেনে অলিখিত ভাবেই ধরে নেওয়া হয় কৈশোর মূলত টিনএজ কিংবা ত্রয়োদশউত্তীর্ণ হওয়ার সাধারণ সীমা- এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো যে ঘটনা প্রবাহ বর্নিত হচ্ছে সেখানে এই বর্ণনাটা অনাবশ্যক। অপ্রয়োজনীয়, কিন্তু ব্লগ হিসেবে এই ঘটনাটার মূল্য আছে, এই ঘটনার সরসতা অনেক বেশী মন্তব্য আকর্ষণ করে। ঠিক এই জায়গাটাতে এসেই আমার সন্দেহটা শুরু হয়। এটা বোধ হয় ব্লগাকারে লিখিত স্মৃতিকথার সংকলন।

পৃষ্টা ৩২- যাত্রা দেখার বর্ণনা- নাচতে নাচতে নর্তকী যেই আয়ত্তে চলে এলো, অমনি ছুঁড়ে দিলাম ঢিল। লাগবি তো লাগ শরীরের অন্য কোথাও। সোজা লাগলো গিয়ে বুকের পাহাড়ে। যদিও বর্ণনাটা অন্য ভাবেও দেওয়া যেতে পারতো, কিন্তু ব্লগে সচেতন মানুষটা হয়তো পাঠকদের সাথে তার বয়েসের ব্যবধানের সংকোচে নিজের মতো হাত খুলে কিবোর্ড চিপে লিখতে পারেন নি, ঠিক যেই শব্দগুলো মাথায় এসেছিলো, বরং সেই সচেতন সুশীলতা কিংবা মধ্যবিত্ত্বতাই প্রকাশ পেয়ে যায়। একটু ওমন ভাবে বললে দোষ কেটে যায়।

এমন সীমিত কিছু উদাহরণ হয়তো দেওয়া যেতে পারে, তার বুবুর গল্প, যার স্তনে হাত পড়লেও ভালো লাগতো বলে অকপট স্বীকারোক্তি আছে শেখ জলিলের। কিংবা অসুস্থ মায়ের মাথায় পানি ঢালা সোমত্ত মেয়েদের যৌবন দেখে উল্লসিত হওয়ার বর্ণনা। এইসব সাধারণ মানুষের নিজস্ব জীবনের গল্প। সেখানে অকপট শেখ জলিল এবং যদিও বর্ণনা সুশীলতার সীমা অতিক্রম করে না কিন্তু সুশীলতা সব সময়ই নারীর অবমাননা কিংবা নিজের কামনাকে চাদরের আড়ালে লুকাতে পারে না। সেখানে পরিশীলিত শব্দের আড়ালেও একজন পুরুষই প্রকট হয়ে থাকে।

জায়গীর নামা ভালো। বর্ণনার ধরণ নিয়ে আমার আপত্তিটা হয়তো সুশীল মহলে গন্য হবে না। জীবনের কঠোরতা এবং নির্মমতার গল্পগুলো যখন সফল মানুষের কন্ঠে পুনরুচ্চারিত হয় তখন একটা আলাদা সাফল্যের ঢেকুরের সংবেদ পাওয়া যায়। জায়গীর নামায় কোনো কোনো সময়ে এই ঢেকুরটা অস্ফুট হলেও শোনা যায়, কিন্তু এরপরও একজনের বেড়ে উঠবার গল্প পড়তে অনাগ্রহী না হলে একবার পড়বার মতো বই জায়গীর নামা।



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।