আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সোশ্যাল ট্যাবু, প্রান্তিক জনপদের ভাষা এবং ব্লগীয় গালি

যেতে চাও যাবে, আকাশও দিগন্তে বাঁধা, কোথায় পালাবে!

(সম্প্রতি নাস্তিকের ধর্মকথা তার পোষ্টে যৌনতাকেন্দ্রিক গালি, সোশ্যাল ট্যাবু এবং প্রান্তিক জনপদের ভাষার সাথে গালির সম্পর্ক নিয়ে একটি পোষ্ট দেয়ায় এই পোষ্টের অবতারণা) সাধারণ দৃষ্টিতে যে সব শব্দ গালি হিসাবে বিবেচিত হয় তার অনেক শব্দই প্রান্তিক জনপদের মানুষের সাধারণ ভাষা। এবং শুধু আখতারুজ্জামান ইলিয়াস নন আরো অনেক সাহিত্যিকের সৃষ্টিতে এই সব শব্দ কথোপকথনে উঠে এসেছে অবলীলায়। কোন অবস্থাতেই সেই সব শব্দ গালি মনে হয়নি কারন শব্দগুলিকে ব্যবহার করা হয়েছে প্রেক্ষিত ঠিক রেখে। এক্ষেত্রে যে শব্দগুলি বলছে এবং যাকে উদ্দেশ্যে করে বলছে তাদের চিন্তা একই তরঙ্গে অনুরণিত হয়। আমরা সেই সব সাহিত্য কর্ম পড়ে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের চিন্তাভাবনার প্রকাশকে জানতে পারি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে সেই একই শব্দ এই ব্লগে কারো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলে সেটা গালি হবে কিনা। হবে এবং একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করি কেন হবে। বিভিন্ন যৌনতা নির্ভর গালির সাথে একটি শব্দ উল্লেখ করা হয় যেটি হলো "মাগী" । এই শব্দটি পুরাতন ঢাকার মানুষ হরহামেশা ব্যবহার করেন, গ্রাম গন্জেও প্রচলিত। এই ক্ষেত্রে তারা যখন কোন মেয়েকে বলেন " মাগীকে আজ সুন্দর লাগছে" তখন যাকে বলা হচ্ছে সেও বুঝতে পারে যে এটা তার জন্য প্রশংসাসুচক একটি কথা, তাই সে কথাটিতে আহত হয়না।

কিন্তু সেই একই "মাগী" শব্দটি যদি কোন ব্লগার অপর কোন নারী ব্লগারকে উদ্দেশ্য করে বলেন তাহলে তা নিশ্চিতভাবেই গালি হবে কারণ যিনি বলছেন তিনিও সেই জনগোষ্ঠীর ভাষায় কথা বলেননা এবং যাকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে তিনিওনা । একটি শব্দ কি উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে তাই নির্ধারণ করে শব্দটি গালি হবে নাকি প্রান্তিক জনপদের ভাষার উদাহরণ হবে । তাই প্রান্তিক জনপদের ব্যবহৃত যে কোন শব্দই সু-নির্দিষ্ট প্রেক্ষিত ছাড়া ব্যবহার করা যায় না । এই একই উদাহরণ "খানকি" সহ অন্যান্য যে সব উদাহরণ দেয়া হয়েছে তার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। এবার আসা যাক চ-বর্গীয় বিভিন্ন গালি যেগুলি নারীকে অবমাননার জন্য এবং পুরুষের ধর্ষকামী মানসিকতার প্রকাশ ঘটানোর জন্য ব্যবহার করা হয় ।

নাস্তিকের ধর্মকথা বিভিন্ন যুক্তির মাধ্যমে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন যে এগুলি প্রকৃতপক্ষে তথাকথিত বিভিন্ন সোশ্যাল ভ্যালুজ বা ট্যাবুর জন্য আপত্তিকর লাগে কারণ নারীর যৌনতাকেন্দ্রিক আক্রমণ গালি হিসাবে বিবেচনা করছি কিন্তু হাত পা মাথা অন্যান্য অঙ্গ কেন্দ্রিক কথাকে আপত্তিকর বা গালি হিসাবে বিবেচনা করছিনা। আমি মনে করি বিষয়টিকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। সমাজ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পুরুষ নারীকে নির্যাতনের ক্ষেত্রে যৌনতাকে ব্যবহার করছে এবং সভ্যতার ক্রমবিকাশের হাত ধরে নারীকে এইসব হিংস্রতা থেকে রক্ষার জন্যই বিভিন্ন সামাজিক বা ধর্মীয় ট্যাবুর উদ্ভব হয়েছে । এরপর পুরুষ যখন সরাসরি শারীরিকভাবে নারীকে আক্রমণ করতে পারেনি তখন আশ্রয় নিয়েছে যৌনতাকেন্দ্রিক বিভিন্ন শব্দের যা নারীর জন্য অবমাননাকর, এরপর এইসব শব্দকে সমাজে উন্মুক্ত ব্যবহারের বিরুদ্ধেও ট্যাবু গড়ে উঠেছে। এটা সভ্যতার বিবর্তনের একটা অংশ, একে অস্বীকার করার মানে হলো সেই আদিম ব্যবস্থায় ফিরে যাবা যেখানে কোন ট্যাবু বা রেস্ট্রিকশন আরোপিত ছিলোনা এবং সব কিছুরই স্বাধীনতা ছিলো।

আধুনিকতার প্রয়োজন আছে কিন্তু সকল সোশ্যাল ট্যাবুকে অস্বীকার করে আধুনিকতা আনয়ন করা যায়না বরং অনেক ক্ষেত্রে ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে অর্জন করা অনেক কিছুকে অস্বীকার করে পুনরায় সেই অ-সভ্য অবস্থায় যাবার মানসিকতা প্রকাশ পায়। এ ক্ষেত্রে আরেকটি ব্যাপার খেয়াল করতে হবে, নাস্তিকের ধর্মকথার পোষ্টে আলোচনায় মনে হচ্ছে যে কোন সোশ্যাল ট্যাবুই মুক্ত চিন্তার বা মুক্ত কর্মের জন্য ক্ষতিকর এবং সেই জন্য তিনি বলছেন "যৌনতা ও নারীর পবিত্রতা বা সতীত্ব কেন্দ্রিক সমাজে যেসব ট্যাবু, সংস্কার বা তথাকথিত মূল্যবোধের ধারণা বিরাজ করে সেগুলোকে অক্ষত রেখে কোনদিনও এ সব গালিকে আমাদের সমাজ জীবন থেকে দূরে রাখা যাবে না। " আসলে এখানেই মুল সমস্যাটি। অনেক সামাজিক ট্যাবু আছে যেগুলিকে অক্ষত রাখাটাই অনেক ক্ষেত্রে সভ্যতা এবং সামাজিক সহনশীলতা ও সমাজের সুষ্ঠুভাবে বেড়ে উঠার জন্য দরকারী। ট্যাবু শব্দটিকেই নেগেটিভলী নেবার কারণ নেই।

অধিকাংশ ট্যাবুই গড়ে উঠেছে যৌনতাকন্দ্রিক সম্পর্ক এবং বিধিনিষেধকে কেন্দ্র করে। অবাধ যৌনতা সমাজ স্বীকৃতি দেয়নি দেখেই এইসব ট্যাবুর উৎপত্তি । যেমন একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ইউরোপে "সমকামীতা" একটা সোশ্যাল, রিলিজিয়াস ও মোরাল ট্যাবুর আওতায় নিন্দনীয় হিসাবে দেখা হতো । যেটা এখনও বিশ্বের অনেক সমাজেও নিন্দনীয় হিসাবে (বাংলাদেশ সহ) দেখা হয়। একইভাবে "পেডোফিলিয়াও" বিশ্বের প্রায় সব সমাজেই সোশ্যাল, রিলিজিয়াস ও মোরাল ট্যাবুর আওতায় নিন্দনীয় এবং অগ্রহণযোগ্য ।

পেডোফিলিয়ার ব্যাপারে এই ট্যাবু গড়ে উঠেছে মানুষের দীর্ঘ সময়ের বিবেচনাবোধ এবং সামাজিক বিবর্তনের ক্রমধারাবাহিকতায়। এখন আপনি যদি নারীর যৌনতাকেন্দ্রিক ট্যাবু সংস্কারের একই যুক্তিতে এই ট্যাবুকে যদি অক্ষত রাখতে না চান, তাহলে তা কিন্তু সামাজিক বিপর্যয়ই ডেকে আনবে। তাই শুধুমাত্র ট্যাবুকে আক্রমণ না করে সেই ট্যাবু সমাজ সভ্যতায় কি ভূমিকা রাখছে সেটা সর্বপ্রথমে বিবেচ্য হওয়া উচিত। সর্বশেষে গালি বিষয়ে আরো দুএকটি কথা । সামহোয়্যার এর মত ব্লগ একটি সামাজিক কমিউনিটি, যেটা সমাজের একটা নির্দিষ্ট অংশকে প্রতিনিধিত্ব করেনা (যদিও বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় সিংহভাগ মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে প্রতিনিধিত্ব করেন) ।

এইরকম একটি সামাজিক কমিউনিটিতে নিজে কথা বলার সময় বা কারো উদ্দেশ্যে কথা বলার সময় অডিয়েন্স যেই ভাষায় স্বচ্ছন্দ সেই ভাষা ব্যবহারের দিকে খেয়াল করা উচিত। অডিয়েন্সের ভাষা ব্যবহার করেই তার কাছে কোন মেসেজ পৌছানো সবচাইতে সহজ। সে যেই ভাষায় পরিচিত নয়, তাকে উদ্দেশ্য করে আক্রমণের ক্ষেত্রে (তা যৌনতাকেন্দ্রিক হোক বা না হোক) সেই ভাষার ব্যবহার এক ধরণের অভদ্রতা। শব্দের ইনসেনসিটিভ এবং পরিপ্রেক্ষিত বিহীন ব্যবহার সাহসিকতা বা বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষতাকে নির্দেশ করেনা বরং ভীরুতা, নীচতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াপনা বা বোঝার অক্ষমতাকেই নির্দেশ করে। শুধুমাত্র নীচ এবং কাপুরুষরাই প্রেক্ষিত ছাড়া শব্দ ব্যবহার করে তাকে জায়েজ করার জন্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাষার সাথে তুলনা করে।

এটা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে চূড়ান্তভাবে অপমান করা ছাড়া আর কিছু নয়। এখানে অবশ্যই উল্লেখ করা প্রয়োজন কেউ যদি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাষাকে প্রেক্ষিত ঠিক রেখে ব্যবহার করে কোন সাহিত্য বা ব্লগ রচনা করেন তা কিন্তু কখনই আমার বিবেচনায় অশ্লীল বা অগ্রহণযোগ্য হবেনা । একজন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাষা ব্যবহারের উদ্দেশ্য এবং ব্লগে নানা জনকে উদ্দেশ্যে সেই সব ভাষার বিভিন্ন খন্ডাংশকে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যের পার্থক্য যদি কেউ বুঝতে না পারেন তাহলে আমার এ বক্তব্য অরণ্যে রোদন ছাড়া কিছুই হবেনা এবং সেক্ষেত্রে আপনাদের সময় নষ্ট করার জন্য দু:খিত ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.