আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জোছনা ছুঁয়ে যাই তবু

আমি কাক নই, আমি মানুষ...

বইমেলায় আমার লেখা ‌কাক' গল্পগ্রন্থের ১৪ নম্বর গল্প জোছনা ছুঁয়ে যাই তবু ব্লগার বন্ধুদের জন্য পোস্ট করলাম ঃ গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু রাতের অন্ধকার শেষ না হতেই বাঘা এসে দাঁড়াল ডাস্টবিনটার পাশে। নাহ! তার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। সারারাত মদে বুঁদ হয়ে ছিল। পার্কের বেঞ্চে পড়েছিল।

কখন রাত কেটে গেছে বলতে পারে না। আর একটু পরেই এ শহর আলোকিত হবে। তার মতো নষ্ট মানুষগুলো রুটির আশায় ছুটবে। স্বাভাবিক নিয়মেই বাঘা ঝাড়– হাতে বের হয়। পার্কের গেট ঝাড়– দেয়াই তার দৈনন্দিন কাজ।

এতে যা আয় হয় তার সবটুকুই খরচ হয় লাল পানিতে। একটা অদ্ভুত নিয়মের মাঝে জীবনের চলাচল। বাঘা পড়াশুনা জানে না। মেথর পরিবারে তার জন্ম। ঝাড়ুদার হিসেবে কেটে গেছে ২০ বছর।

একসময় সে ডাকাতি করত। তখন রমরমা যৌবন। জীবনের কোনো দিক নেই। মা-বাবা ছিল না তার। নেড়ী কুত্তার মতো গড়াগড়ি করে যৌবনের রক্তে পড়েছিল।

গরম রক্ত। টগবগে তেজের রক্ত। ডাকাতি করে তিন বছর। কাঁচা টাকায় যৌবনের তেজ আরো বাড়ে। নারীর সস্তা শরীরে তেজ কমে।

যাত্রা দেখে অলৌকিক সুখ জেগে ওঠে। রঙের পৃথিবীতে রঙের জীবন। অথচ একদিন তার হাত দিয়েই খুন হয় মানুষ। তারও খুচরা পয়সার মতো ছড়ানো বিবেক আছে। সেই ছড়ানো বিবেক ভাটিয়ালী গান ধরে।

মানুষ-অমানুষ পার্থক্য শেখায়। কিন্তু রক্তে যদি জোঁক লেগে যায়, তবে সে রক্তও চুষে নেয় অজ্ঞাত রাক্ষস। বাঘার জীবন বিচিত্র কি না জানা নেই। তবে ডাকাতি মামলায় জেল হয় তার। চৌদ্দ শিকের চৌদ্দ ফুট ঘরে কাটে ১৪ বছর।

রক্ত চুষে অজানা রক্তচোষা। ফ্যাঁকাশে জীবন নিয়ে ১৪ বছর কাটে। তারপর? তারপর সেই লাল রক্তই খেলা করে শিরা-ধমনীর জালিকায়, নয় দরজার দেহে। কিন্তু রক্তের রঙ কখন যে লাল থেকে হলুদ হয়ে গেছে তা কে জানত? ৫৬ বছরের বাঘা এখন ঝাড়–দার। নিয়মানুযায়ী জীবনের পাপ পরিষ্কার করতে সে পারেনি।

কিন্তু রোজ রাস্তা পরিষ্কার করে সে। তার জীবনের কোনো উদ্দেশ্য নেই। এ শহরে তার মতো উদ্দেশ্যহীন মানুষের সংখ্যাও অনেক। কিংবা কে জানে হয়তো অনেক কম। সেই বাঘা, ৫৬ বছরের বাঘা, অন্ধকারেই দাঁড়িয়ে যায় ডাস্টবিনটার পাশে।

অনেক নোংরা আবর্জনা পড়ে আছে ওখানে। হাজার মানুষের অপ্রয়োজনীয় জিনিস। সেখানেই পড়ে আছে একটা শিশু। মানব শিশু। জন্মপরিচয়হীন একটা শিশু।

এই শিশুর জন্মপরিচয় কেউ জানে না। এমনকি বাঘাও জানেন না। জানার কথাও নয়। তার বুদ্ধির দৌড়ে এ পৃথিবীর নিষ্ঠুর এ ঘটনা অন্ধকারেই থেকে যাবে। সে কখনো জানবে না এ শিশুর পরিচয়।

সে জানে না এ শিশুর বাবা কে? মা কে? হ্যাঁ, শিশুটির মা একজন পতিতা। কিংবা আরো নিকৃষ্টভাবে বললে বেশ্যাই বলতে হয়। কিন্তু এ শহরে বেশ্যার সংখ্যাও তো কম নয়। তবে এ শিশুর মা কোন বেশ্যা? বাঘা শিশুটির বেশ্যা মাকে চেনে না। চেনে এই শহরের ভদ্রবেশী মুখোশধারী মানুষগুলো।

ওই তো বাঘার ঝাড়– দেয়া পরিষ্কার রাস্তায় ওরা জুতা পরে হেঁটে যায়। কিংবা লাল গাড়ি হাঁকিয়ে হর্ন দেয়। হ্যাঁ, কালো কোট গায়ে দেয়া তার। জাপানি টাই গলায়। দামি ডলারে কেনা প্যান্ট।

ওই প্যান্টে একটা জিপার আছে। দুটো সময়ে এরা চট করে জিপার খোলে। দামি টাইলসে ঘেরা টয়লেটে আর অন্ধকারে এই শিশুর মায়ের সামনে। এসব ভদ্রলোক এই শিশুর বাবা। শিশুর মা নিজের পরিচয়ের জন্য ছোটেনি।

ছুটেছে পেটের জন্য। পেটের ুধার জন্য। সেখানেই তার অস্তিত্বের জন্ম। তার মা জানত না অস্তিত্বেরও একটা অধিকার থাকে। কিন্তু ভদ্রলোক খদ্দের তার।

একটুু এদিক-ওদিক হলেই ইংলিশ গালি হজম করতে হবে। অন্ধকার যে বয়ে যায়। সূর্যের আলো ফোটার আগেই পেটের চিৎকার থামাতে হবে। প্রচণ্ড ব্যথায় সারারাত কেটেছে শিশুটির মায়ের। কত ভদ্রলোক পাশ দিয়ে হেঁটে গেছে।

ফিরেও তাকায়নি। কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে বলেছে, জারজ পেট। লাথি মার। অথচ ওই জারজ পেটের জন্ম দিতেই ভদ্রলোক জিপার খুলেছিলেন। থু, ভদ্রলোক, থু।

শিশুর মায়ে ব্যথাটা প্রাকৃতিক নিয়মের। সন্তান জারজ হোক অথবা নিয়মতান্ত্রিক। মাতৃত্বের নিয়মে কোনো পরিবর্তন নেই। আকাশ-পাতালে ওলট-পালট করে এ শিশুর জন্ম। অথচ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস।

তার মতো অনেকের জন্য কত ঢোল, বাদ্য বাজনা। কত অপেক্ষা, কত স্নেহ, মায়া, মমতা। অথচ এ শিশুর জন্য কিছুই অপেক্ষা করে নেই। কোন আকাশের স্বপ্ন নিয়ে এলো তবে শিশুটি? শিশুর মা সারারাত অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলেন পার্কের নাম না জানা গাছের নিচে। আজ তার শরীর ছুতে কেউ আসেনি।

রক্তমাখা শরীর ভদ্র কুত্তা যে চাটে না। এটা নিয়ম, নির্মম সত্য, নিষ্ঠুর নিয়ম। এটি ভাঙবে কে? রাত গভীর হয়। দ্বিপ্রহরে ডেকে ওঠে শহুরে ডাহুক। নিয়ম করে আকাশ থেকে ঝড়ে পড়ে একটা তারা।

সবাই ঘুমিয়ে। এমনকি বাঘার মতো নিষ্ঠুর ডাকাত কিংবা ঝাড়–দাররাও ঘুমিয়ে অতল। অথবা গভীর আবেশে একদল সুখী মানুষের নিদ্রা। কিংবা নতুন বউয়ের আঁচলে মুখ ঢেকে গরম নিঃশ্বাস ফেলে নতুন জামাই। কেউ খবর রাখেনি।

বাতাসের গন্ধ ভারী হয়ে ওঠেনি। শুধু দূরে দুটো নেড়ী কুত্তা ডেকে উঠেছিল। কিংবা কুণ্ডুলী পাকানো জংলায় নিবু নিবু আলোয় দুটো জোনাকি উড়ে গিয়েছিল। আরো শুদ্ধ করে বললে বলতে হয়, শুধু সভ্য মানুষকে পাহারা দিতেই দুটো প্রহরী বাঁশি বাজিয়েছিল। সেই বাঁশির শব্দে সৃষ্টিকর্তার ঘুম ভেঙেছিল কি না জানা নেই।

তবে শিশুর কান্না শুরু হয়েছিল তাতে। আকাশভেদী কান্না। কবিতার ভাষায় করুণ সুরের মূর্ছনা। অথবা কবির ভাবুক দৃষ্টির ঝাপসা ক্রন্দন। শিশুর কান্নায় নুয়ে পড়া গাছের পাতা ঝড়ে পড়ে।

আকাশের শিশির ঠাণ্ডা থেকে গরম হয়। ঝি ঝি পোকার ডাক থেমে যায়। আস্তে আস্তে জ্ঞান ফিরে মায়ের। এ সমাজের চোখে অপবিত্র শরীর থেকে ঢেলে দেন পবিত্র দুধ। এটিই প্রথম, এটিই শেষ পবিত্রতা।

মা উঠে বসেন। অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখেন অস্তিত্বের চোখ। কী শান্ত! কী নীরব সে চোখ! হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেন না তিনি। তার অপবিত্র হাতের ছোঁয়ায় অমঙ্গল লেখা আছে। কিন্তু তাতেই কি মুক্তি মিলবে শিশুর? শিশুটিকে কোলে তুলে আদর করেন মা।

তারপর অন্ধকারে বুকে পাথর বাঁধেন। যদি তার পরিচয়ে এ শিশু বেঁচে থাকে, তবে তা মৃত্যুর চেয়েও অধিক। তাই রেখে আসেন ডাস্টবিনে। যদি ওখান থেকে কেউ কুড়িয়েও পায়। যদি একটা মিথ্যা পরিচয়েও সে বড় হয়, তবুও এ পরিচয়ের চেয়ে তা হবে সুখের।

ডাস্টবিনে শিশু কাঁদে না। সে দেখছে তার অপবিত্র মা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে দূরে। সারা জীবনের জন্য। অন্ধকারে মা হারিয়ে যান। মা, শিশুটির মা, একবারও ফিরে তাকায়নি পেছনে।

পেছনে তাকালেই সর্বনাশ হয়ে যাবে। পেছনে তাকালে সমাজের মুক্তি হবে, কিন্তু মনুষত্বের মৃত্যু ঘটবে। তা কি হয়? একটি অপবিত্র মায়ের কি সে সাহস আছে? কে আগে, সমাজ না মনুষত্ব? আমরা কেউ জানি না। শিশুর মা অন্ধকারে ঝুলে থাকে রশিতে। পরদিন কী হবে এ পৃথিবীতে।

আত্মহত্যার দায়ে সৃষ্টিকর্তা তাকে কোন দোজখে পাঠাবেন? নাকি বিসর্জনের পুরস্কার হিসেবে পাবেন জান্নাতুল ফেরদাউস? নাকি পাপী শরীর পুড়িয়ে দিবে অযুত-নিযুত আগুনের কণা? পর দিন হয়তো কিছুই হবে না। অজ্ঞাত পরিচয় লাশ হিসেবে শিশুর মায়ের গল্প শেষ হবে। অথবা সমাজের আপদ বিদায় হয়েছে বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলব আমরা। নাহ! এ পৃথিবী চলবে স্বাভাবিক নিয়মে। সূর্য উঠবে, পাখি ডাকবে।

যান্ত্রিক নগরে যান্ত্রিক মানুষের কোলাহল বাড়বে। কার এত নষ্ট সময় আছে? কে ভাববে এসব সস্তা ঘটনা নিয়ে? এমন অনেক কিছুই হতে পারে। কত গল্প বৃষ্টির মতো পড়ে এ শহরে। ছুঁয়ে দেখার সময় কোথায়? কিন্তু এসব গল্পের কোনোটিই জানে না বাঘা। বরং তার দৃষ্টি স্থির হয়ে যায়।

তবে কি তার মতো হতভাগ্য অভাগা আরো একটি জন্ম নিল? এ পৃথিবী শিশুকে কী দেবে? সে বড় হবে। তীব্র ঘৃণার সমাজ তার মুখে থু থু ছিটাবে। নাহ! এমন নিষ্ঠুর পরিণতির দিকে শিশুকে টেলে দেয়া যায় না। বাঘার চোখ চকচক করে ওঠে। তার হত্যাকারী হাত নড়ে ওঠে।

এখনি এ শিশুকে মুক্তি দিতে হবে। এ সমাজের হিংস্র থাবা থেকে রক্ষা করতে হবে তাকে। সভ্য মানুষের থু থু তার পবিত্র শরীরে পড়ার আগেই তাকে চলে যেতে হবে। বাঘা শিশুকে কোলে তুলে নেয়। আস্তে আস্তে দু’হাত দিয়ে গলা চেপে ধরে।

হাতের রগ শক্ত হয় তার। পাপী রক্ত চিৎকার করে ওঠে। গভীর অন্ধকার থেকে আলো বেরিয়ে আসছে। আস্তে আস্তে অন্ধকারের পরাজয় ঘটছে। হাত দুটো অবশ হয়ে আসছে তার।

পাপী রক্তের ডাক কি তবে থেমে গেছে। ভোরের আলোয় চকচক করছে শিশুর চোখ। শিশুটি হাসছে। বাঘা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বহু বছর পর তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু।

কে জানে হয়তো এ অশ্রু পবিত্র। ভোরের আলোয় সে অশ্রু কি শিশুটি দেখছে? এমন পবিত্র আলোয় কোনো পবিত্র শিশুকে হত্যা করা যায় না।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।