আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের আরো ক’জন আবদুল্লাহ আল-মুতী দরকার

হয়তো আমি কোন কিছু সম্পর্কে নিশ্চিত নই

বিজ্ঞান শিক্ষার ধারণা বাংলাদেশে যারা সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট করে তুলেছিলেন, আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন তাদের একজন। বাংলাদেশের বিজ্ঞান শিক্ষা ও বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে তিনি একজন অগ্রপথিক হিসেবে যেমন দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তেমনি এ কাজে তাঁর উত্তরসূরী তৈরিতেও তিনি ছিলেন সদা সচেষ্ট। নিরলস কর্মপ্রচেষ্টার মধ্যদিয়ে তিনি সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন বিজ্ঞানের চেতনা। বিজ্ঞান বিষয়ে পড়া এবং বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া- দুটো যে এক বিষয় নয়, সে কথাটি তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে বুঝাতে চেয়েছেন। যদিও খুব কম মানুষই এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছে।

ফলে এখনো দেখা যায়, বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করার পরও কেউ কেউ প্রচলিত কুসংস্কার নিয়ে মেতে থাকেন, সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের সময় কোনো ধরনের খাবার খান না, প্যারাসাইকোলজির মতন নিয়ে মেতে থাকেন দিনের পর দিন। কেউ কেউ কুসংস্কারগুলোকে ব্যাখ্যা করতে চান বিজ্ঞানের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে। যতো দিন যাবে মানুষ ততো এসব কুসংস্কার ছেড়ে বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠবে, বিজ্ঞানচেতনার আলোকে জীবনেক সাজাতে সক্ষম হবে, এমন আশা করা হলেও এর কোনো প্রতিফলন আজকে দেখা যায় না। যে শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা বেড়ে উঠছি, সেই শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন দুর্বলতার কারণে বিজ্ঞানকে আজ প্রযুক্তির বাইরে নিয়ে যেতে পারি নি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে সমার্থক করে দেখছি।

ফলে নিত্যনতুন প্রযুক্তি আবিষ্কারের পাশাপাশি মানুষের বোধকে যুক্তিসম্মত করা, চিন্তাচেতনাকে সুগঠিত করে বিজ্ঞানভিত্তিক ও পর্যাক্রমিক ধারাবাহিকতার মধ্যদিয়ে জীবনাচরণ প্রতিষ্ঠা করা- সে বিষয়টিই উপেক্ষিত থাকছে আজকের সমাজে। আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন কাজ করেছেন ঠিক এই জায়গাটিতেই। প্রচলিত বিজ্ঞানকে তিনি যেমন সাধারণ মানুষের আঙ্গিনায় নিয়ে এসেছিলেন, তেমনি বিজ্ঞানকে কীভাবে নিজ জীবনের প্রভাবক হিসেবে কাজে লাগাতে হবে, সে বিষয়েও তিনি ছিলেন সমানভাবে সোচ্চার। তাঁর মৃত্যুর পর যেভাবে অন্যদের এগিয়ে আসার দরকার ছিলো, তেমনটা আসলে দেখা যায় নি। এখনো অনেকে এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছেন।

কিন্তু তাঁদের সংখ্যা খুবই কম। বর্তমান এই বন্ধ্যা সময়ে আবদুল্লাহ আল-মুতীর মতো স্বচ্ছধারণাসম্পন্ন ও কর্মোন্মুখ ব্যক্তির সংখ্যা বাড়াটা অনেক জরুরি। না হলে দেখা যাবে, নিত্যনতুন প্রযুক্তি আমরা ব্যবহার করছি ঠিকই, সেই সাথে ধ্যানধারণায় রয়ে যাচ্ছি পুরনো যুগে। আবদুল্লাহ আল-মুতীর সংক্ষিপ্ত জীবনী: পুরো নাম: আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন জন্ম: ১ জানুয়ারি ১৯৩০ জন্মস্থান: সিরাজগঞ্জের ফুলবাড়ি গ্রামে মাতা: হালিমা শরফুদ্দিন পিতা: শেখ শরফুদ্দিন শিক্ষা: মাধ্যমিক- সরকারি মুসলিম হাই স্কুল, ঢাকা। ১৯৪৫ সালে ঢাকা বোর্ডের প্রবেশিকা পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধাতালিকায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন।

উচ্চ মাধ্যমিক- ঢাকা কলেজ। ১৯৪৭ সালে আইএসসি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধাতালিকায় প্রথম স্থান অর্জন। স্নাতক (সম্মান)- পদার্থবিদ্যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৫২ সালে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ।

স্নাতকোত্তর- পদার্থবিদ্যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৫৩ সালে পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন। পরে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬২ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ। তাঁর অভিসন্দর্ভ ছিলো: Curriculum Change in Pakistan with Special Reference to High School Science Education. কর্মজীবন: লেখালেখি শুরু ছাত্রজীবন থেকেই।

১৯৪৭ সালে মুকুল ফৌজ আন্দোলনে যোগ দিয়ে পরবর্তী বছরে ‘মুকুল’ নামে কিশোর পাক্ষিক পত্রিকা বের করেন। কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার মেলার প্রতিষ্ঠাতা। ‘ইত্তেফাক’, ‘আজাদ’, ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন। আনুষ্ঠানিক পড়ালেখা শেষ করে অধ্যাপনায় যোগ দেন। ১৯৭৫ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যুগ্মসচিব হিসেবে যোগ দেন।

পরবর্তীকালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৮৬ সালে সরকারি চাকুরি থেকে অবসরগ্রহণ করেন। সভাপতি, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ (১৯৮৮-৯০) ও বাংলা একাডেমী, ঢাকা (১৯৮৬-৯০)। প্রধান উপদেষ্টা, প্রথম ঢাকা মহাকাশ উৎসব ‘বেক্সিমকো স্পেসফেস্ট ১৯৯৬’, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের দশম বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটি (১৯৯৮), উপদেষ্টা, দ্বিতীয় ঢাকা মহাকাশ উৎসব ‘স্পেসফেস্ট ১৯৯৯’। প্রধান উপদেষ্টা, ঢাকা প্রস্তাবিত স্পেস সেন্টার, উপদেষ্টা, মেঘনাদ সাহা বিজ্ঞান তথ্যকেন্দ্র ও গ্রন্থাগার (১৯৯৭-৯৯)।

রাজনৈতিক জীবন: যৌবনে বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৮ ও ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গ্রেফতার হয়েছিলেন। পরে রাজনীতি ছেড়ে দেন। প্রকাশিত গ্রন্থ: শিশু ও বিজ্ঞান-বিষয়ক: এসো বিজ্ঞানের রাজ্যে (১৯৫৫), অবাক পৃথিবী (১৯৫৫), আবিষ্কারের নেশায় (১৯৬৯), রহস্যের শেষ নেই (১৯৬৯), বিজ্ঞান ও মানুষ (১৯৭৫), জানা-অজানার দেশে (১৯৭৬), সাগরের রহস্যপুরী (১৯৭৬), আয় বৃষ্টি ঝেঁপে (১৯৮০), এ যুগের বিজ্ঞান (১৯৮১), মেঘ বৃষ্টি রোদ (১৯৮১), ফুলের জন্য ভালোবাসা (১৯৮২), সোনার এই দেশ (১৯৮৩), তারার দেশের হাতছানি (১৯৮৪), বিচিত্র বিজ্ঞান (১৯৮৫), বিপন্ন পরিবেশ (১৯৮৫), প্রাণলোক: নতুন দিগন্ত (১৯৮৬), বিজ্ঞানের বিস্ময় (১৯৮৬), ছবিতে আমাদের পরিবেশ (১ম ভাগ-১৯৮৭, ২য় ভাগ-১৯৯০), টেলিভিশনের কথা (১৯৮৮), বিজ্ঞান-জিজ্ঞাসা (১৯৮৮), কীটপতঙ্গের বিচিত্র জগত (১৯৮৮), কাজী মোতাহার হোসেন (১৯৮৮), বিজ্ঞান এগিয়ে চলে (১৯৯১), চোখ মেলে দেখ (১৯৯২), ফারিয়া-নাদিয়ার মজার সফর (১৯৯৬), পরিবেশের সংকট ঘনিয়ে আসছে (১৯৯৬), আজকের বিজ্ঞান ও বাংলাদেশ (১৯৯৬), মহাকাশে কী ঘটছে (১৯৯৭)। শিক্ষা-বিষয়ক: শিক্ষা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (১৯৭৫), শিক্ষা ও বিজ্ঞান- নতুন দিগন্ত (১৯৯১), আমাদের শিক্ষা কোন পথে (১৯৯৬)।

অনুবাদ: আকাশের সঙ্গে মিতালী (১৯৫৬), মহাবীর পরমাণু (১৯৫৭), রহস্যটা জানতে হবে (১৯৫৮), সেকালের জীবজন্তু (১৯৫৮), তাপ (১৯৫৮), আলো (১৯৬১), শিক্ষা ও জাতীয় উন্নয়ন (১৯৬৫), বিশ্বসৃষ্টির মালমসলা (১৯৬৫), পরমাণুর রাজ্যে (মিনা শরফুদ্দিনের সঙ্গে, ১৯৭১)। অপ্রকাশিত গ্রন্থ: কম্পিউটারের আশ্চর্য জগত। সম্পাদনা: আধুনিক বিজ্ঞান (১৯৬৮), সাধারণ বিজ্ঞান ২য় খণ্ড (১৯৮৩), বাংলাদেশের বিজ্ঞান চিন্তা (১৯৮৮), আজকের বিজ্ঞান, সংবাদপত্রে বাংলাভাষা (যুগ্ম-সম্পাদনা, ১৯৮৯), Education for All (1968), Education is Progress (1969), Improvement of Teacher Education (1969), Cooperation of Education, Science and Culture in South Asian Region (Joint Editor, 1987), Role of UNESCO in Scientific and Technological Development (Joint Editor, 1988), বাংলা একাডেমীর বিজ্ঞান বিশ্বকোষ (প্রধান সম্পাদক, ১ম খণ্ড), মাসিক কম্পিউটার বিচিত্রা (প্রধান সম্পাদক), শিশু একাডেমীর শিশু বিশ্বকোষ (বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ)। পুরস্কার: শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য টিকিউএ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার (১৯৬৯), লোকশিক্ষামূলক সাহিত্যে ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬৯), সাহিত্যের জন্য ইউবিএল পুরস্কার (১৯৬৯), বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৫), ড. কুদরাত-এ-খুদা স্বর্ণপদক (বিজ্ঞান-বিষয়ক রচনার জন্য, ১৯৭৯), শিক্ষার জন্য জিয়াউর রহমান জাতীয় পুরস্কার (১৯৮১), শিশু সাহিত্যের জন্য শহীদুল্লাহ কায়সার স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮২), শিশু সাহিত্যের জন্য শাব্বির ফাউন্ডেশন পুরস্কার (১৩৮৩), বিজ্ঞান জনপ্রিয় করার বিষয়ে ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক কলিঙ্গ পুরস্কার (১৯৮৩), শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান রাখায় বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক (১৯৮৫), আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৫), কাজী মাহাবুবউল্লাহ পুরস্কার (বিজ্ঞান, ১৯৮৭), শিশু সাহিত্যে বিজ্ঞানের জন্য অগ্রণী ব্যাংক পুরস্কার (১৩৮৮, ১৩৯৪, ১৪০২), বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ কীর্তির জন্য ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী পুরস্কার (১৪০০), প্রযুক্তি জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে আইডিই পদক (১৯৯৩), বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯৫), শিশু একাডেমীর শিশু সাহিত্য পুরস্কার (১৪০৩)। (এই লেখাটি তৈরি করতে বিভিন্ন বই, ম্যাগাজিন ও সংবাদপত্রের সাহায্য নেওয়া হয়েছে।

তথ্যে কোনো ভুল থাকলে বা অসম্পূর্ণ তথ্য থাকলে জানালে তা সংশোধন করা হবে। )


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।