আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

'আমাকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা না হয়'

munirshamim@gmail.com

'আমাকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা না হয়'-গত কালের দৈনিক প্রথম আলোর ভেতরের পাতায় একটি বক্স নিউজ এর শিরোনাম ছিল এটি। মূলধারার অনেক সংবাদের পাশে হয়তো অনেকের চোখে পড়েনি এ সংবাদটি। যেমনটি আমাদের চোখে পড়েনি, চোখে পড়ে না এবং এখনও পড়ছে না গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য বীর মুক্তিযোদ্ধার কষ্টের দিনগুলো, একটু খেয়ে পরে বেঁচে থাকার প্রাত্যহিক সংগ্রামে টিকতে না পেরে অভিমানে তাদের ক্রমাগত চলে যাওয়াটা। আমাদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত আমাদেরই বীর পূর্বসূরীদের প্রস্থানের প্রক্রিয়াটা। গত কালের প্রথমআলো পত্রিকায় এক সমূদ্র ক্ষোভ আর অভিমানী হৃদয়ে এ স্বত:স্ফুর্ত বক্তব্যটি দিয়েছেন, বরিশালের গৌরনদীর উপজেলার আহত মুক্তিযোদ্ধা মো: বাদশা মিয়া।

৭১ এর বীর মুক্তিযোদ্ধা বাদশা মিয়া আজ বয়সের ভারে ক্লান্ত। ম্রিয়মান। চোখের চশমার ফ্রেমও ভীষণ ভারী। সাথে চশমার গ্লাস দুটোও। চশমার ভারী ফ্রেম, ভারী গ্লাস আর অভাবের সাথে লড়াইয়ে হেরে যাওয়া ফেলা আসা দিনগুলো যেন জীবন্ত হয়ে প্রতিদিন মনে করিয়ে দেয় বাদশা মিয়াকে- বাকি দিনগুলো তার জন্য আরও কঠিন।

আরও কষ্টের!!! অথচ এ বাদশা মিয়াই তার তারুন্য ও যৌবনের সমস্ত সম্ভাবনার পুঁজিকে একদা ঢেলে দিয়েছিলেন আমাদের মুক্তির সংগ্রামে, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে..। অন্য সব মুক্তি সংগ্রামীর মতোই চোখে তার স্বপ্ন ছিল। সে স্বপ্ন শুধু একটি ভুখন্ডের জন্য নয়, সে স্বপ্নের আকুতি ছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য। যে রাষ্ট্রটি কোনভাবেই সংখ্যালগিষ্ট সুবিধাভূগী শাসকের হবে না। বরং এটি হবে সংখ্যাগরিষ্ট গণমানুষের।

নারী ও পুরুষের। ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সকল মানুষের। রাষ্ট্রটি হবে সমতার। মুক্তি সংগ্রামী লাখো মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে, প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। এ রাষ্ট্রে একটি ন্যয্য ও শক্তিশালী স্বপ্রণোদিত অর্থনীতি থাকবে।

রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে স্বাধীন এ রাষ্ট্রে সকল মানুষ মানবিক মর্যাদা নিয়ে জীবন যাপন করবে। বুকের ভেতরে পুষে রাখা প্রিয় মাতৃকার জন্য অপার এ সম্ভাবনাগুলোর স্বপ্ন নিয়ে বাদশা মিয়ারা অপেক্ষা করেই পার করে দিয়েছেন গত তিনটি দশক। জীবনের সবচেয়ে বর্ণীল দিনগুলো। এখন বাদশা মিয়াদের নিজেদের জীবনটাই যেন আধারে ঢাকা। জীবনের হিসেব খাতায় কেবলই চোখে পড়ে অপ্রাপ্তি আর বেদনার চিহ্ন।

বাদশা মিয়াদের সহায়তায় কোন অর্থবোধক ও কার্যকর সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসেনি রাষ্ট্র। এগিয়ে আসেনি সরকার। নিভৃত গ্রাম থেকে বাদশা মিয়ারা তাদের চোখের সামনে পর্যবেক্ষণ করেছেন, লুটপাটের রাজনীতি আর অর্থনীতি। নতুন ধনিক শ্রেণীর বেড়ে উঠা। দেখেছেন বাদশা মিয়াদের ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে রাজাকার পুনর্বাসন প্রক্রিয়া।

দেখেছেন রাজকার অর্থনীতির উন্নয়ন। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশে মৌলবাদী অর্থনীতির (যা প্রকৃত পক্ষে রাজকার অথবা তাদের সমর্থকদের দ্বারা পরিচালিত অর্থনীতি) বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার শতকরা দশ ভাগ বা তার চাইবে বেশি। অথচ আমাদের জাতীয় অর্থনীতির বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার তার চেয়ে অনেক কম। একটি স্বাধীন গবেষণা পরিচালিত হলে আমরা নিশ্চিত করে দেখতে পাবো যে, গত তিন দশকে যে মাত্রায় স্বাধীনতা বিরুধীরা আমাদের জাতীয় রাজনীতি ও অর্থনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছেন ঠিক সে মাত্রায় বা তার চেয়েও দ্রুত গতিতে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তির অর্থনৈতিক অসহায়ত্ব ও দারিদ্রায়ন প্রক্রিয়া তরান্বিত হয়েছে। একদিকে মুক্তিযোদ্ধা বাদশা মিয়ারা না খেয়ে, না পরে অভাবে দিন যাপন করছেন।

অপরদিকে তাদেরই রক্তে অর্জিত দেশে রাজাকাররা একটি নিজস্ব অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ভিত তৈরি করে তার ওপর দাঁড়িয়ে মহাবিক্রমে মুক্তিযুদ্ধকে গোন্ডগোল, গৃহযুদ্ধ আখ্যা দিতে সামন্যটুকু দ্বিধা করছে না। এ রকম অবস্থায় ৭১ এর বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধা অথচ জীবন যুদ্ধে ক্রমাগত হেরে যাওয়া একনজ দেশ প্রেমিক বাদশা মিয়া আর কী দিয়ে নিজের আবেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারেন!! হয়তো এ জন্যই তিনি বলেছেন-আমাকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় যেন দাফন করা না হয়। আমরা জানি না আর কত মুক্তিযোদ্ধা এ ভাবে জীবন যুদ্ধে হেরে অভিমানে চুপ করে বসে আছেন। আর এ প্রজন্মের জন্য, আমাদের জন্য মনে মনে করুণা করছেন। এ করুণার ভার নিয়ে আমরা সত্যি কি এগুতো পারবো।

সত্যি কি এগুতো পারবো? বিজয়ের মাসে এ জিজ্ঞাসা অন্তত শুরু হোক আমাদের সকলের মাঝে.........।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.