আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পরীক্ষাকালীন রোজনামচা

জীবন গঠনে নিজেস্ব প্রতিক্রিয়ার দায় বেশি, ঘটে যাওয়া ঘটনার ভূমিকা সামান্য।

নভেম্বর ২, ২০০৭ সেমিস্টারের শেষ দিন। ও আল্লা! সেমিস্টার ফাইনাল... মা গো, আমার তো কিচ্ছু পড়া হয় নি! বুকে চাপ হয়ে থাকা তীব্র অপরাধ বোধ নিয়ে ডায়রী খুলে ঝট পট প্ল্যান করে ফেললাম। তিন দিন এন্ডোক্রাইন ফিজিওলজি, পারসেপশনে দুই দিনই হবে, এনাটমিতে দুই দিন লাগবেই... আহ, কি দারুন প্ল্যান হয়ে গেল! এইবার আমার দৌঁড় ঠেকায় কে! নভেম্বর ৩, ২০০৭ ঘোর বৃষ্টিতে এট্টু (এই ঘন্টা কয়েক) চ্যাট কর্লাম ইয়াহুতে। তারপর পড়তে হবে বলে বহুত জোশ নিয়ে উঠে গিয়ে বসলাম।

টেবিলে না, টিভির সামনে। মীরা এসে জিজ্ঞাসা করলো টিভি দেখছি কেন, আমি গম্ভীর মুখে জবাব দিলাম-- দেখ, আমার এখন ছুটি। সারা সেমিস্টারে গরু খাটার পরে শেষ মেষ ছুটি হলো, এখনও টিভি দেখতে দিবি না? তুই মানুষ? মীরা লজ্জিত, বিমর্ষ এবং অনুতপ্ত হলো। আমার পড়াশোনা হচ্ছে না তাতে কি, প্ল্যান তো আছে! নভেম্বর ৪-১১, ২০০৭ পড়াশোনার খেতা-বালিশ-লেপ তোষক পুড়িয়ে ড্রাইভিং পরীক্ষা দিলাম। তারপর, লাইসেন্সের আনন্দে ভাসলাম।

ছুটি। তাই টিভি দেখলাম। উদ্ভট সব অনুষ্ঠান বিষদ মনোযোগে দেখলাম। প্রতিদিন দুপুরে বিশাল আয়োজনে রান্না করলাম, খেলাম, অপরকে খাওয়ালাম। তারপর ঘুম দিলাম।

'ফ্রেশ হয়ে পড়তে বসবো'। ঘুম থেকে উঠে, খেয়ে দেয়ে টেবিলে আসতে আসতে আরেক ঘুমের সময় হয়ে যায়। বই খুলতেই হাই উঠে। ধুর এভাবে পড়া যায়? আচ্ছাসে এক ঘুম দিয়ে উঠে তারপর শুরু করতে হবে পড়া... নভেম্বর ১২, ২০০৭ সকাল--ও আল্লাহ, কালকে নাকি আমার পরীক্ষা? দুপুর--প্লীজ, কেউ একজন সময়কে থামিয়ে দাও! রাত এগারোটা--উপস। আমি তো পড়ছি বায়োকেমিস্ট্রি থিওরীর জন্য।

পরীক্ষা তো প্র্যাকটিক্যাল! ড্যাম! ভাইয়াকে বলায় ও অদ্ভূত চোখে তাকালো। নভেম্বর ১৩, ২০০৭ পার মনে হয় পেয়েই গেলাম! এই বার আল্লাহ মায়া করে ছেড়ে দিয়েছে, পরের বার সোজা মারবে। বাসায় গিয়ে খুবসে পড়া দিতে হবে... আর না! বাসায় ফিরে 'একটু ফ্রেশ' হওয়ার জন্য টিভি ছেড়ে বসে গেলাম। মুভি দেখলাম ঘন্টা দুই। যেটা দেখলাম, সেটা এখন আমার সবচেয়ে প্রিয় মুভ্যির তালিকায়! 'বিফোর সানরাইজ' দেখে একে ওকে ফোন করে গদ গদ কণ্ঠে দেখার জন্য চাপাচাপি করলাম।

মেয়েটাকে আমার নিজের ফ্রেঞ্চ ভারশন মনে হলো। খুব জানা দরকার কয় জন মুভ্যিটা দেখে ভালোবাসে! নভেম্বর ১৫, ২০০৭ বায়োকেমিস্টি পরীক্ষা। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। নভেম্বর ১৬, ২০০৭ তিন দিন ছুটি! কত্ত সময়! পুরা সময় পড়লে আমার মহিলা আইনস্টাইন হওয়া কে থামায়? এত কে পড়ে, এক্টু ব্লগাই, এক্টু টিভি দেখি। এক্টু খবর পড়ি।

নভেম্বর ১৮, ২০০৭ রাত এগারোটা থেকে সিরিয়াস হলাম। এক গ্লাস দুধে দেড় চামচ কফি আর তিন চামচ চিনি মিশিয়ে ঢক ঢক করে গিলে খেলাম। সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহষ্পতিবার। চার দিন পরীক্ষা! এবার বোধ হয় কানা গলি এসেই গেল! সারা সেমিস্টার পড়ে যদি পরীক্ষার আগে রিভিশনের জন্য নৌকা তলিয়ে যায়... কি লজ্জা! কি ভয়ংকর! নভেম্বর ১৮ (বাকি রাতটুকু), ১৯, ২০, ২১, ২২ (সকাল) ২০০৭ কানা গলির ডরে, রুদ্ধ শ্বাসে, গলা ফাটিয়ে পড়লাম। আকাশ কাঁপিয়ে, বাতাস কাঁপিয়ে।

চা গিলে, কফি গিলে। দিনে তিন ঘন্টা ঘুমিয়ে, বাকি সময়ে বড় চোখে জেগে থেকে। নভেম্বর ২২, ২০০৭ পরীক্ষা শেষ আজকে। হল থেকে বের হয়ে মনে হলো, ব্যাপারটা আসলে অতটা খারাপ ছিল না! পড়াশোনাটা তো বেশ মজাই যাচ্ছিল, এখন আবার তিন মাসের জন্য নো পড়াশোনা? বুক থেকে ভারি এক দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো। পড়াশোনা থাকায় ফাঁকিবাজি করা আর পড়াশোনা না থাকায় বিটলামি করা--দু'টো কি কখখনও এক হতে পারে? কখখনও না! বাইরে ঘোর বৃষ্টি হচ্ছে।

আমার সারা শরীর ভেঙে আসছে। নিদ্রাহীন রাতগুলো, ক্যাফেইনে মাতাল, তিতা কোষগুলো আর খেটে মরা পেশীগুলো একটু ঘুম চাচ্ছে। মাথার নিউরনগুলো চিৎকার করছে। আমি বিছানায় গড়াতে ভয় পাচ্ছি। একবার বিছানায় পড়লে আর উঠতে পারব না।

আমার চোখের কোনের ল্যাকরিমাল গ্ল্যান্ডে অশ্রু থাকে না, ওখানে ঘুম থাকে। কম্প্রেসড জিপ ফাইল হিসেবে জমে যায় বকেয়া ঘুম। তারপর সুযোগ বুঝে বাঁধ খুলে দেয়। ঢল নামে, পাহাড়ী ঝরণার চেয়েও নিষ্ঠুর। যত যাই হোক, ঝুম বৃষ্টিতে ঠান্ডা ঠান্ডা বিছানায় বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে অপরাধবোধহীন, এক বুক তৃপ্তি নিয়ে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে যাওয়ার লোভ আর সামলাতে পারছি না!


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।