আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চড়িয়া মানব গাড়ি, যাইতেছিলাম বন্ধুর বাড়ি, মধ্যপথে ঠেকলো গাড়ি উপায় বুঝি মেলেনা...

অনেকের মাঝেও একা থাকা যায়, নি:সঙ্গতায় কারো অনুভব ছুঁয়ে যায় ...

'প্রথম আলো'র (৯ই নভেম্বর ২০০৭) প্রথম পাতার খবরগুলো বেশ গরম গরমই ছিল - মেয়র তৈয়েবুরের চাঁদাবাজি ঘটনার স্বীকারোক্তিমূলক বিবরণ, দিনাজপুরের ৪৬ একর আয়তনের মাতাসাগর দিঘি খালেদা জিয়ার পরিবারের হাত ঘুরে সাবেক প্রতিমন্ত্রী পটলের হস্তগত হওয়ার আদ্যোপান্ত। বিকেলের চায়ের টেবিলের সাথে এসব কুড়মুড়ে খবরগুলোকে ছাপিয়ে আমার চোখ স্থির হয় পত্রিকার ডানদিকে, ভ্রু কিঞ্চিত কুঞ্চিতও হয় - " রাজধানীতে আসছে নতুন পাঁচ হাজার সিএনজি চালিত অটোরিকশা" !!! পরিবারের ছোটদের আদর বেশী থাকে বটে কিন্তু সিরিয়াস ব্যাপারগুলোতে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কম থাকে। কথাটা বললাম এই কারনে যে, আমার মনোযোগী চোখ উপেক্ষা করে বরাবরের মতই ভাইয়া এসে পত্রিকাটি নিয়ে গেল। মেজাজ গরম; খবরটা পড়া হলোনা। মাথায় মধ্যে ব্যাপারটা খচখচ করছিল।

অবশেষে আজকে একটু অবসরে কয়েকদিন আগের সেই বাসি খবরের কাগজটি খুঁজে বার করলাম। বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে আনা ১০৮টা নীলপদ্ম হাতে পেলে আমার অনুভূতি কি হত জানিনা; তবে এই মুহুর্তে পত্রিকা হাতে আমি বড়ই উত্সুক। আবেদনকারীর সংখ্যা নাকি ৫০০০ এরও অধিক ছিল। বিআরটিএ -এর চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে বিলি-বন্টন সংক্রান্ত কমিটি নতুন ৫০০০ সিএনজির নিবন্ধের সুপারিশ করেন । এরকম সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে খুবই স্বাভাবিকভাবে অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি।

প্রশ্ন হলো এই সিদ্ধান্ত কতটা সময়োপযোগী ? কোন জরিপের উপর ভিত্তি করে এরকম সিদ্ধান্ত নেয়া হলো ? ৫০০০ সিএনজি যখন ঢাকার রাস্তায় নামবে তখন যানযট পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ? আজকাল সকাল বেলা ভলভো বাসে করে মিরপুর সাড়ে এগার থেকে মিরপুর-১০ পার হতেই নিদেন পক্ষে ৩০ মিনিট লেগে যায়। এরপর তো আছে বিজয় স্বরনী, ফার্মগেটের জ্যাম। ৫ মিনিটের দেরী ২০ মিনিটের ভোগান্তি ডেকে আনে প্রতিদিনই । অফিসে দেরী করে পৌঁছে একটা অস্বস্তিমাখা হাসি দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠেছি। অফিস আওয়ারে সিএনজি স্কুটার /ক্যাব ভাড়া করতে গেলে যে সমস্যাটা হয় সেটা হলো , তারা যেতে রাজি হয়না ।

যদিওবা কেউ রাজি হয় তখন আবার আরেক আব্দার- মিটার থেকে ১০ টাকা বাড়িয়ে দিতে হবে। তর্ক-বিতর্ক করে পারা যায়না, ড্রাইভারদের আওয়াজ বেশী জোরালো- "কইতে হয়না, ৫-১০ টাকা এমনিই দেয়, এইটাই নিয়ম..." । হাতে সময় কম থাকলে কিনবা বাজার-সদাইয়ের ব্যাগের ভাড়ে হাত ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হলে এরকম আব্দার রক্ষা করি। কয়েক সপ্তাহ আগে, প্লাস্টার বাঁধা, মচকানো পা নিয়ে বাধ্যগত কর্মীর মত অফিস পথে রওনা দিলাম। ভাবলাম কি দরকার বাসের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার! তারচেয়ে একটা সিএনজিই নিয়ে ফেলি।

সকাল বেলা স্বভাবতই সিএনজি স্কুটার/ক্যাব চালকরা পুরো মাত্রায় টপ গিয়ারে থাকে। তাদের আব্দারগুলোও তাই প্রশস্ত হয়। ১০ টাকা নয় ; নির্দিষ্ট অংক ভাড়া হিসেবে দাবী করা হয়। আমি এক সিএনজি স্কুটার ড্রাইভারকে কোথায় যেতে চাই বলতেই জানাল - ১০০ টাকা । আমি বললাম, "আপনার মিটার নাই ?" ড্রাইভার বলে , "এই সময় মিটারে কেউ যাইবনা; আপনি যাইবেন কিনা কন ?" এই চালক যদি ঠিকমত মিটারে রওনা দিত তাহলে রিডিং -এ ১০০ টাকা উঠলেও তা দিতে আমার কোন আপত্তি হতোনা।

কিন্তু আমার মেজাজ চড়ে যায়; ভাবি দু'য়েক দিন আরাম-আয়েশ করার কোন দরকার নেই । আমার জন্য বাসই শ্রেয়। আমি, "যাব না" বলে ঘুরে বাস স্ট্যান্ডের দিকে রওনা দিলে, পেছন থেকে মনে হলো স্কুটার ড্রাইভার আমার ভাড়া দেয়ার সামর্থ্য নিয়ে কোন তাচ্ছিল্যসূচক মন্তব্য করল। বেশ কয়েকমাস আগে মিটিং-সিটিং করে সিএনজি স্কুটারের ভাড়া বাড়ল; শোনা গেল তাদের মনিটর করা হবে অযথা ভাড়া বেশী আদায় করা হচ্ছে কিনা; গন্তব্যে যেতে চাইছে কিনা ঠিক মত ইত্যাদি । প্রথম দিকে তেমন জোড়ালো ভাবে না হলেও ক্ষেত্র বিশেষে আমার মনে হয় মনিটরিং ঠিকই হয়েছিল।

কিন্তু এখন পরিস্থিতি হলো - যেই লাউ সেই কদু মার্কা। স্কুটার চালকেরা ৫-১০ টাকা বেশী চাইবেই; তার উপর আবার সব জায়গায় যেতেও চাইবে না কয়েকটা রুটের বাস ছাড়া বাকি সব বাস ঝরঝরা টাইপের। শীতকালে না হয় সমস্যা নেই; কিন্তু গরম কালটা প্রতিদিনের যাতায়াতকে নরকের শাস্তি করে তোলে । তার উপর আবার বাস স্টপেজ নেই ঠিক মত; ইদানীং কিছু বাস স্টপেজ করা হয়েছে ছোট ছোট আকারের, কিন্তু ফুটপাতগুলোর যে অবস্থা তাতে বেশী ক্ষন দাঁড়াবার জো থাকেনা। আমার একবার মনে হলো একটু গুগল সার্চ দিয়ে দেখি আমাদের দেশে ট্রান্সপোর্টেশন -এর কি অবস্থা ।

তেমন কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না ; ভাবলাম, তারচেয়ে আমার দেখা প্রতিদিনের অভিজ্ঞতাগুলোই পুঁজি হোক আমার আজকের লেখার। নিত্যদিনের যানজট নিরসনে সরকার বহু চেষ্টা করছেন; কিন্তু ফল আসছেনা আশাপ্রদ। আমরা একবার চোখ বুলিয়ে নিই সম্ভাব্যকারণগুলোর দিকে- ১. আমারদের শহরমুখী মনোভাব; গার্মেন্টস থেকে শুরু করে সরকারী অফিস এবং আই.টি সেক্টর সহ সব বড় বড় ব্যবসায়িক এমন কি বিনোদনধর্মী কার্যালয়গুলোর বেশীর ভাগই ঢাকা কেন্দ্রীক। এতে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ আসছে তার পরিবারবর্গ নিয়ে; বাড়ছে বস্তি; ঘরবাড়ী। স্বাভাবিকের চেয়ে চেয়ে ঢাকা এখন অনেক বেশী সংখ্যক জনসংখ্যা ধারন করছে।

২. রাস্তার প্রস্থসহ বিভিন্ন রুটের অলটারনেটিভ রাস্তার অভাব যানজটের অন্যতম কারণ। আমি প্রতিদিনই চোখের আন্দজে বুঝি, মিরপুরের রাস্তায় ভলভো সহ যখন আরো ৪-৫ টা রুটের বাস একসাথে চলাচল করে তখন কচ্ছপ গতিতে বাহনগুলোর এগুনোই স্বাভাবিক। ৩. বাস থামার জন্য নিদিষ্ট কোন বাস স্টপেজ নেই বেশীর ভাগ বাসেরই। নামার সময় বাস ঠিকমত থামেওনা; উঠার সময়ও না; এটা অনেকটা মর্জিমাফিকই হয়। ৪. পাবলিক বাসগুলো পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নয় সব শ্রেণীর মানুষের কাছে ।

যার কারণে স্কুটার/ক্যাবের পেছনে ছুটতে হয়; দৈনন্দিন চলাচলে এসব খুচরো একেকটি যানবাহন লোক বহন করছে কম কিন্তু রাস্তা দখল করছে তুলনামূলকভাবে বেশী । ৫. আন্ডারপাস, ফুটওভার, ফুটপাথ - এগুলো সবসময় বেশ নোংরাই থাকে। কারওয়ান বাজার আন্ডারপাসে বৃষ্টি হলে সিঁড়ির নীচে পানি জমে দুর্গন্ধময় পরিবেশ সৃষ্টি করে। তাই এসব প্রয়োজনীয় চলাচল মাধ্যমগুলো অনেকেই এড়িয়ে যেতে বাধ্য হয়। ৬. মহাখালী ফ্লাইওভার একসময় আসলে বেশ ভালই দিবা স্বপ্ন দেখিয়েছিল।

সকালে অফিস যাওয়ার সময় এবং বিকালের পর অফিস ছুটি হলে ফ্লাইওভারের ওঠা-নামার ঢালে জ্যাম লাগবেই । কিছু কারণ যেহেতু বলেছি, তার কিছু প্রতিকার নিয়েও চিন্তা করেছি বটে- ১. অফিস, ব্যবস্যা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। দলে দলে মানুষ জনের গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা কে নিরুতসাহিত করতে হবে। তাতে বস্তি সংখ্যা হ্রাস পাবে। ঢাকাতে নাগরিক চলাচলের হার স্বাভাবিক হবে কিছুটা ।

২. নির্দিষ্ট বাস স্টপেজ খুবই জরুরী। বাস স্টপেজগুলোও আকারে বড় করা দরকার । যাতে রোদে-বৃষ্টিতে অপেক্ষমান যাত্রীরা ঠিকমত মাথা বাঁচাতে পারে। বাস স্টপেজে বাস ঠিক মত থামছে কিনা তা মনিটর করা দরকার । সব বাসগুলো সারি বদ্ধভাবে বাস স্টপেজে থাকবে; যাত্রিরাও লাইন ভঙ্গ করবেনা।

এ ব্যাপারে জনসচেতনতা মুলক ছোট নাটিকা গনমাধ্যমগুলোতে প্রচার করা যেতে পারে। ৩. আমাদের দেশে বাস-রুট তৈরীর সময় কি চিন্তা করে করা হয় জানিনা। শহরের কিছু দর্শনীয় স্থান আছে, যা এমনকি বিদেশীরাও দেখতে আসে। আইডিবি, নভো থিয়েটার, বসুন্ধরা সিটি ইত্যাদি জায়গাগুলোকে মাথায় রেখে যদি বাস স্টপেজ করা হতো এবং বাসরুট করা হতো তাহলে অনেক সুবিধা হয় যাতায়াতে, এমনকি সাশ্রয়ও। ৪. পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ।

ফুটপাথে, যেখানে-সেখানে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়া বন্ধ করতে হবে। আন্ডারপাস, ফুটওভার এগুলো পরিস্কার রাখতে হবে। এতে করে মানুষ রাস্তা বাদ দিয়ে ফুটপাথ ধরে হাঁটতেই উতসাহী হবে। ৫. আরও দীর্ঘ ফ্লাইওভার প্রয়োজন । বিষয়টা উচ্চাভিলাষী শোনাবে কিনা জানিনা, তবে ইন্টার সিটি পাতাল রেল চালু করা গেলে চাপ কমে যেত নিঃসন্দেহে।

৬. সিএনজি স্কুটার/ক্যাব চালকদের মিটারে যাওয়া নিশ্চিত করতে হবে কঠোরভাবে। ৭. পাবলিক পরিবহনকে মান সম্মত করা খুবই জরুরী। ৮. রিক্সার চলাচল আরো নিয়ন্ত্রিত করতে হবে। আমি এখনও জানিনা ৫০০০ সিএনজি রাস্তায় নামিয়ে শুধুই উটকো ঝামেলা বাড়ানোর যৌক্তিকতা কি। এতে আরো কিছু পরিবার শহরমুখী হবে, বাড়বে বস্তি; ধরে নেয়া যায় কিছু ক্রাইমও বাড়বে।

যানযট নিরসনে সরকারের যেখানে বদ্ধপরিকর হওয়ার কথা সেখানে এরকম সিদ্ধান্ত কতটা যুগান্তরী ? পুনশ্চ : আমার এধরনের বিষয় বস্তু নিয়ে ডেইলী স্টার -এ একটা লেখা এসেছিল। লিংকটা দিলাম - Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।