আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফতোয়ার নানা রূপ - ২ (হিন্দু ধর্মে)



উত্‍সবে-পার্বণে বাঙালী মুসলমানের আলিঙ্গন-প্রথায় সংখ্যা-সমস্যা (একবার না তিনবার) এবং কোরবানির পূর্বাপর (কোলাকুলি কোরবানির আগে না পরে) ধর্মীয় বিধি-নিষেধ আছে কিনা জানি না ৷ তবে ঈদের দিনে আলিঙ্গনাবদ্ধ হওয়া বাঙালী মুসলমানের ঐতিহ্যের অঙ্গীভূত বটে ৷ সেই আনন্দের দিনে আলিঙ্গনের প্রীতিবন্ধন পুরোনা দিনের সমস্ত দুঃখ-ক্ষোভ, মান-অভিমান ভুলিয়ে দেয় ৷ আলিঙ্গনবিহীন ঈদোত্‍সব কি এখন সংস্কৃতিবান বাঙালী মুসলিম সমাজ ভাবতে পারে? প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালীরা পারস্পরিক মিলন ও মনোগত সমপ্রীতি প্রকাশ আলিঙ্গনের মাধ্যমে করে আসছে ৷ বুকে বুক মেলানোর মধ্যে যে অন্তরের স্পর্শসুখ, হৃদয়াবেগের ঐকতান, উভয়ের হৃদস্পন্দনের ভাবসম্মিলন তা আর কোন্ প্রক্রিয়ায় পাওয়া যাবে, আলিঙ্গন ছাড়া? সেই যে রবীন্দ্রবাণী 'দেবে আর নেবে, মিলিবে মেলাবে' কিংবা 'প্রাণের বেদনা প্রাণের আবেগ' সে-তো আলিঙ্গনের মাধ্যমেই পূর্ণতা লাভ করতে পারে ৷ 'রয়েছি দাঁড়িয়ে দু'বাহু বাড়ায়ে'- এরকম প্রীতিপূর্ণ মিলনের আন্তরিক আহ্বান কেবল আলিঙ্গনের স্পর্শেই অনুভব করা যায় ৷ আলিঙ্গনের মধ্যে যে প্রাণের স্পর্শ তা-কি পাওয়া যাবে করমর্দনের ঝাঁকুনি বা স্যালুটের সশব্দ পদবিক্ষেপে? শৈশবকাল থেকে শিশুতোষ বই এবং পত্র-পত্রিকায় দেখে আসছি, আকাশে চাঁদ এবং টুপি-পাঞ্জাবি পোশাক-পরা আলিঙ্গনের চিত্রকল্পটি ঈদোত্‍সবের আনন্দঘন অনুষঙ্গ ৷ বাঙালীর সেই মিলনপ্রয়াসী ঐতিহ্য থেকে কৌশলে বিচ্যুত করার অপচেষ্টাই বর্তমানে বাংলাদেশী ফতোয়াবাজদের মূল লক্ষ্য ৷ বাংলাদেশে একালের ফতোয়াবাজদের ইসলাম ধর্ম-দর্শন তথা পবিত্র কোরান হাদিস ও শরিয়তী জ্ঞানের গভীরতা সম্পর্কে অবশ্যই প্রশ্ন জাগা স্বভাবিক ৷ কওমি মাদ্রাসার পশ্চাত্‍পদ 'শিক্ষা' এবং 'বিদ্যা' দিয়ে আর যা-ই হোক অন্তত ইসলামের মত একটি 'পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শনে'র ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা চলে না ৷ তাছাড়া বর্তমান মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায়ও সেই সুযোগ কেবল সীমিত নয়, অনুপস্থিত বললেই চলে ৷ দেশের সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থায় দুর্নীতির দুষ্টক্ষত এবং পাবলিক পরীক্ষায় নকলোত্‍সবের প্রাবল্য থেকে মাদ্রাসাগুলো মুক্ত তো নয়ই, বরং সেখানকার পরীক্ষায় নকলপ্রবণতা আরও বেশি ৷ মাদ্রাসাবোর্ডের অধীনে দাখিল থেকে কামেল পর্যন্ত সকল পরীক্ষাই আজ গণ নকলে পর্যবসিত ৷ নকল করে পাশ-করা বিদ্যার বহর নিয়েই এদেশে এক শ্রেণীর মোল্লা-মৌলভী-ইমাম-কামেলরা ইসলামী অনুশাসন সংক্রান্ত রায় দিয়ে থাকে ৷ তাতে ব্যাখ্যার চেয়ে অপব্যাখ্যা, বিশ্লেষণের চেয়ে বিকৃতিই থাকে বেশি ৷ তাই তো 'ফতোয়া' পর্যবসিত হয় 'ফতোয়াবাজিতে', আর ফতোয়াবাজি অবশ্যই গণবিরোধী নির্যাতক এবং প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষাকারী ৷ কারণ ফতোয়া একালে প্রদান করছে ধর্মব্যবসায়ী ও শ্রেণীস্বার্থের ধারক স্বল্প ধর্মজ্ঞানসম্পন্ন গ্রাম্য ইমাম-মোল্লা-মাশায়েকরা ৷ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র লালসালু উপন্যাসে আমরা মজিদ নামে এক কূপমণ্ডূক ধর্মব্যবসায়ী ভণ্ডপীর ও ফতোয়াবাজের চরিত্র পাই ৷ সে ব্যক্তি এলাকার সামন্তপ্রভু খালেক ব্যাপারির স্বার্থরক্ষাকারী এবং দোসর ৷ পীরতন্ত্র ও মাজারের ছত্রছায়ায় পানিপড়া প্রদান এবং ফতোয়াবাজির মাধ্যমে মজিদ কপর্দকহীন অবস্থা থেকে কলাগাছ হয়েছে ৷ ঔপন্যাসিকের ভাষায় : "জীবনস্রোতে মজিদ আর খালেক ব্যাপারি কী করে এমন খাপে খাপে মিলে গেছে... একজনের আছে মাজার, আরেক জনের জমি-জোতের প্রতিপত্তি ৷ সজ্ঞানে না-জানলেও তারা একাত্ম, পথ তাদের এক৷" সামন্তবাদ ও পীরতন্ত্রের মণিকাঞ্চন যোগের ব্যাপারটি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করেছেন মজিদ ও খালেক ব্যাপারির চরিত্রের মাধ্যমে৷ তাছাড়া সমাজে ফতোয়াবাজির স্বরূপও তিনি ঘটনার ক্রমবিকাশে বর্ণনা করেছেন ৷ একালের ফতোয়াবাজরা যে সেই ভণ্ডপীর মজিদের বংশধর কিংবা নতুন সংস্করণ তাতে কোন সন্দেহ নেই ৷ ২ ইসলামী ধর্ম-দর্শন এবং অনুশাসনে বিশেষজ্ঞ কোন পণ্ডিতের দ্বারা যখন কোন বিতর্কিত গূঢ়বিষয়ে যথার্থ ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে মতামত বা রায় দেয়া হয় তখন তাকে বলা হয় ফতোয়া ৷ ফতোয়ার বিষয় ইহলৌকিক এবং পারলৌকিক উভয়বিধই হতে পারে ৷ পারলৌকিক বিষয় সম্পর্কিত ফতোয়া অবশ্যই আলোচনার ঊর্ধ্বে রাখা বাঞ্ছনীয় ৷ প্রচলিত আইন-আদালতেও এ-সম্পর্কে বিধি নিষেধ আরোপ বা মন্তব্য করা অনুচিত ৷ কিন্তু ফতোয়ার বিষয় যখন হয় ইহলৌকিক এবং সামাজিক জীবনযাপন সম্পর্কিত তখন তা সর্বদা নৈর্ব্যক্তিক ও যুক্তিশীল নিরপেক্ষতার মানদণ্ডে নিরূপিত হবে এমনটা আশা করা যায় না ৷ এক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় প্রচলিত রাষ্ট্রীয় আইন ও সংবিধানের সঙ্গে ফতোয়ার রায় বিরোধপূর্ণ হয়ে যায় ৷ এর কারণ তাতে ব্যক্তিগত লাভ ও সুবিধাভোগী শ্রেণীর স্বার্থরক্ষা-বিষয়ক অনুষঙ্গ গোপনে যুক্ত থাকে ৷ তখন ফতোয়ার সদর্থকতা লোপ পায় এবং তা ফতোয়াবাজির কদর্থক রূপ ধারণ করে ৷ ফলে দরিদ্র ও শিক্ষাবঞ্চিত মানুষ এর দ্বারা বিভ্রান্ত হয়, নির্যাতিত হয় ৷ বাংলাদেশের অতীত ও বর্তমানের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসে এর বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় ৷ তবে ফতোয়াবাজি কেবল ইসলাম ধর্মের নামে এবং এদেশেই যে সীমাবদ্ধতা নয় ৷ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ফতোয়াবাজি বা ব্যাপক অর্থে পবিত্র ধর্মের নামে অপব্যাখ্যার মাধ্যমে ব্যক্তি ও শ্রেণীস্বার্থ উদ্ধারের অপপ্রয়াস পূর্বাপর প্রচলিত সকল ধর্মেই ছিল এবং এখনও আছে ৷ বিশেষত সনাতন (হিন্দু), খ্রিস্ট ইত্যাদি ধর্ম যথা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক পুরোহিত-যাজকরা ব্যক্তি ও শ্রেণী স্বার্থ সংরক্ষণে ধর্মের অপব্যাখ্যায় কম পারঙ্গম নয় ৷ হিন্দু ও খ্রিস্ট ধর্মে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনবিধান ব্যাখ্যায় ফতোয়াবাজির প্রভাব যথেষ্ট পরিলক্ষিত হয়েছে অতীতে, এখনো হয় ৷ রাষ্ট্রশক্তি ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে একসময় পৃথিবীর দেশে দেশে দীর্ঘদিন ধর্মের অপব্যাখ্যা তথা ফতোয়াবাজি চলেছে ৷ বিজ্ঞানসিদ্ধ এবং বস্তুনিষ্ঠ সত্য প্রচারের কারণে তা প্রচলিত মতবিরোধী বলে দার্শনিক সক্রেটিসকে বিষপানে হত্যা করা হয়েছিল ৷ এরিস্টটলকে বহু নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল ৷ সনাতন হিন্দুধর্মে কি ফতোয়াবাজি কম হয়েছে? ব্রাহ্মণ্যবাদীদের স্বার্থরক্ষায় প্রাচীনকালে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা আর্থসামাজিকভাবে যে শোষণ-নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তা ধর্মের নামে ফতোয়ার মাধ্যমেই ৷ হিন্দুসমাজের অস্পৃশ্যতা, ছুতমার্গ, বর্ণ-গোত্র-জাতিভেদ প্রথা ইত্যাদি সনাতনী ফতোয়াতন্ত্রেরই উজ্জ্বল উদাহরণ ৷ সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে পেশাগতভাবে শ্রমজীবী এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীই তখন নিম্নবর্ণ 'শূদ্র' নামে আখ্যায়িত হয়েছিল ৷ ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এই শ্রমজীবী দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর আধিপত্য ও শোষণ বজায় রাখার জন্যেই অস্পৃশ্যতা, ছুতমার্গ ও বর্ণাশ্রম প্রথার উদ্ভব ঘটিয়েছিল ৷ ষোড়শ শতাব্দীতে বঙ্গদেশে চৈতন্য দেবের আবির্ভাব এবং তাঁর সামাজিক সাম্যের মূলমন্ত্র 'মুচিও শুচি হয়, যদি কৃষ্ণ ভজে' হিন্দু সমাজের অস্পৃশ্যতা, ছুতমার্গ ও বর্ণভেদের ফতোয়াবাজির বিরুদ্ধে সার্থক প্রতিবাদ ৷ হিন্দুধর্মে ফতোয়াবাজির অন্যতম নির্দশন পাওয়া যায় ব্রাহ্মণ্যবাদী যাজকদের রচিত একটি সংস্কৃত শ্লোকে : "অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানি চ ভাষায়াং মানব শ্রুত্বা রৌরভ নরকাংব্রজ্যেত্‍" ৷ অর্থাত্‍ আঠারোটি পুরাণ, রামচন্দ্রের চরিতকথা, একমাত্র ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য নিম্নবর্ণের কেউ শুনলে সে ব্যক্তি রৌরভ নামক নরকে (তুলনীয় : ইসলাম ধর্মে হাবিয়া দোজখ) যাবে ৷ ধর্মীয় আধিপত্য এবং সামাজিক কর্তৃত্ব ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাতে কুক্ষিগত করার অপকৌশল এই শ্লোকে বিধৃত হয়েছে ৷ তাছাড়া সেকালে হিন্দু সমাজে ধর্মের নামে ফতোয়াবাজির নমুনা আমরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন সামাজিক প্রথাগুলোর মধ্যে পাই ৷ সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, গঙ্গায় প্রথম সন্তান বিসর্জন, গুরুপ্রসাদী, বিধবাদের জন্যে প্রাণিজ আমিষ নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদি সামাজিক কুপ্রথার উদ্ভব হয়েছে সনাতন ধর্মের নামে ফতোয়াবাজির মাধ্যমে ৷ প্রমথনাথ বিশীর কেরী সাহেবের মুন্সী, কালী প্রসন্ন সিংহের হুতোম প্যাঁচার নকশা ইত্যাদি গ্রন্থে তত্‍কালীন হিন্দু সমাজে ধর্মের নামে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ফতোয়াবাজির নির্মম নারকীয় অমানবিক বর্বরতার অনুপুঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যায় ৷ চলবে...........

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.