আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মহাশক্তি শ্রী শ্রী দুর্গা

সময়... অনাদি... হতে... অনন্তের... পথে...

যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তি রুপেন সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ দেবী পূজার মূল উৎস হচ্ছে সনাতন ধর্মের আদি শাস্ত্র বেদ। অভৃশ্য ঋষির কন্যা ব্রহ্মবাদিনী বাক সর্বপ্রথম তাঁর অতীন্দ্র ধ্যাননেত্রে আবিস্কার করেন দেবীসুক্ত। এই দেবীসুক্তই হচ্ছে মাতৃবন্দনার মঙ্গলসূত্র। জুগন্নিয়ন্ত্রী মহাশক্তি শুধু পুরুষ দেবতারুপে আমাদের পূজার পাত্র হননি, স্ত্রী দেবীর মাধ্যমেও মহাশক্তিকে আরাধনা করা হচ্ছে যুগে যুগে।

যখনই দুঃখে-ক্লেশে-বিপদে মুহ্যমান হয়ে মর্তের মানুষ ও স্বর্গের দেবতা পরিত্রাণের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন, তখনই তাঁদের পরিত্রাতা রুপে আবির্ভূতা হয়েছেন দুর্গতি হারিনী শ্রীদুর্গা। শক্তি পূজার দু’টি দিক আছে একটি হলো আধ্যাত্মিক এবং অপরটি হল আধিভৌতিক। মাতৃসাধক আধ্যাত্মক্ষেত্রে মহামায়া আদ্যাশক্তির আরাধনা করেন এবং অন্তরে কাম ক্রোধাদি রিপু ও ইন্দ্রিয়দিগকে জয় করে আধ্যাত্মিক কল্পনা ও মুক্তি লাভ করেন। অন্যদিকে আধিভৌতিক ক্ষেত্রে সাধক তাঁর পূজা বন্দনা করেন দেশ ও সমাজের বাহ্য শত্রুর ও অন্তঃবিল্পবের কবল হতে দেশ জতিকে মুক্ত করতে। মহাশক্তি শ্রীদুর্গা দেহ দুর্গের মূল শক্তি।

মানুষের দেহ একটি দুর্গ বিশেষ। পঞ্চভূতে নির্মিত যথা-ক্ষিতি, অপ,তেজ,মরুদ, ব্যোম। দেহের মূলশক্তি প্রাণশক্তিকে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ , মাৎসর্য-এ ষড়রিপু আক্রমন করে। সমস্ত বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে প্রাণই শ্রেষ্ঠ প্রান হলো ব্রহ্ম সনাতন। সাধনার মাধ্যমে প্রাণ তাঁর স্বরুপে বিকশিত হয়, তখন সাধক হন মহাশক্তিধর।

সনাতন ধর্মের পূজা অনুষ্ঠান সমূহে এবং বিভিন্ন প্রতিমার রুপ কল্পনায় মূল শক্তি হলো আত্মশক্তি। যাকে সংস্ড়্গৃতিতে বলে ‘আত্মানাং বিদ্ধি’ অর্থাৎ নিজেকে জান বা আত্মাকে জান। দুর্গা সাধকের নিজের এবং বিশ্বের মূল মহাশক্তি। ঋষি বেদব্যাস পরম ব্রহ্মের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেছেন-তুমি রুপ বিবর্জিতা; আমি ধ্যানে তোমার রুপ কল্পনা করেছি। অপরুপকে রুপময়, অনির্বচনীয়কে বচনীয় এবং সর্বব্যাপীকে স্থানিক করা হয়েছে সর্ব লোকের কল্যাণের জন্য।

আমাদের ঋষিকবিরা মানুষের মধ্যকার সুরশক্তির ও অসুরশক্তির দন্ধের কথা এবং পরিনামে অসুরশক্তির বিনাশ ও সুরশক্তির জয়ের কথা ধর্মগ্রন্থে রুপকে বর্ণনা করেছেন। সমস্ত দেবতার তেজরাশির সমন্বিত শক্তিরুপই মহাশক্তি দুর্গা। আধ্যাত্মিকতা সনাতন ধর্মের মূল। আধ্যাত্মিক ভাবনা দুর্গা কাঠামোতে অন্তর্নিহিত। দুর্গার দশহাত দশদিক রক্ষা করার প্রতীক, দশপ্রহরণ এক এক দেবতার সাধনলব্দ বিভূতি।

দেবী ত্রিভঙ্গা-ত্রিগুণাত্মিকাশক্তির প্রতীক অর্থাৎ সত্ব;রজঃ তমগুণের প্রতীক। দেবী ত্রিনয়নী-একটি নয়ন চন্দ্রস্বরুপ, একটি সূর্যস্বরুপ এবং তৃতীয়টি অগ্নিস্বরুপ। তাঁর ত্রিনয়নের ইঙ্গিতেই নিয়ন্ত্রিত হয় ত্রিকাল। দেবী সিংহবাহনা-তামসিক পশুশক্তির অধিপতি পশুরাজ সিংহ। মহিষাসুর-দেহস্থ প্রবল রিপুর প্রতীক।

কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য এর ঘনীভূত মূর্তি মহিষাসুর। শিব-সর্বপুরি অধিষ্ঠিত শিব মঙ্গল ও স্থিরত্বের প্রতীক। দেবীর ডানপার্শ্বে উপরে লক্ষ্মী-ধনশক্তি বা বৈশ্যশক্তির, গণেশ-ধনশক্তির বা শূদ্রশক্তির, সরস্বতী-জ্ঞানশক্তি বা ব্রহ্মণ্যশক্তির, কার্তিক ক্ষত্রিয়শক্তির প্রতীক। শক্তিসমূহ অনুভূতির বিষয় অনুভূতির আকার নেই। আকার দেয়া হয়েছে মানুষের বোঝার সুবিধার জন্য।

সকল শক্তিই ব্রহ্মশক্তি। সাধকের হিতার্থে ব্রহ্মের নানান রূপ কল্পনা । দুর্গা দেহদুর্গের মহাশক্তি। সাধক সাধনাকালে সেই শক্তিকে জাগ্রত করেন। সেই শক্তি যখন জাগ্রত হয় তখন দেহস্থিত রিপুসমূহ তাকে পরাজিত করে বশীভূত করার জন্য উদ্যোগি হয়।

সে সময় দেবশক্তি ও রিপু তথা আসুরিক শক্তির মধ্যে বাঁধে সংঘর্ষ। সেই অন্তর জগতের সংঘর্ষের একটি প্রতীকি রুপ শ্রী শ্রী চন্ডির মাধ্যমে রুপায়িত হয়েছে। বাঙ্গালী হিন্দুদের হßদয় জাগানো যে শ্রেষ্ঠ উৎসব তা হল শারদীয় শ্রী শ্রী দুর্গা পূজা। এই মহান উৎসবটি ধর্মনুরাগী ভক্তদের হßদয়ে যেমন আধ্যাত্মিক চেতনার উন্মেষ ঘটায় তেমনি বাঙ্গালী সর্বসাধারণের মনে আনন্দ উল্লাসের অনুভূতি যোগায়। তবে শ্রী শ্রী দুর্গাপূজায় যে মহৎতত্ব নিহিত রয়েছে তা অনেকেই ভেবে দেখেন না।

পূজার সময়ে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করা হয়, মাইক বাঁজানো হয়, অত্যাধুনিক আলোকসজ্জ্বার ব্যাবস্থা করা হয় আরতির নামে অশ্লীল নৃত্য প্রতিযোগিতা ও পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সর্বকালের সকল অশুভ ও আসুরিক শক্তি ধ্বংস করে সকল অত্যাচারির হাত থেকে পরিত্রাণের মানসে শক্তি সঞ্চারের জন্যই আমরা দুর্গা পূজা করে থাকি। বস্তুতঃ পূজার মন্ডপে যারা অপবিত্র ও কলুষিত মনোভাব নিয়ে প্রবৃষ্ঠ হয় তাদের সে ভাবটি পরিবর্দ্বিত হয় শতগুন। পক্ষান্তরে যাঁরা শুচি-শুদ্ধ-পবিত্র মনোবুদ্ধি নিয়ে মাতৃদর্শনে ও তাঁর কৃপালাভে উন্মুখ আকুল-ব্যাকুল হয়, মায়ের কৃপাশীষে সেই ভাবটি বিকশিত ও পরিপুষ্ট হয়ে উঠে শতভাবে। আসুন, আমরা এই পবিত্র লগ্নে আমাদের হৃদয় মন হতে যাবতীয় মলিন বাসনা ও কুৎসিত ভাবনা সযন্তে পরিহার করে করুনাময়ী-মহাশক্তি-স্বরূপিনী-মহামায়া রাতুল চরণে শক্তি লাভের জন্য আন্তরিক প্রার্থনা নিবেদন করি- ‘সর্ব মঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্ব্বার্থসাধিকে।

শরণ্যে ত্রম্বকে গৌরি নারায়নি নমোহস্ততে শরণাগতদীনার্ত্ত পরিত্রাণ পরায়ণে। সর্ব্বস্যার্ত্তি হরে দেবী নারায়নি নমোহস্ততে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।