আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কি জাদু করিয়া বন্ধে মায়া লাগাইছে.!



মানুষের বিভিন্ন রকমের সখ থাকে, কারো কারো সখ আবার বিচিত্র। অনেক ক্ষেত্রে কোন সখ নেশা হয়ে উঠে। আমারও বেশ কিছু সখের কাজের মাঝে একটি অনন্য হয়ে উঠেছে, মনে হয় নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছি! বেশ অনেক বছর আগে নিজের অজান্তেই এই সখের বীজ বপিত হয়ে গেছে মনে। এখন এমন নেশার মতো হয়ে গেছে যে কিছু দিন না পেলেই মনে হয় কি যেন নেই! এক ধরনের শূণ্যতার সৃষ্টি হয়! সমুদ্র আমার কাছে নেশার মতো, প্রতি বছর যেতেই হবে, সম্ভব হলে একাধিকবার। অসংখ্য না হলেও বেশ কিছু সৈকত দেখেছি, একেকটি সৈকতের সৌন্দর্য একেক রকম।

প্রতিটি সৈকতের আছে নিজস্ব বৈশিষ্ট। আমাদের দেশের কক্স'সবাজারের মতো সমতল সৈকত যেমন আছে তেমনি আছে পাথুরে সৈকত, পতেঙ্গা সৈকতও কক্সবাজারের চেয়ে ভিন্ন। আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে "অরিগন" নামের স্টেটে "ক্যনন বীচ" বেশ নাম করা। এতো গল্প শুনে সেই বীচে গিয়ে আমার মন খারাপ হয়ে গেছে, সমুদ্রের পাশে বিশাল এক কালোপাথর, আমার কাছে রিতীমতো কুৎসিত মনে হয়েছে, অথচ সেই পাথর দেখতেই নাকি প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ আসে! তবে সেই বীচ থেকে দুরে যে প্রাচীন লাইটহাউজটি দেখা যায়, তাও বেশ আকর্ষনীয়। ক্যালিফোর্নিয়ার লস এ্যন্জেলেসের বিখ্যাত 'ম্যালিবু বীচ" দেখে মনে হয়েছে আনন্দের বালুকাবেলা।

ব্যস্ত একটি নগরের মাঝেই এই শহুরে বীচ! শত শত (হয়তো হাজার হাজার) মানুষের ভীড়ে সমুদ্র যেন আড়াল হয়ে যায়। সৈকতের ধার ঘেঁষে বিখ্যাত নামী দামী তারকাদের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার মুল্যের বিলাস বহুল বাড়ি! সৈকত যেমনই হোক, আমর তেমন ভাবান্তর সাধারনত হয়না, কারন সমুদ্রটাই মূখ্য। সমুদ্রে দর্শনার্থীদের ভীড় প্রায় সারা বছরই থাকে, গ্রীষ্মকালে বারাবারি রকমের হয়ে যায় সেই জনারণ্য। প্রচুর মানুষ যায় সমুদ্রস্নানে, কেউ কেউ যায় সার্ফিং, স্কুবা ডাইভিং অথবা সান ট্যানিং। গরমকালে বীচ ভলি বেশ জমে উঠে।

অনেকেই আবার ঝিনুক কুড়িয়ে আনন্দ পায়। শিশুরা (অনেক ক্ষেত্রে বড়রাও) মনের আনন্দে গড়ে বালির প্রাসাদ! এক বার একজন শিল্পীকে অনেক ধৈর্য্য ধরে একটি মৎসকন্যা গড়তে দেখেছিলাম! কি সুক্ষ কারুকাজ অথচ বালু দিয়ে তৈরী, একটু জোয়ার এলেই সব ধুয়ে যাবে! আমি সমুদ্রে যাই শুধু সমুদ্র দেখতে। সমুদ্রজলে দাঁড়িয়ে, ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে পারি। সেসময় যদি বৃষ্টি পড়ে তাহলে তো কথাই নেই! অনেক বছর আগে এক বৃষ্টি ঝরা সন্ধ্যায়, চাঁদের আলোয় বঙ্গোপসাগরে হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে আবিস্কার করেছিলাম 'সমুদ্র কথা বলে', তার নিজস্ব একটি ভাষা আছে'। সেই ভাষায় কতো রকম অভিব্যক্তি!!! অনেকের কাছে মহা পাগলের প্রলাপ মনে হতে পারে, তবে আমার কাছে এটাই সত্য! সমুদ্রের সেই ভাষা আবিষ্কারের পর আমার এই নেশার শুরু।

ফ্লোরিডার "পেনসাকোলা বীচ' আমার দেখা খুব সুন্দর কয়েকটি বীচের অন্যতম। এই বীচের বালু চকের গুড়োর মতো সাদা, ছুঁলে মনে হয় সাদা কাঁচের গুড়ো হাতে নিয়ে আছি। এক পূর্ণিমায় সেখানে ছিলাম, হোটেলের রুমে বসেই সমুদ্র দেখা যায়, সারা রাত প্রচুর মানুষ জেগে কাটিয়েছে। পূর্ণিমার রাতে মনে হয় সমুদ্র জেগে উঠে, অদ্ভুত প্রানবন্ত এক রূপ ধারন করে! আমি তিন তলার বারান্দায় বসে দেখেছি, চাঁদের আলোর তীব্রতার সাথে কিভাবে একটূ একটু করে সমুদ্র তার রূপ পরিবর্তন করেছে, সৌন্দর্যের এক আসাধারন খেলা। কিছু জোৎস্না পাগল অথবা সমুদ্র পাগলে ছেলে মেয়ে প্রায় সারারাত সৈকতে হাঁটাহাটি করে, বসেই কাটিয়েছে।

পেনসাকোলা বীচের কিছু হোটেল এক দম সমুদ্র ঘেঁষে, জোয়ারের সময় মনে হয় সমুদ্র এসে যেন হোটেলের পা ধুয়ে দিয়ে যায়। আমার এই নেশা দেখে অনেক বন্ধু বান্ধব, পরিচিতজন পূর্ণিমা রাতে সমুদ্র দর্শনে চলে গেছেন, ভাষা বুঝতে না পারলেও নিখাদ ভালোলাগা আর গভীর আনন্দ নিয়ে ফিরেছেন। এতোদিন পর হঠাৎ এমন লিখছি কারন কয়েকদিন আগে আমি আমার একটি সৈকত খুঁজে পেয়েছি। ঠিক করেছি, বার বার ফিরে আসবো এখানে, যতোদিন যতোবার সম্ভব। শহর থেকে দুরে প্রশান্ত মহাসাগরের পারে একটি বীচ, এমন ভাবে সংরক্ষিত যে সদ্যজাত শিশুর মতোই নিমর্ল আর নিখাদ।

সুনামী থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যেই হোটেলগুলো বীচ থেকে কিছুটা দূরে, পেনসাকোলার মতো একেবারে সাগরের গা ঘেঁষে নয়। আমি যাই কেবল সমুদ্র দর্শনে, অন্যকিছুর কথা সেভাবে মনে হয়না, তবে এখানে কিছু জিনিস ভাবিয়েছে। সমুদ্রের পাশে ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড, প্রচুর মানুষ গাড়ির পাশে তাবু গেড়ে কাটিয়ে দিচ্ছে তিন চার দিন! সৈকতে গাড়ি নিয়ে ড্রাইভ করছে(অবশ্য অনবরত পুলিশ টহল দিচ্ছে, কারো গাড়ি আটকে গেলেই ফাইন করবে), ঘোড়ার মালিক ১৫/২০ টি ঘোড়া নিয়ে ব্যবসা খুলে বসেছে, মানুষ ঘোড়ায় চড়ে সৈকতে ভ্রমন করছে। দুজন কিশোরীকে বেশ দক্ষ হর্সরাইডার মনে হলো, সৈকত ছেড়ে কিছুটা পানিতে জোরে ঘোড়া ছুটিয়েছে! সবচেয়ে ভালো লেগেছে, একটি পরিবার ক্যাম্প গ্রাউন্ড ছেড়ে একেবারে সমুদ্রের কাছে এসে তাবু খাটিয়েছেন। তাঁদের দেখে কিছুটা ঈর্ষা আর কিছুটা অনুতাপের মিশ্র অনুভূতি, ভাবা যায়, সারা রাত সমুদ্রের এতো কাছে বসে কাটিয়ে দেয়া! এখানে এসে জেনেছি কতো সুন্দর আর গভীর ভাবে সমুদ্র উপভোগ করা যায়, আর সেই আকর্ষনে শীঘ্রই ফিরতে হবে।

তবে, পরিবার পরিজন, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবের বড় দল নিয়ে আসা। শীত দুয়ারে এসে কড়া নাড়ছে, এবছর সমুদ্রে ঘর বাঁধার স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা বুঝতে পারছিনা! দিনের একেক সময়, সমুদ্রের একেক রূপ! ভোরের সমুদ্র শান্ত, স্নিগ্ধ! সৈকতে বেড়াতে আসা মানুষগুলোর আচরণও সৌম্য, শান্ত। সন্ধ্যায় সমুদ্রের আরেক রূপ! টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছিলো, আমি দাঁড়িয়ে সমুদ্র জলে, এক সময় মনে হলো হাঁটু জল হয়ে গেছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঢেউ দেখছিলাম, এক সময় নিজের নাম শুনে পিছনে ফিরে দেখি অন্যরা চিৎকার করে ডাকছে, কেউ কেউ ছুটে আসছে, কানে আইপডের ঝংকার থাকায় শোনা যায়নি আগে। হঠাৎ অশান্ত হয়ে উঠেছে মহা প্রশান্ত, পানি অনেক অনেক বেড়েছে! নিতান্ত অনিচ্ছা সত্বেও ফিরে এলাম।

কি অদ্ভুত ভালোলাগা আর বিচিত্র অনুভূতি! প্রশান্তর পানি ছুঁয়ে মনে হলো, কে জানে হয়তো এই পানি স্পর্শ করে এসেছে আমাদের বঙ্গপোসাগরকে, হয়তো এই ছুঁয়ে যাওয়া পানিই সর্বগ্রাসী রূপ ধরে ধ্বংস করেছে ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা আর ভারতের হাজার হাজার জীবন! অথচ সেই এখন কতো মানুষের শ্রান্তি দুর করছে তার নির্মল ছোঁয়ায়! ফেরার পথে গাড়িতে উঠে মন খারাপ। আমি ড্রাইভ করছিলাম না। মনে হচ্ছিলো খুব প্রিয়, খুব কাছের কাউকে ছেড়ে আসছি, পিছনে ফিরে যতক্ষণ দৃষ্টিসীমায় ছিলো সমুদ্রকে দেখেছি। আমার মন খারাপের কারনে গাড়ির পরিবেশও থমথমে! অপ্রশস্ত পথের দুধারে গাঢ় সবুজ ঝাউবন; লাল, হলুদ, নীল বেগুনী বুনো ফুল ফুটে আছে সেই বনের পায়ের কাছে। আর কিছু দুরে প্রকৃতিতে হেমন্তের সেই বিখ্যাত রূপ ধারন শুরু হয়েছে, গাছের পাতায় বিভিন্ন রঙের আভা! তারপর ও কোন সৌন্দর্য সেভাবে স্পর্শ করছেনা আমাকে, মন পড়ে আছে সমুদ্রের কাছে।

গাড়িতে গান বেজে যাচ্ছে.. "কি জাদু করিয়া বন্ধে মায়া লাগাইছে..."। সত্যিই মায়া!!! মায়ার এই ইন্দ্রজাল ছিন্ন করার সাধ্য অথবা ইচ্ছে কোনটি আমার নেই। এআমার নেশা, আমার সমুদ্র বিলাস!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।