আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিশ্বজুড়ে বাল্য বিয়ে : কন্যা শিশু প্রথম শিকার

আমি কাক নই, আমি মানুষ...

বাংলাদেশেরই মেয়ে রেবেকা। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তার বিয়ে হয় এক ৩৯ বছর বয়সী লোকের সঙ্গে। যৌতুকের ভয়ে রেবেকাকে প্রবীণ ওই লোকটির হাতে তুলে দেয় তার মা-বাবা। স্কুলে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ থাকলেও বিয়ে দেয়ার জন্য অনেক আগেই তার শিক্ষার পাট চুকিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু এর পরের অধ্যায় আরো করুণ।

মেয়েটি এখন স্বামীর দ্বারা গোপন রোগে আক্রান্ত। জরায়ুতে আলসারের জন্য তাকে দুবার অপারেশন কক্ষেও যেতে হয়েছে। রেবেকা বাংলাদেশের মেয়ে হলেও তার এই কাহিনী ওয়াশিংটনে অবস্থিত আন্তর্জাতিক নারী গবেষণা কেন্দ্রের ফাইল থেকে নেয়া। সারা দুনিয়া থেকে রেবেকার মতো অসংখ্য শিশুর কাহিনী প্রতিদিন হাজির হয় এখানে। দেখা গেছে শিশু বয়সে বিয়ে দেয়া প্রায় প্রতিটি মেয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার।

শিশুকাল না কাটতেই এদের অনেককে বরণ করতে হয় বিধবার পরিণতি । এমন অনেক শিশুমাতা তাদের সন্তানদের জীবন ধারণের জন্য বাধ্য হয় অন্ধকার পথে পা বাড়াতে। বর্তমান বিশ্বে শিশু মাতার সংখ্যা কত? এর কোন সঠিক হিসেব পাওয়া সত্যিই কঠিন। তবে শুধু উন্নয়নশীল দেশে এই সংখ্যা ৫ কোটি ১০ লাখের মতো বলে মনে করা হয়। এই পরিসংখ্যান আন্তর্জাতিক নারী গবেষণা কেন্দ্রের।

নিউইয়র্ক ভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রজনন স্বাস্থ্য সংস্থা অঙ্গ সংগঠন পপুলেশন কাউন্সিলের হিসাবে আগামী ১০ বছরে আরো ১০ কোটি কন্যা শিশু বাধ্য হবে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে। বাল্য বিয়ের প্রবণতা সবচেয়ে বেশী দক্ষিণ এশিয়া ও সাব-সাহারান দেশগুলোতে। ভারত,ইথিওপিয়া ও নাইজেরিয়ায় ১৫ বছর পেরুনোর আগেই প্রায় ৪০ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। বাংলাদেশ, নেপাল, নাইজার, শাদ, মালি, মোজাম্বিকও উগান্ডায় ৫০ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়স পেরুনোর আগে। বিশ্বের ২০টির মতো দেশে বাল্য বিয়ে এতটাই স্বাভাবিক ঘটনা যে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে কোন পরিসংখ্যান সংগ্রহের ঝামেলায় যেতে চায়নি।

২০০০ সালে জাতিসংঘের বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্ব থেকে দারিদ্র্য বিদায় করার লক্ষ্যে যে ‘সহস্ত্রাব্ধ উন্নয়ন লক্ষ্যে’ যে ৮টি লক্ষ্যের ব্যাপারে ঐক্যমত্য পোষন করেন তার মধ্যে রয়েছে ব্যাল্যবিয়ে কমিয়ে আনা, মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়ন এবং শিক্ষাক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ের ব্যবধান বিলুপ্তকরণ। কিন্তু বাল্যবিয়ের ব্যাপকতা শুধু এই লক্ষ্য অর্জনের পথে বাধা সৃষ্টি করেনি এতে বেড়ে গেছে কন্যাশিশুর স্বাস্থ্য ঝুঁকি। বেড়েছে শিক্ষা ও অর্থনৈতিক সুযোগপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে তাদের বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা। গত জুলাইয়ে দুই ডেমক্রেট দলীয় সিনেটর হিলারী কিনটন ও রিচার্ড ডারবিন এবং রিপাবালিকান চাক হেগেল-এর উদ্যোগে মার্কিন সিনেটে পাশ হয় আন্তর্জাতিক বাল্য বিয়ে প্রতিরোধ ও সহায়তা আইন। এতে বিশ্বব্যাপী মার্কিন সাহায্য কর্মসুচীতে বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে প্রচেষ্টা জোরদারের আহবান জানানো হয়।

এই বিলের ফলে এখন থেকে বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার বিষয়ক রিপোর্টে বাল্য বিয়ের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বিশ্বব্যাপী বাল্য বিয়ে বন্ধে বহু আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক চুক্তি হয়েছে। কিন্তু অনেক সমাজে বাল্য বিয়ের প্রচলন এত ঘনিষ্ঠভাবে মিশে আছে যে কেবল আইন করে এর প্রতিরোধ কোন ভাবেই সম্ভব নয়। দরিদ্র দেশগুলোবে বাল্য বিয়ের প্রবণতা ব্যাপক হলেও ধনী দেশগুলো এ থেকে একেবারে মুক্ত ভাবার কারণ নেই। তবে এখানেও এই প্রবণতা দারিদ্রের সঙ্গে যুক্ত।

যুক্তরাষ্ট্রে এমন অনেক রাজ্যের আইনে আছে অবিভাবকের সম্মতি থাকলে মাত্র ১৪ বছর বয়সের কোন মেয়েই বিয়ে করতে পারে। গতবছর কানসাস রাজ্যে এরকম এক ঘটনায় ১৪ বছরের এক মেয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়ায় বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু আদালত বিয়ের নতুন বয়স সীমা মাত্র ১ বছর বাড়িয়ে ১৫ বছর নির্ধারণ করে। ওয়াশিংটন ভিত্তিক সেন্টার ফর ল এন্ড সোশাল পলিসি’র এক জরিপে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে এক শতাংশের মতো বিয়েতে কনের বয়স থাকে ১৫ থেকে ১৭ বছরে মধ্যে। সবচেয়ে আতঙ্কের হলো ১৯৯০’র দশকের পর থেকে এই প্রবণতা প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে বলে জানায় দেশটির আদমশুমারি ব্যুরো।

‘সেভ দ্যা চিলড্রেন’-এর২০০৪ সালের রিপোর্টে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রে ২০ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে এক-পঞ্চমাংশের বিয়ে হয়েছিল কিশোরী অবস্থায়। শিল্পন্নোত দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বাল্যবিয়ের এই সংখ্যা সর্বোচ্চ। যুক্তরাষ্ট্রের গ্রামীণ এলাকায় দারিদ্রতার মধ্যে বসবাসরত এবং স্বল্প শিক্ষিতদের মধ্যে মেয়েদের বাল্য বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয়ার প্রবণতা বেশী। বাল্য বিয়ের সঙ্গে দারিদ্রের সম্পর্ক প্রবল। বাংলাদেশ, মালি, মোজাম্বিক ও নাইাজরের মতো দেশে তিন-চতুর্থাংশ মানুষের দৈনিক আয় ২ ডলারের নীচে।

এসব দেশে নীচু আয়ের পরিবারগুলোতে শিশু বা কিশোরীদের বিয়ে দেয়ার প্রবণতা অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল পরিবারগুলোর চেয়ে দ্বিগুণ বেশী। এর কারণ এসব পরিবারের অবিভাবকরা মনে করে তাদের সন্তানদের একমাত্র ভবিষ্যৎ বিয়ে। কন্যা শিশুর শিক্ষা বা সে উপার্জনে সক্ষম এমন ভাবনা খুব কম পিতা-মাতার মধ্যে দেখা যায়। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের গবেষণায় দেখা গেছে, মেয়ে যতই শিক্ষিত হয় তার বাল্যবিয়ের আশঙ্কা ততই কমে আসে। এ কথা মাথায় রেখে বাংলাদেশ, জিম্বাবুয়ে, কেনিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশে কন্যাশিশুদের স্কুলে ধরে রাখতে অবিভাবকদের আর্থিক সুবিধা প্রদানের কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়।

বালবিয়ে দারিদ্র্য চক্রকে কেবল দীর্ঘায়িত করে। এর মাধ্যমে একটি মেয়ের অনেক সম্ভাবনা হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে যুক্ত হয় তার স্বাস্থ্যসেবার পেছনে ব্যয় আর বেড়ে যায় শিশুমৃত্যুর হার। ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের ক্ষেত্রে গর্ভধারণ ও সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুর আশঙ্কা স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ গুণ বেশী। এমনকি এদের বিভিন্ন প্রাণঘাতি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুকিও বেশী। ভারতের বিহার ও ঝারখন্ড রাজ্যে আন্তর্জাতিক নারী গবেষণা কেন্দ্রের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৮ বছরের কম বয়সী বিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতন বা বিভিন্ন হুমকির শিকার হওয়ার ঘটনা অন্যদের চেয়ে দ্বিগুণ বেশী।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.