আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রানহীন দেহে দেখি বিগত জীবনের ছায়া

জীবন গঠনে নিজেস্ব প্রতিক্রিয়ার দায় বেশি, ঘটে যাওয়া ঘটনার ভূমিকা সামান্য।

সার করে রাখা স্টেইনলেস স্টিলের ট্রলিগুলো। সেখানে সাদা, ভেজা তোয়ালেতে ঢাকা বড় ধরণের কিছু। আর তীব্র অপ্রীতিকর গন্ধ। গন্ধটা চেনা চেনা লাগছে কেন ভাবতে ভাবতে খুঁজে পেলাম অবশেষে।

বাংলাদেশী কেঁচকি এনেছিল বাবা একবার। সেটার প‌্যাকেট খুলতেই ক্যামিকেলের এই গন্ধটা নাকে লেগেছিল। বাবা বলেছিল, সেটা ফরমারলিনের গন্ধ। হিউম্যান অ্যানাটমি ল্যাবে ফরমারলিনে চুবানো সাদা তোয়ালে দিয়ে ঢাকা বস্তুগুলো আর কিছুই ছিল না, মৃত মানবদেহ। হিউম্যান এনাটমি এই সেমিস্টারের আগে করতে হয় নি।

সিনিয়রদের থেকে শুনেছিলাম প্র্যাক ক্লাসে সত্যিকারের লাশের অংশবিশেষ থাকে। আগ্রহই হয়েছে বলা যায়, টিভি সিরিজগুলোতে দেখায় মরা লাশে কাটাকুটি করে পোস্ট মর্টেম করা হচ্ছে। দেখে কখনও বেশি খারাপ লাগে নি, মনে হয়েছে গবেষণার বিষয়ের উপর গবেষণা করা হচ্ছে, উত্তর খোঁজা হচ্ছে। অনেকটা অংক করার মতই। কিংবা কম্পিউটার নিয়ে ঘাটাঘাটি।

তাছাড়া বাংলাদেশে থাকার ফলে পশু কোরবানী কম দেখি নি তো। রক্ত দেখে অভ্যাস আছে--নিজেকে বলেছিলাম। আশা করি নি নিজেকে লাশের সামনে দেখতে খারাপ লাগবে। কিন্তু তোয়ালে দিয়ে ঢাকা মৃত মানবদেহের সামনে বসে থাকতে থাকতে কেমন খারাপ লাগা শুরু হলো হঠাৎ। ফরমারলিনের খারাপ গন্ধটাই হবে--নিজেকে প্রবোধ দিলাম।

সকালে নাস্তা করি নি--যদি সব বের হয়ে আসে, এই ভয়ে। চমকে উঠলাম শুধু পাশের মজার ছেলেটার জোক শুনে। সাদা তোয়ালেতে ঢাকা বস্তুগুলো দেখিয়ে ঠোঁট চেটে বলে--'উমম ডিনার'। আমি মাথা নিচু করলাম। আচ্ছা, মৃত মানুষটা যদি শুনতে পেত, কেমন লাগত তার? তোয়ালে খুলতেই ধাক্কা খেলাম।

আমাদের শিখার সুবিধার্থে অনেকভাবে কেটে রেখেছে চারটা মৃতদেহকে। এক একটাকে দেখে মনে হচ্ছে, ধারালো কোন ছুরি দিয়ে কেটে ফেলা হয়েছে একটা লাশকে। কখনও সোজা নাক বরাবর--শরীর দু' ভাগ। কখনও সামনের অংশ পুরাটাই নেই--উম্মুক্ত হৃদপিন্ড, পাকস্থলী, অন্ত্রসমূহ। কখনও হাত, পা সব আলাদা করে টেবিলে ছড়িয়ে রাখা।

কখনও শরীরের একাংশের চামড়া পুরা অক্ষত, অন্য অংশে চামড়া খোলা, কিংবা আরও বেশি। আমি আশা করি নি এরকম। আমি আমার সারা জীবনে মৃত দেহ দেখেছি একটাই। নানাভাইয়ের। তাও ধুয়ে সাদা চাদরে মুড়ে উঠানের মাঝাখানে যখন রেখেছিল, তখন।

সাদা দাড়ি দিয়ে ঘেরা মুখটা জ্যোতি ছড়াচ্ছিল যেন। ঘুমিয়ে সুন্দর স্বপ্ন দেখার সময় বুঝি এমনই লাগে? কিন্তু, এগুলো তো, তেমন না... মৃত মানব দেহে রক্ত থাকে না, রক্ত তৈরি বন্ধ হয়ে যায়। ধুয়ে, ফরমারলিনে চুবিয়ে রেখেছে বলে পঁচে নি। টিভিতে পোস্ট মর্টেমে যেমনটা দেখায়, রক্তে ভরপুর, সাদা গ্লাভ রক্তে মাখামাখি--যাতে দেহে প্রান না থাকলেও মনে হয়েছে ইটস আ ম্যাটার অফ লাইফ--এখানে তেমন না। ওই যে হৃদপিন্ড, রক্তকে বইয়ে বেড়ায় সারা দেহে--সেটা শুধু বাদামী রঙের পেশীবহুল মাংসপিন্ড।

অন্ত্রগুলো হলদেটে। প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে পারি নি আমি। আমি এখান থেকে চোখ সরিয়ে ওখানে তাকাচ্ছি, নতুন করে ধাক্কা খাচ্ছি। চোখ বন্ধ করে ফেলছি। দাঁড়িয়ে ছিলাম যেখানে, সেখানে যেই দেহাংশটা ছিল--ওটার শুরু থুতনি আর চোয়াল থেকে, কোমর অব্দি।

থুতনি আর চোয়ালে এখনও চামড়া আছে। লাশ তো ধরতেই হবে, শুরু করতে গ্লাভস পরা হাত কাছে নিয়ে আস্তে করে ধরলাম খোঁচা খোঁচা দাড়িসহ দৃঢ় চোয়াল। ভয়াবহ চমকে উঠে হাত সরিয়ে নিলাম। হাত গুটিয়ে রাখলাম বেশ করে... শেইভ করা পুরুষ গাল আমার সচরাচর ছোঁয়া হয় না, ধুম করে মামাদের কথা মনে পড়ে গেল কেন? আমার ভিতরটা উল্টে বেরিয়ে আসতে চাইলো, প্রথমবারের মত যেন বুঝলাম, সেই যে মানুষটা কিছুদিন আগে আমাদের মত হাঁটতো, নাচতো, গাইতো, ভালোবাসতো, সেই এখন টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে স্টেইনলেস স্টীলের ঠান্ডা টেবিলে। ওই যে কুঁকড়ে যাওয়া আঙ্গুলগুলো... কতদিন হবে শেষ পেয়েছিল প্রিয় কারো স্পর্শ? আমি বিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়ে ছিলাম টুকরো মানবদেহ সামনে নিয়ে, সবাই কি সাবলীল ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, গবেষনা করছে, দেখছে, হাসছে।

গোপনতম অঙ্গ প্রতঙ্গ হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখছে--যেন কেমিস্ট্রির প্লাস্টিকের মডেল। আমি পারছি না। আমি তীব্র খারাপ লাগায় ভুগছি, কেবলই মনে হচ্ছে, মানুষটা যদি জানতো, ভালো লাগতো তার? জানি বিজ্ঞানের উপকারে শরীর দান করে গিয়েছে জেনে শুনেই, কিন্তু, সত্যিকারের এই আবেগহীন বাস্তবতার সাথে কি জানাশোনা ছিল তার? আমি ইস্টে ইস্টে ফুলে যাওয়া কিডনী দেখে নিমিষে ভেবে ফেলি--আহারে বেচারা মদ খেতে ভালোবাসতো অনেক। সেটাই কি মৃত্যুর কারণ? আমি সূতা দিয়ে বাঁধা অন্ত্র দেখে বুঝি, মৃত্যুর সময় ভর পেটে ছিল। শেষ কি খেয়েছিল? কে রেঁধেছিল? কার সাথে খেয়েছিল? আমি কাদামাটি রঙের রক্তশূন্য হৃদপিন্ড হাতে নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম--বড় বেশি নিশ্চুপ।

শেষ বার কে কান পেতে শুনেছিল এর আনন্দিত চিৎকার? বাসায় এসে দেখি বাবা খুব আগ্রহ নিয়ে রাঁধছে। নতুন রান্না শিখেছে যে! আমি একটু চিমটি দিয়ে খেয়ে নিয়ে 'খুব ভালো হয়েছে' বলে উঠিয়ে রাখলাম। খেতে পারি নি মুরগির ডানাগুলো, আমার খুব প্রিয়, তবু। আমার খোলা চোখের সামনে নাচছিল হলদেটে, চামড়া ছাড়া রক্তশূণ্য হাত পা। আচ্ছা, আমিও কি একদিন সেরকম হয়ে যাব?


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।