আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অসহনীয় হয়ে উঠেছে বাজার

রাজনীতি ও অর্থনীতি এই দুই সাপ পরস্পর পরস্পরকে লেজের দিক থেকে অনবরত খেয়ে যাচ্ছে

অসহনীয় হয়ে উঠেছে বাজার। বেঁচে থাকতে মানুষকে বাজারে যেতেই হচ্ছে। কিন্তু দেশের সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষের কাছে বাজারে যাওয়া এখন এক অসহনীয় অভিজ্ঞতার নাম। নিয়ন্ত্রণে নেই দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলছে।

আর এতে কষ্টে আছে দেশের সাধারণ মানুষ। সীমিত ও স্বল্প আয়ের মানুষের আয় বাড়েনি, বাড়ছে ব্যয়। গ্রামের পরিস্থিতি আরো খারাপ। শহরের তুলনায় গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেশি। সেখানে নেই বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ।

ফলে গ্রামের মানুষই কষ্টে আছে বেশি। এই সব মানুষের জন্য আপাতত কোনো সুখবরও নেই। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের দাম কমে জীবনযাত্রার ব্যয় খানিকটা সহজ হওয়ার কোনো লক্ষ্মনও আপাতত নেই। তত্বাবধায়ক সরকারও এখন পর্যন্ত সামাল দিতে পারছে না পরিস্থিতি। বিভিন্ন ধরণের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও তাতে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ রাখা যায়নি।

আগামি ডিসেম্বরের আগে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হবে সে ভরসাও দিতে পারছে না কেউ। ফলে স্বস্তিতে নাই দেশের মানুষ। সাধারণ মানুষকে এই স্বস্তি দিতেও এখন পর্যন্ত ব্যর্থ সরকার। তত্বাবধায়ক সরকার উর্ধমুখী মূল্যস্ফীতি পেয়েছিল উত্তরাধিকার সূত্রেই। সেই মূল্যস্ফীতি গত ৬ মাসে আরো বেড়েছে।

গত জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫.৯৪ শতাংশ, আর এখন তা ৮.০৫ শতাংশ। এতদিন খাদ্য সূচকেই মূল্যস্ফীতি ছিল উর্ধমূখী, এখন খাদ্য বহির্ভূত সূচেকে তা দেখা যাচ্ছে। গত এপ্রিলে জ্বালানি তেলের মূল্যবাড়ানোই তার কারণ। এখন আবার পরিকল্পনা চলছে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়াবার। অর্থনীতিবিদরা এই উদ্যোগকে আÍঘাতি বলেই মনে করছেন।

ঘাতক মূল্যস্ফীতি: তত্ত্বগতভাবে মূল্যস্ফীতিকে বলা হয় অর্থনীতির ঘাতক। আবার মূল্যস্ফীতিকে এক ধরনের করও বলা হয়। গত বাজেটে কর না বাড়লেও ৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতিই কর হিসাবে কাজ করছে। মানুষকে এখন বাজারে গিয়ে এই কর দিয়ে দিতে হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে দিচ্ছে মানুষের য়মতাও।

৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো ১শ টাকার পণ্য এখন কিনতে হয় ১০৮ টাকায়। এই বাড়তি আট টাকা যাদের নেই তাদের কিনতে হয় কম পণ্য। ফলে নিজের বাজেট সামলাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে সব ধরণের সীমিত আয়ের মানুষের। এসময় পেটপুরে দুবেলা খাওয়ার পরিবর্তে কম খেয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করে এসব মানুষ। মানুষ সবচেয়ে সংকটে আছে চাল নিয়ে।

সরকারি হিসাবেই আয়ের প্রায় ৫৪ শতাংশ ব্যয় হয় খাদ্য কিনতে। তবে গ্রামের মানুষ খরচ করে আরো বেশি, সাড়ে ৫৮ শতাংশ। যাদের আয় কম তাদেরই চালের খরচ বেশি। ফলে চালের দাম বাড়লেই সংকটে পড়ে যায় সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষ। তখন তারা চাল কেনার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে, কমে যায় ভোগ।

আন্তর্জাতিক বাজার: নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে আন্তর্জাতিক বাজার। চাল, গম ভোজ্য তেল, গুড়া দুধ, ডাল-সব কিছুরই দাম চড়া। তত্বাবধায়ক সরকার যখন দায়িত্ব নেয় সে তুলনায় এখন প্রতিটি পণ্যেরই দাম বেড়েছে ১শ থেকে ২শ ডলার পর্যন্ত। দুর্নীতি ও মজুদ বিরোধী অভিযানের কারণে শুরুতে ব্যবসায়ীরা ছিল আতঙ্কে। সেই আতঙ্ক এখন অনেকটা কাটলেও আন্তর্জাতিক বাজার চলে গেছে নাগালের বাইরে।

দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের প্রায় ৭০ শতাংশই আমদানি করতে হয়। ফলে স্থানীয় বাজারে এসব পণ্যের মূল্যস্তর অনেকখানিই নির্ভর করে আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের উপর। ভোগ্য পণ্য ব্যবসায়ীরা জানালেন, গত মার্চেও যদি বিভিন্ন ধরণের নিত্য প্রয়োজনীয় পন্য আমদানি করে সরবরাহ বাড়ানোর তৎপরতা থাকতো, তাহলেও অন্তত ১শ ডলার কম দামে ডাল ও গম কিনতো পারতো বাংলাদেশ। বিশ্বের অনেক দেশই সরবরাহ বাড়িয়ে নিলেও বাংলাদেশ ছিল মূলত পরিকল্পনা আর আলোচনার মধ্যেই। পাকিস্তান ও ইউক্রেন বন্ধ করে দিয়েছে গম রপ্তানি, ভারত বন্ধ করেছে ডাল রপ্তানি, বাড়ছে চালের দাম।

ফলে চাইলেও এখন এসব পণ্য আমদানি করাও আর সহজ হচ্ছে না। ভোগ্যপণ্যের প্রধান উৎস দেশ ভারত থেকে বৈধ ও অবৈধ পথে বিভিন্ন পণ্য আসা বন্ধ হওয়ায় বাংলাদেশের বিপাক বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। সব পণ্য এখন আনতে হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে, তাতে পরিবহন খরচও বেড়েছে অনেক। এসব কারণে আমদানি আগের চেয়ে কমে গেছে বলে জানা গেছে। দেশের একজন বড় ভোগ্য পণ্য ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করে প্রথম আলোকে জানান, বেসরকারি খাতে এখনই পণ্যের সবচেয়ে কম মজুদ রয়েছে।

লাগামহীন বাজার ও সরকার: বিগত জোট সরকারের সময় থেকেই মূলত বাজার ছিল লাগামহীন। ২০০১ সালে জোট সরকার যখন মতা নেয় সে সময় গড় মূল্যস্ফীতি ছিল মাত্র ১ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এর পর থেকে মূল্যস্ফীতি কেবলই বেড়েছে। এর মধ্যে অক্টোবরে মতা ছেড়ে দেওয়ার সময় তারা মূল্যস্ফীতি রেখে যায় ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ। সাবেক সরকার কখনোই উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে স্বীকার করে নাই।

জোট সরকারের মন্ত্রীরা বরং ক্রয় মতা বৃদ্ধির গল্প শুনিয়েছিলেন। এখন বলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজার দর আর ভারতের সঙ্গে মূল্যের তুলনামূলক আলোচনা। জানানো হচ্ছে ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের বাজার দরে খুব বেশি পার্থক্য নেই। তথ্য অনুযায়ী, ভারতে মাথাপিছু আয় এখন ৮২০ ডলার, আর বাংলাদেশে ৪৮২ ডলার। ফলে দাম কাছাকাছি থাকলেও সংকট এ দেশের সাধারণ মানুষেরই বেশি।

বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) সাধ্যমত চেষ্টা করেও স্থিতিশীল রাখতে পারেনি দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি। তবে দেশজুরে তাদের ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রির উদ্যোগে লাভবান হয়েছে নিুবিত্তরাই। বাকিদের জন্য ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) কিছু পন্য আমদানি উদ্যোগ নিলেও তা ছিল অপর্যাপ্ত। দীর্ঘদিন অকার্যকর হয়ে থাকা টিসিবি রাখতে পারছে না কাঙ্খিত ভূমিকা। অথচ ভারতে রয়েছে পণ্য আমদানির অন্তত ৬টি সরকারি প্রতিষ্ঠান।

বাজেটের আগে চাল ও গমের আমদানি শুল্ক তুলে নেওয়া হয়েছিল। আর বাজেটে প্রত্যাহার করা হয় ডাল ও ভোজ্য তেলের আমদানি শুল্ক। কিন্তু ততদিনে আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের দর আরও বেড়ে যাওয়ায় শুল্ক কমানোর কোনো সুবিধাই পায়নি দেশের ক্রেতারা। ফলে সরকারের এই উদ্যোগও সফলতার মুখ দেখেনি। গত এপ্রিলেই শুল্ক কমানোর উদ্যোগ নিলে কিছু সুফল পাওয়া যেতো বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।

সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ: আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের ৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতিতে সবচেয়ে বিপাকে রয়েছে দরিদ্র্যরা। কেননা এই মূল্যস্থীতির ঝুঁকি থেকে রেহাই পেতে তাদের তাদের যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতিও থাকে না। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা সামনের দিনগুলোতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। কেননা মূল্যস্ফীতি বাড়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকলে সব ধরণের পণ্যের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাবে। বাড়বে সাধারণ মানুষের অসন্তোষও।

প্রবৃদ্ধি অর্জন ও দারিদ্র্য বিমোচন করতে হলে তার প্রথম পূর্বশর্তই হচ্ছে সামগ্রিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রা করা। আর এই স্থিতিশীলতার সর্বাপো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়েন্ত্রণে রাখা। এটা না থাকলে উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ করার আকাঙ্খা কমে যাবে, লোকজনের সঞ্চয় প্রবণতাও হ্রাস পাবে। মানুষের প্রকৃত আয়ও কমবে। (এটা পত্রিকায় প্রকাশিত আমার একটা লেখা)


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.