আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কৃষিকেন্দ্রিক শিল্প : আগামি নোয়াখালীর সম্ভবনার সড়ক



বঙ্গোপসাগরের পাড়ে মেঘনা অববাহিকায় অবস্থিত নোয়াখালী জেলা, মেঘনা নদীর ভাঙ্গা-গড়া দ্বারা প্রভাবিত। জেলার অধিকাংশ এলাকা মেঘনা নদীবাহিত পলি দিয়ে গঠিত। ফলে একদিকে যেমন বঙ্গোপসাগরের প্রভাব এ জেলার ওপর রয়েছে তেমনি মেঘনা নদীও এ জেলার প্রকৃতি ও মানুষকে প্রভাবিত করে থাকে। এখানে অন্তহীন সমস্যার মধ্যেও রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। এসব সম্ভাবনাকে ঘিরে বেঁচে থাকার স্বপ্ন নিয়ে আমাদের রয়েছে বহুমাত্রিক ভাবনা।

নানান বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা। একদিকে রয়েছে ভুমি ভাঙ্গন, জলাবদ্ধতা, খাস জমি বন্টন ও শহর উন্নয়নসহ অনেক সমস্যা। অন্যদিকে নতুন জেগে ওঠা চরাঞ্চলে সাধারণ মানুষের জীবিকায়নের জন্য গবাদি পশু ও মৎস্য সম্পদ উন্নয়ন, বনাঞ্চল ও সবুজ বেষ্টনী, নিঝুম দ্বীপের মতো অভয়ারণ্য সৃষ্টি ও পর্যটন সম্ভাবনাকে ঘিরে ভবিষ্যত কেন্দ্রিক উন্নয়ন ভাবনা। প্রয়োজন প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় দূরদৃষ্টি, পরিকল্পনা এবং ঐকমত্য। এসব বিষয়ে হতে পারে আলাপ আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্ক।

উদার ও যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে পারি সবার জন্য বাসযোগ্য সমৃদ্ধ নোয়াখালী গঠনের কাজে। নোয়াখালী জেলার একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে। ধারণা করা হয় ১৪০০ থেকে ১০০০ খ্রীস্টপূর্বে প্রথম এ এলাকায় মানব বসতি গড়ে উঠে। প্রাচীনকালে এ এলাকা সমতট রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮২২ সালের ২৯শে মার্চ ‘ভুলুয়া’ নামে এ জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৬৬০ সালের দিকে ত্রিপুরার পাহাড় থেকে বয়ে আসা পানিতে ভুলুয়া জেলার উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে বন্যার সৃষ্টি হয়। এ দুর্যোগ থেকে মুক্তি পেতে এ সময় ডাকাতিয়া নদী থেকে রামগঞ্জ, সোনাইমুড়ি ও চৌমুহনীর ওপর দিয়ে একটি খাল খনন করা হয়, যাকে বলা হয় নোয়া (নতুন) খাল। বলা হয় নোয়াখালী জেলার নামকরণ এ খালের নামানুসারেই হয়েছে। ১৮৬৮ সাল থেকে ভুলুয়া জেলা নোয়াখালী নামে পরিচিত হতে থাকে। জেলার সদর নোয়াখালীর পশ্চিম তীরে সুধারাম নামক স্থানে স্থাপিত হয়।

এ জেলার মানুষ ১৮৩০ সালের জিহাদ আন্দোলন এবং ১৯২০ সালের খিলাফত আন্দোলনে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। ১৯৪৬ সালে মহাত্মা গান্ধী এ জেলা ভ্রমণ করেন। এ জেলার মোট আয়তন ৩,৬০১ বর্গ কি. মি., যা সমগ্র বাংলাদেশের আয়তনের ২.৪৪%। জেলার মোট লোক সংখ্যা ২৫.৭১ লাখ। আয়তনের দিক দিয়ে উপকূলীয় জেলাগুলোর মধ্যে এ জেলার অবস্থান ৫ম এবং জনসংখ্যার দিক দিয়ে ২য়।

ভাঙ্গা-গড়ার মধ্যেদিয়ে এগিয়ে চলছে নোয়াখালী। এতদিন নাগাদ নদীভাঙ্গা নোয়াখালী বলে কথা চালু ছিল আজকের অবস্থা তার থেকে অনেক ভালোর দিকে। উপকূলীয় মোট ১৯টি জেলার বার্ষিক গড় আয় প্রবৃদ্ধির হার যেখানে ৫.৪ শতাশ সেখানে নোয়াখালীর আয় প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের মত। সাক্ষরতার হার ৫০ শতাংশ। রাজনৈতিকভাবে নোয়াখালী একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা হওয়া স্বত্বেও এখানে রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা উদাহরণ যোগ্য।

উন্নয়ন প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান ও আপাতঃ বৈপরিত্যের মধ্যেও জেলাবাসীর রয়েছে অনেক মৌলিক প্রশ্নে মতৈক্য। দারিদ্র্যমুক্ত একটি অঞ্চল হিসেবে নোয়াখালী জেলাকে দেখতে চায় সবাই। সবাই চায়, প্রাকৃতিক সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহার। সমৃদ্ধ শহর। সমৃদ্ধ জেলা।

নোয়াখালীর দক্ষিণাঞ্চলে জেগে ওঠা বিশাল চরাঞ্চল এ জেলার প্রধান শক্তি। ৫-৭ বছর আগে চরাঞ্চল মানে হতাশা, দারিদ্র্য, ফসলহীনতা, অভাব এমন একটি পরিবেশের চিত্র চোখে ভেসে আসত। কিন্তু নোয়াখালীর চরাঞ্চলের আজকের অবস্থা তার ঠিক উল্টো। কৃষি, গবাদিপশু, ফলজ ও বনজ বৃক্ষরাজি, হাঁস-মুরগি, মৎস সম্পদের এক বিশাল সম্ভাবনার দিক উম্মোচিত হয়েছে চরাঞ্চলে। এ বছর সয়াবিন, বাদাম, তরমুজ, ভুট্টা ও কাচামরিচের চাষ হয়েছে ব্যাপকভাবে।

এটি জীবন-জীবিকার উন্নয়নে একটি সুগম রাস্তা তৈরি করে দিবে। প্রতিবছর শীত মৌসুমে এখানে ব্যাপকভাবে সবজির উৎপাদন হয়। কিন্তু সকল পণ্যের বাজারজাত করণের ক্ষেত্রে এখানে পরিবহন একটি বড় সমস্যা। এ উন্নয়ন সম্ভাবনাকে টিকিয়ে রাখতে হলে এখানে সুপরিসর যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। অন্য এখানে কৃষি সম্ভবনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে নতুন নতুন কৃষিভিত্তিক শিল্প কারখানা।

বেকার সমস্যা সমাধানে এ উদ্যোগগুলো ইতিবাচক অবদান রাখবে। এ অঞ্চলের শিল্প সম্ভবনাকে তত্বান্বিত করতে এখানে আরো কৃষিভিত্তিক শিল্প কারখানা স্থাপন করতে হবে। এজন্য আগ্রহীদের মনোযোগ আর্কষণ করতে হবে। গবাদিপশু সম্পদ এখানকার বিশাল সম্ভবনা। নোয়াখালী চরাঞ্চলে রয়েছে প্রায় দুই লাখ একর খাসজমি।

গবাদিপশুর জন্য এটি বিশাল গোচারণ ভুমি। নোয়াখালীর দক্ষিণাঞ্চলের বাজারগুলো গরুর দুধের লিটারপ্রতি মাত্র ১২ থেকে ১৪ টাকা। অথচ তার থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে জেলা সদরে দুধের লিটার প্রায় ৩০ টাকা। সঠিক বিপণন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকাতে প্রান্তিক উৎপাদকরা প্রতিদিন ঠকছে। এজন্য সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

নিঝুম দ্বীপ আরেকটি বিশাল সম্ভবনা। দেশের একমাত্র কৃত্রিম ম্যানগ্রোভ বন এটি। এ বনে একদিকে রয়েছে প্রায় ১ লাখ হরিণের বসবাস অন্যদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের দারুন সুযোগ। ২০০১ সালের ৮ মে সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নিঝুমদ্বীপকে জাতীয় উদ্যানের ঘোষনা দেন। কিন্তু তা ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।

বাস্তবায়নের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। পর্যটনের ক্ষেত্রে নিঝুম দ্বীপ অনেক বড় একটি ক্ষেত্র। কিন্তু এ সুযোগটি আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। যোগাযোগ ব্যবস্থা এ দ্বীপের সাথে প্রধান সমস্যা। একই সাথে পর্যটককে আর্কষণের জন্য এখানে কোনো স্থাপনা, আবাসিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি।

স্থানীয়দের মতে এ দ্বীপে প্রতিবছর প্রায় তিন হাজার পর্যটক আসে কিন্তু তাদের আবাসন, খাবার, যাতাযাত ইত্যাদি সমস্যায় পড়তে হয়। তাই এসকল সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেতে হবে। সেই সাথে এখন নাগাদ নিধুম দ্বীপে জায়গা হস্তান্তর বা বেচাকেনা প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। এ প্রক্রিয়াটি শুরু করেতে হবে। তাহলে নিঝুম দ্বীপের পর্যটন সম্ভবনাকে ঘিরে অনেক বেসরকারি উদ্যোক্তা এখানে বিনোযোগে আগ্রহী হবে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য গড়ে তোলা সবুজ বেষ্টনী উপকূলের মানুষের একটি সুরক্ষা ব্যবস্থা। একে রক্ষা করা ও নতুন নতুন বনাঞ্চল সৃজনের মাধ্যমে এর স¤প্রসারণ জরুরি। বনাঞ্চলের কারণে জমির স্থায়িত্ব, উৎপাদনশীলতা, বনজ সম্পদ সৃষ্টি, জ্বালানী কাঠ, জীব বৈচিত্রের উন্নয়ন আমাদের পরিবেশ সুরক্ষা করবে। প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও ঝড় জলোচ্ছাস থেকে জনপদকে রক্ষা করবে। নিঝুম দ্বীপ একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে।

বনায়নের কারণে নিঝুম দ্বীপে একটি বিশেষ সম্ভাবনাময় অভয়ারণ্য সৃষ্টি হয়েছে। পশু, পাখির স্বাধীন বিচরণ ক্ষেত্র হয়েছে। শীতের পাখিরা নিয়ে আসছে আমাদের জন্য আনন্দ সংবাদ। আমাদের পরিবেশ হয়ে উঠছে সবার বাসের উপযোগী। নোয়াখালীর দক্ষিণাঞ্চলের পরিবেশ পর্যটন বিকাশে রাখতে পারে খুব ভালো ভুমিকা।

এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমরা আরো অনেক নতুন নতুন অভয়ারণ্য তৈরি করতে পারি। গড়তে পারি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। রক্ষা করতে পারি জৈব বৈচিত্র এবং আমাদের বেঁেচ থাকার সুরক্ষা ব্যবস্থা ও প্রাকৃতিক পরিবেশ। বয়ারচর আগামি সময়ের একটি বড় সম্ভবনার জায়গা। এ চরে প্রতি বছর প্রায় ৩০ লাখ টাকা কলা উৎপাদন হয়।

প্রতিবছর শুধুমাত্র শিমের বিচি উৎপাদন হয় কমবেশি তিনশ মণ। কিন্তু এসবই চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এর প্রধান কারণ। বর্তমানে চর বসতি স্থাপন ও পুর্নবাসন প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার বয়ারচরে কাজ করছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের একটি পরিকল্পিত সভ্যতা তৈরিতে ভূমিকা রাখা জরুরি।

বয়ারচরকে কেন্দ্র করে কমিয়ে আনা সম্ভব হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপের যোগাযোগ দুরত্ব। বয়ারচরে পূর্ব ও দক্ষিণদিক গভীর মেঘনার পাশে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এখানে গড়ে তোলা সম্ভব একটি সমুদ্র বন্দর, যা নোয়াখালীর মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি। এখানে সমুদ্র বন্দর তৈরি হলে নোয়াখালীর শিল্প যোগাযোগ সমস্যার অনেকখানি সমাধান হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের দিকে ঝুঁকেছে যুবকদের একটি অংশ।

তারা স্থানীয় সম্পদ ও বাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলছে তাদের ব্যবসায়িক ক্ষেত্র। নারীদের একটি বিশাল অংশ যুক্ত হয়েছে কুটির শিল্প সংশ্লিষ্ঠ কাজে। অনেকে হোগলা পাতা, বাঁশ-বেত, পাটিপাতা ইত্যাদি দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে তা দিয়ে ব্যবসা করেছে। শেষ কথা আজকের পরিবর্তিত বিশ্ব প্রেক্ষাপটে জ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক, দারিদ্র্যমুক্ত ও সামাজিক ন্যায্যতা অভিমূখীন লক্ষ্যে পৌছানোর নোয়াখালীর এ যাত্রাপথে প্রয়োজন ব্যাপক ঐকমত্য। আমাদের ব্যাপক সম্ভবনা রয়েছে।

একই সাথে সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। জলাবদ্ধতা, ভূমিহীনতা, লবণাক্ততা, খাসজমি বন্টনে অব্যবস্থাপনা, অনুন্নত যোগাযোগ, অপরিকল্পিত জেলাশহর ইত্যাদি সমস্যার সমাধান করতে হবে। তাহলে সম্ভবনার ক্ষেত্রেসমূহকে আমরা কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে পারবো।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.